Festive Mood

হালখাতা, বঙ্গজীবনের একটি লুপ্তপ্রায় প্রথা

এই প্রথা নিভু নিভু দেউলটির প্রদীপের মত আজও জ্বালিয়ে আসছেন গ্রামগঞ্জ, শহর, শহরতলির সনাতনি বাঙালি ব্যবসায়ীরা।

কিগো গিন্নি, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। বউবাজারে চন্দ্রবাবুর সোনার দোকানে আজ হালখাতার নিমন্ত্রণ আছে যে। তারপর যেতে হবে শোভাবাজারে। সেখানেও দু-তিনটে নিমন্ত্রণ সারা বাকি। সেসব ভুলে গেলে নাকি? ধুতিতে মালকোঁচা দিতে দিতে পাশের ঘর থেকে স্ত্রীকে তাড়া লাগান বিশ্বম্ভর নাথ। সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে বাবার হাত ধরে বউবাজার, শোভাবাজারের সোনার দোকানে হালখাতার নিমন্ত্রণ সেরে আসছেন তিনি। ভুঁড়ি বেড়ে গেল। মাথার টাক চওড়া হল। তবু হালখাতার নেমন্তন্ন রক্ষা করতে তিনি আজও ভোলেন না।

আজকের প্রজন্মের অনেকেই তো হালখাতা কি সেটাই জানে না। তারা খালি বোঝে, মলে যাও। সেখানে দোকানগুলোতে নগদ টাকা দিয়ে বা ডেবিট কিম্বা ক্রেডিট কার্ড মেরে যতখুশি শপিং কর। আর নাহলে অনলাইন আছেই। ঘরে বসে আয়াস করে পপকর্ন চিবোতে চিবোতে মনের মত জিনিসের অর্ডার দেওয়ার স্বর্ণসুযোগ। তা সেই অর্ডার সাজগোজের হোক বা ফোনের। গয়নার হোক বা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রির। সারাবছর ধরে মাল তুলে চেনাজানা দোকানির থেকে জিনিস কেনার আহ্লাদ এ যুগে বিলুপ্তপ্রায় ‘অ্যাক্টিভিটি’-র পর্যায়ে পড়ে গেছে। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে বাবার বলা হালখাতা প্রবর্তনের ইতিহাসের পাতায় ডুব দেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বিশ্বম্ভর নাথ।


মোঘল সম্রাট আকবরের হাত ধরে নাকি সূত্রপাত হয়েছিল পয়লা বৈশাখ আর হালখাতার। সেকালে কৃষিপ্রধান বঙ্গদেশের চাষিভাইদের চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, পাওনাগণ্ডা শোধ করতে হত। কারণ, তার পরের দিন থেকেই নতুন বঙ্গাব্দের শুরু। নতুন বছর মানে নতুন করে সবকিছুর শুভারম্ভ। এইদিন ভূমি মালিকরা নিজেদের অঞ্চলের বাসিন্দাদের মিষ্টি দিয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন। মালিকদের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন প্রজারাও। নতুন বছরের প্রথম দিনে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি কালক্রমে একটি সামাজিক পরম্পরায় পরিণত হয়। তখনকার সময়ে পয়লা বৈশাখের প্রধান বিষয় ছিল হালখাতা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বইকে বোঝানো হত। এটি আসলে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাবপত্র একজায়গায় করার প্রক্রিয়া।

আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটিমাত্র মোটা খাতায় যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাঁদের পুরনো দেনাপাওনার হিসাব এক জায়গায় করে বাংলা সালের প্রথম দিনে হিসাবের নতুন খাতাটি খুলতেন। তার আগে খদ্দেরদের বিনীতভাবে পুরাতন বছরের যাবতীয় পাওনা শোধ করার কথা মনে করিয়ে দিতেন ব্যবসায়ীরা। পয়লা বৈশাখের কিছুদিন আগে কার্ড দিয়ে বা করজোড়ে খরিদ্দারদের সপরিবারে দোকানে পদার্পণের নিমন্ত্রণ জানাতেন দোকানের মালিক। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে কামনা করতেন, তাঁদের সারা বছর যেন ব্যবসা ভাল যায়।


পূজার্চনার পর দেবতার পায়ে ছোঁয়ানো সিঁদুর দিয়ে আঁকা স্বস্তিকা চিহ্ন ও চন্দনচর্চিত নতুন মোটা লাল গেরোর খাতায় নতুন বছরের হিসেবনিকেশ আরম্ভ হত। আর খদ্দেররা এলে তাঁদের মিষ্টি খাইয়ে ক্রেতা লক্ষ্মীকে তুষ্ট করতেন দোকানিরা। যাতে বছরভর খদ্দেরদের কৃপাদৃষ্টিতে ফুলেফেঁপে ওঠে ব্যবসায়ীর লক্ষ্মীর ঘট। ব্যবসায়ীদের নিমন্ত্রণ রক্ষার পাশাপাশি এইদিন খদ্দেররাও তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরনো দেনা শোধ করে দিতেন। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সব জায়গাতেই এভাবেই সূচনা হয় হালখাতা উৎসবের।

এই প্রথা নিভু নিভু দেউলটির প্রদীপের মত আজও জ্বালিয়ে আসছেন গ্রামগঞ্জ, শহর, শহরতলির সনাতনি বাঙালি ব্যবসায়ীরা। খদ্দের যে লক্ষ্মী, এই বিশ্বাসে আজও আসন পেতে বৈশাখী গরমে মিষ্টির পঞ্চব্যঞ্জন, ঠান্ডা পানীয় আর আকর্ষণীয় উপহারের ডালি সাজিয়ে নববর্ষের দিন দিনভর ক্রেতার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকেন ব্যবসায়ীরা। আর সেজেগুজে দোকানে গিয়ে ভূরিভোজ সেরে উপহার হাতে বাড়ি ফিরে বিশ্বম্ভরবাবুর মত শান্তির ঘুম আঁকড়ে বাঁচে বাঙালির হালখাতা।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button