
কলমের গাঁটছড়ায় ফের একবার বাঁধা পড়ল পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ। যোগসূত্রটা ভাষা। আর পছন্দে মিলটা সাহিত্যানুরাগ। এপার বাংলা আর ওপার বাংলা। এই এপার আর ওপারের তথাকথিত কাঁটাতারের বেড়াটা ভেঙে দিলে যে বাকিটা মিলেমিশে একাকার, তা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ‘অচ্ছুৎ’।
‘অচ্ছুৎ’ শব্দটার মধ্যে কোথাও যেন লুকিয়ে আছে একটা বুকভরা অভিমান। অনাদরে পড়ে থাকা কিছু লেখার অভিমান। সেই অভিমানের জ্বালা থেকেই কিছু অচেনা, অদেখা মানুষ বোধহয় সব বন্ধন ভেঙেচুরে মিশে গেছে একে অপরের কলমের সঙ্গে। ভাবনার সঙ্গে। ছন্দের সঙ্গে। আর সেটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য ‘অচ্ছুৎ’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আরীয়া বেগমের।
দেশে দেশে সীমানার বিভাজন রেখা যে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মাঝে গণ্ডি কাটতে পারেনা তা আগেই প্রমাণ করে দিয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মত সোশ্যাল মিডিয়াগুলি। তাই সেই সীমান্তভাঙা ফেসবুককেই জমি করে অক্ষর মিলনের এই বীজ বপন করেছিলেন আরীয়া বেগম। তাঁর এই উদ্যোগে সঙ্গী হয়েছিলেন বাংলাদেশের কবি আমীর হোসেন ও ভারতের লেখিকা স্বপ্না।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকের পাতায় জন্ম নিয়েছিল এই সাহিত্যদল। মাত্র ৭ মাসে সেই ছোট্ট গ্রুপটায় লেখা ১০ হাজার অতিক্রম করেছে। এত অল্প সময়ে এতবড় সাফল্যের পিছনে অবশ্য ভারতের কবি পঙ্কজ ঘোষ, রত্নাকর রায়, সুজাতা ভট্টাচার্যরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন বাংলাদেশের কবি পাঞ্জাব বিশ্বাস, হাসি ইকবালরা। এঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মাত্র ৭ মাসের পথচলায় মহীরুহ হয়ে ওঠাই নয়, ফেসবুকের পাতা থেকে বাছাই কবিতা নিয়ে ‘অচ্ছুৎ’ প্রকাশ করেছে ‘বিশ্ব সাহিত্য ও কবিতা সম্ভার’-এর প্রথম সংস্করণ।
আরীয়া বেগমের সম্পাদনায় এই বইয়ে জায়গা হয়েছে দুই বাংলার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকা বহু আপাত অনামী কবি, লেখকদের সৃষ্টির। ‘অচ্ছুৎ’-এর ফেসবুক পেজে আজ শুধু ভারত বা বাংলাদেশের সাহিত্যপ্রেমী মানুষজনই নয়, যুক্ত হয়েছেন সিরিয়া, সৌদি আরব থেকে জার্মানির মত অনেক দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলাপ্রেমী মানুষজন।
নামী লেখকদের কবিতা, গল্প, উপন্যাসের ভিড়ে ক্রমশ কোণঠাসা হতে হতে অনামীরা হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। লেখা পড়ে থাকে কোনও ছেঁড়া ডায়েরির পাতায়। দিস্তা পাতায় লেখা গল্প কোনও দিন অজান্তেই বিক্রি হয়ে যায় পুরনো খবরের কাগজের ভিড়ে। সেসব কবি, সাহিত্যিকদের আলো দেখাচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে, একটা শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম দিচ্ছে ‘অচ্ছুৎ’। সে ফেসবুকের পাতাই হোক বা বাঁধানো বইয়ের কালো কালো অক্ষর। সব লেখক, কবি, সাহিত্যিকই চান তাঁর সৃষ্টিটাও মানুষ পড়ে দেখুক। তাঁর শেষটুকু দিয়ে তিনি যে ভাবনার জন্ম দিয়েছেন তা পৌঁছে যাক মানুষের কাছে। সেই কাজটা কিন্তু ‘অচ্ছুৎ’ করে দিয়েছে।
‘বিশ্ব সাহিত্য ও কবিতা সম্ভার’-এর প্রথম সংস্করণের লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার মত স্পর্ধা আমার নেই। কোথায় এঁরা স্বনামধন্যদের চেয়ে কম তাও ঠিক মেপে উঠতে পারলাম না। অগত্যা ‘অচ্ছুৎ’-এর তারিফ না করে উপায় নেই! এই লড়াই বেঁচে থাক। বেঁচে থাক ভালো লেখাকে মর্যাদা দেওয়ার এই দুরন্ত উদ্যোগ।