ইচ্ছে মন, আমি আমার মতন…
প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেলা হয়ত এখনও সমাজ পরিস্কার চোখে দেখতে পায়না। মেনে নিতে পারেননা অনেক অভিভাবক। তাঁদের কাছে এই ব্যাপারটি কখনও ঘৃণ্য বা কখনও হাস্যকর, কিন্তু সত্যি যে সত্যিই থাকে।
সমাজের সঙ্গে মনের পাশা খেলায় সমাজ জিতে যায় বারবার। নিজস্ব ইচ্ছেগুলো চাপা পড়ে যায় অনেকসময়। নিজের ইচ্ছে, চাহিদা, ভালোলাগাকে আয়ত্তে আনতে পারেননা অনেকে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অবশ্য এই মানচিত্রের কিছুটা বদল ঘটেছে।
আমদের আশেপাশেই এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিজেদের সত্তাকে অনুভব করে সাহসিকতার সঙ্গে লিঙ্গ পরিবর্তন করে নতুন অধ্যায় শুরু করতে পেরেছেন। আবার অনেকে হারিয়ে গেছেন সামাজিক বয়কটের ব্ল্যাকহোলে। যাঁরা নতুন অধ্যায় শুরু করতে পেরেছেন তাঁদের মধ্যে একজন এখনও বহাল তবিয়তে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে বেঁচে জীবন কাটাচ্ছেন। নাম মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের লিঙ্গের পরিবর্তন করলেও মানুষ মানবী কিন্তু বিদ্যাবুদ্ধি বা সাফল্যে কারও থেকে কম নন। শিক্ষায় গুণমানে অন্যতমা মানবী নিজে। নারী পুরুষের ভেদাভেদ পছন্দ করেনা। বিশ্বাস করেন মানুষে। তিনি মনে করেন, একটি শিশু যখন জন্মায় তখন তার শরীরে মায়ের ২৩টি ক্রোমোজোম আর বাবার ২৩টি ক্রোমোজোম থাকে। অর্থাৎ জন্মলগ্ন থেকেই পুরুষ নারীর দুই সত্তা নিয়েই পৃথিবীতে আসতে হয় প্রত্যেককে।
মানবী নিজে শুধু উদাহরণ নন। পাশাপাশি বহু নাম উঠে আসে যাঁরা নিজের জীবনে সফল। অ্যাঞ্জেলা মোরলি একজন রূপান্তরকামী এবং একজন সফল মিউজিক কম্পোজার। বিলি টিপ্টন একজন জ্যাজ মিউজিসিয়ান। রেনে রিচার্ডস একজন টেনিস প্লেয়ার। নঙ্গ পয় এক অসামান্যা থাই মডেল। ফ্লরেনিকা দেলাভ একটি ম্যাগাজিনের এডিটর। সেইসঙ্গে একজন মা। কাল্কি সুব্রহ্মণ্যম একজন রূপান্তরকামী হয়েও প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক। সম্প্রতি গৌরব অরোরা একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন শোতে মডেলিং করেছেন। ১৬ ইঞ্চি বাইসেপ আর ৮ প্যাক অ্যাবস নিয়ে সেলুলয়েড জগতে আত্মপ্রকাশ ছিল একটা সময়। কিন্তু আজ তিনি গৌরী অরোরা। ছিপছিপে তরুণীতে পরিণত একজন মানুষ।
এঁরা সকলেই রূপান্তরকামী। পুরুষ থেকে নারী সত্তাকে সদিচ্ছায় আলিঙ্গন করেছেন তাঁরা। জীবনে সাফল্যও পেয়েছেন। হয়তো একটা বড় অংশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও। কিন্তু এর পাশাপাশি এই সমাজেই এরকম অনেক মানুষ আছেন যাঁরা নিদারুণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, শুধু তাঁদের ভিতরের সত্তাটাকে আত্মপ্রকাশের আশায়। মায়া দাস খুব সাধারণ সাদামাটা একজন মানুষ। গ্রাজুয়েশন শেষ করে বর্তমানে একটি এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষায় ও কাজে মায়া এগিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সমাজ ও তাঁর পরিবার কোথাও গিয়ে মেনে নিতে পারেনি তাঁর এই পরিবর্তনকে। এখন পরিবার থেকে তিনি আলাদা। সৌরভ থেকে মায়ার যাত্রাপথে তাঁর পরিবারকে তিনি পাশে পাননি। তবু অন্তরের ডাককে উপেক্ষা করতে পারেননি মায়া। তাই আজ তিনি স্বজন ছাড়া। কিন্তু জীবনের ছন্দে পিছিয়ে নেই। কাজ,পড়াশুনো সব কিছুর মধ্যে নিজেকে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছেন মায়া। আগামী দিনে সফল ভাবে নারী পরিচয়ে বাঁচতে চান তিনি। বর্তমানে তাঁর হরমোনাল চিকিৎসা চলছে। মায়া আশা করছেন, সার্জারির পর তিনি বাঁচতে পারবেন গর্বের সঙ্গে।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও এমন বহু মানুষ প্রকৃতির দেওয়া জন্মগত পুরুষ বা নারী পরিচয়কে মেনে নিতে পারেননা। রূপান্তর নিয়ে আজও অনেকের মনে নানা সংশয়, দুশ্চিন্তা, ভয় ঘিরে রয়েছে। হয়ত তাঁদের কাছে এই পুরো ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক। বিজ্ঞানের এই প্রশ্রয়কে আজও অনেকে মেনে নিতে পারেননা। যার ফলে রূপান্তরকামী মানসিকতা এখনও সমাজের কাছে ব্রাত্য।
কথা হচ্ছিল বিশিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সিলর মোহিত রণদীপের সঙ্গে। তাঁর মতে, নারী হোক বা পুরুষ, তাঁর দক্ষতাই তাঁর পরিচয়ের মাপকাঠি হওয়া উচিত। সেই মানুষ তখনও পর্যন্ত স্বস্তিতে থাকেননা যখন তিনি বাইরে পুরুষ আর অন্তরে নারী বা বাইরে নারী ও অন্তরে পুরুষ। মোহিতের মতে, লিঙ্গ পরিবর্তন কোনও সামাজিক ব্যাধি নয়। সাধারণত বংশগত বৈশিষ্ট্য, শৈশবের নিদারুণ অভিজ্ঞতা বা শরীরের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের ফলে একটা মানুষের মধ্যে লিঙ্গ পরিবর্তন করার মানসিকতা জন্ম নিতে পারে। এখানে শরীরের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন বলতে, একজন পুরুষের মস্তিষ্ক যদি নারী সত্তার প্রতি ধাবিত হয় বা শরীরের হরমোনাল ক্ষরণের তারতম্য ঘটে। মস্তিষ্ক থেকে তৈরি হওয়া চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি সাহায্য করে নিজের সত্তাকে চিনিয়ে দিতে। এই প্রসঙ্গে সমাজের ও পরিবারের উদ্দেশ্যে মোহিত রণদীপের পরামর্শ, পরিবারকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে, এটি কোনও অসুখ নয়। শৈশবের সময় থেকেই মা-বাবাকে পাশে থাকতে হবে। বৈষম্য নয়, দরকার একতা।
মানুষ চায় তার নিজ অস্তিত্ব বংশ পরম্পরায় চলতে থাকুক। টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষ গুরুত্ব দেয় প্রজননকে। তাই একটি পরিবার চায় তাঁদের কন্যা বা পুত্র যেন শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে কন্যা বা পুত্র থেকেই বংশের স্বাভাবিক গতিকে বজায় রাখুন। বংশের প্রদীপ যেন জ্বলতেই থাকে। ঠিক এই চিন্তাভাবনা নিয়ে যখনই পরীক্ষা শুরু হয়, তখনই বাধে বিরোধ। শিকার হতে হয় লাঞ্ছনার, অবমাননার। মানসিক অবসাদে ভোগে বহু শিশু, বহু প্রাণ। লিঙ্গের রূপান্তর, মনের রূপান্তর কোনও অসুখ বা ব্যাধি নয়। প্রকৃতির নিয়মেই সব হয়। তাই এই রূপান্তরের মানসিকতাও আদপে প্রাকৃতিক বলেই মনে করেন মোহিত রণদীপ।
সবার নাম উল্লেখ না করলেও বেশ কয়েকজন রূপান্তরকামী মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে তাঁদের বার্তা এই সমাজের প্রতি, আমি মানুষ। আমার মান আছে, আমার হুঁশ আছে। এই নিয়েই আমি রক্ত মাংসের মানুষ। তাঁদের সকলের বক্তব্য কোথাও গিয়ে একই সরলরেখায় প্রবাহিত হয়। সমাজ আমায় পরিচয় দেয় আমি নারী। কখনও আবার পুরুষ। পরিচয়ের এই মেরুকরণে আহত হয় প্রাণ। কারণ, সেই প্রাণের পরিচয় সীমাবদ্ধ থাকে নারী বা পুরুষে। কারও ব্যক্তিগত সত্তাকে উন্মোচন করার সিদ্ধান্ত এই সমাজের নয়। এই সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে শুধু নিজের ওপর। নিজের সত্তাকে চেনা ও তাকে নতুন জীবন দেওয়া এখনও আমাদের সমাজে সাহসিকতার নিদর্শন। যেদিন সমাজ একে স্বাভাবিকভাবে নেবে, সেদিন এই ভাবনাকে সফল করতে কোনও সাহসী মন দরকার পড়বে না। শুধু ইচ্ছেটুকুই সম্মান পাবে।
শরীর ও মনের রূপান্তরের একমাত্র অভিভাবক হওয়া উচিৎ নিজের সিদ্ধান্ত, আপন চাহিদা ও স্ব-অনুভূতি। আমি একটা প্রাণ, আমার মনুষ্যত্ব আছে, আমি কাজে কর্মে সাবলীল, আমারও অনুভূতি আছে। এটাই কি পর্যাপ্ত নয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে? অবশ্য এর পরেও যে পরিচয় বাকি থাকে তা হল আমি পুরুষ নাকি নারী। শারীরিক কাঠামো আর মানসিক কাঠামোর সামঞ্জস্য না হলেই শুরু হয় বিরোধ। মস্তিষ্ক যেদিকে ধাবমান হয় সেই রূপ চরিতার্থ করাই হল বড় লড়াই।
প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেলা হয়ত এখনও সমাজ পরিস্কার চোখে দেখতে পায়না। মেনে নিতে পারেননা অনেক অভিভাবক। তাঁদের কাছে এই ব্যাপারটি কখনও ঘৃণ্য বা কখনও হাস্যকর, কিন্তু সত্যি যে সত্যিই থাকে। মানা আর না মানার কাঁটাতারে বিদ্ধ হতে হয় অনেক পরিবারকে আবার অনেক রূপান্তরকামী মানুষকেও।
মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সিলর মোহিত রণদীপের বক্তব্য, একজন মায়ের কাছে তাঁর সন্তানই শেষ কথা। সন্তানের চাহিদা পূরণ, সন্তানকে বোঝা, সন্তানকে সঙ্গ দেওয়া একজন মায়ের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। পরিবারেরও উচিত সেই সন্তানের পাশে থেকে তার মনের ইচ্ছাকে সম্মান জানানো। তবেই সে হয়ে উঠবে সুস্থ স্বাভাবিক আত্মসচেতন মানুষ।