ক্রমশ সঞ্চয়ী হয়ে উঠছেন এই রাজ্যের যৌনপল্লিগুলির মেয়েরা
বহু যৌনকর্মীর ছেলেমেয়েই এখন যৌনপল্লির বাইরে অন্যত্র হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া শিখছে। সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালানোর মতো টাকাটা তাঁদের যে জমাতেই হবে তা বুঝতে পারছেন অনেক যৌনকর্মী।
পেশায় থাকাকালীন একটি পয়সাও সঞ্চয় না করায় এই রাজ্যের যৌনকর্মীদের ভিতর অনেকেই একটা বয়সের পর ফুটপাথে বসে ভিক্ষা করেছেন অথবা শেষ বয়সে চরম দুর্গতির শিকার হয়েছেন। জীবনের নির্মমতা ক্রমাগত যন্ত্রণা দিয়েছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর অশক্ত হয়েছে। একে তো সারাটা জীবন সমাজে প্রান্তিক মানুষ হিসাবে জীবন কাটানো। তার ওপর এই সমাজেরও ওঁদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর মানসিকতা ছিটেফোঁটাও ছিল না। ফলে পেশা থেকে সরে যাওয়ার পরের দিনগুলিতে যৌনকর্মীদের একাংশের চরম দুর্গতি অনেক যৌনকর্মীর চোখ খুলে দিয়েছে। ফলে তাঁদের ভাবনা চিন্তায় বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে। যৌনকর্মীদের ভিতর সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে। তাঁদের একটা বড় অংশ নিয়মিতভাবে সঞ্চয় করছেন। রোজগারের তুঙ্গগগনে থাকাকালীন সঞ্চয় করার অভ্যাসটি যে কোনও মানুষেরই সুঅভ্যাসের মতো করে অনুশীলন করা উচিত। সারা বাংলার যৌনকর্মীদের ভিতর গরিষ্ঠ সংখ্যকই এখন এমনটি মনে করেন। কিন্তু কলকাতা-সহ এই রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লিগুলিতে নিয়মিত কিছু কিছু করে টাকা সঞ্চয় সম্পর্কে সচেতনতা জাগানোর কাজটি করতে সময় লেগেছে প্রায় দুটি দশক। এখন তাঁর সুফল ভোগ করছেন অধিকাংশ যৌনকর্মী।
কোথাও গিয়ে এর কিয়দংশ কৃতিত্ব প্রাপ্য ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের। এটি যৌনকর্মীদের জন্যে তৈরি প্রথম সমবায়। জানা গিয়েছে, সমবায়ের টার্ন ওভার এখন বার্ষিক ২৯ কোটি টাকা।
কলকাতা শহরের সোনাগাছি যৌনপল্লিটি মহানগরীর সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম যৌনপল্লি। এছাড়াও, মহানগরীর পরিচিত যৌনপল্লিগুলির ভিতর রয়েছে রামবাগান, বৌবাজার, ওয়াটগঞ্জ, খিদিরপুর, কালীঘাট এলাকার যৌনপল্লিগুলি। এছাড়াও দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ জুড়ে বিভিন্ন যৌনপল্লিগুলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন যৌনপেশার সঙ্গে যুক্তরা। এঁদের ভিতর একটা বড় অংশই ওই যৌনপল্লিগুলিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কেবলমাত্র সোনাগাছিতেই যৌনকর্মীর সংখ্যা অন্ততপক্ষে ৯ হাজার। ১৯ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক মেয়েরা এখানে যৌনপেশায় যুক্ত বলে জানা গিয়েছে। মাথা পিছু দৈনিক রোজগার অবশ্য একেক রকম। জানা গিয়েছে, বয়স্ক মহিলাদের চেয়ে তরুণীদের রোজগার তুলনায় অনেকটাই বেশি। সোনাগাছির বাসিন্দা একজন তরুণী যৌনকর্মী দিনে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করে থাকেন। এখানকার বাসিন্দা যৌনকর্মীদের ন্যুনতম দৈনিক আয় গড়ে ৫০০ টাকা। তবে বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ের পরিমাণও কমতে শুরু করে।
ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের ফিনান্স ডিরেক্টর শান্তনু চ্যাটার্জি জানিয়েছেন, যৌনকর্মীরা অনেকেই দেখে শিখেছেন। সমবায় ওঁদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয় স্কিম চালু করেছে। তার ভিতর আছে সেভিংস, রেকারিং, দৈনিক কালেকশন, ফিক্সড ডিপোজিটের মতো স্কিম। প্রতিটি স্কিমেই যৌনকর্মীরা নিয়মিত টাকা জমাচ্ছেন। শান্তনুবাবুর দাবি, যৌনকর্মীদের সঙ্গে ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছে। ইতিমধ্যে একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কও তাঁদের শাখাগুলিতে অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যাপারে যৌনপল্লির মেয়েদের উৎসাহিত করছে। সেই ডাকে ইতিমধ্যে ওঁরা সাড়াও দিয়েছেন। কথা বলে জানা গিয়েছে, বহু যৌনকর্মীরই এখন একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। টাকাটা যে নিছক খোলামকুচি নয় আরও অনেক বাস্তব সত্যের মতো এটাও তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
এই সঞ্চয়ের সুফলও এখন হাতেনাতে পাচ্ছেন যৌনকর্মীরা। এ ব্যাপারে আশাব্যঞ্জক তথ্য জানিয়েছে ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ। যেমন, নিজেদের সঞ্চয়ের টাকায় যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত মেয়েদের কেউ তাঁদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। বিভিন্ন স্কিমে টাকা জমালে প্রয়োজনের সময় দরকার মতো টাকা ঋণ হিসাবে মিলছে। ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত বছরই ৪৩-৮৭ শতাংশ যৌনকর্মী তাঁদের ছেলেমেয়েদের আরও লেখাপড়া শেখানোর জন্যে সমবায় থেকে ঋণ নিয়েছেন। স্বাস্থ্যখাতে ঋণ নিয়েছেন ২৫ শতাংশ যৌনকর্মী, বাড়িঘর তৈরি বা সারানোর জন্যে ঋণ নিয়েছেন ২২ শতাংশ যৌনকর্মী। এছাড়া, বাকিরা ঋণ নিয়েছেন মেয়ের বিয়ে কিংবা অন্য কোনও জরুরি উদ্দেশ্যে। জানা গিয়েছে, গত বছর সমবায়ের তরফে মোট ৭ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।
এবার দেখা যাক যৌনকর্মীদের সঞ্চয়ের প্রবণতা কী হারে বেড়েছে? এ ব্যাপারে ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে রাজ্যের যৌনপল্লিগুলিতে সঞ্চয়ের প্রবণতা ৩৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। এর আগে এই হার ছিল ২২ শতাংশ। আরও জানা গিয়েছে, প্রতিদিন শুধু সোনাগাছি থেকেই অন্ততপক্ষে তিন থেকে চার লক্ষ টাকা নগদ সমবায়ে জমা পড়ে থাকে। সমবায়ের তরফে যৌনকর্মীদের জমানো টাকা খাটানো হচ্ছে সমবায়ের নিজস্ব ফিশারি, হ্যাচারি ইত্যাদি প্রকল্পগুলিতে। প্রকল্পগুলি গড়া হয়েছে সমবায়ের নিজস্ব জমিতেই।
ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিমগুলিতে আকর্ষণীয় হারে সুদ দিয়ে থাকে। সেভিংস স্কিমে ৫ শতাংশ, রেকারিং স্কিমে ১১ শতাংশ সুদ দেয় সমবায়। তাছাড়া, ফিক্সড ডিপোজিট স্কিমে প্রদেয় টাকা দ্বিগুণ হচ্ছে ৮ বছর ৮ মাসে। প্রসঙ্গত, এমুহুর্তে রাজ্য জুড়ে সমবায়ের মোট গ্রাহক সংখ্যা ৭৭৭২ জন।
টাকা তোলার জন্যে সমবায় চাকরি দিয়েছে ২২ জন কর্মীকে। এঁদের ভিতর আবার ১৮ জনই যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়ে। যে সমস্ত যৌনকর্মী মাসিক ভিত্তিতে টাকা জমান অথবা দৈনিক ভিত্তিতে কিছু কিছু করে টাকা জমানোর অভ্যাস তৈরি করেছেন তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে টাকা আদায় করার কাজটি করছেন সমবায়ের নিজস্ব আদায়কারীরা। বহুক্ষেত্রে তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা নিয়ে আসেন। টাকা আদায়ের পরিবর্তে যৌনকর্মীদের হাতে রসিদ ধরিয়ে দেন। সেই টাকা জমা করেন সমবায়ে।
এমনই একজন আদায়কারী অশোক দাস। সোনাগাছির যৌনপল্লি থেকে টাকা আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের মধ্যে অন্যতম অশোক। কথায় কথায় অশোক জানালেন, সোনাগাছির বাসিন্দা অন্ততপক্ষে ৭০০ জন মেয়ে দৈনিক ভিত্তিতে টাকা জমান। তবে সব মেয়েই যে এখনও টাকা জমাচ্ছেন তা নয়। দৈনিক ন্যুনতম ১০ টাকা সঞ্চয়ের স্কিমও রয়েছে। অশোকদের মতো কর্মীদের কাজ হল কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মেয়েদের ভিতর সঞ্চয়ের সুঅভ্যাস তৈরি করা। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁদের নানা ধরণের অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হতে হয়। অশোকের দাবি, কাউকে কাউকে অনেক বোঝাতে হয় এখনও। ওঁদের পিছনে টানা লেগে না থাকলে মুশকিল। দিনের পর দিন ধরে বোঝাতে হয়। নিজেদের ভবিষ্যতের দিনগুলির কথা ভেবে সামান্য হলেও জমানোটা কতটা জরুরি তাও বোঝানো হয়।
কলকাতা ও রাজ্যের অন্য যৌনপল্লিগুলিতেও ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের আদায়কারীরা কাজ চালাচ্ছেন। সমবায়ের ফিনান্স ডিরেক্টর শান্তনুবাবু বললেন, এ নিয়ে ২১ বছর আগে কাজ শুরু করেছিল ঊষা। এর ভিতরই সমবায় নিজের লক্ষ্যে সফল। যৌনপল্লিগুলিতে যে মেয়েরা বসবাস করেন, তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশই যৌনপেশায় এসেছিলেন অভাবের তাড়নায়। বাবা-মায়ের অসুখের চিকিৎসার খরচের ব্যবস্থা করতে গিয়ে কিংবা পারিবারিক ক্ষেত্রে বা অন্য কোনও ধরনের বিপর্যয় ঘটার জেরে ওই মেয়েরা যৌনপেশায় ঢুকে রোজগার করতে বাধ্য হন। অন্য কোনও পেশায় ঠাঁই না পেয়েই ওঁদের যৌনপেশায় প্রবেশ।
দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি বা বর্তমানে যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সামিল অন্যান্য সংগঠনগুলির দাবি, যে সমস্ত মেয়েরা যৌনপেশায় আসতে বাধ্য হন, এই পেশায় আসার আগে তাঁদের বিরাট অংশই গ্রামাঞ্চল বা অনুন্নত এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। অধিকাংশ মেয়েই নাম সই করতে পারেননা। ফলে ওঁদের ভিতর সঞ্চয় সচেতনতা বৃদ্ধি করতে অনেকটা সময় লাগে।
বহু যৌনকর্মীর ছেলেমেয়েই এখন যৌনপল্লির বাইরে অন্যত্র হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া শিখছে। সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালানোর মতো টাকাটা তাঁদের যে জমাতেই হবে তা বুঝতে পারছেন অনেক যৌনকর্মী। তাছাড়াও রয়েছে অতর্কিত বিপদের দিনের জন্যে খরচ। সঞ্চয় না থাকলে ভীষণ প্রয়োজনের সময় কোথায়, কার কাছেই বা হাত পাতবেন তাঁরা? হ্যাঁ, সাতপাঁচ ভেবে যৌনকর্মীরাও বিচক্ষণ হয়ে উঠছেন। অনেকেই বলছেন, খাই না খাই মাসে মাসে কিছু টাকা জমাবই।
সারা দেশে বেশ কয়েক বছর ধরেই নিজেদের পেশার আইনি স্বীকৃতির দাবিতে যৌনকর্মীরা লড়ছেন। এই লড়াইটা লড়তে গিয়ে তাঁদের নিজেদেরও অনেক কিছু শিখতে হচ্ছে। সেই শিক্ষাই যৌনকর্মীদের ক্রমশ সঞ্চয়ী করে তুলছে। — চিত্রণ – বিশ্বজিৎ