Blog

পক্ষীরাজের দৌরাত্ম্য

গাড়ি ততক্ষণে গতি বাড়িয়েছে। যেন পক্ষীরাজ উড়ছে। নিজেকে ঠাকুমার ঝুলির রাজপুত্র বলে মনে হল।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন অঞ্জনবাবু। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িগুলো। চেহারা ছোটখাটো হলে কি হবে, গায়ে সবুজ রঙের বাহার। মাথায় হলুদ টুপি। ঠিক যেমন ছেলে বলেছিল।

মনে পড়ে যাচ্ছিল ছেলেবেলায় দেখা টেম্পোর অভিজ্ঞতা। সময়ের ধুলো ঝরে পড়তেই মনে পড়ে গেল, পাড়ার সরস্বতী পুজোয় ভাসানের দিন ডেকে আনা হত টেম্পো। ঠাকুরের মূর্তি চাপিয়ে গাদাগাদি করে বসে পড়তেন সকলে। তারপর ভটভট আওয়াজ তুলে, সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে চলত তিন চাকার টেম্পো। সর্বক্ষণ আতঙ্ক হত, এই বুঝি উলটে যায় গাড়ি। চিৎপাত হয়ে পড়েন রাস্তায়।


দূর থেকে অঞ্জনবাবু লক্ষ্য করলেন, লাইনের কোনও বালাই নেই। ঝপাঝপ প্যাসেঞ্জার উঠে পড়ছে একেকটা গাড়িতে। অঞ্জনবাবু উঠতে গেলেন সামনের ফাঁকা গাড়িটায়। হাঁ হাঁ করে উঠলেন ড্রাইভার, ‘কোথায় যাবেন দাদু’?

– ‘কাঁকুড়গাছি’।


– ‘এটা যাবে না’।

অঞ্জনবাবু স্পষ্ট দেখেছেন, গাড়ির গায়ে লেখা শিয়ালদহ টু বেঙ্গল কেমিক্যাল। ছেলে পইপই করে বলে দিয়েছে, শিয়ালদা স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডানদিকের ফুটপাথ ধরে এগোলে প্রথম ডানদিকের রাস্তা কাইজার স্ট্রিট। ওখানেই দেখবে ছোট গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে। লোকে অটোরিকশা বলে।

প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বছর পঁচিশ পর প্রথম পা রাখলেন কলকাতায়। খবরের কাগজের কল্যাণে অটোর সুনাম দুর্নাম, দুইই তাঁর শোনা। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা হয়নি, এইমাত্র।

প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও অঞ্জনবাবু বলে বসেন, ছেলে যে বলেছিল বেঙ্গল কেমিক্যাল লেখা অটো কাঁকুড়গাছি যায়।

মধ্যবয়সী ড্রাইভার খেঁকিয়ে উঠল, ‘আমি ফুলবাগান’।

অঞ্জনবাবু ভাবান্তরে পড়লেন, ‘কেউ কি কাঁকুড়গাছি যাবে না’?

এবার যেন কিছুটা সদয় হল ড্রাইভার, ‘পেছনে জিজ্ঞেস করুন – কে যাচ্ছে’?

উপদেশ শিরোধার্য। পায়ে পায়ে পরের অটোর সামনে দাঁড়ালেন। কাঁকুড়গাছি শুনে সেও মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়াল – ‘যাব না’।

পরেরটা। তার পরেরটা। সবার এক রা। গনগনে ভাদ্রের রোদে মাথার চাঁদি ফাটার জোগাড়। পাঁচ নম্বর অটোর ছোকরা ড্রাইভার দাঁড়িয়েছিল কোমরে হাত রেখে। চকরাবকরা গেঞ্জির সঙ্গে একালের বারমুডা। পায়ে আবার বাহারি স্পোর্টস সু। অঞ্জনবাবু সামনে দাঁড়াতেই বলে উঠল – ‘কাঁকুড়গাছি তো। উঠে বসুন’।

অঞ্জনবাবু বুঝতে পারলেন, তাঁর অটো সন্ধান নিশ্চয় ছোকরার চোখে পড়েছে। গাড়িতে বসতে পেরে এতক্ষণে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আরও দুজন যাত্রী এসে তাঁর পাশে বসলেন। কিন্তু গাড়ি ছাড়ার যে কোনও লক্ষণ নেই। পরের দুজন বেজায় বিরক্ত। অঞ্জনবাবু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘ভাই গাড়ি কখন ছাড়বে’?

সপাট উত্তর এল, ‘আরও একজন আসুক’।

আবার শুরু হল প্রতীক্ষা। কিন্তু কোথায় কি। পেছনের অটোগুলো সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। পাশের যাত্রীর বোধহয় অফিসের তাড়া আছে। একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ল কণ্ঠে – ‘এই হয়েছে তোমাদের জ্বালাতন। রোজ লেট খাচ্ছি অফিসে’।

ড্রাইভার ছেলেটি খেঁকিয়ে উঠল, ‘আগে বেরলেই তো পারেন। যত ঝাল আমাদের ওপর। …একজনের এক্সটা পয়সা কি আপনি দেবেন’?

ধুন্ধুমার তর্কযুদ্ধ হয়তো লেগেই যেত। হঠাৎ একজন ভদ্রমহিলা এসে হাজির হলেন – ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল যাবেন’? সঙ্গে স্কুলের পোশাক পরা বছর পাঁচ-ছয়ের একটা শিশু।

ড্রাইভারের পাশের সিট বেজায় ছোট। ভদ্রমহিলা দ্বিধা জড়ানো গলায় বলে উঠলেন, ‘সামনে তো বসতে পারব না’।

নিরাসক্ত কণ্ঠে ড্রাইভার শুনিয়ে দিলেন, ‘পারলে বসুন, নইলে পেছনে খুঁজুন’।

বাকি দুজন যাত্রী তবু নির্বিকার। বৃদ্ধ অঞ্জনবাবু এবার নিজেই ঠেলেঠুলে নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে। ভদ্রমহিলা ছেলে কোলে বসলেন পেছনের সিটে।

সুইচ টিপে গাড়ি স্টার্ট হল। পরক্ষণেই ড্রাইভার ছোকরা মাথার ড্যাশবোর্ডে কি যেন একটা সুইচ টিপে দিল। ব্যস, অঞ্জনবাবু আঁতকে উঠলেন, চড়া সুরে একটা হিন্দি গান শুরু হল – ‘দিল ধকধক করনে লাগা…’।

সপ্তাহ খানেক হল রিটায়ার করেছেন সরকারি চাকরি থেকে। গানের প্রতিটা বিট যেন সরাসরি ধাক্কা দিচ্ছে হার্টে। দিল তো ধকধক করবেই বাবা! কাতর কণ্ঠে অঞ্জনবাবু অনুনয় করলেন, ‘ভাই, এটা বন্ধ করা যায় না’?

মুখে তেরঙ্গার প্যাকেটটা উপুড় করে ঢেলে ড্রাইভার উত্তর দিল, ‘গাড়ি যে রান করবে না, দাদু’।

গাড়ি ততক্ষণে গতি বাড়িয়েছে। যেন পক্ষীরাজ উড়ছে। নিজেকে ঠাকুমার ঝুলির রাজপুত্র বলে মনে হল। সামনেই নজরে পড়ল ডিআরএম বিল্ডিং। রাস্তায় বাঁকের পর বাঁক। গাড়ির গতি কিন্তু কমছে না। হর্নের বালাই নেই কোনও পক্ষের। কখনও আবার মাখনের ভেতর ছুরি চালানোর মতো গাড়ি পাশ কাটাচ্ছে। অঙ্কের এক ইঞ্চি ভুলচুক হলে ছেলেবেলার সেই চিতপাতের আশঙ্কা।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল। ভদ্রমহিলার কোল থেকে শিশুটা গাড়ির মেঝেতে পড়ে গেছে। তীব্র গতিতে গাড়ি বাঁক নেওয়ার সময় ছেলে সামলাতে পারেননি। অঞ্জনবাবুর মনে পড়ে যাচ্ছিল, কবে যেন কাগজে পড়েছিলেন অটোয় বসা বাচ্চা মায়ের হাত ফসকে বাইরে রাস্তায় পড়ে যায়। তারপর…।

আড়চোখে অঞ্জনবাবু দেখলেন, ড্রাইভারের কোনও হেলদোল নেই। পেছনের যাত্রী দুজন এবারও নির্বিকার। তিনি শহরের নতুন অতিথি। অগত্যা মুখে কুলুপ।

অটো ততক্ষণে নারকেলডাঙা খালপোল পেরিয়েছে। হঠাৎ সামনের মিনিবাসটাকে বিপজ্জনকভাবে ওভারটেক করতে গিয়ে তাঁদের ছোট্ট গাড়িটা এসে পড়ল উলটো দিক থেকে আসা একটা মিনিবাসের মুখোমুখি।

দ্রুত হ্যান্ডেল ঘোরাল ড্রাইভার। অঞ্জনবাবু চোখ বুজে ফেললেন। শিরদাঁড়া বেয়ে কৈশোরের টেম্পো চড়ার আতঙ্ক কুলকুল করে বইতে লাগল। খবরের কাগজের একটা হেডিং ঝলসে উঠল মনের পর্দায় – ‘অটো উলটে হত ১, আহত ৩’।

মুহুর্তের জড়তা। পরক্ষণেই চোখ খুলে দেখলেন, অবিশ্বাস্য! সেই একই দ্রুত গতিতে চলছে অটো। তারস্বরে ধকধক করনে লাগা… তখনও চলছে।

‘কিভাবে বাঁচালে ভাই? অঞ্জনবাবু সাগ্রহে জানতে চাইলেন।

ড্রাইভার ছেলেটি সগর্বে উত্তর দিল – ‘দাদু, আমরা পাইলট। এরোপ্লেন চালাই’।

অটো ততক্ষণে সি আই টি রোডে উঠে পড়েছে। পাশে চোখে পড়ল প্যান্টালুনসের বিশাল শো রুম। দেওয়ালে সুন্দরী মডেলের একটা বিশাল কাটআউট। মোহময় অভ্যর্থনা করছে।

সদ্য জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দে অঞ্জনবাবু ড্রাইভারের কাছে আবদার করে বসেন, ‘একটা বাংলা গান শোনাও না’।

ছেলেটি সুইচের কান মুচড়ে দিতেই উচ্চগ্রাম শব্দের ঢেউ আবার আছড়ে পড়ে – কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা হই বিলা…ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ….।

অঞ্জনবাবুর ততক্ষণে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা। মিনিট কয়েকের মধ্যে গাড়ি ব্রেক কষে দাঁড়ায় তীব্র আওয়াজ তুলে। ড্রাইভার হাসিমুখে জানায়, ‘এটাই কাঁকুড়গাছি, দাদু’।

অটো থেকে নেমে পড়েন অঞ্জনবাবু। ভাড়া মেটাতে গিয়ে বিড়বিড় করে ওঠেন – ‘দীর্ঘজীবী হও বাবা।…’

তীব্রগতিতে ছোট্ট অটো ডানদিকে বাঁক নেয়। অঞ্জনবাবুর মনে হয়, ড্রাইভার ছেলেটা ভুল বলেছিল – এরা এরোপ্লেন নয়। রূপকথার সেই পক্ষীরাজ ছোটায়। — চিত্রণ – সংযুক্তা

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button