Mythology

বাংলার প্রাচীনতম দুর্গামন্দিরের দেবী জাগ্রত, তাঁর মাহাত্ম্য অপরিসীম

৪০০ বছর আগে গভীর অরণ্যে চিতে ডাকাত নরবলি দিয়ে যে দশভুজার পুজো করতেন, সেই দেবী আজও পুজো পেয়ে আসছেন সেই আমল থেকে।

বাদশা আকবরের রাজত্বকালের শেষ, ১৬০৬ সাল থেকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শুরু। এই সমসাময়িক সময়ে সুতানুটির উত্তর সীমানার পরেই ছিল ভয়াবহ জঙ্গল আর শ্বাপদেভরা অজচিত্রপুত্র গ্রাম। এখানেই তখন বাস করত চিতে ওরফে চিত্তেশ্বর রায়। সেকালের বিখ্যাত ভয়ঙ্কর ডাকাত, যার নাম শুনলে ভয়ে কাঁপত গাঁ-গঞ্জের লোক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে একটি গ্রাম ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিৎপুরকে। তার আগে এখানে ছিল গভীর জঙ্গল। একচ্ছত্র রাজত্ব ছিল ডাকাতদের। একসময় এ অঞ্চলের খুবই পরিচিত ও দাপুটে ডাকাত ছিল চিতে। গভীর অরণ্যে প্রতিদিন দেবী দশভুজার পুজো করত ষোড়শোপচারে। পুজোর অন্যতম উপচার ছিল মাঝেমধ্যেই নরবলি। ডাকাত চিত্তেশ্বরের নামানুসরণ করে দেবী দশভুজা দুর্গার নাম হয় চিত্রেশ্বরী বা চিত্তেশ্বরী। গবেষকদের অনুমান, চিৎপুর নামের উৎপত্তিও একই কারণে।

হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ‘চিত্তেশ্বরীর মন্দিরেই ডাকাতেরা নরবলি দিত। গঙ্গার তীরস্থ বিজন অরণ্যমধ্যে এই মন্দির স্থাপিত ছিল। এই চিত্তেশ্বরী এবং কালীঘাটের কালী ব্যতীত আর কোন বিখ্যাত কালী মন্দিরই তখন এদেশে ছিলনা।’


তিনি আরও লিখেছেন : ‘চিৎপুর রোড কলিকাতার একটি অতি পুরাকালের পথ। মোগল বাদশাহদিগের আমল হইতে এই পথটির অস্তিত্ব। তখন ইহার দুই পার্শ্বে ভীষণ জঙ্গল ছিল। এই জঙ্গলের মধ্যস্থলে অপ্রশস্ত বনপথ। এই পথে যাত্রীরা, কাপালিক এবং শাক্ত-সন্ন্যাসীরা, সেই পুরাকালে চিত্রেশ্বরী ঠাকুর দেখিয়া, জঙ্গল সমাচ্ছন্ন চৌরঙ্গীর মধ্য দিয়া কালীঘাটে যাইতেন। চিত্রেশ্বরীর নাম হইতেই এই পথটির নাম ‘চিৎপুর’ হইয়াছে। চিত্রেশ্বরীর মন্দির বহুকালের। স্বনামপ্রসিদ্ধ হলওয়েল সাহেবের আমলের ব্লাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্র এই মন্দিরটি নূতন করিয়া নির্মাণ করিয়া দেন।’

আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে গঙ্গার দুই কূল ছিল শ্বাপদসঙ্কুল ও ভয়াবহ বনজঙ্গলে ভরা। চিৎপুরের গভীর অরণ্যে চিতে ডাকাত নরবলি দিয়ে যে দশভুজার পুজো করতেন, সেই দেবী আজও পুজো পেয়ে আসছেন চিতের আমল থেকে। ১৭৫৮ সালে কোম্পানির রাজত্বে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উল্লেখ আছে চিৎপুরের জঙ্গল বিষয়ে। রেভারেন্ড লঙ সাহেব লিখেছেন –


‘Northward was the native town with the old Chitpur Road, as now, in the centre the houses were much mixed up with jungle and surrounded by stagnant pools and all kinds filth. The jungle on all sides of the city was very thick, (Calcutta Review, 1846)’

সেকালে ডাকাতরা দেবীকালিকাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নরবলি দিত, এখানে নরবলি হত চিত্তেশ্বরী দুর্গার উদ্দেশ্যে। চিতে ডাকাতের দেবী চিত্তেশ্বরীর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি নরবলি হত, ১৮৪৬ সালে রেভারেন্ড লঙ সাহেব তার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন –

‘It was then written Chittrapur and was noted for the temple of Chittreswari Dew or the Goddess of Chittru, known among European as the temple of Kali at Chitpore. According to popular and uncontradicted tradition, this was the spot where the largest number of human sacrifices was offered to Goddess in Bengal, before the establishment of the British Government. (Calcutta Review, Vol. III 1846)’

অসংখ্য গ্রন্থে দেখা গিয়েছে দেবী চিত্তেশ্বরী দুর্গাকে উল্লেখ করা হয়েছে কালী বলে। লঙ সাহেবের ভাষায় –

“It was then written chittrapur and was noted for the temple of chittraswari Devi or the Goddess of chittru, known among Europeans as the temple of ‘kali’ at chitpore.”

দেবী চিত্তেশ্বরী মন্দিরটি আকারে বিশাল নয়। সাধারণ কারুকার্য রয়েছে মন্দিরের দেওয়ালে। নাটমন্দিরটি বেশ বড়। সমতল ছাদবিশিষ্ট দালান রীতির মন্দির দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি থামের উপর। মন্দির এলাকায় প্রবেশদ্বারটিও ভারী সুন্দর। গর্ভমন্দিরে স্থাপিত বিগ্রহ দেবী দুর্গার। কিছু স্বাতন্ত্র্য আছে এই বিগ্রহে। দুর্গার চার ছেলেমেয়ে কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী এখানে অনুপস্থিত। সাদা সিংহের কামড়ে ক্ষত হয়েছে অসুরের হাত। সিংহবাহিনী হলেও বাঘ আছে একটি। মাঝারি আকারের দারুমূর্তি। সবুজরঙের অসুরের বুক বিদীর্ণ হয়েছে ত্রিশূলাঘাতে। মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দশভুজা। এক চালায় চিত্তেশ্বরীর অপার্থিব রূপ যেন উথলে পড়ছে।

Adi Chitteswari Durga Temple Cossipore

পরম্পরাগত কথা, নবাব আলিবর্দির সেনাপতি সৈন্যসামন্ত নিয়ে একবার গভীর জঙ্গলে এসেছিলেন চিত্তেশ্বরীর পুজো দিতে। দেবী জাগ্রত বলে সেকালে খ্যাতিলাভ করেছিল। নবাবের সেনাপতি চক্রপাণি দত্ত যখন পুজো দিতে গিয়েছিলেন, সেই সময় পুজোয় আসীন ছিলেন চিতে। অসংখ্য সেনাসামন্ত পুজো দিতে বাধা দিলে সংঘর্ষ বেধে যায় চিতের সঙ্গে। সেনারা তখন ধরে ফেলে চিতেকে। পরে বিচারে চিতের প্রাণদণ্ড হয়।

ডাকাত চিতের মৃত্যুর পর দেবী চিত্তেশ্বরী অবহেলায় পড়ে রইলেন জঙ্গলে। বন্ধ হল পুজোপাঠ। অনেকগুলো বছর কেটে গেল এইভাবে। ১৫৮৬ সালে নৃসিংহ ব্রহ্মচারী নামে এক সাধু যোগসাধনা করতেন চিৎপুরের বনে। একদিন গভীর রাতে মা চিত্তেশ্বরী ব্রহ্মচারীকে নির্দেশ দিলেন জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করতে। পরের দিন বহু অনুসন্ধানের পর উদ্ধার করলেন দারুমূর্তি। নিত্যপুজো শুরু করলেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে।

কাশীপুরের জঙ্গলাকীর্ণ এই স্থানটি তখন ছিল মনোহর ঘোষের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার কুলাই গ্রামের অন্যতম জমিদার ছিলেন। বসতি স্থাপনের জন্য একদিন জঙ্গল পরিস্কার করতে গিয়ে কর্মচারীরা দেখা পেলেন নৃসিংহ ব্রহ্মচারীর। তারা তাঁকে স্থান পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দিলে স্থানীয় প্রজারা দেবীর মাহাত্ম্য ও ব্রহ্মচারীর অসাধারণ ক্ষমতার কথা জানালেন জমিদার মনোহরকে। তখন জমিদার ৩৬ বিঘা জমি দেবীর উদ্দেশ্যে দান করে কুটির থেকে মন্দির নির্মাণ করে দিলেন সেখানে। মনোহর ছিলেন টোডরমলের গোমস্তা।

এর বহুপরে কোম্পানি আমলে ব্ল্যাক জমিদার নামে খ্যাত গোবিন্দরাম মিত্র নতুনভাবে নির্মাণ করে দেন মন্দিরটি। এরপর পুরনো মন্দিরটি ভেঙে পড়লে কাশীপুর নিবাসী স্বর্গীয় কুমার কালীকৃষ্ণ রায় বাহাদুরের বণিতা শ্রীমতী সূর্যরানি দাসী বর্তমান মন্দিরটি ১২৮৬ সালে নির্মাণ করে দেন বলে একটি ফলকে লেখা আছে। এছাড়াও মন্দিরে প্রবেশপথের বাঁদিকে মার্বেল ফলকে খোদাই করা লেখা – “আদি চিত্তেশ্বরী মন্দির চিত্রপুর স্থাপিত ইং ১৬১০ সাল।”

নাটমন্দিরের দক্ষিণে মার্বেল পাথরে খোদাই করা লিপি – “শ্রীশ্রী ৺জয়চণ্ডী চিত্তেশ্বরী চিৎপুরের আদি চিরপ্রসিদ্ধ সর্ব্বজন বিদিত চিত্তেশ্বরী দুর্গাদেবী স্থাপিত ইং ১৬১০ সাল।”

নাটমন্দিরের উত্তর গায়ে লেখা আছে – “শ্রীগিরীশ চন্দ্র দাস ও শ্রীমতী নিবদামনী দাসী ২১ নং যদুনাথ মিত্রের লেন শ্যামবাজার কলিকাতা।”

মেঝেতে মার্বেলপাথরে উৎকীর্ণ লিপি : “চরণ রেণু প্রয়াসী ৺যদুনাথ দত্ত তস্য পুত্র ৺নিবারণ চন্দ্র দত্ত তস্যপুত্র শ্রীসুশীল চন্দ্র দত্ত গড়পার কলিকাতা।”

নাটমন্দিরের দেওয়ালে একটি নিবদ্ধ বোর্ডে লেখা আছে “৩৮৮ বৎসর পূর্ব্বে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ অগ্রদ্বীপের ও ঘোষপাড়ার বাসুদেব ঘোষের বংশধর বর্দ্ধমান ও মুর্শিদাবাদ জেলার সীমানায় কুলাই গ্রামের জমিদার মনোহর ঘোষ ও তাহার পত্নী সেওড়াফুলী রাজার কন্যা উভয়ে ইং ১৫৮৬ সালে এই চিত্তেশ্বরী দেবীর মন্দির স্থাপন করিয়া কিছু ভূসম্পত্তিসহ তদীয় সেবাইত মহন্ত নৃসিংহ ব্রহ্মচারিকে দান করেন। চিতুডাকাত এই দেবীকে পূজা করিতেন। কলিকাতা চিৎপুর রোড এই চিত্তেশ্বরী দেবীর নাম হইতে আখ্যাত। উপস্থিত সেবিকা-বিল্বমাতা ব্রহ্মচারিণী। ইং ১৯৭৪।”

দেবীমন্দিরটি ৯, খগেন চ্যাটার্জি রোড, কাশীপুরে, গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরির পাশে রাস্তার উপর। যে কোনও বাসে বি. টি. রোডে চিড়িয়া মোড়ে নেমে পশ্চিমে কে. সি. রোড ধরে কিছুটা গেলেই দেবীমন্দিরের দেখা মিলবে।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button