ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে এবারের বিশ্বকাপ থেকে দ্বিতীয় বড় দল হিসাবে বিদায় নিল আর্জেন্টিনা। গ্রুপ লিগ থেকেই ছিটকে গেছে জার্মানি। আর শেষ ষোলো থেকে ছিটকে গেল মেসির আর্জেন্টিনা। টানটান উত্তেজনার ম্যাচের পর একদিকে যেমন ছিল ফ্রান্স শিবিরে উল্লাস। তেমনই আর্জেন্টিনা শিবিরে চোখের জল বাধ মানেনি। এবারও দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিতে ব্যর্থ লিওনেল মেসি। গতবার ফাইনালে হেরে চোখের জল তাঁর বাধ মানেনি। দেশের হয়ে আর খেলবেননা বলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন। পরে কর্মকর্তা ও দেশবাসীর অনুরোধে ফেরেন জাতীয় দলে। কিন্তু এবারও ব্যর্থ তিনি। বরং গতবার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। এবার শেষ ষোলোর লড়াইতে হেরেই বিদায়।
এদিন খেলার শুরু থেকেই ২ দল আক্রমণাত্মক মেজাজে খেলা শুরু করে। ফ্রান্সের সুপারস্টার গ্রিজম্যানের একটা দুরন্ত ফ্রি কিক আর্জেন্টিনার বারে লেগে ফিরে আসে। এরপর খেলার ১৩ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। পেনাল্টি নিতে আসেন গ্রিজম্যান। তাঁর অব্যর্থ শট আর্জেন্টিনার গোলকিপারকে পরাস্ত করে জালে জড়িয়ে যায়। ১ গোলে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। এরপর আর্জেন্টিনাও আক্রমণ বাড়ায়। তার সুফলও মেলে। খেলার ৪১ মিনিটের মাথায় ফ্রান্সের পেনাল্টি বক্সের বাইরে অরক্ষিত অবস্থায় বল পেয়ে যান নীল সাদা জার্সি গায়ে ডি মারিয়া। ভুল করেননি তিনি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ঠান্ডা মাথায় বল রিসিভ করে পজিশন নেন। তারপর বুলেটের মত শটে ফ্রান্সের গোলকিপারকে পরাস্ত করে বল জড়িয়ে দেন জালে। খেলায় সমতা ফেরে। প্রথমার্ধ শেষ হয় ১-১ স্কোরে।
এদিন প্রথমার্ধ যতটা টানটান হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজনার ছিল ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনার দ্বিতীয়ার্ধ। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরুর ৩ মিনিট পর খেলার ৪৮ মিনিটের মাথায় মেসির করা জোড়াল শটে পা ছুঁইয়ে দেন গাবরিয়েল মারকাদো। কিছু বোঝার আগেই ফের ফ্রান্সের জালে বল ঢুকে যায়। মাত্র ৭ মিনিটের ব্যবধানে খেলার ছবিটাই বদলে যায়। আর্জেন্টিনা এগিয়ে যায় ২-১ গোলে। নীল সাদা শিবিরের এই উচ্ছ্বাস কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। খেলার ৫৭ মিনিটের মাথায় দূরপাল্লার দুরন্ত ভলিতে খেলায় সমতা ফেরান ফ্রান্সের বেঞ্জামিন পাভার্ড। এখান থেকে ফ্রান্সের ম্যাজিক শুরু। আর্জেন্টিনার দুর্বল রক্ষণ এবং ১ নম্বর গোলকিপারের অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ফ্রান্সের বারবার আক্রমণ আছড়ে পড়তে থাকে। তাতে কাজও হয়। খেলার ৬৪ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টিনার গোলমুখে বলকে নিজের দখলে রেখে জোরাল শটে গোলের দিকে ঠেলে দেন এমবাপে। যা গোলকিপারের হাতে লেগে গোলে ঢুকে যায়। ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। ১ গোলের ব্যবধান খুব বড় ব্যবধান নয়। যে কোনও মুহুর্তে গোল শোধ হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় সাজানো পাসের খেলায় ৬৮ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টিনার গোলমুখের কিছুটা দূরে বল পায়ে পান এমবাপে। সময় নষ্ট করেননি তিনি। দুরন্ত শটে ফের জালে জড়িয়ে দেন বল। ফ্রান্স এগিয়ে যায় ৪-২ ব্যবধানে। সেইসঙ্গে পেলের সঙ্গে একসারিতে নাম লিখিয়ে নেন এমবাপে। তিনি হলেন বিশ্বের তৃতীয় টিন এজ ফুটবলার, যিনি নক আউট পর্যায়ে দেশের হয়ে একই খেলায় ২টি গোল করলেন।
২ গোলে পিছিয়ে থাকা আর্জেন্টিনা এরপর বারবার ফ্রান্সের গোলে হানা দিলেও ফিনিশারের অভাব নজর কেড়েছে। নজর কেড়েছে বয়স জনিত কারণে ফ্রান্সের গতির কাছে বারংবার পরাস্ত হওয়ার দৃশ্যও। মেসির সাজিয়ে দেওয়া গোলও ফ্রান্সের জালে জড়াতে ব্যর্থ হতে থাকেন আর্জেন্টিনার অন্য খেলোয়াড়েরা। সময় কমতে থাকে। আরা হৃদপিণ্ডের গতি বাড়তে থাকে বুয়েনোস আইরেস থেকে কলকাতার। ৯০ মিনিটের খেলায় ৪-২ ব্যবধান থাকা অবস্থায় ৪ মিনিটের ইনজুরি টাইম যোগ হয়। আর সেখানেই মেসির সাজানো শটে হেড দিয়ে গোল করেন সার্জিও আগুয়েরো। ব্যবধান কমে। কিন্তু তখনও সমতা ফেরাতে আরও ১ গোল বাকি। এই অবস্থায় মাঝ মাঠে একটা ফাউলকে কেন্দ্র করে ২ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি শুরু হয়। হলুদ কার্ড দেখেন ২ দলের ১ জন করে খেলোয়াড়। খেলার শেষ বাঁশি বাজার ঠিক আগের মুহুর্তে একটা গোল করার সুযোগ এসেছিল আর্জেন্টিনার সামনে। কিন্তু সে সুযোগও হাতছাড়া হয়। খেলা শেষে আর্জেন্টিনার গ্যালারি থেকে মাঠে দাঁড়ানো হতাশ খেলোয়াড়দের যখন চোখের জলে বাধ মানছে না। তখন অন্যদিকে ফ্রান্সের গ্যালারি উল্লাসে আত্মহারা। মাঠেই আনন্দে মেতেছেন খেলোয়াড়েরাও। এরমধ্যেই চরম হতাশ মেসিকে পোগবা সহ বেশ কয়েকজন ফ্রান্সের খেলোয়াড় সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন।
এটাই বিশ্বকাপ। এটাই ফুটবল। যেখানে ফাইনাল শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রতিটি খেলায় কম বেশি একই ছবি নজর কাড়বে। কেউ হাসবে, কেউ কাঁদবে। আর জিতবে ফুটবল।