Feature

তাঁর আশির্বাদে বংশরক্ষা হল মহারাজের, খালি হাতে ফিরলেন বামাক্ষ্যাপা

আত্মবিস্মৃত উন্মত্ত সন্তান ক্ষ্যাপাবাবা মা মা বলে স্নেহ বাৎসল্যে পাষাণময়ী বিগ্রহকে কোলে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতে বাধা দিলেন পূজারি পাণ্ডারা।

দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতীর করুণাধারায় স্নাত মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। কিন্তু এতটুকুও শান্তি ছিল না মনে, পুত্রসন্তান ছিল না বলে। তাই দত্তকপুত্র গ্রহণ করেছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্র মহারাজা প্রদ্যোৎকুমারকে। এমনই কপাল, তাঁরও কোনও পুত্র হল না। যতীন্দ্রমোহনের এই মনোব্যথাই নিত্যবরেণ্য সাধক বামাক্ষ্যাপাকে (আবির্ভাব : ১২৪৪ সাল — তিরোভাব : ১৩১৮) নিয়ে এল কলকাতায়।

যতীন্দ্রের ভাগনে ছিলেন সত্যনিরঞ্জন। একসময় ক্ষ্যাপাবাবাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর মুখে নির্বিকার শ্মশানচারী বামের কথা শুনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন মহারাজা। কিন্তু পদমর্যাদার কথা ভেবে তিনি নিজে গেলেন না তারাপীঠে, যে করেই হোক ভাগনেকে দিয়ে ক্ষ্যাপাকে আনার চেষ্টা চালালেন। বার দুয়েক চেষ্টা করে বিফল হলেন সত্যনিরঞ্জন। ফিরে এলেন তারাপীঠ থেকে।


এক সময় যতীন্দ্রমোহনের প্রাণের আকুল টানে নড়ে উঠলেন তারাপীঠের শ্মশানবাসী ভৈরব। আবার গেলেন সত্যনিরঞ্জন। বামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাম। তাঁর সাহায্য নিলেন পাণ্ডাদের পরামর্শে, রাজি হলেন মাতৃসাধক।

১৮৯৮ সালের কথা (১৩০৫ সন)। ভারতবরেণ্য মহাশক্তিধর মহাপুরুষ কৌপীনবন্ত ক্ষ্যাপাবাবা পদধূলি দিলেন মহারাজা যতীন্দ্রের রাজপ্রাসাদে। আদর আপ্যায়নের ত্রুটি রাখলেন না ভোগীশ্রেষ্ঠ মহারাজা। আর এটাও তিনি জানতেন বাম শ্মশানচারী তান্ত্রিক। জঙ্গলাকীর্ণ দ্বারকাতীরের শ্মশানেই তাঁর জীবন কাটে। জনসমাকীর্ণ মহানগরী তাঁর ভালো লাগে না। তাই থাকার ব্যবস্থা করেছেন শাখানগর সিঁথির প্রমোদ উদ্যানে Emerald Bower তথা বিলাসক্ষেত্র মরকতকুঞ্জে। তাঁর আরও একটি উদ্দেশ্য, মহাসাধকের চরণ দর্শন পাবেন মহারানিও।


মহারাজের এতটুকুও ত্রুটি নেই রাজকীয় আয়োজনে। বামার জন্য মহাপ্রসাদও এসেছে কালীঘাট থেকে। কারনের ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ, যথাযথ। পরিচর্যার জন্য অসংখ্য রাজভৃত্য প্রাসাদজুড়ে। যথাসময়ে রসনা পরিতৃপ্ত করলেন সমস্ত সেবক-পাণ্ডা। কুলকুণ্ডলিনীতে কারন ও শুদ্ধি আহুতি দিয়ে কারনানন্দে আত্মহারা হলেন কুমার ব্রহ্মচারী বামা।

রাজোচিত আভরণ ছাড়াই যতীন্দ্রমোহন এলেন বামের কাছে। প্রণামাদির পর্বও শেষ হল। ক্ষ্যাপাবাবার সঙ্গে একান্তে তিনি কিছু কথা বলতে চান গোপনে। মহারাজা বললেন, ‘বাবা, আমরা মোক্ষের চিন্তাও করি না, মোক্ষ আমাদের দূর বটে। তবে আশির্বাদ করুন যাতে ভক্তি হয়।’

এ কথা যে মহারাজার অন্তরের কথা নয় তা ক্ষ্যাপাবাবা বুঝেই বললেন, ‘ভক্তি বড় দুর্লভ। সংসারের কামনা হৃদয়ে জাগরূক থাকলে তা আসে না। তোমার প্রাণ সতত যেভাবে ভোগ চাইছে, শরীরের সুস্থতা ও বংশরক্ষা চাইছে, ভক্তি কি সে ভাবে চাইছে?’

মহারাজা দেখলেন তাঁর হৃদয়ের কথা জেনে ফেলেছেন বামা। প্রকাশিত হয়েছে আসল কথা, অন্তরের কথা। এবার সর্বত্যাগী নিঃস্ব বামার কাছে করজোড়ে ভিক্ষা চাইলেন লজ্জাবনত মহারাজ, রোগ আরোগ্য ও বংশরক্ষার। নির্বিকার ক্ষ্যাপাবাবা জানালেন, বংশরক্ষার যে বাধা, তার সমাধানের পথ। বাক্যের দ্বারা আশির্বাদও করলেন বংশরক্ষার। বামের আশির্বাদ ও বাক্য বিফল হয়নি। বংশরক্ষা হয়েছিল মহারাজের, মুক্তও হয়েছিলেন সেকালের অসাধ্য অম্লশূল থেকে।

উচ্চকোটি সাধক ক্ষ্যাপাবাবা। তারাপীঠ থেকে এসেছেন কলকাতায়। অবস্থান করছেন মরকতকুঞ্জে। এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল ঝড়ের বেগে। শুরু হল মহাপুরুষ দর্শনার্থে জনলহরি। ভেসে গেল যতীন্দ্রের প্রাসাদ-উদ্যান। এবার মন একেবারেই অস্থির হয়ে উঠল তারাপীঠ ভৈরবের।

নিষ্কাম শ্মশানপ্রেমিক ক্ষ্যাপাবাবা। মহারাজের আকুল আকুতিতে সাড়া দিয়ে নিজ শ্মশানভূমির আসন ছেড়ে এসেছেন রাজপ্রাসাদে। ভক্তের প্রয়োজনও শেষ হয়েছে। একে জনবহুল মহানগরী, তার উপরে রাজগৃহ। এতে শ্মশানবাসীর মন উচাটন না হয়ে পারে! আর থাকতে চাইলেন না তিনি। বালকের মতো আচরণ করেন, ‘অনেক হয়েছে, এবার তারাপীঠে চল’। কিন্তু বামাকে ছাড়তে নারাজ মহারাজা। অনুরোধ করলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাম আর সঙ্গী পাণ্ডাদের, অন্তত দিন তিন-চারেক বাবা থাকুন এখানে।
এবার কালীঘাটে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন মহারাজা। অনুরোধ করলেন বাম-সহ সেবকদের। চারদিন ধরে রাখলেন বামকে। মাকালী বামের চোখে ছোটমা, তারা মা হলেন বড়মা। মাতৃদর্শনের লোভেই বালকের মতো ভুললেন তারাগতপ্রাণ ক্ষ্যাপাবাবা।

কালীঘাটের সেবক হালদারদের সংবাদ পাঠালেন মহারাজা। তারাপীঠের বামাক্ষ্যাপাকে নিয়ে তিনি যাচ্ছেন কালীঘাটে। এক ঘণ্টা মন্দিরে কোনও যাত্রী প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করলেন। সেই জন্য টাকাও দিলেন পালাদারকে।

ভোরের গাড়ি করে কালীঘাটে আনা হল বামাকে। হালদাররা সপরিবারে উপস্থিত। প্রণাম করলেন শ্রদ্ধাভরে। উপস্থিত ভক্তপ্রাণ যাত্রীরাও বামাদর্শনে উদগ্রীব। বামা দেখলেন গর্ভমন্দির শূন্য। একটি লোকও নেই তাঁর দর্শনের কারণে। যে কোনও তীর্থে সকলেরই সমান অধিকার। তাই আর সকলের সঙ্গেই ছোটমাকে দর্শনের কথা জানালেন ক্ষ্যাপাবাবা। অতএব দ্বার অবারিত হল সকলের জন্য।

বামাকে এনে দাঁড় করানো হল মাতৃমূর্তির সামনে। অপলক দৃষ্টিতে বামা চেয়ে রইলেন ছোটমার দিকে। হৃদয়সমুদ্র উথলে উঠল ভক্তিলহরিতে। দু’চোখ বেয়ে দরদর করে নেমে এল পরমানন্দের মন্দাকিনী ধারা। ‘জয় তারা’ নাদ নেই মুখে। আত্মহারা হয়ে উঠলেন বামা। ধীরে ধীরে চোখদুটি হয়ে এল অর্ধনিমীলিত। মন চলে যায় এক অজানা অজ্ঞাতলোকের অতল তলে। অবয়ব ক্রমে হয়ে ওঠে ধীরস্থির অচঞ্চল। মাতৃপ্রেমিক ক্ষ্যাপা বিবশভাবে বলে ওঠেন, ‘এই যে আমার কালী মা। রূপের কি ছটা, মাথায় আবার মোহিনী জটা, যেমনি লকলকে জিভ, তেমনি টানা টানা চোখ, যেন জ্বলজ্বল করছে। তুই কাদের মেয়ে রে? চল না মা, তোকে তারা মা’র কাছে কোলে করে নিয়ে যাই। তুই যাবি তো, বেশ বেশ – তবে আয় আমার কোলে।’

আত্মবিস্মৃত উন্মত্ত সন্তান ক্ষ্যাপাবাবা মা মা বলে স্নেহ বাৎসল্যে পাষাণময়ী বিগ্রহকে কোলে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতে বাধা দিলেন পূজারি পাণ্ডারা। স্পর্শ করতে দিলেন না নিত্যশুদ্ধ চৈতন্যরূপিণী দেবী কালিকার বিগ্রহ। বামের অন্তরের ভাব তারা কেউ বোঝেননি। সেবাইত ছাড়া আর কেউ বিগ্রহ স্পর্শ করতে পারেন না, এটাই ছিল সেকালের নিয়ম। সে নিয়ম তখন রক্ষাও হল বটে। ক্ষ্যাপার দিব্যদৃষ্টিতে জননীর সেই স্নেহময়ী রূপ ও ভাব মিলিয়ে গেল মুহুর্তে। বহির্নয়নে ভেসে উঠল পাষাণময়ীর বিকট রূপ ও কঠিন মুখমণ্ডল। বিচ্ছেদ হল দিব্যভাবের। এবার শ্মশানচারী ঘোর তান্ত্রিক ঊর্ধ্বরেতা ক্ষ্যাপাবাবা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বললেন, ‘চাই না তোদের রাক্ষসী কালীকে, যেমন কেলে রূপ, তেমনি লকলকে, মস্ত জিভ, যেন গিলতে আসছে। আহা, আমার তারা মা’র যেমন ছোট্ট জিভ তেমন রূপের ছটা, মাথায় জটা, পা দু’খানি খুরখুরে। চাই না তোদের কেলে কালী, আমার আকাশ তারাই ভালো’।

মুহুর্তে মন্দিরের পরিবেশ হয়ে উঠল গম্ভীর, নীরব। দর্শনার্থী যাত্রীরা ভীত, বিহ্বল। সেই সময় হালদারমশাইরা উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তাঁরা ভর্ৎসনা করলেন পুরোহিতদের। অপরাধ স্খলনের জন্য অনুরোধ করলেন নিরভিমান বামকে, ‘না বাবা, আপনি স্পর্শ করতে পারেন মাকে।’

ক্রোধ উপশম করলেন ক্ষ্যাপাবাবা। কোনও অভিশাপ বর্ষিত হল না সেবাইত পূজারিদের উপরে। অন্তর্যামী জানেন মা-ই বাধা দিয়েছেন ওদের মাধ্যমে। তাই নিরভিমানের অভিমান হল মায়েরই উপর। তিনি আর স্পর্শ করলেন না মায়ের পাষাণ বিগ্রহ। ধীর স্থির শান্ত অচঞ্চল পদক্ষেপে বেরিয়ে এলেন মন্দির থেকে। এই ভাবেই সেদিন সাঙ্গ হয়েছিল নিরহংকার ক্ষ্যাপাবাবার কালীঘাটের কালীদর্শন।

সহায়ক গ্রন্থ : সাধক কবি রামপ্রসাদ – যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ভারতের সাধক – শঙ্করনাথ রায়, দেবালয়ে দেবালয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ – দেবব্রত বসু রায়, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস – সত্যচরণ মিত্র, কথামৃত – শ্রীম, শ্রীশ্রীসুবোধানন্দের জীবনী ও পত্র (শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, ঢাকা), বরানগর আলমবাজার মঠ – রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, লীলাপ্রসঙ্গ, গুরুভাব, উত্তরার্ধ। এছাড়াও সাহায্য নিয়েছি আরও অসংখ্য গ্রন্থের। সব গ্রন্থ ও লেখকের নাম লেখা হল না। কৃতজ্ঞ লেখক ক্ষমাপ্রার্থী। — শিবশংকর ভারতী

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button