Festive Mood

শীতল ষষ্ঠী কেন পালন করা হয়, ষষ্ঠী পালনের সঠিক নিয়ম

প্রত্যেক জাতিরই কিছু একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। প্রথা থাকে। সাংস্কৃতিক গাঁটছড়া থাকে। দুনিয়া ইধার সে উধার হয়ে গেলেও সে বন্ধনে ফাটল ধরানো অসম্ভব।

শীতল ষষ্ঠী। অপভ্রংশে শেতল ষষ্ঠী। মা-ঠাকুমার কাছে এককথায় গোটা সেদ্ধ। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের এও এক পার্বণ। বছরভর বিভিন্ন ষষ্ঠী পুজোর এটাও একটা। কিন্তু এই একটা দিন ফের একবার বাঙালিকে যে কতটা বাঙালি করে তোলে তা একটু গভীরভাবে ভাবলেই স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

প্রত্যেক জাতিরই কিছু একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। প্রথা থাকে। সাংস্কৃতিক গাঁটছড়া থাকে। দুনিয়া ইধার সে উধার হয়ে গেলেও সে বন্ধনে ফাটল ধরানো অসম্ভব। এই অসম্ভবটা যেদিন সম্ভব হয়ে যাবে সেদিনই সেই জাতি তার নিজস্বতা হারাবে। মিশ্র সংস্কৃতির গ্রাসে বিলীন হয়ে যাবে একান্ত আপনার কিছু সনাতনি প্রথা। আর কয়েক প্রজন্ম পরে মানুষ ভুলে যাবে এমন কোনও প্রথা তাদের ক্যালেন্ডারে আদৌ কোনোদিন জায়গা পেত।


গোটা মুগ, গোটা বেগুন, জোড়া মাখন সিম, জোড়া কড়াইশুঁটি, শিস পালং, টোপা কুল, সজনে ফুল, বাঁধাকপি। শীতল ষষ্ঠীর অবশ্য উপাদান। বাজার থেকে এসব কিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কেনা শেষ করতে হয় সরস্বতী পুজোর সকালের মধ্যে। তারপর সন্ধ্যে নামলে উনুন বা আজকাল গ্যাস ওভেন ধুয়ে মুছে তাতে শুরু হয় রান্না। বিশাল হাঁড়িতে বসে গোটা সেদ্ধ।

গোটা সেদ্ধ, কারণ হাঁড়িতে যা পড়ে তার সবই থাকে গোটা গোটা। অর্থাৎ গোটা বেগুন, গোটা জোড়া সিম, গোটা কড়াইশুঁটি। এসব গোটা সেদ্ধ হলে হাঁড়ি নামিয়ে আগুনে ভাতে বসে। তারপর একে একে আলু-সজনে ফুল ভাজা, টোপা কুলের চাটনি। সঙ্গে লুচি, বাঁধাকপির তরকারি। সব রান্না শেষ হলে সেগুলোকে একটা আলাদা জায়গায় রাখা হয়। সারারাত সেসব রান্না রাখা থাকে।


সরস্বতী পুজোর পর দিন সকালে তিথিগতভাবে ষষ্ঠী থাকতে থাকতে হয় ষষ্ঠীপুজো। তারপর হয় বাড়ির শীল, নোড়ার পুজো। ফুল, প্রসাদ দিয়ে শীল-নোড়ার পুজো দিয়ে দইয়ের ফোঁটা দেওয়া হয় শীল-নোড়ার গায়ে। পুজো শেষে সেই দইই আগের দিনের রান্না করা খাবারে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ব্যস, এবার ওই ঠান্ডা রান্না খাওয়ায় কোনও আপত্তি নেই।

এদিন কিন্তু প্রথামত সকাল থেকে আগুন জ্বলবে না। আগুনের এদিন ছুটি। অনেকটা অরন্ধনের মত এই পার্বণ নিয়ে সরস্বতী পুজোর পরদিন বেশ একটা অন্য আবহ তৈরি হয়। তবে এই পার্বণ মূলত এ দেশীয়দের মধ্যে প্রচলিত। মানে যাকে বলে ঘটিদের মধ্যে। তবে ঠান্ডা রান্নার একদম অন্যরকম স্বাদ। আর সেই সঙ্গে নিজের বাপ-ঠাকুরদার মেনে আসা প্রথাকে আরও একবার ঝালিয়ে নেওয়ার একটা আত্মগর্ব আছে বৈকি।

শীত বিদায় নিচ্ছে। আসছে বসন্ত। এই সময়ে শরীরের পক্ষেও গোটা সেদ্ধর ভূমিকা প্রশ্নাতীত। যাক সে কথা। আসল কথা হল সংস্কৃতিকে ধরে রাখা। প্রতিটি প্রজন্মের একটা অলিখিত দায়িত্ব থাকে। তার জাতিসত্তা, তার পারিবারিক আদর্শ, রীতিনীতি, সনাতনি প্রথার ধারক ও বাহক হিসাবে দায়িত্ব পালন করাও তার কর্তব্য।

বদল অবশ্যম্ভাবী। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। আর সেই বদলের সঙ্গে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ তা না করলে পৃথিবী তোমাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। কিন্তু অনেকে এই এগিয়ে যাওয়ার মানে করে পুরনো সব কিছুকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। অথচ তা তো ঠিক নয়!

এই এগিয়ে যাওয়া কোনও কিছুকে শেষ করে এগিয়ে যাওয়া নয়। বরং পূর্বের ভুলকে পিছনে ফেলে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে পা মিলিয়ে, আর্থসামাজিক অবস্থা, ধ্যান ধারণার পরিবর্তনের সঙ্গে পা মিলিয়ে দুনিয়ার পরিবর্তন যজ্ঞে নিজেকে শামিল করা। সময়োচিত করে তোলা। তার সঙ্গে চিরাচরিত প্রথার বিবাদ কোথায়!

এই পরম সত্যটাই বোধহয় এই জমানাতেও অফিসের তাড়ার ফাঁকে গোটা সেদ্ধ খাওয়ার আনন্দকে মুছে দিতে পারে না। কর্পোরেট অফিসে সদা ব্যস্ত কেতাদুরস্ত নয়া প্রজন্মের বিবাহিতা নারীদের একটু সকালে উঠে ষষ্ঠীপুজো সারায় কুণ্ঠা বোধ হয়না। বরং এই আনন্দটা উপভোগই শুধু নয়, মনে মনে পারিবারিক প্রথার প্রতি নিষ্ঠা তাঁদের পূর্ণাঙ্গ নারী করে তোলায় অবশ্যই সহায়তা করে।

নয়া জামানার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের পুরনো রীতিনীতিকে ধরে রেখে আপন জাতিসত্তাকে মাথা উঁচু করে বাঁচিয়ে রাখা। এই দু’য়ের সমানুপাতিক সঙ্গতই তো আজও আমাদের বাঁচিয়ে রাখে বাঙালি করে। তাই না!

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button