‘হোলসেল একশো টাকা। যাতে হাত দেবেন দিদিভাইয়েরা মাত্র একশো টাকা। দুশো টাকায় গেঞ্জি নিয়ে যান দাদাভাই। দেড়শতে সুন্দর সুন্দর কুর্তি আছে! নিতে হবে না। খালি একবার দেখে যান। গ্যারান্টি, পছন্দ হবেই। দেড়শতে দুটো বালিশের ওয়াড় নিয়ে যান বউদিরা। একঘর মাল।’ কান ঝালাপালা করা দোকানিদের এমন চিলচিৎকারে প্রতিবারের মত এবারেও সরগরম চৈত্র সেলের বাজার। কদিন বাদেই নতুন বছর কড়া নাড়তে চলেছে বঙ্গের দুয়ারে। বাঙালির নববর্ষ বলে কথা। নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন পোশাক পরে হালখাতার নিমন্ত্রণ রক্ষা আছে। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডার মোক্ষম দিন বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন। তার আগে ঘরদুয়ার ঝেড়ে, পরিস্কার করে নবরূপে সাজিয়ে তোলার ঝক্কি আছে। এরজন্য প্রয়োজন টুকিটাকি সাজসরঞ্জাম। সস্তায় সেইসব সরঞ্জাম পেতে বাঙালির দরবারে ফি বছর আবির্ভাব হয় চৈত্র সেলের।
নিয়মমাফিক গোছানো সংসার নিয়ে বাজার এলাকায় এবারেও ফুটপাথ দখল করে জমিয়ে বসেছেন দোকানিরা। নববর্ষে পা পড়ার আগে পুরাতন স্টক খালি করতে হবে। নাহলে বাজারে পুরাতনের তেমন আর কাটতি থাকবেনা। অতএব ক্রেতা লক্ষ্মীদের দরাদরির সাঁড়াশি আক্রমণের আগেই সম্ভারের গায়ে বসিয়ে দাও ‘চৈত্র সেল’-এর ট্যাগ। ক্রেতাদের এতে লাভ বই ক্ষতি নেই। বছরভর যেসব জিনিস থাকে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে, সেই জিনিস এইসময় হয়ে ওঠে সস্তা, সহজলভ্য। প্রকৃতি যেমন শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে, বসন্তের ফাগুন রাঙা সাজে সেজে উঠে নবতর রঙে, ঢঙে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও শুভাশুভ, নতুনত্বের গুরুত্ব আছে বৈকি। পুরাতনকে ভালোয় ভালোয় বিদায় দিতে না পারলে সাদর নবীনবরণ হবে কি করে! তাই তো মেট্রোপলিটনের আনাচেকানাচে, বাজারে, শপিং কমপ্লেক্সে, মলে সর্বত্র এইসময় থাবা গাড়ে বহুপ্রতীক্ষিত চৈত্র সেল। বিপণনের ওপর ছাড়ের মহাযজ্ঞ! এইসময় পোশাক-পরিচ্ছদ পাওয়া যায় সর্বোত্তম ছাড়ে। দিলখুশ করে দেওয়া ছাড় মেলে গৃহস্থালির নানা সামগ্রিতেও। ছাড়ের এমন প্রলয় বঙ্গভূমিকে কাঁপিয়ে দেয় বারো মাসের এই একটিমাত্র নির্দিষ্ট মাসেই।
শারদোৎসবের আগে থেকে জিনিসপত্রের দাম একেবারে ছ্যাঁকা খাওয়ার পর্যায়ে চলে যায়। তাই বুদ্ধিমান হিসেবিরা সারাবছরের কেনাকাটা, বিয়েবাড়ি, অন্নপ্রাশন, জন্মদিনসহ হাজার রকমের অনুষ্ঠানের বায়নাক্কার উপহার ঘরে মজুত করে তোলেন এইসময়েই। মোক্ষম সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়। তাইতো পয়লা এপ্রিলে পা পড়তেই দোকানিদের হুংকার আর শপিং হপারদের ঢল নামে গড়িয়াহাট, বড়বাজার, হাতিবাগান, শ্যামবাজারের মত বড় বড় মার্কেট চত্বরে। স্থানীয় বাজারগুলোও এইসময় রমরমিয়ে রাজ্যপাট সামলায় নববর্ষের দিন পর্যন্ত। দিনের বেলা গরম হাওয়া আর রোদের তাপে কেউ যে বাজার করতে আসবে না, তা ভালমতোই জানেন পসারিরা। তাই সূর্যের আলো চোখরাঙানি কমাতেই যে যাঁর নির্ধারিত জায়গায় আসন পেতে বসেন। রাত অবধি চলে যুগান্তরের বিকিকিনি। লোকে লোকারণ্য শহর, মফঃস্বল, গ্রাম গঞ্জের বাজারহাট ফিরে পায় ঈর্ষণীয় প্রাণ। একগাল হাসিতে গাল চওড়া হয় ক্রেতা-বিক্রেতা দুই তরফেরই। দিনের শেষে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে ফিরতি পথে চলে টুকটাক ভুরিভোজ। মনে মনে একটাই প্রার্থনার রস দ্রবীভূত হয়। আসছে বছর আবার হবে।