বিলুপ্তির পথে নাড়ি টেপা ডাক্তার
সমাজটা বেজায় দৌড়ঝাঁপ করে এমন দ্রুত গতিতে পাল্টে গেল যে বাঙালি পরিবারের অনেক রীতিনীতিও বেমালুম উধাও হয়ে গেল। তার ভিতর চোখে লাগার মতো একটি হল, বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির নিজস্ব কোনও পারিবারিক চিকিৎসক।
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর বলে যতই আর্তনাদ করুন না কেন, সেটি হওয়ার কিন্তু জো নেই। সময়ের স্বভাবচরিত্রের কিছু দিক আছে যা ক্ষমাহীন, নির্মম। এ কারণেই আগে এমন অনেক কিছুই ছিল একালে যা হারিয়ে গিয়েছে। সেসব ফের ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সত্যিই তো তাই!
সমাজটা বেজায় দৌড়ঝাঁপ করে এমন দ্রুত গতিতে পাল্টে গেল যে বাঙালি পরিবারের অনেক রীতিনীতিও বেমালুম উধাও হয়ে গেল। তার ভিতর চোখে লাগার মতো একটি হল, বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির নিজস্ব কোনও পারিবারিক চিকিৎসক। পারিবারিক ডাক্তারবাবুর ধারণাটা কেউ আর তেমন পাত্তা দেন না। এর অনেক সামাজিক কারণ থাকতে পারে। তবে মূল কারণটা মানসিক।
বাঙালি মধ্যবিত্ত চিন্তাচেতনার স্তর বৈপ্লবিকভাবে পাল্টে গিয়েছে গত ৩০ বছরের ভিতর। অনেক পাটই সেক্ষেত্রে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেইমতোই উঠে গিয়েছে পারিবারিক চিকিৎসকের পাটটিও। তার আগে দেখে নেওয়া যাক, কারা ছিলেন সেদিনের শ্রদ্ধেয় পারিবারিক চিকিৎসক। তাঁদের প্রতি পারিবারিক চৌহদ্দিতে কী ধরনের মনোভাব পোষণ করা হত। আর কেনই বা পারিবারিক চিকিৎসক নামধারী আস্ত একটি সম্প্রদায় হারিয়ে গেল। আর এও দেখার সেই শূন্যস্থান ভরাট করাতে গিয়ে আদতে কী ঘটল। কেননা বিজ্ঞানের অমোঘ নিয়মে শূন্যস্থান বলে তো দুনিয়ায় কিছুই থাকতে পারে না। সময়ে সময়ে অপূরণীয় ক্ষতিটতি হিসাবে যা কিছু বলা হয়ে থাকে, ধরে নেওয়া যেতে পারে তা হল আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন বা বিনয়ের ফলাফল।
আশির দশকেও প্রায় প্রত্যেক বাঙালি পরিবারেই একজন না একজন নির্ভরযোগ্য ডাক্তারবাবু থাকতেন। অনেক ক্ষেত্রেই সে মানুষটি হতেন বয়স্ক একজন চিকিৎসক। জ্বর, পেটখারাপ থেকে শুরু করে যে কোনও ব্যাধিতে তাঁর পরামর্শই ছিল পরিবারের কর্তাদের কাছে বেদবাক্য। যদি কোনও ক্ষেত্রে রোগী বা রোগিণী গুরুতর অসুস্থ হতেন, তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার প্রয়োজন হত – সেক্ষেত্রেও তা ছিল পারিবারিক চিকিৎসকের অনুমোদন সাপেক্ষ। পারিবারিক এই চিকিৎসকেরা সবাই যে বড় বড় ডিগ্রিধারী হতেন তা নয়। ফিজও ছিল তুলনায় অনেক কম। অনেকেরই মোটরগাড়ি ছিল না। রোগীর বাড়ি থেকে কল এলে রিক্সা চেপে রোগী দেখতে যেতেন।
তবে সম্মান পাওয়ার ক্ষেত্রে তাতে কখনও কোনও ঘাটতি পড়েনি। ডাক্তারবাবুকে দেখামাত্র পরিবারের ছেলেপুলেরা কেউ ছুটে গিয়ে তাঁর অ্যাটাচিটা নিজের হাতে নিয়ে নিত। পরিবারের বড়রা ডাক্তারবাবুর রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে দিতেন। বলাবাহুল্য, রোগীর বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে এক ধরণের আত্মীয়তা ছিল সেদিনের পারিবারিক চিকিৎসকদের। পরিবারের বিভিন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ডাক্তারবাবুকে নিমন্ত্রণটাও ছিল বাঁধা।
এখনও বহু অ্যালোপ্যাথ কিংবা হোমিওপ্যাথ ডাক্তারবাবু রয়েছেন, যাঁরা কেবলমাত্র পাড়াতেই ডাক্তারি করেন। সরকারি বা নামী বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোমের চাকরিতে তাঁদের মতি নেই। এঁদের কেউ কেউ এখনও পারিবারিক চিকিৎসকের মতন। তবে পুরনো দিনের মানসম্মানের স্বাদ তো এ যুগে পাওয়াটা আর সম্ভব নয়। কেননা পরিবার জিনিসটিই যে ভেঙেচুরে গিয়েছে। এখন বেশিরভাগ পরিবারই ছোট পরিবার। একটি পরিবারের চৌহদ্দিতে কাকা-জ্যাঠা-মাসিমা-পিসিমার সহাবস্থানও দুর্লভ। কোটিতে দু-চারটি ক্ষেত্রে হয়তো মিললেও মিলতে পারে ওই অমূল্য রতন!
পাড়ায় পাড়ায় ডাক্তারি করেন গৌতম বসু নামে এক এমবিবিএস চিকিৎসক। পসার ভালোই। গৌতমবাবু বললেন, আগে যা ছিল তার ভিতরকার অনেক কিছুই বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছে। আশির দশকে আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি, পরিবারের কারও অসুখবিসুখ হলে একজন অতিবৃদ্ধ ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনা হত। উনি ছিলেন সে যুগের নাড়ি টেপা ডাক্তার। আমাদের পরিবারের চিকিৎসক। এ কালের ডাক্তারবাবুদের মধ্যে যাঁরা পাড়াতে প্ৰ্যাকটিস করেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল একটি ব্যাপারে ওঁরা সকলেই একমত যে সেকালের পারিবারিক ডাক্তারবাবুরা নাড়ি টিপেই রোগের ভূতভবিষ্যৎ নির্ণয় করতে পারতেন। এ ব্যাপারে প্রায় ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল তাঁদের। টেস্ট করার পর্বটি যে ছিলনা তা নয়। তবে সে সবের প্রয়োজন হত কেসটি গুরুতর হলেই।
এখন তো পরিস্থিতি পুরো উল্টো। ডাক্তারবাবুদের একটা বড় অংশ প্রথমেই রোগীকে নানাবিধ টেস্ট করানোর পরামর্শ দেবেন। একজন বললেন, এখন সাধারণ পেট ব্যথা হলেও ডাক্তারবাবুরা আলট্রাসোনোগ্রাফি না করিয়ে ছাড়েন না। জ্বর হলে রক্ত পরীক্ষা-সহ হেনতেন একগাদা টেস্ট করানোটাও প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাড়ি টেপা ডাক্তার আর এ যুগে কোথায়? এমনকি যাঁরা কেবলমাত্র পাড়াতেই রোগী দেখেন, তাঁদেরও নাড়ি টিপে রোগ নির্ণয়ের দুর্লভ ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে।
কিন্তু গোড়াতে যে প্রসঙ্গটা ছিল, শূন্যস্থান বলতে আদতে কিছুই হয় না। তবে কোনও একটি গর্ত মাটি দিয়ে নিপুণভাবে ভরাট করা গেলেও, ক্ষতচিহ্নটি কিন্তু থেকেই যায়। পারিবারিক চিকিৎসকদের শূন্যস্থান ভরাট করছেন এ যুগের কনসালটান্ট চিকিৎসকেরা। কনসালটান্ট চিকিৎসকদের মধ্যে অ্যালোপ্যাথ বা হোমিওপ্যাথ দু’ধরনই রয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, নামের পাশে চিফ কনসালটান্ট কিংবা কনসালটান্ট তকমা জুড়ে দিয়ে একশ্রেণির ডাক্তারবাবু রীতিমতো ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। রোগী ডাক্তারবাবুর চেম্বারে দেখাতে এলেই ওঁরা ন্যুনতম ৫০০ টাকা ভিজিট হাঁকবেন। বাড়িতে এলে দর আরও চড়া। তাছাড়া, যে কোনও সাধারণ রোগীকেও একগাদা টেস্ট করানোর নির্দেশ দেবেন। খসখস করে প্রেসক্রিপশনে লিখবেন গাদাগুচ্ছের ওষুধপত্র। মধ্যবিত্ত এখন ওঁদের কাছেই ছুটছে। ফলে ওঁরাও দু’হাতে ‘কামাচ্ছেন’।
এক ভদ্রলোক বললেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে-বউদের একটা বড় অংশ সাধারণ জ্বরজারিতে আক্রান্ত হলেও ছুটবেন কনসালটান্টের চেম্বারে। এ যেন রূপে ভোলানোর মতো ফ্যাশন। আমার বউও তো কনসালটান্ট ছাড়া দেখানই না। রোগীর পকেটে নির্বিচারে কাঁচি চালানোর অভিযোগটাও ডাক্তারবাবুদের সম্পর্কে পুরনো। তাছাড়া, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর ক্লিনিকগুলির সঙ্গে একশ্রেণির ডাক্তারের যে শক্তপোক্ত অসাধু যোগসাজশ রয়েছে, সেই অভিযোগও ইতিমধ্যে পুরনো হয়ে গিয়েছে।
কনসালটান্ট সেজে চিকিৎসকদের একাংশ চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করছেন বলে অভিযোগ। তার ওপর কোনও কোনও চিকিৎসক কনসালটান্ট তকমা লাগিয়ে ব্যক্তিগত আর্থিক লোভও চরিতার্থ করছেন বলে অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি এক চিকিৎসকের কথা শোনা গেছে যিনি দাবি করছেন যে বিশেষ এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন তিনি। পদ্ধতিটির নাম কিউরোপ্যাথি। যা শরীরকে ডি-টক্সিফায়েড করাবে। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের রোগ-শোক-জরা-ব্যাধির কারণ কুচিন্তা বা উদ্বেগজনিত কারণে শরীরে বিষের সঞ্চয়। এর সঙ্গে রয়েছে কুখাদ্য এবং কুচিকিৎসা। কিউরোপ্যাথি হল বিষে বিষে বিষক্ষয় করিয়ে রোগের কারণকেই নির্মূল করে দেওয়ার পদ্ধতি। ক্যান্সার, হাঁপানি, বাত থেকে শুরু করে যে কোনও দুরারোগ্য অসুখ কিউরোপ্যাথিক ওষুধপত্র প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ সারিয়ে তুলছেন বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু ঠিক হবেই তার প্রমাণ কী? চিকিৎসক মেনে নিয়েছেন, প্রমাণ এখনও কিছু নেই। তবে শীঘ্রই তিনি প্রমাণ করে ছাড়বেন। তাঁর এই উদ্ভাবন নিয়ে কোনও গবেষণাপত্র দাখিল করতে পারেননি ডাক্তারবাবু।
কলকাতা শহর তো বটেই গ্রামগঞ্জের মধ্যবিত্ত মানুষজন এই ডাক্তারবাবুর কথায় বিশ্বাস করেই তাঁকে দেখিয়ে চলেছেন। ন্যুনতম ফি ৫০০ টাকা। এছাড়া, যে কোনও রোগীর ক্ষেত্রেই শর্ত হল, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ডাক্তারবাবুর কাছ থেকেই কিনতে হবে। সেও অন্ততপক্ষে হাজারখানেক টাকার ধাক্কা।
এভাবেই ক্রমশ কনসালটান্টের রমরমায় হারিয়ে যেতে বসেছে নাড়ি টেপা চিকিৎসক বা পারিবারিক চিকিৎসকদের ধারণা। যেমন ক্রমশ পুরানো বাড়ি কলকাতার পাড়াগুলোতে লুপ্তপ্রায় প্রজাতির চেহারা নিয়েছে। সে জায়গা দখল করে নিচ্ছে ঝাঁ চকচকে আবাসন। তেমনই আধুনিকতার আবহে ক্রমশ হারাচ্ছে মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ। বা মধ্যবিত্ত মানসিকতা। এই ঝড়েই খড়কুটোর মত হারিয়ে যাচ্ছে পাড়ার ফ্যামিলি ডক্টর। যা এক সময়ে ছিল মধ্যবিত্ত জীবনে টুকটাক রোগব্যাধির একমাত্র মুশকিল আসান।
(চিত্রণ – বিশ্বজিৎ)