রাত আকাশে রংবাজি
বাজি বানানোর হাতেখড়িটা বাবার কাছেই। বাবার হাত ধরে ক্লাস এইটে পড়তে প্রথম বাজির মশলা কিনে এনেছিল নতুন বাজার থেকে।
ড্রয়ারটা তন্নতন্ন করে খুঁজেও ছোট্ট ডায়েরিটা খুঁজে পেল না রাজীব। ‘এখানেই তো রেখেছিলাম, গেল কোথায়’? নিজের মনেই বিড়বিড় করছে সে। কিন্তু সব হাঁটকেও ডায়েরির হদিস না পেয়ে হঠাৎ ওর মেজাজ চড়ে গেল। ‘বারবার বলেছি, আমার জিনিসে কেউ হাত দিও না, কে বলেছিল আমার ড্রয়ার পরিস্কার করতে’, বাড়ির সকলের উদ্দেশে হুংকার ছাড়িল সে। ‘তোর জিনিসে কেউ হাত দেয়নি, দেখলাম অপরিস্কার হয়ে আছে তাই একটু ঝেড়ে দিয়েছি। কোনও জিনিস এদিকওদিক করি নি। দেখ নিজেই কোথাও গুঁজে রেখেছিস’।
রাজীব সেন। উত্তর কলকাতার ছেলে। এবছর হায়ার সেকেন্ডারি দিয়ে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজে ঢুকেছে। মেধাবী ছাত্র। তবে শুধু পড়াশোনা নিয়ে থাকা ওর ধাতে নেই। পাড়া, ক্লাব, ক্রিকেট, ক্যারাম সব চলে। সবে পুজো শেষ হয়েছে। লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন ক্লাবে বসে সকলে আড্ডা দিচ্ছে। নিমাইদা এসে বলল ‘শোন, এবছরও কালীপুজোয় তুবড়ি আর রংমশালের কম্পিটিশন হবে। যে কেউ অংশ নিতে পারে। তোরা সকলকে জানিয়ে দে। আশপাশের পাড়াগুলেোতেও খবরটা ছড়িয়ে দিস। এন্ট্রি ফি পঞ্চাশ টাকা’।
ওদের পাড়াতেই একটা চিলড্রেন্স পার্ক রয়েছে। ছোট পার্ক। কিন্তু সাজানো। বাচ্চাদের জন্য ঘেরা জায়গায় দোলনা-টোলনা আছে। তার পাশে খোলা সবুজ পার্ক। সেখানে সিমেন্টের সিট করা আছে। পাড়ার অনেকে এখানে বসে সময় কাটায়। এই সবুজ জমিতেই গতবছর তুবড়ি আর রংমশালের কম্পিটিশন হয়েছিল। দুটোতেই থার্ড হয়েছিল রাজীব। এবার ফাস্ট হতেই হবে। তাই সকালেই মশলার ভাগের ডায়েরির খোঁজ পড়েছে। আর সেটা না পেয়েই মেজাজ তিরিক্ষি।
বাজি বানানোর হাতেখড়িটা বাবার কাছেই। বাবার হাত ধরে ক্লাস এইটে পড়তে প্রথম বাজির মশলা কিনে এনেছিল নতুন বাজার থেকে। এক ছটাকি, আধ ছটাকি বিভিন্ন মাপের তুবড়ির খোল কিভাবে দেখে শুনে নিতে হয় তাও বাবার কাছেই শেখা। পরে বাজি বানানো নিয়ে রাজীবের উৎসাহ দেখে বাবাই তার এক অফিসের বন্ধুর সঙ্গে ওকে দেখা করিয়ে দেন। প্রদীপকাকু। প্রদীপকাকু বেশ এক্সপার্ট লোক। বাজি বানানোয় তুখোড়। কম্পিটিশনে লড়তে গেলে বাজি বানানোয় যে যত্ন আর পরিশ্রম লাগে তা প্রদীপকাকুর কাছেই শেখা। সেই প্রদীপকাকুই ওকে বাজির মশলার ভাগ দিয়েছিলেন।
ডায়েরিতে লেখা ভাগ খুঁজে না পেয়ে ঘরটা লণ্ডভণ্ড করে ফেলল রাজীব। আর তাতেই কাজ হল। বইয়ের আলমারির মধ্যে থেকে উদ্ধার হল সেই যখের ধন! রাজীবের মনে পড়ে গেল মাস দুয়েক আগে ড্রয়ার গোছানোর সময় ও নিজেই ওটা সরিয়ে রেখেছিল। ইতিমধ্যেই বাড়ির লোকজনের ওপর যথেষ্ট চোটপাট সেরেছে। তাই নিজের ভুল বেমালুম চেপে গেল ও।
নতুন বাজারের একটা দোকান বাবা চিনিয়ে দিয়েছিল। এখন দোকানদার ভদ্রলোকও ওকে চিনে গেছেন। প্রতি বছর বাজির মশলা এখান থেকেই যায়। বেলার দিক। তাই দোকান বেশ ফাঁকা। জুত করে বসে একে একে ফিরিস্তি দিতে লাগল রাজীব। ব্যারাইটা, সোরা, গন্ধক বা দোকানদারদের কথায় মাটি, অ্যালুমিনিয়াম পাউডার, ম্যাগনেসিয়াম পাউডার, লোহাচুর, অ্যালুমিনিয়াম চুর। সবই নিখুঁত ভাগে ভাগে যাচাই করে কিনে ফেলল রাজীব। সঙ্গে বিভিন্ন মাপের তুবড়ির খোল আর রংমশালের খোল। তারপর টাকা মিটিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরল ও।
বাড়ির চিলে কোঠার ঘর বলতে যা বোঝায় রাজীবদের বাড়িতে সেটাই আছে। বাজি বানানোটা ওখানেই সারে রাজীব। বাড়ির কাছেই পাড়ার কালীপুজোর প্যান্ডেল তৈরি শুরু হয়ে গেছে। ফলে একটু আগেই ট্যাক্সি থামিয়ে মালপত্র নিয়ে কিছুটা হেঁটে আসতে হল রাজীবকে। ‘কিরে মশলা কিনেছিস মনে হচ্ছে’? পাড়ার ভোলাদা আওয়াজ দিল। রাজীব মুচকি হেঁসে সম্মতি জানিয়ে বাড়ার দিকে এগোলো। চিলেকোঠার ঘরে মালপত্র রেখে আলমারি থেকে একে একে দাঁড়িপাল্লা, গুঁড়ো করার হামান-দিস্তা, ছাঁকনি বের করে রাখল সে। তারপর ছুট দিল চান খাওয়া সারতে। আজই বসে যেতে হবে কাজে।
বালি আর মাটি, দুটোই স্যাঁতস্যাঁত করছে। তাই ছাদে ওগুলো শুকোতে দিয়ে কাজে বসল রাজীব। তারপর শুরু হল সোরা মিহি করে বেঁটে ছাঁকনি দিয়ে ছাঁকা। গন্ধক গুঁড়োনো। অ্যালুমিনিয়াম চুর ছাঁকা। ব্যারাইটাটাকে একটু রোদ খাইয়ে মিহি করে গুঁড়িয়ে নিল রাজীব। তারপর শুরু হল মশলা মাখার কাজ। তুবড়িটা আগে বানাবে ও। তাই তুবড়ির মশলার প্রতিটা জিনিস একেবারে দাঁড়িপাল্লায় করে ওজন করে আলাদা করে রাখল। তারপর সব একসঙ্গে মাখতে গিয়েই মনে পড়ল একটা কেলেঙ্কারি করেছে। সব কিনেছে স্পিরিটটা কিনতেই ভুলে গেছে। অগত্যা চিলে কোঠার দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে রাজীব ছুট দিল বরুণদার দোকানে।
এরপর এক সপ্তাহ রাজীবের টিকি মেলা ভার। চান খাওয়ার বাইরে অধিকাংশ সময়টাই ও চিলেকোঠার ঘরে নিজেকে বন্দি করে রাখল। অফিস থেকে ফিরে রাজীবের বাবাও চা খেয়ে চিলে কোঠায় ছেলের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কাটান। উৎসাহ দেন। পরামর্শ দেন। দরকারে ওখানে বসেই প্রদীপকাকুকে ফোন করা চলে। আর খাওয়ার সময় মায়ের কড়া হুকুমে হাতে খাওয়া ছেড়ে চামচে করে ভাত মেখে খাওয়া। বাজি বানানোর সময় সারা গায়ে বাজির মশলা মাখামাখি হয়। নখের কোনায় লেগে থাকে বাজির মশলা। ধুলেও কিছুটা থেকেই যায়। তাই মা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে বাজি হাতে খাওয়া যাবে না। অগত্যা এই কটা দিন চামচ দিয়েই খেতে হবে।
ওদের পাড়ায় কালীপুজোর আগের দিন বাজির কম্পিটিশনের রেওয়াজ। ফলে ওদিন সন্ধে থেকে পার্কের চারপাশে পাড়ার লোকের ঢল নেমেছে। কচিকাঁচার দল তো আছেই। এমনকি বুড়োরা পর্যন্ত চরম উৎসাহে হাজির হন। চোদ্দবাতি দিয়ে বারান্দায় বারান্দায় বাড়ির মহিলারা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে পড়েন অধীর অপেক্ষায়। তারপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। একে একে তুবড়ি, রংমশাল নিয়ে প্রতিযোগীরা মাঠে নামেন। শুরু হয় মাঠ জুড়ে রঙের খেলা। আলোর রোশনাইতে চতুর্দিক আলোর বন্যায় ভেসে যায়। সকলে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকেন আতসবাজির বাহারি রোশনাইয়ের দিকে।
হাতের নখটা কামড়ে প্রায় পুরোটাই খেয়ে ফেলল রাজীব। মুখ জুড়ে টেনশন ফুটে বের হচ্ছে। প্রতিযোগিতা শেষ। এবার পুরস্কার বিতরণ। কে প্রথম হল তা আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানা যাবে। বিচারকরা তাঁদের মতামত জানিয়েই দিয়েছেন। ভোলাদাকে জিজ্ঞেস করলে হয়না? তাহলে ভেতর থেকেই জানা যেত কে প্রথম হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই রাজীবের মনে হল আর তো কয়েক মিনিট। এজন্য আর ভেতর থেকে জেনে কাজ নেই। বিচারকরা মঞ্চে উঠেছেন। সকলেই একদৃষ্টে চেয়ে তাঁদের দিকে। যাঁরা প্রতিযোগী নন তাঁদেরও যেন টেনশন। রাজীবের বুকের মধ্যে হামানদিস্তে পিটছে। তুবড়ি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন এই পাড়ারই রাজীব চন্দ। নামটা ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাততালির রোল উঠল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরা ওকে জড়িয়ে ধরেছে। লাফাচ্ছে। রাজীব বুঝতে পারছে না কি করবে। এখনও যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না ও প্রথম হয়েছে। এমন সময় পাশ থেকে একটা অতি পরিচিত হাত ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বাবাকে জড়িয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলল রাজীব।
সেদিন সব মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হল। পাড়ার পুজো। তাই গভীর রাত পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে প্যান্ডেলেই কাটাল রাজীব। হাত লাগাল বেদী তৈরির কাজে। বেদীতে মাটি লেপতে লেপতে রাজীবের একবার কালী প্রতিমার দিকে চোখ গেল। মনেমনে প্রণাম করল ও। প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবু ওর মন বলছে মা কালী ওকে দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করছেন। মায়ের পায়ের দিকে চেয়ে চোখটা সকলের অলক্ষ্যে একবার বন্ধ হয়ে গেল।
তুবড়িতে প্রথম হলেও রংমশালে সেই তৃতীয় স্থানটাই কপালে জুটেছিল রাজীবের। পরদিন সকালেই নিজের জিতের খবরটা প্রদীপকাকুকে দিয়ে রংমশালের ভাগটা তাঁকে জানাল ও। কেন এবারও তৃতীয় হতে হল? ভুলটা কোথায় হচ্ছে? গতকাল থেকে মনটা খচখচ করছে। ফোনেই চুলচেরা বিশ্লেষণটা সেরে ফেলল দু’জনে। প্রদীপকাকুর বলা কয়েকটা নতুন টিপসও চটপট লিখে নিল ডায়েরিতে। কালীপুজোর সকাল। ফোন রাখতেই বাড়িতে হাজির রিন্টু-মিন্টু। ওর দুই মাসতুতো ভাই। এসেই আবদার। ‘দাদা সামনের বাড়ির তিতুনরা কাল লাল রংমশাল পোড়াচ্ছিল। তুমি আমাদের লাল রংমশাল বানিয়ে দাও।’ রাজীবের মনে পড়ল কিছুটা রংমশালের মশলা থেকে গেছে। ভাইদের আবদারে না করতে পারল না সে। ‘ঠিক আছে আজ বিকেলের মধ্যে তোদের আমি লাল রংমশাল বানিয়ে দেব। প্রমিস।’ তারপর সময় নষ্ট না করে ফের ছুটল নতুন বাজার। দোকানদাররা স্ট্রনসিয়াম নাইট্রেট অল্পই আনে। ফুরিয়ে গেলে লাল রংমশাল বানানো লাটে উঠবে যে! — চিত্রণ – সংযুক্তা