এক মুঠো রোদ্দুর
ডান্স বাংলা ডান্স-এর অরিত্র এখন টালিগঞ্জের ব্যস্ত শিশু অভিনেতা। তার মধ্যেই সময় করে আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিল এই দুষ্টু মিষ্টি ছেলেটি।
একটা টিন এজার যে এত গুছিয়ে কথা বলতে পারে তা বোধহয় অরিত্রর সঙ্গে কথা না বললে বিশ্বাস করতে পারতাম না। অরিত্র দত্ত বণিক। ছোটপর্দা থেকে বড় পর্দার অতি পরিচিত শিশু অভিনেতা। যার নাম বললেই লোকে চোখ গোলগোল করে বলে ওঠেন, ‘আরে চিনব না! ডান্স বাংলা ডান্স-এর অরিত্র তো!’ একেবারেই তাই। সেই ডান্স বাংলা ডান্স-এর অরিত্র এখন টালিগঞ্জের ব্যস্ত শিশু অভিনেতা। তার মধ্যেই সময় করে আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিল এই দুষ্টু মিষ্টি ছেলেটি।
সোদপুর হাইস্কুলের ছাত্র অরিত্রর ছোট থেকেই আবৃত্তির সখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতাটা একটানা বলতে পারত ছোটবেলা থেকেই। তাও আবার হাত পা নেড়ে। গুছিয়ে। সঙ্গে থাকতো লাইনের ভাবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কণ্ঠস্বরের মারপ্যাঁচ। তবে এই পর্যন্তই, অভিনেতা হওয়ার কথা নিজে তো নয়ই, এমনকি বাড়িতে বাবা-মাও সেভাবে ভেবে দেখেননি। কিন্তু এ ফুল যে অভিনয় জগতেই ফুটে ওঠার জন্য বিধাতা পুরুষ তৈরি করেছেন। বোঝা গেল চার পাঁচ বছর বয়সেই। তাই ভবিতব্যের হাত ধরেই ঘুরল ভাগ্যের চাকা।
অরিত্রর মাসির এক সহকর্মী অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। তিনিই প্রথম প্রস্তাবটা দেন। তখন অরিত্রর সাড়ে চার কি পাঁচ বছর বয়স। কিন্তু ততদিনে বেশ কয়েকটি আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে ফেলেছে সে। ফলে কথা বলার ভঙ্গিমাটা ভালই ছিল। অভিনয়ের প্রস্তাব আসতে অনেকটা ’যেতে বলেছে যাচ্ছি’ গোছের মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই মায়ের হাত ধরে অডিশনে পৌঁছয় ছোট্ট অরিত্র। কিন্তু কে জানত যে ওই দিনটাই ওর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যাবে। এক চান্সে নির্বাচিত হয়ে গেল অরিত্র। একটি সিরিয়ালের শিশু চরিত্রে ওদিনই জায়গা হয়ে গেল তার।
তারপর বেশ কয়েকটি সিরিয়াল করলেও অরিত্রর নাম মুখে মুখে ঘুরতে শুরু করল ডান্স বাংলা ডান্স-এর হাত ধরেই। এমজি আর অরিত্রর খুনসুটি ওই রিয়ালিটি শো-কে একটা অন্য মাত্রায় তুলে নিয়ে গেছিল। এমজি অর্থাৎ মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে এক মঞ্চে অরিত্রর সাবলীল পাকা পাকা বক্র উক্তি মানুষকে হাসতে বাধ্য করল। তবে এর পিছনে মিঠুন চক্রবর্তীর অবদান এককথায় স্বীকার করে নিল অরিত্র। বেশ বড়দের মতই বলল, ‘এমজি আমাকে সাহায্য না করলে আমার পক্ষে এত ভাল করে কাজ করা সম্ভব হত না। সেদিক থেকে এমজি’র কাছে আমি কৃতজ্ঞ’।
এই মুহুর্তে সেলেব্রিটি অরিত্র। ফলে স্কুল থেকে রাস্তাঘাট সর্বত্রই বের হলে মানুষ ঘিরে ধরে। কথা বলতে চায়। অনেকে অটোগ্রাফও নেয়। এই অল্প বয়সেও এভাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা হওয়ার আনন্দটা উপভোগ করে অরিত্র। সে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মধ্যে পড়েনা। এই বিশ্বাসটা ইতিমধ্যেই হাড়ে মজ্জায় ঢুকে গছে তার। ফলে ছোট্ট অরিত্রর সাফ কথা, ‘আমি একটা অন্য জীবন বেছে নিয়েছি। ফলে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত আমিও রাস্তাঘাটে সহজে ঘুরব, খেলব, সেটা আর সম্ভব নয়’।
‘জানিনা ভগবান কি ট্যালেন্ট দিয়েছেন। মায়ের সঙ্গে যাই। স্ক্রিপ্ট পড়ি। তারপর অভিনয়টা ক্যামেরার সামনে করে দিই, বিনা তালিমেই। একমাত্র সিনেমা হলে কিছুদিন আগে স্ক্রিপ্ট পাওয়া যায়। তখন মাঝে মধ্যে সময় পেলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্ক্রিপ্ট প্রাকটিস করি।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল অরিত্র। ও যে কথাটা গুছিয়ে বলতে পারে তা ঢুকেই বুঝতে পেরেছিলাম। আর সময় যত গড়াতে থাকলো, যত গল্প জমতে থাকলো, ততই সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় ভাবে আমার মনে গেঁথে যেতে থাকলো।
শুটিং, এখানে সেখানে শো, পড়ায় যে কিছুটা প্রভাব ফেলে তা মেনে নিল অরিত্র। তাই বাড়ি থাকলে পড়াটা এগিয়ে নেওয়াই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এই ছোট্ট চেনা মুখ। অঙ্কে ভয়। তাই ওটা বাদ দিয়ে অন্য সব বিষয়ে ভাল ফলও করে। আর পড়ার বাইরে? পড়ার বাইরে ভিড় জমে যাওয়ার ভয়ে বিশেষ মাঠে খেলতে যায় না অরিত্র। তার চেয়ে বাড়িতেই একটু নিজের মত করে খেলা অর কার্টুন দেখে অবসর কাটায়। টম এন্ড জেরি থেকে ছোটাভীম। কোনও কিছুই ছাড়ে না সে।
মা বেশি বকে, কিন্তু মাকেই বেশি ভালবাসে অরিত্র। সেকথা অকপটেই স্বীকার করল সে। বাবাকে মায়ের চেয়েও বেশি দরকার পড়ে যখন ফুচকা আলুকাবলি, খাওয়ার দরকার হয় তখন। কিন্তু এসব কথার পর সে যেটা বলল তাতে বেশ নড়েচড়ে বসলাম। অরিত্রর হবি বাগান করা! ছাদে অনেক গাছ আছে, সেগুলোর পরিচর্যা করে সে। আর কি হবি? ‘রান্না করা।’ উত্তরটা শুনে চোখ প্রায় কপালে ওঠার জোগাড়। আজ পর্যন্ত যত বাচ্চার সঙ্গে মিশেছি তাদের কেউ কখনও রান্না করতে ভালবাসে বলেছে এমনতো মনে পড়ে না! তবে তার এই রান্নার হবিতে তার দুই জোগাড় বাবা আর মা। তবে হ্যাঁ, সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে কোনও রান্নার রেসিপি বলা। সব দিক বাঁচিয়ে অরিত্রর উত্তর, সে কোনও রেসিপি বলার রিস্ক নেবে না, কারণ তা খেয়ে যদি কাউকে হাসপাতালে যেতে হয়, তাহলে সে এসে ওকে মারবে! মনেমনে ওর উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না।
যে ছেলে রাঁধতে ভালবাসে, সে যে খেতে ভালবাসবে তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে। অরিত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। মিষ্টি আর কিছু নিরামিষ তরকারি বাদ দিলে বিশেষ অরুচি কিছুতেই নেই। তবে মাছ, মাংস ছাড়া থাকতে পারেনা ছোট্ট অরিত্র। এমনকি লাউ হলে লাউ চিংড়ি বা তরকারি হলে তাতে মাছের মাথা দিয়ে রান্না হতে হবে। মানে এককথায় তরকারিতেও মাছের ছোঁয়াটা চাই। মামার বাড়ি বেড়াতে গেলে অরিত্র আগেভাগেই সেখানে ফোন করে জানিয়ে দেয় সে গিয়ে কি কি খাবে। আর আদরের নাতির ফরমাইস রাখতে দাদুই কোমর বেঁধে নেমে পড়েন রাঁধতে।
টালিগঞ্জের প্রায় সব হিরোর সঙ্গেই কাজ করেছে অরিত্র। এদের মধ্যে আবার দেবের সঙ্গে ওর দারুণ সম্পর্ক। অনেকটা দাদা-ভাইয়ের মত। কখনও ওকে হাতে তুলে নিয়ে নিয়ে দেব ব্যায়াম করে তো, কখনও ভুলভাল বুঝিয়ে দেবকে পুরো শিলিগুড়ি চক্কর খাওয়ায় অরিত্র। আর ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে মিঠুন চক্রবর্তীকে। অরিত্র নাচতে পারত না। সেটাও আপাতত কিছুটা রপ্ত হয়েছে ওই মিঠুন চক্রবর্তীর জন্যই।
রাস্তাঘাটে তাকে চিনতে পেরে কেউ এগিয়ে এলে, তারিফ করলে ভালই লাগে অরিত্রর। অটোগ্রাফ নেওয়াটাও আজকাল বেশ এনজয় করে। কিন্তু প্রবল আপত্তি গাল টেপায়। অনেকেই ছোট বলে গাল চিপে আদর করে দেয়। এভাবে গাল টেপাকে যে অরিত্রর একেবারেই না পসন্দ তা বেশ স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিল সে। ছোট্ট অরিত্র এখন পরিচিত মুখ, সেলেব্রিটি। ফলে বিভিন্ন শো-তে যেতেই হয়। আর সেখানে তাকে গান করার ফরমাইস করেন দর্শকরা। তার জন্যও নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রেখেছে অরিত্র। সাক্ষাৎকারের শেষে বললাম, ‘একটা গান শোনা।’ কোনও না নেই। বলার সঙ্গে সঙ্গে একবার বাবা-মার দিকে চেয়ে নিঃসংকোচে অরিত্র খোলা গলায় গেয়ে উঠল, ‘যদি কেড়ে নিতে বলে কবিতা ঠাসা খাতা, জেনো কেড়ে নিতে দেবোনা, যদি ছেড়ে যেতে বলে…।’