মাটির ছোঁয়ায় মৃন্ময়ী
পুজোর আর কয়েকদিন বাকি। ফলে ব্যস্ততা তুঙ্গে বললেও কম বলা হয়। কুমোরটুলির অপরিসর রাস্তা আরও ছোট হয়ে গেছে। ভিড় থিকথিক করছে।
রাহুল যখন আমার বাড়ি এল তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে আটটা। প্ল্যানটা গতকাল রাতেই সারা ছিল। কথামত ঠিক সময়েই রাহুল হাজির। দেরিটা হল আমার দিক থেকেই। এমনিতেই লেট রাইজার। তার ওপর কাল মাঝরাত পর্যন্ত প্যারিসে থাকা নিলাদ্রির সঙ্গে চ্যাট করেছি। ফলে রাহুল আসার পর ওর হাঁকডাকেই ঘুমটা ভাঙল। ‘কি রে? এখনও ঘুমচ্ছিস? শালা, আমায় এখন আসতে বললি কেন? রবিবারের বাজার একটু আয়েস করে আসতে পারতাম?’ ‘সরি বস, যদি খিস্তি করতে চাস করে নে। আমি কিছু বলব না। কিন্তু…’, কথা শেষ করতে দিল না রাহুল। ব্যাপক চটেছে। ‘আধ ঘণ্টা সময় দিলাম, রেডি হতে পারিস তো হ, নয়তো আমি স্ট্রেট ব্যাক টু হোম, ক্লিয়ার?’ ‘ইয়েস বস, জো হুকুম’, একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে ছুট দিলাম বাথরুমে।
‘তোরা কোথায় যাচ্ছিস রে? খাবার টেবিলে লুচি আর বেগুন ভাজা সার্ভ করতে করতে রাহুলকে কথাটা জিজ্ঞেস করল মা। ‘কুমোরটুলি কাকিমা। আমাদের যে কজন বন্ধু বাইরে, তারা কলকাতার পুজো মিস করছে। তাই প্রচুর ছবি পাঠাব ওদের। ওরা এখানে থাকতে প্রতি বছরই পুজোর আগে একবার অন্তত আমরা সব বন্ধু মিলে কুমোরটুলি যেতাম! এখন ওরা অনেকে দুরে থাকে। তাই আজ অনেক ছবি তুলে ওদের পাঠিয়ে দেব। সেই সুযোগে পুজোর কাজ কেমন চলছে সেটাও দেখা হয়ে যাবে। মানে রথ দেখা কলা বেচা আর কি!’ মা মুচকি হেসে বলল, ‘ঘুরে বাড়ি ফিরে যাস না। এখানেই লাঞ্চটা করে যাবি, কেমন।’ রাহুল ঘাড় নাড়ল।
লালমন্দিরের সামনে বাস থেকে নেমে একটু হাঁটা পথ। অলিগলি হয়ে কুমোরটুলি খুব বেশি হলে মিনিট দশেক। আমরা যখন কুমোরটুলি পৌঁছলাম তখন বেলা সাড়ে দশটা। পুজোর আর কয়েকদিন বাকি। ফলে ব্যস্ততা তুঙ্গে বললেও কম বলা হয়। কুমোরটুলির অপরিসর রাস্তা আরও ছোট হয়ে গেছে। ভিড় থিকথিক করছে। দু’পাশে শিল্পীদের স্টুডিও। স্টুডিও মানে টালি বা অ্যাসবেস্টসের চালা। আর তারমধ্যে সারি দিয়ে রয়েছে দুর্গা। ছোট বড় বিভিন্ন তার আকার। অনেকগুলোরই রং শেষ। কোনওটায় চলছে শেষ মুহুর্তের তুলির টান। একটা স্টুডিওতে দেখলাম ঘরামিতে চড়ে চলছে চক্ষুদান। আমি ক্যামেরাটা বের করলাম।
আজকাল অনেকক্ষেত্রে কুমোরটুলিতে ছবি তুলতে গেলে পারমিশন লাগে। তবে আমরা পরিচিত মুখ। ফলে সেটার আর দরকার পড়ল না। চক্ষুদানের সময় শিল্পীকে ডিস্টার্ব করতে নেই। তাই ফ্ল্যাশটা অফ করে নিলাম। সকালের আলোটা কিছুটা হলেও ঘরে ঢুকছে। আমার ক্যামেরা লো লাইটেও ভাল কাজ করে। বিভিন্ন কোণা থেকে ছবি নেওয়া শুরু করে দিলাম। ছোট জায়গা। তারমধ্যে সারি সারি ঠাকুর। কোথাও ঠাকুরের হাত বেরিয়ে আছে। কোথাও অসুর। কোথাও বা ময়ূরের পেখম। ফলে বেশ সন্তর্পণেই ছবি তুলতে হচ্ছে। অনেক সময় নিচু হয়ে ছবি তুলে মাথা নিচু করেই সরে আসছি। কুমোরটুলির পুরনো পাঠ, ‘যদি কোনও ঠাকুরের পায়ের কাছে গিয়ে কাজ কর, তাহলে বের হওয়ার সময় মাথা নিচু করেই বের হতে হবে।’ কারণটাও জানতাম। তৈরি ঠাকুরের পায়ের কাছে কাজ করে হঠাৎ করে মাথা তোলার চেষ্টা করলে ঠাকুরের হাত ভেঙে যায়!
আমরা এগোলাম। এরমধ্যেই রাহুল নিজের ক্যামেরায় টপাটপ ছবি তুলে চলেছে। ব্যস্ততা, ঠাকুর, ঠাকুরের সাজ, অপরিসর রাস্তা, বিদেশিদের আনাগোনা। কিছুই ছাড়ছে না। এবার যে শিল্পীর ঘরে পৌঁছলাম সেখানে একচালার ঠাকুর ভর্তি। এগুলো মূলত বাড়ির ঠাকুর। ছোট ঠাকুর। অতসী রঙের দুর্গা। সবুজ অসুর। টানা টানা চোখ। দেখলেই বনেদিয়ানার গন্ধ পাওয়া যায়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিগো, সাপ্লাই কবে’? এই তো মহালয়া শেষ হলেই সাপ্লাই শুরু হয়ে যাবে। কাজ থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলেন কাঁচাপাকা দাড়ির শীর্ণকায় মৃৎশিল্পী।
বাইরে একটা শোরগোলের আওয়াজে আমি আর রাহুল বেরিয়ে এলাম। একটু দূরেই অন্য এক শিল্পীর ঘরের সামনে বেশ কয়েকটি ছেলের ভিড়। সেদিকেই এগোলাম। ছেলেগুলো একটা বারোয়ারির সদস্য। সঙ্গে কয়েকজন বয়স্ক মানুষও আছেন। তাঁদের সঙ্গেই শিল্পীর কথা কাটাকাটি চলছে। ঠাকুরের মুখ নিয়ে যত গণ্ডগোল। বারোয়ারির দাবি, যেমন ঠাকুরের মুখ তারা অর্ডার দেওয়ার সময় চেয়েছিলেন তা হয়নি। শিল্পী যদিও তা মানতে নারাজ। আর তাতেই ঝগড়া। এখানে আর বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করে লাভ নেই। পুজোর সময় এ নিত্যদিনের ঘটনা।
শিল্পীরা ঠাকুর গড়ে দেন। কিন্তু অস্ত্র দেন না। সেই অস্ত্র কেনা হয় অন্য দোকান থেকে। সেখানে রাতদিন এক করে টিনের পাত কেটে শুধুই অস্ত্র তৈরি চলছে। চিৎপুরের ট্রাম লাইনের উপরের এই দোকানের মালিক আমাকে চেনেন। ফলে অসুবিধে হলনা। দোকানের তলায় যেখানে অস্ত্র তৈরির কাজ চলছে, সেখানে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম আমরা। নমুনা করাই আছে। শুধু টিনের পাতের উপর নমুনা বসাচ্ছে আর ঝপাঝপ কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলছে। তারপর তাতে রঙ করলেই মাল তৈরি। শুধু বারোয়ারির লোকজনই নয়, এখানে দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসেন অস্ত্র কিনতে। দোকানে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ই দেখলাম উত্তরবঙ্গ থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ী এসেছেন। অনেক মাল কিনলেন। দোকান মালিক এত ব্যস্ততার মধ্যেও ডাকলেন আমাকে। সামনেই বসে আর এক ভদ্রলোক। ‘এনাকে দেখো, ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছেন আমার কাছে।’ অনেক অস্ত্র কিনেছেন দেখলাম। সুযোগটা হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না। টপ করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম হিন্দিভাষী ওই মাঝবয়সী ভদ্রলোকের।
ফের স্টুডিওর দিকে এগিয়ে গেলাম। অলিগলি দিয়ে ঘুরছি। এমন সময় নজরে পড়ল শ্যাওলা রঙের একটা গাছের গুঁড়ি। আর তার উপর দুর্গা। দুর্গার পেটের কাছ থেকে মাথা পর্যন্ত আছে। নিচের অংশটা গাছের গুঁড়ির আদলে তৈরি। একইভাবে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হয়েছে গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক। দাড়িয়ে পড়তেই হল। এমন দুর্গা কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না। যত রকমভাবে ছবি নেওয়া সম্ভব তুলে ফেললাম আমরা। এ সুযোগ ছাড়তে নেই। কিন্তু জিজ্ঞাসাটা রয়েই গেল। পাশের ঘরটায় ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাইরের গাছের আদলে তৈরি দুর্গাটা কি আপনার তৈরি’? একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে মধ্যবয়সী শিল্পীর অলস উত্তর, ‘হ্যাঁ’। ‘আচ্ছা, কি বোঝাতে চাইছেন যদি একটু বলেন’, প্রশ্নটা রাহুলই করল। ‘গাছ কাটার প্রতিবাদ করে একটা বারোয়ারি এবার থিম পুজো করছে। আমায় এসে বলেছিল। তাই ভেবেচিন্তে এমন একটা ঠাকুর বানিয়ে দিলাম’, উত্তরটা দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন ওই শিল্পী।
আর কয়েকটা দিন। তারপরই কুমোরটুলির রাস্তায় তিল ধারণের জায়গা থাকবে না। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে লরি। বারোয়ারির ছেলেদের ভিড়। শিল্পীর ঘর ছেড়ে সংসার সমেত মা পাড়ি দেবেন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। আর তার জন্যই হৈচৈ। অপরিসর স্টুডিও থেকে আগে ঠাকুর বড় রাস্তায় বের করা হয়। তার পরে তোলা হয় লরিতে। একটু বেশি টানা হ্যাঁচরা করলেই বিপদ। মট করে ভেঙে যাবে নতুন ঠাকুরের অঙ্গ। সে নিয়ে আবার তুলকালাম লেগে যাবে। তবে ফি-বছর ঠাকুর সাপ্লাই দিতে দিতে কোনও বারোয়ারি এলে ঠাকুর বের করে দেওয়ার টেকনিক এখানকার সব শিল্পীরই রপ্ত। ওদিনের সেই ছবিও তোলার দরকার। মোটা বাঁশে কাছি বেঁধে ঠাকুরকে লরিতে তোলার ছবি রেখে দেওয়ার মত।
ঘড়ির কাঁটায় প্রায় দেড়টা। বেলা হল। এসময়ে শিল্পীরাও ঘণ্টা দুয়েকের জন্য বিশ্রাম নেন। স্নান, খাওয়া সারেন। রাহুলকে বললাম তাহলে দ্বিতীয়ার দিন একবার সন্ধের দিকে আসতে হবে বুঝলি। ঠাকুর বের করার ছবি হাতছাড়া করা যাবেনা। রাহুলও মাথা নেড়ে এক কথায় রাজি। ঠিক হল, দ্বিতীয়ার দিন বিকেলে রাহুল আমার বাড়িতেই মিট করবে। তারপর সেখান থেকে কুমোরটুলি। সেদিনের মত পাততাড়ি গুটিয়ে দুজনেই বাড়ির যখন দিকে এগোলাম, তখন চিৎপুরের ওপর গাড়ি বেশ কমে গেছে। একটা গলি ধরে লালমন্দিরের দিকে এগোচ্ছি। এমন সময় পাশের একটা বাড়ি থেকে তীব্র শব্দে প্রেশার কুকারের সিটি বেজে উঠল। রাহুল মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নির্ঘাত মটন!’ ‘আমি বললাম ‘বাড়িতেও সেটাই অপেক্ষা করছে।’ দু’জনের পায়ের গতি যেন অজান্তেই বেড়ে গেল! — চিত্রণ – সংযুক্তা