কেন মকরসংক্রান্তির দিন হয় পিঠেপুলি উৎসব, কী এর মাহাত্ম্য, পিঠেপুলির ইতিকথা
কথায় বলে, পেটে খেলে পিঠে সয়। আর সেই পিঠে যদি শীতের হাওয়া গায়ে মেখে গরম গরম পাতে পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই। চোখের নিমেষে পিঠেপ্রেমীরা তার সদ্গতি করে ফেলবেন নিশ্চিত।
কথায় বলে, পেটে খেলে পিঠে সয়। আর সেই পিঠে যদি শীতের হাওয়া গায়ে মেখে গরম গরম পাতে পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই। চোখের নিমেষে পিঠেপ্রেমীরা তার সদ্গতি করে ফেলবেন নিশ্চিত। পৌষের শেষে বাংলার তথা ভারতের নানা প্রান্তে গলির আনাচকানাচ ম ম করে ওঠে পিঠেপুলির সুরভিতে। অথচ সুস্বাদু এই মিষ্টি খাবারটি কিন্তু রন্ধনমহলে বিপুল সমাদরের সঙ্গে তৈরি হয় বছরের নির্দিষ্ট দিনে। এখন প্রশ্ন হল কেন? কেন মকরসংক্রান্তি-র দিন পিঠেপুলি খাওয়ার চল? এর উত্তর পেতে আমাদের চোখ রাখতে হবে গ্রামবাংলার শস্য উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে।
পৌষের শেষে কৃষকদের ঘরে ওঠে হেমন্ত ও শীতকালীন ফসল। বিশেষত ফসল বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে ধান, গম, নতুন গুড়, তিল ইত্যাদি। আর তার সঙ্গে রয়েছে নারকেল, ক্ষীরসহ অন্যান্য ১২ মাস পাওয়া যায় নানা সামগ্রি। নতুন ফসল ঘরে তোলা মানে নতুন করে যেন লক্ষ্মীর বরলাভ। অনটনের সংসারে স্বল্প সময়ের প্রাচুর্য। একটু মনের মাধুরী মিশিয়ে তাই নতুন ওঠা চাল আর গুড় দিয়ে কৃষিজীবী গ্রামবাংলার মেয়েরা তৈরি করে ফেলেন বাহারি স্বাদের পিঠে। পৌষ মাসে ঘরে ঘরে নতুন চালের সেই উৎসব বঙ্গদেশে এভাবেই রূপ পায় ‘পিঠে সংক্রান্তি’-র।
তাছাড়া সূর্যের উত্তরায়ণের শুরু মানে শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে প্রকৃতির আবার শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠা। শীত পেরিয়ে বসন্তের শুরু। এই সময় যেন একটা উৎসবের আমেজ লেগে থাকে বাংলার আকাশে-বাতাসে। আর উৎসব মিষ্টিমুখ ছাড়া যেন অনেকটাই অসম্পূর্ণ।
গ্রীষ্মকালে আগুনের ধারে ঘেমে-নেয়ে ধৈর্য ধরে রাশি রাশি পিঠে বানানো খুবই কষ্টকর। তাই শীতের দিনে এমন সময়সাপেক্ষ খাবার প্রস্তুত করাই ভালো। যা স্বাদে স্বর্গীয়। আবার শরীর সুস্থ ও গরম রাখতে সহায়ক। সেই স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখেই পৌষ থেকে মাঘ অবধি পিঠে বানানোর ধুম পড়ে যায় দেশের নানা প্রান্তে। পিঠের নামও তার স্বাদের মতই বাহারি। সিদ্ধ পিঠে, পুলি পিঠে, ভাপা পিঠে, খেজুরি পিঠে, চিল পিঠে, চিতই পিঠে, রস পিঠে এবং আরও কত কী!
লোকমতে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হতেই খুলে যায় স্বর্গদ্বার। ৬ মাস টানা বিশ্রাম নেওয়ার পর দেবতাদের শক্তিতে নাকি ‘মরচে’ পড়ে। তাঁদের শক্তি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন হয় যজ্ঞ, পূজার্চনার। আর সেই পুজো সুস্বাদু মিষ্টান্ন প্রসাদ ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাই পৃথিবীবাসী দেবতাদের তুষ্ট করতে প্রস্তুত করে থাকেন নানা আকারের সুস্বাদু পিঠেপুলি। অবশ্যই তা প্রস্তুত করতে হয় নতুন চাল দিয়ে। এই প্রথা মধ্যযুগের সরণী বেয়ে বর্তমান সময়ে তার স্বমহিমায় মূর্তমান।
এছাড়া মকরসংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে পিতৃপুরুষের রসনা তৃপ্ত করতেও তাঁদের অনেকে পিঠেপুলি নিবেদন করে থাকেন। তারপরে নিজেরা সেই পিঠেতে বসান কামড়। তবে এসব তো গেল পৌরাণিক কাহিনি বা প্রচলিত প্রথার কথা। আদত কথা হল এই সময়ে সহজেই মেলে চালের গুঁড়ো, নলেন বা খেজুর গুড়, পাটালি গুড়। যাদের সঙ্গে পিঠেপুলির আবার আদি ও অকৃত্রিম সংযোগ।
তাই সময় ও যোগান, দুয়ে মিলে পিঠেপুলির সম্ভারে ভরে উঠুক বাঙালির হেঁশেল। হাজারো জিভে জল আনা পদ নিশ্চিন্তে চালান করে দিন মুখে। জিহ্বার ছোঁয়ায় যার স্বাদ আপনাকে গত বছরের না ভোলা স্বাদের কথা ফের একবার মনে করিয়ে দেবে। আর এই মনে করানোর পাশাপাশি যেটা উজাড় করে দেবে তাকে বাংলায় এককথায় বলে ‘পরমানন্দ’!