Sports

ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নভঙ্গ, ২০ বছর পর দ্বিতীয় বারের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স

মাঠ জুড়ে শুধু ছুটে গেলে বা বল দখলে রাখলেই জেতা যায়না। তারজন্য দরকার অভিজ্ঞতা ও সঠিক রণকৌশল। গেম প্ল্যান যে কত বড় জিনিস তা এদিন দেখিয়ে দিল ফ্রান্স। মাঠ জুড়ে সারাক্ষণ ক্রোয়েশিয়া খেলে গেল ঠিকই। কিন্তু কাজের কাজটা করল ফ্রান্স। তাও খুব বেশি লম্ফঝম্ফ না করে। সঠিক পরিকল্পনা তাদের এনে দিল বিশ্বকাপ জয়ের বিরল মুহুর্ত। ২০ বছর আগে ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপ হাতে তুলেছিল জিনেদিন জিদানের ফ্রান্স। ২০ বছর পর সেই ফ্রান্সের ঘরে ফিরল বিশ্বকাপ। ১৯৯৮-তে দিদিয়ের দেশঁ ছিলেন বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স দলের অধিনায়ক। ২০১৮-তে তিনিই ফ্রান্সের কোচ হিসাবে পেলেন বিশ্বকাপ। এমন কৃতিত্ব এর আগে মাত্র ২ জনেরই রয়েছে। দেশঁ হলেন তৃতীয় খেলোয়াড় ও কোচ যিনি খেলোয়াড় হিসাবে এবং কোচ হিসাবে বিশ্বকাপ জিতলেন। ফ্রান্সও ঢুকে পড়ল একাধিক বিশ্বকাপ জয়ীদের ক্লাবে। অন্যদিকে ক্রোয়েশিয়া অনেকটা হারল তাদের অভিজ্ঞতার অভাবে। রণকৌশলের অভাবে। লড়ল, খাটল, কিন্তু জিততে পারলনা। সেখানেই বাজিমাত করল ফ্রান্স।

খেলার প্রথমার্ধে একটা নিজের গোলে বল ঢোকায় ক্রোয়েশিয়া। পরে ফ্রান্সের গোলে বল ঢুকিয়ে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে। সমতা ফেরায়। আবার পেনাল্টি বক্সের মধ্যে হ্যান্ডবল করে ফ্রান্সকে সুযোগ করে দেয় এগিয়ে যাওয়ার। গ্রিজম্যান ভুল করেননি। ঠান্ডা মাথায় সম্পূর্ণ মনঃসংযোগ রেখে ছবির মত শটে বল ক্রোয়েশিয়ার জালে জড়িয়ে দেন তিনি। ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক সুবাসিচ তখন অন্য প্রান্তে ঝাঁপ দিয়ে ফেলেছেন। প্রথমার্ধের মোদ্দা কাহিনি এটা হলেও এর মাঝে পুরো সময়টায় ক্রোয়েশিয়া কিন্তু বল দখলে অনেকটা এগিয়ে থেকেছে। মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছোটায় ফ্রান্সকে পিছনে ফেলেছে। বেশি কর্নার আদায় করেছে। গোলের সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেছে। তুলনায় ফ্রান্সকে অনেকটাই গুটিয়ে খেলতে দেখা গেছে। গ্রিজম্যান, পোগবা, এমবাপের মত নামকে এদিন প্রথমার্ধে সেভাবে দেখতে পাওয়া যায়নি।


খেলার ১৬ মিনিটের মাথায় ক্রোয়েশিয়ার পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি কিক পায় ফ্রান্স। ফ্রি কিক নিতে আসেন গ্রিজম্যান। সেট পিসে গোলের জন্য ইতিমধ্যেই এবারের বিশ্বকাপে নজর কেড়েছে ফ্রান্স। গ্রিজম্যান আবার এসব ক্ষেত্রে মাপা শট নিতে সিদ্ধহস্ত। নেনও তাই। গ্রিজম্যানের ফ্রি কিকে মাথা ছোঁয়াতে লাফ দেন ফ্রান্সের খেলোয়াড়েরা। অন্যদিকে বল ক্লিয়ার করতে লাফ দেন ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়েরা। এই ঝাঁকের মধ্যে বল গিয়ে লাগে ক্রোয়েশিয়ার মারিও মাজুকিচের মাথায়। তারপর তা সোজা বারের ধার ঘেঁষে ঢুকে পড়ে গোলে। ক্রোয়েশিয়ার আত্মঘাতী গোলে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। এর ঠিক ১২ মিনিট পর ফ্রান্সের পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি কিক পায় ক্রোয়েশিয়া। সুবর্ণ সুযোগ। শট নেন অধিনায়ক। তারপর ক্রোয়েশিয়ার ৩ জন খেলোয়াড়ের মাথা ছুঁয়ে ফ্রান্সের গোল মুখে বল পান ইভান পেরিসিচ। বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফাঁক গলিয়ে কোণা করে শট নেন। গোলরক্ষক ঝাঁপও দেন বল রুখতে। কিন্তু কিছু করার ছিলনা। দুরন্ত গোলে সমতা ফেরায় ক্রোয়েশিয়া। ৩৮ মিনিটের মাথায় ফের গ্রি‌জম্যানের একটি কর্নার থেকে ভাসানো বলে হাত ছুঁইয়ে ফেলেন ক্রোয়েশিয়ার পেরিসিচ। রেফারিকে ছেঁকে ধরেন ফ্রান্সের খেলোয়াড়েরা। এখানে ভিডিও রিভিউর সুযোগ কাজে লাগান রেফারি। ভিডিও খতিয়ে দেখে পেনাল্টি দেন তিনি। সেই পেনাল্টি থেকে গোল করেন গ্রিজম্যান। ফ্রান্স এগিয়ে যায় ২-১ ব্যবধানে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেও খেলায় ক্রোয়েশিয়ার আধিপত্য বজায় ছিল। ফ্রান্স খেলছিল সুযোগের সন্ধানে। আর সেই সুযোগ আসে খেলার ৫১ মিনিটের মাথায়। অমানুষিক গতি‌তে বল নিয়ে ক্রোয়েশিয়ার গোলমুখে ছুটতে শুরু করেন ফ্রান্সের যুব প্রতিভা এমবাপে। ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডার তাঁকে ধরতে পারেননি। কিন্তু গোলরক্ষক সুবাসিচ অনেকটা এগিয়ে আসেন। আর সেটাই কাজে দেয়। এমবাপের করা শট তিনি বাঁচিয়ে দেন। ফ্রান্সের তৃতীয় গোল করার সুযোগ মাঠে মারা যায়। খেলার ৫২ মিনিটের মাথায় খেলা কিছুটা থমকে যায় অদ্ভুত এক কারণে। বিশ্বকাপের ফাইনাল চলাকালীন মাঠে ঢুকে পড়েন ২ ফুটবলপ্রেমী। তাঁরা মাঠের মাঝখান দিয়ে ছুটতে শুরু করেন। দ্রুত নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের পাকড়াও করে মাঠের বাইরে নিয়ে যান। কিন্তু মাঠের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়।


খেলার ৫৯ মিনিটে আসে ফের এক চমক। ফ্রান্সের ম্যাজিক। পোগবার একটা দুরন্ত শট ক্রোয়েশিয়ার গোলে জড়িয়ে যায়। দূরপাল্লার এই শট দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া উপায় ছিলনা ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষকের কাছে। ৩-১ ব্যবধানে খেলায় এগিয়ে যায় ফ্রান্স। এর ঠিক ৬ মিনিট পর ফের ব্যবধান বাড়ান ফ্রান্সের আশ্চর্য তরুণ এমবাপে। ১৯ বছরেই গোটা বিশ্বকে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের আগামী তারকা হতে চলেছেন তিনি। সেই এমবাপে ঠিক পোগবার মত জায়গায় পায়ে বল পান। তিনিও একই শট নেন। একইভাবে বলও জড়িয়ে যায় ক্রোয়েশিয়ার গোলে। ৪-১ ব্যবধানে গিয়ে ঠেকে খেলা। কার্যত এই গোলের সঙ্গেই ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে শেষ পেরেকটা পড়ে যায়। এর ঠিক ৪ মিনিট পর কার্যত বিধ্বস্ত ক্রোয়েশিয়া দল ছুটছিল গোলের খোঁজে। সেই সময় নিজেদের গোলের কাছে একটি বল গোলরক্ষক হুগো লরিসকে পাস করেন ফ্রান্সের খেলোয়াড়। সাধারণত গোলরক্ষক সেই বল মাঝ মাঠে পাঠিয়ে দিয়ে থাকেন। গোলকিপারকে তাড়া করছিলেন ক্রোয়েশিয়ার মারিও মাজুকিচ। আচমকা দেখা গেল মারিও এগিয়ে আসতে বল সপাটে দূরে না পাঠিয়ে ফ্রান্সের গোলরক্ষক তথা অধিনায়ক মারিওকে পাস কাটানোর চেষ্টা করে শট কাছের সতীর্থ খেলোয়াড়কে দিতে যান। কিন্তু সেই বলে পা ঠেকিয়ে ফ্রান্সের গোলে বল পাঠিয়ে দেন মাজুকিচ। কার্যত প্রায়শ্চিত্ত করেন। কারণ ফ্রান্সের প্রথম গোলটা তাঁর মাথায় লেগেই এসেছিল। ৬৯ মিনিটের মাথায় এই আজব গোলে কিছুটা হলেও অক্সিজেন পায় ক্রোয়েশিয়া। ফের নতুন উদ্যমে আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু সেই উদ্যম কেমন যেন হারিয়ে যায় খেলার ৮০ মিনিটের পর থেকে। মূল সময়ের ১০ মিনিট এবং ইনজুরি টাইম। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। অনেক গোল হতে পারে। খেলার মোড় ঘুরে যেতে পারে। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার দলটা কেমন যেন হাল ছেড়ে দিল। মাঝ মাঠে ক্রমাগত বল হাতছাড়া করতে থাকে তারা। ইনজুরি টাইমে আবার পোগবা ফ্রান্সের হয়ে ২টি গোল করার সুবর্ণ সুযোগ পান। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। ফাঁকা গোল পেয়েও বলে পা ঠেকাতে ব্যর্থ হন তিনি। খেলা শেষ হয় ৪-২ ব্যবধানে। ১৯৫৮ সালের পর বিশ্বকাপের ফাইনালে এত গোল হল। সেবার ব্রাজিল ৫-২ ব্যবধানে হারিয়েছিল সুইডেনকে। এবার ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতল ফ্রান্স।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button