অপুত্রক জমিদার কন্যারূপে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন মাকালীকে
আত্মীয়স্বজনরা পোষ্যপুত্র গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন তাঁকে। অনুরুদ্ধ জমিদার বলেন, পুত্র নয়, একটি পোষ্যকন্যা নেবেন তিনি।
শিয়ালদা কিংবা হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল হয়ে কাটোয়া রেলপথে সোমড়া বাজার রেল স্টেশন। এখানে গ্রাম্য পরিবেশের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পিচের বাঁধানো পথ ধরে রিকশায় পৌঁছনো যায় সুখাড়িয়া গ্রামে সোমড়া আনন্দময়ী কালীমন্দিরে। ভাগীরথী তীরে সোমড়া ও বলাগড়ের মাঝামাঝি সুখাড়িয়া একটি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ গ্রাম। এখানকার পুরাকীর্তিগুলির মধ্যে বহু দেবালয়ই উল্লেখযোগ্য, যেগুলির অধিকাংশই স্থানীয় প্রসিদ্ধ মুস্তৌফী বংশের প্রতিষ্ঠিত।
সুস্তৌফী বংশের আদি নিবাস ছিল নদিয়া জেলার উলা-বীরনগর। এক সময় নদিয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে আনন্দরামের মনোমালিন্য ঘটায় তিনি চলে আসেন বর্ধমানাধিপতি তিলকচাঁদ বাহাদুরের অধীন তৎকালীন বর্ধমান জেলার অন্তর্গত সুখাড়িয়া গ্রামে। বংশানুক্রমে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এই গ্রামে।
শান্ত নির্জন গ্রাম্য পরিবেশে প্রাচীরে ঘেরা আনন্দময়ী কালী মন্দিরটি আজও বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৮১৩ সাল থেকে। পঞ্চবিংশরত্ন মন্দিরের একটি অনবদ্য নিদর্শন সুখাড়িয়ার এই মন্দির। তিনতলা বিশিষ্ট মন্দিরে শিখর বা চূড়া আছে মোট পঁচিশটি। ছ’ফুট উঁচু ভিত্তি বেদির উপরে ৭০ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার এই বিশালাকার মন্দিরটি গঠনে ও অলঙ্করণে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে সারা বাংলা জুড়ে।
মন্দিরের সম্মুখভাগে সিংহবাহিনী, তারা, দুর্গা, অন্নপূর্ণা, জগদ্ধাত্রী, রাধাকৃষ্ণ, রাম-লক্ষ্মণ-সীতা, মহাবীর, গণেশ প্রভৃতির মূর্তি ফলকে উৎকীর্ণ আছে। মূর্তিগুলির গঠন, অঙ্গ সঞ্চালন ও মুখভঙ্গি আন্তরিক যত্ন ও নিষ্ঠা সহকারে উৎকীর্ণ হয়েছে বলে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মূর্তিগুলি সবই নয়নাভিরাম, জীবন্ত, অতি মসৃণ ও সুন্দর। এইরকম সুদৃশ্য দেবদেবীর মূর্তি কালনায় বর্ধমান রাজবংশের নির্মিত শিবমন্দিরে এবং বড়নগর মুর্শিদাবাদে রানি ভবানীর চারবাংলা ঠাকুরবাড়ির একটি শিব মন্দিরে ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।
সুখাড়িয়ার তৎকালীন জমিদার ছিলেন বীরেশ্বর মিত্র মুস্তৌফী। অপুত্রক ছিলেন তিনি। আত্মীয়স্বজনরা পোষ্যপুত্র গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন তাঁকে। অনুরুদ্ধ জমিদার বলেন, পুত্র নয়, একটি পোষ্যকন্যা নেবেন তিনি। ১৮১৩ সালে (১৭৩৫ শকাব্দ) নির্মাণ করলেন গোটা বাংলার নয়ন জুড়নো পঁচিশ শিখরের রত্নমন্দির, কন্যারূপে মন্দিরে স্থাপন করলেন আনন্দময়ী কালীমাতার পাথর প্রতিমা। ১৮১৩ সালে কমবেশি ১ টাকা চার আনায় যখন বাংলায় এক মন (৪০ সের) উৎকৃষ্ট চাল পাওয়া যেত তখন সুখাড়িয়া কালীমন্দির নির্মাণে বিরেশ্বরের ব্যয় হয়েছিল এক লক্ষ টাকা। এছাড়াও তিনি দেবীর নিত্যসেবায় দিয়ে যান অগণিত অর্থ।
মন্দিরের গর্ভগৃহে সিমেন্টের বেদিতে কাঠের সিংহাসনে শায়িত শিব। শিবের হাত দুটি মাথার দিকে। মা আনন্দময়ী বাবু হয়ে বসে আছেন শিবের মুখের দিকে মুখ করে। মাথায় রুপোর মুকুট। দেবী চতুর্ভুজা। কষ্টিপাথরে নির্মিত বিগ্রহ উচ্চতায় প্রায় তিন ফুট। বসা বিগ্রহের আকর্ষণই আলাদা। ফালা ফালা চোখ দুটো যেন একটা পটলের দুটো ফালি।
মন্দিরের সামনে বিস্তৃত সবুজ প্রাঙ্গণ। এর দু-পাশে দু সারিতে ছ’টি করে প্রতিষ্ঠিত মোট বারোটি শিব মন্দির। এর মধ্যে দুটি পঞ্চরত্ন, বাকি দশটি আটচালা। পঞ্চরত্নের মন্দির দুটির মধ্যে একটি গণেশের। সুখাড়িয়ার আনন্দময়ী কালীমন্দিরে লোহার গ্রিলের দরজায় লেখা আছে,
‘আনন্দময়ী ঠাকুরানী / প্রতিষ্ঠাতা / ৺বীরেশ্বর মুস্তাফি / মন্দির স্থাপিত ১১৭০ সাল।’
এই মন্দিরে নিত্য অন্নভোগের ব্যবস্থা নেই। মন্দির খোলা, বন্ধের সময় ও নিয়ম আছে বলে মনে হল না, তবে একটা সুবিধা হল, গ্রিলের দরজা থাকায় যখন খুশি মন্দিরে গেলে মা আনন্দময়ীর দর্শন পাওয়া যায় অনায়াসে।