বাংলার এই প্রাচীন মেলায় মহাপ্রভু পান নুন, মণ্ডা ভোগ
বাংলার প্রাচীন যে কটি মেলা আজও তার গরিমা ধরে রেখেছে তার একটি অবশ্যই এই মেলা। এই মেলার অন্যতম বিশেষত্ব হল এখানে মহাপ্রভু পান নুন, মণ্ডা ভোগ।
বাংলার পল্লীজীবনের অন্যতম বিনোদন মেলা। সীমিত বিনোদনের সুযোগের কারণে স্থানীয় মেলার আশায় বছরভর অপেক্ষায় থাকেন গ্রামের মানুষজন। এখন অবশ্য দিন বদলেছে। বছরভর বিনোদনের এখন অভাব নেই। তবে মেলা তার আকর্ষণ হারায়নি। এখনও মেলা বসবে কবে, সেই আশায় অপেক্ষায় থাকেন মানুষজন।
এমনই এক মেলা বীরভূমের ইলামবাজারের ২৪ প্রহর মেলা। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবকে সামনে রেখেই এই মেলার শুরু। সে বহু বছর আগের কথা। সে সময় রাঢ় বাংলায় পদব্রজে ভ্রমণের সময় ইলামবাজারের এক স্থানে এসে বিশ্রাম নেন মহাপ্রভু।
কথিত আছে সে সময় স্থানীয় মানুষের কাছে ভাত দিয়ে খাবার জন্য একটু নুন চেয়েছিলেন তিনি। মহাপ্রভুর সেই ক্ষণিকের বিশ্রামকে সামনে রেখেই পরবর্তীকালে এখানে মহাপ্রভুর একটি মন্দির নির্মিত হয়।
বলা হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের ২০ তারিখে মহাপ্রভু বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন এখানে। তাই সেই তারিখকে সামনে রেখেই এখানে ২৪ প্রহর মেলা শুরু হয়। যা বাংলার প্রাচীন মেলাগুলির একটি। কবে থেকে এই মেলার শুরু তা এখন সঠিকভাবে জানা যায়না। তবে তার প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনা।
প্রতিবছর মন্দিরে ১৯ জ্যৈষ্ঠ হয় মহাপ্রভুর অধিবাস। ২০ জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু হয় মেলা। মেলা শুরুই হয় মহাপ্রভুর মূর্তিকে কোলে করে নগর পরিক্রমা করানোর মধ্যে দিয়ে।
যেহেতু মহাপ্রভু বিশ্রাম নেওয়ার সময় স্থানীয় মানুষের কাছে ভাত দিয়ে খাওয়ার জন্য নুন চেয়েছিলেন, সেকথা মাথায় রেখে আজও মহাপ্রভুর মন্দিরে এই সময় নুন ও মণ্ডা দিয়ে ভোগ নিবেদন করেন ভক্তেরা।
মেলা চলাকালীন মন্দির চত্বরে যে নামসঙ্কীর্তন শুরু হয় তা ৩ দিন অখণ্ড ভাবে চলতে থাকে। যে কারণেই এই মেলা ২৪ প্রহর মেলা বলে পরিচিত।
মেলা বসে ইলামবাজারের হাটতলায় মহাপ্রভুর মন্দিরের চারপাশ ঘিরে। খেলনা, পুতুল থেকে বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস এবং আরও কত কিছুই বিক্রি হয় মেলায়। ভিড়ও হয় চোখে পড়ার মতন। থাকে খাওয়াদাওয়ার জন্য স্টল। মেলায় ঘুরলে যে গ্রামের মেলার গন্ধ পাওয়া যায় তা তথাকথিত শহুরে মেলায় নেই।
৩ দিন ধরে টানা মেলা চলার পর চতুর্থ দিনে এখানে হয় মোচ্ছব। ২৪ প্রহর মেলা কমিটির উদ্যোগে এই মোচ্ছবে ১০ হাজারের ওপর মানুষ খাওয়াদাওয়া করেন। পাত পেড়ে বসিয়ে খাওয়ানো হয় সকলকে। কারও খালি পেটে ফেরার উপায় নেই। গোটা এলাকার মানুষ উপচে পড়েন এই মোচ্ছবে শামিল হতে। ভাত, ডাল, ২ রকম নিরামিষ তরকারি, চাটনি, পায়েস, এই মেনুই চলে আসছে বছরের পর বছর। যার টানে সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন এলাকার ধনী দরিদ্র সকলেই।
মোচ্ছবের পরদিন হল এই উৎসবের শেষদিন। এদিন মহাপ্রভুকে নিয়ে ফের নগর পরিক্রমায় বার হন সকলে। সঙ্গে চলে নাম নামসঙ্কীর্তন। সঙ্গত দেয় হরিরলুট। এদিনের উৎসবকে বলা হয় ধুলট। নগর পরিক্রমার জন্য ওড়া ধুলো আর হরিরলুট, এই দুইয়ে মিলে ধুলট। কার্যত ধুলটেই শেষ হয় ইলামবাজারের এই বিখ্যাত ২৪ প্রহর মেলা। ৫ দিনের আনন্দের পর ফের মানুষ ফেরেন দৈনন্দিন জীবনে। আর শুরু হয় দিনগোনা। সামনের বছরের ২০ জ্যৈষ্ঠের জন্য অধীর অপেক্ষা।