জাগো, তুমি জাগো, জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিনী…, মোবাইলটা বাজছে। মহালয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে রিংটোনটা কাল রাতেই পাল্টে ফেলেছেন তরুণবাবু। তরুণ চট্টোপাধ্যায়। বয়স ৬১, রিটায়ার্ড সার্ভিসম্যান। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলেন। অবসরের পর হাতে এখন অফুরান সময়। এক ছেলে, বিদেশে। বাড়িতে মানুষ বলতে কত্তা-গিন্নি, আর একটি রাতদিনের কাজের মেয়ে। বয়স হলে কি হবে, কম্পিউটার স্যাভি বলতে যা বোঝায়, তরুণবাবু ঠিক তাই। দিনের অধিকাংশ সময়ে কম্পিউটার, ইন্টারনেটে মুখ গুঁজে বসে থাকেন।
এহেন তরুণবাবু তাঁর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রেখে চলেন। পেছনে লেগে থেকে কয়েকজনকে ফেসবুকও শিখিয়েছেন। চ্যাটও করেন।
‘হ্যালো’ – ফোনটা ধরলেন তরুণবাবু।
– ‘কাল এমন একজনের সঙ্গে দেখা হল নামটা বললে চমকে উঠবি।’ ওপার থকে ভেসে এল আওয়াজটা।
– ‘কে?’
– ‘মিতা’!
এই বয়সেও পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত শিহরণ খেলে গেল তরুণবাবুর। ‘কোথায়?’
– ‘আমার বাড়ির কাছে, এইট-বি বাস স্ট্যান্ডে।’
– ‘চিনতে পারলি?’
– ‘বিলক্ষণ, বয়স হলে কি হবে মিতা কিন্তু এখনও সুন্দরীই আছে’।
– ‘ওহ! তা তোকে চিনতে পারল?’ ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন তরুণবাবু।
– ‘প্রথমে একটু অসুবিধা হচ্ছিল, কিন্তু পরে নিজেই বলল, অম্লান না!’
– ‘আর কারো কথা জিজ্ঞেস করেনি!’
– ‘মানে জিজ্ঞেস করছিস তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে কিনা, তাইতো! শালা, তুই পাল্টালি না।’ ফোনের ওপার থেকে একটা আলগা হাসির শব্দ ভেসে এল।
কিছুটা ইতস্তত বোধ করছেন তরুণবাবু। তবে সেটা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেল অম্লানবাবুর পরের কথাটায়। ‘শোন, তোকে ফোন করবে, তোর নম্বরটা আমি দিয়ে দিয়েছি।’
– ‘আমাকে’?
– ‘এই বয়সে আর ন্যাকামি করিস না। শোন পুজোর সময় ও কলকাতায় থাকছে। মেয়ের কাছে। আমি বলেছি পুজোর প্ল্যানটা। তুইও বলে দেখ, যদি আসতে পারে।’
– ‘ঠিক আছে, রাখছি’, ফোনটা রেখে দিলেন তরুণবাবু।
মিতা মুখোপাধ্যায়। কলেজ লাইফের ডাকসাইটে সুন্দরী। তরুণবাবুর ড্রিমগার্ল। তবে ওই ড্রিমগার্লই। তখন কো-এড কলেজেও ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের একটা ভালই দূরত্ব থাকতো। ফলে ক্লাস মেট হলেও টুকিটাকি কথা ছাড়া আর কিছুই এগোয়নি। বন্ধুরা অনেক করে বলেছিল, ‘তরুণ সাহস করে বলেই ফেল। কলেজের দিনগুলো শেষ হয়ে গেলে আর সুযোগ পাবি না।’ কয়েকবার মনের জোর করে এগিয়েও ছিলেন। তবে শেষপর্যন্ত পেরে ওঠেননি। মামুলি কয়েকটা কথা বলে পালিয়ে এসেছিলেন। পাছে মিতার গায়ে একটা আঙুলও লেগে যায়। তাই সচেতনভাবেই দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। যদি মনে করে, ইচ্ছে করে গায়ে হাত দিল! কিন্তু মনে মনে খুব ইচ্ছে করত মিতার হাতদুটো চেপে ধরে বলে, ‘মিতা তোমায় আমি ভীষণ ভালবাসি। তুমি আমার জীবনসঙ্গী হবে?’ না, কিন্তু ওই ভাবাই সার, তিন বছরের কলেজ জীবনে এই কাজটা কোনও দিনই করতে পারেননি, এমনিতে ডাকাবুকো স্বভাবের তরুণ চাটুজ্জে। কলেজের শেষ দিনে খুব সুন্দর করে সেজে এসেছিল মিতা। চোখ সরাতে পারেননি তরুণবাবু। বুকের কোনা থেকে একটা মোচড় দেওয়া ব্যথা যেন গলার কাছ অব্ধি চলে এসেছিল। সেই শেষ। তারপর থেকে আর কখনও মিতার সঙ্গে দেখা হয়নি তরুণবাবুর। শুনেছিলেন তারপরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মিতার।
রাস্তায় ঘাটে পুজোর একটা আবহ তৈরি হয়েছে। জানালার গরাদ বেয়ে বাল্বের সারি নেমে গেছে। কিছুটা দুরে প্যান্ডেলের শেষ মুহুর্তের কাজ চলছে। এবার বেতের প্যান্ডেল করছে তরুণবাবুর পাড়ার ক্লাব। উত্তর কলকাতার পুরনো পুজো। এখানেই জীবন কেটেছে। আগে এত রমরমা ছিলনা। এখন থিমের সঙ্গে পাল্লা দিতে তাঁর পাড়ার ছোট্ট পুজোও কখন যেন বড় হয়ে উঠেছে। তবে তরুণবাবুর এসবে তেমন মত নেই। বনেদিয়ানা হারাচ্ছে পুজোটা। আগে পুরো পাড়াটা যখন মহাষ্টমীর সকালে প্যান্ডেলে হাজির হত, দেখে মনে হত বাড়ির পুজোর ঠাকুর দালান। যথার্থই মিলন উৎসব। সাদামাটা প্যান্ডেল দেখতে ভিড় হত না ঠিকই। তবে পুজোর দিনগুলো যে কি আনন্দে কেটে যেত, বোঝাই যেত না। আজকাল তো নিজেদের প্যান্ডেলে নিজেদেরই ঢোকা দায় হয়ে গেছে। ভিড় ঠেলে, যুদ্ধ করে ঠাকুরের সামনে যেতে হয়।
জাগো, তুমি জাগো, জাগো দুর্গা… তরুণবাবুর ফোনটা আবার বেজে উঠল। বাইরে হ্যালোজেনের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। সার বছর আধো অন্ধকারে থাকা পাড়াটা বেশ আলোয় ভরে উঠেছে। ভাল লাগছে। রণজয় ঢাকিও এসে গেছে। এসেছে সেটা সকলকে জানান দিতে একবার ঢাকটা বাজিয়ে নিল। অনেকদিন পর ঢাকের আওয়াজ শুনতে বেশ লাগছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেসবই দেখছিলেন তরুণবাবু। ফোনের আওয়াজে ঘুরে তাকালেন। অচেনা নম্বর। ‘মনের কোণে একটা সম্ভাবনা এক মুহুর্তের জন্য উঁকি দিয়ে উঠল।
– ‘হ্যালো।’
ওপার থেকে একটা মহিলা কণ্ঠের শান্ত জিজ্ঞাসা, ‘তরুণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারি।’
– ‘বলছি’
– ‘কে বলছি বলতো?’
তরুণবাবু নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বললেন, ‘যদি ভুল না হই, তাহলে মিতা মুখোপাধ্যায়, স্কটিশ কলেজ, ইংলিশ অনার্স।’
– ‘ও খবর তাহলে হয়ে গেছে’।
– ‘তা হয়েছে, অম্লান ফোন করেছিল।’
– ‘হ্যাঁ, ওই তোমার নম্বরটা দিল।’
তরুণবাবু এখন অনেকটা স্বাভাবিক, ‘তোমার তো বিদেশে বিয়ে হয়েছিল, তাই না?’
– ‘ঠিক, তবে বছর তিনেক হল দিল্লিতে থাকি। ওখানেই ফ্ল্যাট নিয়েছি। আমার হাসব্যান্ডের ইচ্ছে ছিল শেষ জীবনটা ভারতেই কাটাবেন। মেয়ে এখন কলকাতায় পোস্টেড। তাই গত বছর থেকে বার কয়েক কলকাতায় এসেছি। ওর ছেলেটা, মানে আমার নাতি, খুব ছোট্ট। ওকে দেখতেই কলকাতায় আসা। আর সেই সুযোগে পৈতৃক সম্পত্তির দেখাশোনাটাও হয়ে যায়। যাক তোমার খবর কী?’
– ‘অ্যাজ ইউজুয়াল, রিটায়ার্ড, ছেলে বিদেশে। বাড়িতে বুড়ো বুড়ি। পুজোয় কী কলকাতায়?’
– ‘একদম, কত্তাও আসছেন। আচ্ছা অম্লানের কাছে শুনলাম তোমরা নাকি কয়েকজন নিজেদের মধ্যে এখনও যোগাযোগ রেখেছ? দারুণ, পুজোর মধ্যে সবাই একসঙ্গে একদিন দেখা করলে হয়না! সেই পুরনো বন্ধুরা!’
তরুণবাবুর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এতো মেঘ না চাইতেই জল। এই কথাটাই বলার জন্য মনটা আকুলি বিকুলি করছিল। কিন্তু কিভাবে বলবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। ‘হ্যাঁ, হতেই পারে। ইন ফ্যাক্ট আমরা প্রতি বছরই পুজোর সময় একদিন একসঙ্গে হই। খাওয়া দাওয়া গল্প, সবই হয়।
– ‘বাহ, তাহলে এবার ভেন্যু আমি ঠিক করছি। অন্য দিনগুলোয় বেশ কিছু ফ্যামিলি কমিটমেন্ট আছে, কিন্তু সপ্তমীর দিন সন্ধেটা ফাঁকা। ওদিন সকলে ম্যাডক্স স্কোয়ারে বিকেল পাঁচটায়। ঠিক আছে? তোমাদের বুড়ো হয়ে কেমন দেখতে হল সেটা একবার দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে!’
কলকাতায় আজকাল চতুর্থী থেকেই ঠাকুর দেখার ভিড় জমে যায়। আগে ছিল হতে গোনা কয়েকটা ঠাকুর, এখন প্রতি বছরই নতুন নতুন সার্বজনীন নাম করছে। এখনতো বেহালা একদিন, দক্ষিণ কলকাতা একদিন, উত্তর একদিন, সল্টলেক একদিন। এভাবেই ঠাকুর দেখার প্ল্যান সাজাচ্ছে সকলে। ভিড় এড়াতে তাই অনেকেই পরিবার নিয়ে চতুর্থী, বা পঞ্চমীর দিন বেরিয়ে পড়েন ঠাকুর দেখতে। অন্যান্য দিন গাড়ি রাখারও জায়গা থাকেনা। যানজটে একটা রাস্তা পের করতে একটা ঘণ্টা লেগে যায়। যেমন রাস্তায় ভিড়, তেমনই খাবার দোকানে। তিল ধারণের জায়গা নেই। খেতে গেলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কখন টেবিল ফাঁকা হবে। তবে হ্যাঁ, কলকাতার পুজোয় কিন্তু আজকাল টাকা উড়ছে। এক একটা পুজোর বাজেট শুনলে চোখ কপালে উঠে যায়। তেমনি সাজাচ্ছেও। এক একটা প্যান্ডেল বা প্রতিমা পুজোর শেষে ভেঙে ফেলা হবে ভাবলেই কেমন খারাপ লাগে। প্রতিটাই সংগ্রহে রাখার মত পিস অফ আর্ট।
ফোনে সকলকে এক জোট করার দায়িত্বটা বেশ আগেভাগেই সেরে ফেললেন তরুণবাবু। অম্লান, অরুনাংশু, অজিত, কালীপদ আর তিনি নিজে। এই পাঁচজনের বেশি ভিড় করার দরকার নেই। মিতার শ্বশুরবাড়ির পাড়া। দেখতে বাজে লাগে। বন্ধুরা সব জানলেও মিতার কলকাতায় আসার খবরটা নিজের স্ত্রীকে, মানে কল্পনাকে বলি বলি করেও বলে উঠতে পারলেন তরুণবাবু। তবে উৎসাহটা নজর এড়াল না। খালি কারণটা যা অন্য ঠাওরালেন কল্পনাদেবী। পুজোর মধ্যে একটা দিন নিজের বাপের বাড়িতে দাদা-বৌদির কাছে ঘুরে আসেন তিনি। এবার সপ্তমীর দুপুরে সেখানেই স্ত্রীকে আগেভাগে ছেড়ে এলেন তরুণবাবু। সুঠাম চেহারা, টকটকে ফর্সা রং। গাড় হলুদ টিশার্ট, আর ডেনিম জিনস। পায়ে কোলাপুরি চটি। এই বয়সেও বেশ লাগছে তরুণবাবুকে। পুরনো বন্ধুরা একসঙ্গে বসলে কল্পনা যান না। পুজোর পর সকলের পরিবার নিয়ে বিজয়া সম্মিলনী যেদিন হয় সেদিন যান। ফলে বের হওয়ার আগে আরও একবার তরুণবাবুর দিকে চেয়ে বেশ কড়া গলায় বলে দিলেন, ‘বেশি ছাইপাঁশ গিলো না। বয়স হয়েছে, সেটা ভুলে যেও না।’ মুচকি হেসে নিজের অল্টোটায় চেপে ড্রাইভার খোকনকে নির্দেশ দিলেন তরুণবাবু। ‘সোজা ম্যাডক্স স্কোয়ার চল’।
সবাই আগেই এসে গিয়েছিল। শেষে এলেন তরুণবাবুই। কিছুটা ইচ্ছে করেই। ম্যাডক্স স্কোয়ারের খালি মাঠটায় এখানে ওখানে বিভিন্ন বয়সের গ্রুপ বসে আড্ডা দিচ্ছে। খাবার স্টল থেকে দেদার খাবার আসছে। এই পুজোয় দুর্গা সাবেকি। বিশাল আকারের। ট্রলির উপর বসানো। প্যান্ডেলে বড় একটা কেরামতি কিছু নেই। তবে এ পুজোর আকর্ষণ এখানকার বিশাল প্রাঙ্গণ, আর আড্ডা। শেষ বিকেলের আলোকে ম্লান করে চারদিক রঙিন আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। গাছের ডালগুলো সবুজ টিউব লাইটের আলোয় বেশ লাগছে। আস্তে আস্তে ঠাকুর দেখার ভিড় বাড়ছে। তরুণবাবু মাঠের দিকে এগোলেন। এমন সময় অম্লানের গলা, ‘এই যে এখানে।’ আওয়াজ লক্ষ্য করে তরুণবাবু ঘুরে তাকালেন। চারজন বয়স্ক মানুষের মাঝে এক মহিলা বসে তাঁর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। চুলে পাক ধরেছে কী? নাহ্, এতটা দুর থেকে বোঝা যাচ্ছে না, মুখাটা বেশ ভারী হয়ে গেছে, সারা শরীরে আভিজাত্যের ছাপ। কিন্তু এখনও ফেটে পড়ছে সেই রূপ। সেই পাগল করা হাসি। তরুণবাবু কিছুক্ষণের জন্য নিজের অজান্তেই একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন মিতার দিকে। ‘কিরে আয়’, তাড়া দিল কেপি মানে কালীপদ। তরুণবাবু এগিয়ে এসে মিতার দিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন, ‘তুমি কিন্তু একই আছো।’ ‘কিন্তু তুমি বদলে গেছো। কলেজ লাইফে এত সুন্দর দেখতে তো ছিলে না। এখনও একটা বিয়ে দেওয়া যায়। প্রেমে পড়ে যাচ্ছি কিন্তু …।’ হাসতে হাসতেই কথাগুলো বলল মিতা। তরুণবাবুও হাসেন। অন্যরা আরও একটু বেশিই জোরে হেসে উঠল।
‘আচ্ছা, তোমরা কিগো, কেউ বউ আনলে না? ফোনে বলিনি বলে কেউ বউ আনবে না!’ বেশ অভিযোগের সুরেই কথাগুলো বলল মিতা। উত্তরটা দিল অম্লান। ‘পুজোর মধ্যে আমরা বসলে একটু পান টান হয়তো, যেটা আজও তোমার এখান থেকে গিয়ে হবে। তাই এদিন আমাদের ব্যাচেলর্স পার্টি। পুজোর পর আমাদেরই কারো বাড়িতে বিজয়া সম্মিলনী, সেখানে সকলে সস্ত্রীক। আর এবার সেখানে তোমাকেও কত্তাকে নিয়ে হাজির হতে হবে।’ মিতা হাসল। ‘তোমার বরের সঙ্গে আমাদের আলাপ নেই। তাঁকে ডাকো।’ বলল অরুনাংশু।
– ‘বর একটু গেছে মেয়ের কাছে, আমিও যেতাম কিন্তু তোমরা আসবে বলে যাইনি। ও জানে তোমরা আসছ। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। তোমাদের বাড়িতেই ডাকতাম। কিন্তু পুজোর দিনে বাড়িতে ভাল লাগে না। তাই না? পুজোর পর কিন্তু সকলকে আমার বাড়ি একবার আসতে হবে।’ সকলেই সম্মতির ঘাড় নাড়ল। ‘আচ্ছা, সেই কলেজে পড়তে পিটিএল স্যার, মানে যাকে আমরা পিছনে পটল স্যার বলতাম। তাঁর কথা মনে আছে তোমাদের। তরুণই ওনার সবচেয়ে বেশি পিছনে লাগত। ওনার মেয়ের সঙ্গে সেদিন আলাপ হল দিল্লিতে।’… সকলে গল্পে মেতে উঠল।
সন্ধে নেমেছে। প্যান্ডেলে বিভিন্ন বয়সের মানুষের ভিড় বাড়ছে। মাইকের শব্দ, মানুষের কোলাহল, সব মিলিয়ে বেশ একটা অন্য পরিবেশ। কোনও একটা টিভি চ্যানেল লাইভ করছে। দুরে ওবি ভ্যানটা দাঁড়িয়ে। জিমি জিবটা একবার ওদের মাথার ওপর দিয়ে ঘুরে গেল। মাঝ মধ্যেই টুকটাক স্ন্যাক্স, কফি আসছে। মিতার সাফ কথা, ‘তোমরা আমার অতিথি। ফলে খাওয়াবো আমিই।’ হঠাৎ মিতার ফোনটা বেজে উঠল। ‘হ্যাঁ, বল, তুমি কোথায়, আমি ফোন করব ভাবছিলাম, ওরা অনেকক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’ ওদিক থেকে কিছু বলছে। মিতা শুনে উত্তর দিল, ‘ঠিক আছে এসো।’ ফোনটা রাখল মিতা। ‘ও জ্যামে আটকে আছে, পুজোর সময় তো, এসে যাবে।’
ইতিমধ্যেই বেশ জমে উঠেছে ম্যাডক্স স্কোয়ার চত্বর। মিতা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। ‘তোমরা সকলে এলে, কিন্তু এখনও তো ঠাকুর দর্শনটাই করনি। আমাদের এখানকার ঠাকুর কিন্তু দেখার মত। চল ঠাকুরটা দেখে আসি, তারমধ্যেই ও এসে পড়বে।’ মিতার কথায় তরুণবাবু ছাড়া সকলেই উঠে দাঁড়াল। ‘তোরা দেখে আয় আমি বসছি’, সহজ গলায় বললেন তরুণবাবু। ‘তুই নাস্তিকই রয়ে গেলি।’ টিপ্পনীটা কাটল অরুনাংশু। মিতা ব্যাপারটা জানতো না। এসব শুনে তরুণবাবুকে উঠে আসার জন্য বারদুয়েক সেও অনুরোধ করল। কিন্তু তরুণবাবু নাছোড়। ওসব ঠাকুর দেখার পাটে তিনি নেই। এবার মিতা এগিয়ে এল তরুণবাবুর দিকে। তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তরুণবাবুর ডান হাতটা খপ করে চেপে ধরল সে। ‘চলো, ওঠো, নাস্তিকদের ঠাকুর দেখতে নেই কে বলল শুনি।’ কথাগুলো বলতে বলতেই মিতা তরুণবাবুকে নিয়ে প্যান্ডেলের দিকে এগোল। তরুণবাবুর হাতটা কিন্তু তখনও মিতার হাতেই বন্দি। কেমন একটা মন্ত্রমুগ্ধের মত মিতার সঙ্গে প্যান্ডেলের দিকে এগোলেন তরুণবাবু। চারপাশের এত কোলাহল কিছুই তাঁর আর কানে ঢুকছে না। শুধু এটুকু ভেবেই শিহরিত হচ্ছিলেন, যে মহিলার হাত সেই কলেজ জীবনে তিন বছরেও ধরে উঠতে পারেননি, জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই ষাটোর্ধ মহিলাই কত সহজে তাঁর হাতটা ধরে আছেন। আর সেই স্পর্শ এখনও তাঁকে শিহরিত করছে। একটা পরম শান্তিতে একাকার করে দিচ্ছে তাঁর সমস্ত শরীর মন।
ঠাকুর দেখা হয়ে গেছে অবেক্ষণ হল। কখন মিতা হাত ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই আবেশ যেন সবার অলক্ষ্যে তরুণবাবুকে এখন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এর মধ্যেই হাজির হলেন মিতার স্বামী রুদ্র ভট্টাচার্য। বেশ কেতাদুরস্ত মানুষ। অনিচ্ছাকৃত দেরির জন্য আগেভাগেই সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। মিতাই সকলের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দিল। ‘পুজোর দিনে এভাবে শুকনো মুখে আলাপ হয়না। কাছের একটি রেস্তোরাঁয় সকলের জন্য টেবিল বুক করা আছে। আপানদের সঙ্গে গাড়ি আছে তো?’ বললেন রুদ্র। সবাই মোট তিনটে গাড়িতে রেস্তোরাঁর দিকে রওনা দিল।
রাস্তায় বেশ ভিড়। সপ্তমীর সন্ধ্যা বলে কথা। গাড়ি প্রায় নড়েই না। রেস্তোরাঁয় পৌঁছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল। রেস্তোরাঁয় মিতার একদিকে তাঁর স্বামী, আর অন্যপাশে তরুণবাবু বসেছেন। সকলে খোশগল্পে মত্ত। সঙ্গে চলছে হুইস্কিতে চুমুক। তরুণবাবু কিন্তু থেকেও নেই। পাশেই বসে আছে মিতা। এটা ভেবেই কেমন বিভোর লাগছে তাঁর। খাওয়া দাওয়া শেষে এবার বিদায়ের পালা। রাত প্রায় সাড়ে নটা। পুজোর দিনের রাত বলে কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। আবার দেখা হবে গোছের সৌজন্য সেরে গাড়িতে উঠলেন তরুণবাবু। স্বামীর সঙ্গে মেয়ের গড়িতে উঠে বসলেন মিতা। টুকটাক কথা হচ্ছে দুজনের মধ্যে। হঠাৎ মিতার মোবাইলে একটা মেসেজ এল। তরুণবাবুর মেসেজ। মেসেজটা খুলল মিতা। লেখা রয়েছে, ‘একটা না ভোলা সন্ধ্যার জন্য ধন্যবাদ, যোগাযোগ রেখো, আমার ভাল লাগবে।’ কথাগুলোর তলায় রয়েছে একটা ই-মেল অ্যাড্রেস ও স্কাইপ অ্যাড্রেস। মিতা ফোনটা বন্ধ করল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইল ভিড়ে ঠাসা আলো ঝলমল রাস্তাটার দিকে। — চিত্রণ – সংযুক্তা