জীবন খাতার প্রতি পাতায়
জমানার তালের সঙ্গে তাল মেলানোর কোনও দায় এঁদের নেই। এঁরা জীবন কাটান বাপ-ঠাকুরদার দেখানো পথেই। তথাকথিত আধুনিক জামানায় এঁদের সংখ্যা কমেছে ঠিকই, তবে এঁরা আছেন। বহাল তবিয়তেই আছেন।
তথাকথিত আধুনিক জামানায় এঁদের সংখ্যা কমেছে ঠিকই, তবে এঁরা আছেন। বহাল তবিয়তেই আছেন। জমানার তালের সঙ্গে তাল মেলানোর কোনও দায় এঁদের নেই। এঁরা জীবন কাটান বাপ-ঠাকুরদার দেখানো পথেই। কোকিল তো দূরে থাক, নেহাত কাকের ডাকেও নয়, এ জাতীয় প্রাণিদের ঘুম ভাঙে ছেলের দুলে দুলে হোম টাস্ক মুখস্থের ছন্দসুরে।
তারপর স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধযুক্ত বাথরুম, থুড়ি কলতলায় মুখ ধুয়ে চিটচিটে কালো নাইলনের থলি ঝুলিয়ে বাজার মুখো হয় এঁরা। তারপর যখন থলির উপর থেকে উঁকি দেওয়া একগুচ্ছ পালং শাক নিয়ে রান্না ঘরে এসে রাখেন, তখন রান্না ঘরের কালো দেওয়ালের ধারে ভাতের হাঁড়ি উথলে গড়িয়ে পড়ে ফ্যান। বাজারের থলি রান্নাঘরে রেখেই এঁরা আচমকা শশব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঘড়ির কাঁটার দিকে একবার তাকিয়েই বেড়াল, কাক থেকে বাঁচিয়ে গোনাগুনতি মাছের টুকরো ধুতে ব্যস্ত এক বিধ্বস্ত রমণীর প্রতি তাদের আদেশ বা অনুরোধ ধরণের শব্দ বেরিয়ে আসে। হ্যাঁগো ভাত বারো। আজ আবার নইলে লাল দাগ পরে যাবে।
এরপর প্রায় একপলা খাঁটি নারকেল তেল মাথার ব্রহ্মতালুতে থপথপ করে চাপড়ে চৌবাচ্চার অফুরন্ত জলে যথেচ্ছ বালতি ডুবিয়ে চলে এঁদের স্নান পর্ব। তারপর পরিপূর্ণ বাঙালি ঢঙে ডাল তরকারি আর মাছের ঝাল সহযোগে হাপুস হুপুস শব্দে তাঁরা ঘর মুখর করেন। খাওয়া সেরে এক চিমটে জোয়ান বা মৌরি মুখে চালান করে দিয়ে টিফিনের ব্যাগ বগলে এঁরা যাত্রা করে রণক্ষেত্রে।
রণক্ষেত্র এই কারণে যে এঁদের ইহকালে এঁরা যতটুকু লড়াই করে বাঁচেন তা এই দশটা পাঁচটাতেই। এই সময় তাঁরা ট্রাম,বাস, মেট্রো আর অফিস মিলিয়ে যে ভীষণ যুদ্ধ করেন তা নেহাত রক্তক্ষয়ী না হলেও প্রবল ঘর্মক্ষয়ী যে বটে সে ব্যাপারে বোধহয় তাঁদের শত্রুরাও দ্বিমত হবেন না। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই যে যুদ্ধ তাও আবার এক বিশেষ ধরণে যুদ্ধের উপর দাঁড়িয়ে। তার নাম বাকযুদ্ধ। তা সে রাজনীতিই হোক বা অর্থনীতি, সামাজিকই হোক বা খেলাধুলো। এমন কোনও বিষয় নেই যাতে তাঁদের পাণ্ডিত্য নেই।
খবরের কাগজ পড়া যে গভীর জ্ঞান তাঁরা সঞ্চয় করেন তার সঙ্গে নিজেদের কিছু অটল বিশ্বাসকে মিশিয়ে সেই ককটেল জ্ঞানের উপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করে এঁরা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। আপাত দৃষ্টিতে তা শুনতে যে মননশীল হয়না এমন নয়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা তাঁদের স্বর-যন্ত্রের উৎকর্ষতায় যে গমগমে শব্দ ঝংকার সৃষ্টি করে তাতে যুক্তির জাল লাটে ওঠে। আর যা পড়ে থাকে তা নেহাতই পাড়া জানানো, মানে অফিস জানানো সশব্দ কম্পন!
সন্ধ্যায় তাঁরা যখন রণক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরেন তখন সেই সকালের মাছ ধোয়া বিধ্বস্ত রমণী চুলে বিনুনি বেঁধে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শাড়ি পড়ে ঠাকুর ঘরে। খানিকক্ষণের মধ্যেই বেজে ওঠে শাঁখ। চল্লিশ পাওয়ারের তেলচিটে ডুমের আলোয় দাদুর আমলের কাজ করা সেগুন কাঠের খাটে ছোবড়ার গদির উপর বসে তাঁদের নাকে ভেসে আসে ধূপ-ধুনোর মিষ্টি গন্ধ।
এমন সময় আটপৌরে ঢঙে দু কাঁধে শাড়ির দুটো আঁচল ফেলে ঘরে ঢোকেন সেই রমণী। হাতে একটা ছোট্ট থালায় দুটো নকুলদানা আর একগ্লাস জল। প্রসাদের প্রতি এই ব্যক্তিরা ভীষণই শ্রদ্ধাশীল। ফলে দাঁড়িয়ে উঠে সেই দুটি নকুলদানা মাথায় ঠেকিয়ে সসম্ভ্রমে মুখে ফেলে তবে এঁদের শান্তি।
এরপর সেই আবার কলতলায় গিয়ে চিটচিটে ধূসর বাল্বের আলোয় চার-পাঁচটা তাগড়াই আরশোলাকে উপেক্ষা করে মুখ হাত ধুয়ে এরা যখন ঘরে ফেরেন তখন এসে গেছে এককাপ চা আর চানাচুর ছড়ানো একবাটি তেল মাখা মুড়ি। পাশের ঘরে ছেলের ছোকরা মাস্টার পড়াচ্ছে। ফলে পা বালিশে বেশ একটা জমিদারি ঠেসান দিয়ে টিভিটা আস্তে করে খবর শুনতে শুনতে এঁদের মনে হয় এবার একটু শান্তি।
এরমধ্যেই যদি শালি,শালা বা জামাইবাবুর দল এসে হাজির হয় তাহলে তো কথাই নেই! আরে, এসো, এসো, বোসো, তোমাদের তো দেখাই নেই, গোছের শব্দের সঙ্গে বেশ একটা মজলিসি চালে চলে আড্ডা। এরমধ্যেই কাউকে দিয়ে আনানো হয় মোড়ের মাথার দোকান থেকে রসগোল্লা আর সিঙ্গারা। রাত হয়। উড়ন্ত আরশোলার ফরফরানি সামলে রান্নাঘরে খাওয়া সেরে মশারি টাঙিয়ে এঁরা শুয়ে পড়েন।
তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নাসিকার সশব্দে ঝংকারে অন্যের ঘুমের দফারফা করে এঁরা জানিয়ে দেন তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। যাঁদের দিনলিপির ছন্দ এমন স্বচ্ছন্দে এগোয় সেসব প্রাণিদেরই ভালো নাম ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি কেরানি। — চিত্রণ – সংযুক্তা