দারিদ্রেভরা দৈন্যময় জীবন থেকে মুক্তি দিলেন মা, স্মৃতিতে শিবশংকর ভারতীর তর্পণ
তখন আমার দিন চলে না মাস বত্রিশ অবস্থা। আমার পোশাক ছিল পাঁচ বছর ধরে পরা একটা ফুলপ্যান্ট, জামা আর পাঁচসিকের ফুটপাথের প্লাস্টিকের চটি, তার দিয়ে সেলাই করা।
সেটা সুখ বা দুঃখ, ভালো কিংবা মন্দের স্মৃতির হোমকুণ্ডে মনের চিমটে দিয়ে খুঁচিয়ে ঘা করাকে মনে হয় স্মৃতিতর্পণ বলে। আজকের এই তর্পণে কোনও কথাটাই আমার আত্মজীবনী নয়, ফেলে আসা জীবনের কথা, যে কথাটা না লিখলে যে গোটা তর্পণটাই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ।
একেবারেই গরিব ঘরের ছেলে আমি। বয়েস তখন বছর বাইশ। একুশেই জ্যোতিষ শাস্ত্রের শিক্ষাগুরু স্বর্গীয় শুকদেব গোস্বামীর আশ্রিত। তখন আমার দিন চলে না মাস বত্রিশ অবস্থা। দিন কাটছে কখনও নিজের হাতে আঁকা ছবি বেচে, হকারি করে, হাওড়া ফুলের হাট থেকে ফুল এনে বাজারে বেচে, কখনও পথে পথে ম্যাজিক দেখিয়ে, আবার কখনও সকালের জলখাবারের (দশ পয়সার পাউরুটি আর পনেরো পয়সার আলুর দম) আশায় ট্যাক্সির চালকের (ট্যাক্সির মালিক ও চালক স্বর্গীয় সিদ্ধিগোপাল সাহা) সঙ্গী হয়ে দিনের পর দিন ঘুরেছি কলকাতার রাজপথে, অলিতে-গলিতে। তখন আমার পোশাক ছিল পাঁচ বছর ধরে পরা একটা ফুলপ্যান্ট, জামা আর পাঁচসিকের ফুটপাথের প্লাস্টিকের চটি, তার দিয়ে সেলাই করা।
এমন দারিদ্রেভরা দৈন্যময় জীবনে গুরুর সন্ধান দিলেন স্বর্গীয় শুকদেবদা। তিলজলায় ঠাকুর শ্রীজিতেন্দ্রনাথ মন্দিরে দীক্ষার দিন ঠিক হল। নির্দিষ্ট দিনে দীক্ষা হল। এতটাই অভাব, গুরুদক্ষিণা হিসাবে একটা টাকাও দিতে পারিনি সেদিন।
আমার দীক্ষা হল কুমারী ও সন্ন্যাসিনীর কাছ থেকে। কুমারীমাতা শ্রীশ্রী মুক্তিমায়া দেবী। গুরুমার পরনে গেরুয়া বসন। গলায় ও বাহুতে রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, তিলক নয়। গায়ের রং বেশ ফরসা। গুরুর উচ্চতা ইঞ্চিতে মাপা যায় না তবে মহিলাদের সাধারণ উচ্চতার তুলনায় সামান্য একটু বেশি। না খুব রোগা, না খুব মোটা। ছোট্ট পায়ের পাতা। মাথার কেশ কাঁচায় পাকায় বেশ। গহন চোখ। পাতলা ফিনফিনে ঠোঁট। আমি দেখেছি, প্রকৃত ভদ্র যারা, ভদ্রঘরের যারা – তারা কখনও চেঁচিয়ে কথা বলে না। কেউ প্রণাম করলে মাথায় হাত দিয়ে স্পর্শ করে আশীর্বাদ করতেন। মুখে হাসির প্রলেপ একটা থাকত। কখনও ব্যাজারমুখো দেখিনি।
১৯১৮ সালে অম্বিকা কালনায় জন্ম মামার বাড়িতে। মাত্র ৯ বছর বয়সে গুরুদেব ঠাকুর জিতেন্দ্রনাথের হাত ধরে গৃহত্যাগ। ১১ বছরে দীক্ষালাভ। গেরুয়া নিয়ে সন্ন্যাসিনী হলেন ১৮ বছর বয়েসে। কুমারী শোভা মুখোপাধ্যায় হলেন কুমারী সন্ন্যাসিনী মুক্তিমায়া দেবী।
সম্ভবত আঠারোতেই গুরুদেবের হাত ধরে এলেন কাশীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা অন্নপূর্ণার আশ্রয়ে। টানা ৩৬ টা বছর কাটালেন বেনারসে বাঙালি টোলায়। প্রতিদিন স্নান করতেন দশাশ্বমেধ ঘাটে। অচিরেই কাশীতে পরিচিত হলেন ‘মাধুমা’ নামে।
নিত্য গঙ্গাস্নানের সঙ্গে যুক্ত হল দুটি সাধনা বা ব্রত। বারোটা বছর কাটালেন অসূর্যস্পশ্যা হয়ে। সঙ্গে টানা বারো বছর কাটল নুন ছাড়া রান্না খেয়ে। গৃহত্যাগের পর স্বপাক রান্না ছাড়া অন্য কারও হাতের রান্না খেতেন না। মা অন্নপূর্ণার করুণায় হাতের রান্না ছিল মনভরানো সুস্বাদু।
বারো বছর নুন ছাড়া রান্না খাওয়ার পর গুরুর নির্দেশে আবার শুরু করলেন নুন খাওয়া। নুন ছাড়া রান্না খেলে জাগতিক সমস্ত আসক্তি কেটে যায় ধীরে ধীরে। আসক্তি বলতে কামনা-বাসনা, কোনও পার্থিব বিষয়ে গভীর অনুরাগ বা লিপ্সা, ভোগবিলাস ইত্যাদি। দীর্ঘ ৩৬টা বছর কাশীতে কাটিয়ে একসময় ফিরে এলেন তিলজলায় ঠাকুর জিতেন্দ্রনাথ মন্দিরে।
১৯৯৫ সালের ৩ মে আমার প্রচারবিমুখ গুরুমা ছেদ টেনে দিলেন মরলীলায়, প্রবেশ করলেন চিদানন্দময় নিত্যধামে।
১৯৮০ সালের কথা। তখন দৈন্যময় জীবন চলছে আমার। একদিন স্বপ্ন দেখেছি, মাথায় সাদা টুপি, সাদা পোশাক পরে সাদা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছি গুরুমার মঠে। হঠাৎ দেখি একটা সাদা দুধের মতো প্যাঁচা উড়ে এসে বসল বাঁ-কাঁধে। আমি হাত দিয়ে উড়িয়ে দিতেই আবার এসে বসল। একটু এগোতেই একটা সাদা হাঁস বসল ডান কাঁধে। আমি আর কিছু করলাম না।
মঠ এল। গুরুমাকে বললাম, মা আপনার দুটো শিষ্য এসেছে। গুরুমা একটা কলা পাতায় প্রসাদ দিলেন তবে আসন পাতলেন তিনটে। আমি মাঝের আসনে বসলাম। প্যাঁচা আর হাঁসকে দু’পাশের দুটো আসনে বসালাম কাঁধ থেকে নামিয়ে। ওরা কিন্তু আসনে বসল না। দুজনেই উঠে বসল দুপাশে কোলের উপরে। মায়ের দেওয়া প্রসাদ প্রথমে খাওয়ালাম ওদের। অবশিষ্ট যেটুকু ছিল তা খেলাম নিজে। স্বপ্নটা ভেঙে গেল। সকাল হতেই ছুটলাম মঠে। জানালাম আনুপূর্বিক আমার স্বপ্নের কথা। জানতে চাইলাম এই স্বপ্নের অন্তর্নিহিত অর্থটা কী? গুরুমা স্মিত হেসে বললেন — বাবা, আজ থেকে মা লক্ষ্মী আর সরস্বতী তোমার কাছে বাঁধা পড়ল।
ব্রজবিদেহী মহন্ত শ্রীশ্রীরামদাস কাঠিয়াবাবাজি মহারাজ বলেছেন, ‘সাধুসন্ত অউর গুরুকা বচন কভি ঝুট্ নেই হোতা হ্যায়।’
গুরু তাঁর ভক্ত শিষ্যদের ওপর তিনভাবে করুণা করে দুর্ভোগ মুক্ত করেন, দৃষ্টির দ্বারা, স্পর্শের দ্বারা আর বাক্যের দ্বারা।
ভারতের বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণকালীন কথা প্রসঙ্গে এক সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, – বাবা, ঈশ্বর বা গুরু কে?
প্রাণের দুয়ার খোলা হাসি হেসে বলেছিলেন, – বেটা, না চাইতে যিনি অনেক দেন, তিনিই ঈশ্বর, তিনিই গুরু।