একদিন দল বেঁধে ক’জনে মিলে
চড়ুইভাতি শব্দটার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক আজকের নয়। বংশপরম্পরায় এ শব্দ বাঙালি জীবনকে ক্ষণিকের খোলা হাওয়ায় ভরিয়ে দিয়েছে।
চড়ুইভাতি শব্দটার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক আজকের নয়। বংশপরম্পরায় এ শব্দ বাঙালি জীবনকে ক্ষণিকের খোলা হাওয়ায় ভরিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করেছে। চড়ুইভাতি শব্দটার সঙ্গে আবার শীত ঋতুর সখ্যতা আজীবনের। ভ্যাপসা গরম আর প্যাচপ্যাচে বৃষ্টিতে নাজেহাল এই ক্রান্তীয় শহরের বুকে শীত হল ক্ষণিকের অতিথি। তাই এই স্বল্প সময়ের শীতল অনুভূতিতে বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। স্কুল কলেজে ছুটি। আর অফিসের পাওনা ছুটি বছর শেষে নিয়ে নিলেই হল। তবে যাঁরা সেই সময় বের করতে পারেন না, তাঁরাও একটা দিন বের করে বেরিয়ে পড়েন চড়ুইভাতিতে।
চড়ুইভাতি মানেই আগের রাত থেকে তোড়জোড়। চাল, ডাল, আনাজপাতি সব গুছিয়ে কেনা। সঙ্গে ডিম, কলা, পাউরুটি। ব্যাডমিন্টনের ব়্যাকেট অথবা অনেক সময় ক্রিকেট ব্যাট গুছিয়ে নেওয়া। আর যেটা সেটা হল প্ল্যানিং। নানা মুনির নানা মত বিনিময় করতে করতেই রাত গভীর হয়। ফলে ভোরে ওঠার দোহাই দিয়ে সকলে ঘুমের দেশে। চঞ্চল মনকে শান্ত করে ঘুমের দেশে যেতে না যেতেই কুয়াশা ঘেরা ভোর সচকিতে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। পরদা টানা জানালাটার দিকে চেয়ে ঘুম চোখে বোঝার চেষ্টা করে আর একটু লেপের তলায় গড়িয়ে নেওয়া যায় কী? না:, জোর করেই শরীরটা টেনে তুলে চটপট বাথরুমে। তার মধ্যেই বাজতে শুরু করে মোবাইলের ঘণ্টি। কি রেডি? আর কতক্ষণ? আমরা রেডি। তোমরা? গোছের বেশ কিছু ফোন ধরতে ধরতেই চলে নিজেকে সাজিয়ে তোলা। আজ একদম অন্য সাজ। চিরাচরিত সাজের বাইরে বেশ রঙিন ভাব। আজ পাড়ার পিকনিক।
আগে থেকে ঠিক করা স্পটে বা গলির মোড়ে পৌঁছেই শুরু হয় হল্লা। মাংসের দোকান থেকে নৌকোয় মাংস তুলে রিক্সায় চেপে ছেলেছোকরার দল ততক্ষণে বাসের ধারে হাজির। এটা নেওয়া হয়েছে। ওটা ভুললি না তো। রীতাদি উঠেছে তো? রঞ্জিতদা সলিড মাঞ্জা মেরেছে গুরু! এমন উড়ে আসা নান শব্দ আর হাসিঠাট্টার মধ্যে গাড়ি ছাড়ে। বেজে ওঠে গান। সদ্য কৈশোর পের করা অন্তরার দিকে আড়চোখে চেয়ে নেয় ছেলে ছোকরার দল। আর গাড়ি ছোটে শহরটা পেরিয়ে দূরে কোথাও, অন্য কোনোখানে। সবুজের দেশে।
পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু নদী। নদীর ধার ধরে বিশাল ঘাস জমি। দূরে কিছু কুঁড়ে ঘর। আশপাশটা গাছ দিয়ে ঘেরা। এ জায়গায় বড় একটা কেউ আসে না। গাড়িতে ঘণ্টা তিনেকের জার্নি। কুন্তলকাকুর চেনা জায়গা। এ সময়ে চেনা পরিচিত পিকনিক স্পটগুলোতে ছুটির দিনে গিজগিজ করে ভিড়। পরপর পিকনিক পার্টি পিকনিক করছে। কোনও প্রাইভেসি নেই। যদি পিকনিকই করব তো এখানে কেন? এদের ব্যাডমিন্টনের কক অন্য দলের তাসের আড্ডায় এসে পড়ছে। অন্যের অনা বক্সের তারস্বর মিউজিকে আর এক দলের কান ঝালাপালা। এসব করে কী পিকনিক হয়? তাই কুন্তলকাকু এই জায়গাটা ঠিক করে দিলেন।
মাটির কিছুটা খুঁড়ে সঙ্গে আসা বামুনঠাকুর তার চারপাশ ইট দিয়ে সাজিয়ে ফেললেন। তারপর কাঠকুটো জ্বালিয়ে তৈরি হল উনুন। চড়ল হাঁড়ি। নদীর ধার ধরে বিশাল করে পাতা হল চাদর। তার ওপর মহিলারা বসে পড়লেন গোল করে। আজ তাদের হেঁশেল থেকে ছুটি। পাউরুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে নিমেষে জমে উঠল মহিলা মহল। আর ছেলেরা নিজেদের মধ্যে গ্রুপ গ্রুপ করে কেউ গেল আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে। কেউ গেল দূরের চায়ের দোকানে। একটু বয়স্করা রান্নার তদারকি করতে ব্যস্ত। আর অপেক্ষাকৃত ছোটরা ব্যাডমিন্টন বা ক্রিকেটে মজে গেল। খোলা হাওয়ায় প্রকৃতির বুকে সকলেই আজ উড়ন্ত পাখি। কোনও বাধা নেই। কোনও রুটিন নেই। শুধু প্রাণখোলা আনন্দ।
কিছুক্ষণ পর মহিলা মহল থেকে হাঁক পড়ল। কী হল, সব গেলে কোথায়? ব্রেকফাস্ট রেডি। আওয়াজ পেয়ে একে একে সকলেই হাজির। একটু দেরিতেই এলাম আমরা, পাড়ার ছেলেছোকরার দল। এসে বসতেই একটা চেনা গন্ধ নাকে এলে সকলের। সিগারেটের গন্ধ। সকলের মুখে চিকলেট পোড়া থাকলেও এ গন্ধ চাপা দেওয়ার নয়। তবে আজ পিকনিক। বড়রা বুঝল ঠিকই। কিন্তু কিছু বলল না।
খাওয়ার সঙ্গে সকলে জমিয়ে আড্ডা, হুল্লোড় আর মজা করতে করতে হঠাৎ একজনের খেয়াল হল সময় বলেও একটা জিনিস আছে। সেটা ঘোরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সকাল থাকে না। বেলা হয়। আর এখন সেটাই হয়েছে। ‘কী ঠাকুর রান্না কদুর’? পাড়ার কাকা, জেঠা স্থানীয়রা চললেন রান্নার দিকে। আজ আর মহিলারা রান্নার দিকে ঘেঁষবেন না। ফলে পঞ্চাশ পের করা রীনা কাকীমা আর নতুন বিয়ে হয়ে পাড়ায় আসা পিঙ্কি বৌদি কোমরে আঁচল গুঁজে নেমে পড়লেন ব্যাডমিন্টন খেলতে। আর সাধারণ দিনে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা অন্তরা, রিমঝিমদের নিয়ে নদীর ধারটা দিয়ে পাশের গ্রামটার দিকে এগিয়ে গেল কৌশিক, প্রবালদের মত পাড়ার উঠতি ছেলের দল।
ভাত, ডাল, তরকারি, চাটনিটা আগেই হয়ে গেছিল। মাংসও শেষ। পাকা হাতের মাংস রান্নার গুণে চারধারে তখন গন্ধে ম্ ম্ করছে। পাড়ার মেয়ে বউরাই লম্বা করে চাদর পেতে বসার জায়গা করে দিল। তারপর কলাপাতার থালা, প্লাস্টিকের গ্লাস দিয়ে সাজিয়ে ফেলল ব্যাচ। পাতে পাতে নুন-লেবু দিতে দিতে এবার আমাদের সকলের বড় সিধু জেঠা ভারী গলায় ফতোয়া জারি করলেন। ‘মিতা বৌমা আজ তোমরা আগে বসবে। তারপর ছেলেরা। পাড়ার সব মেয়েরা প্রথম ব্যাচে বসে পড়। ছেলেরা পরিবেশন করবে। তারপর তোমাদের খাওয়া হয়ে গেলে ছেলেরা বসবে। আর খাওয়ার সময় সকলে এখানে থাকবে। এদিক ওদিক ঘুরতে হয়, খাওয়ার পরে ঘুরো।’ সিধু জেঠার কথা ফেলে কার সাধ্যি। গরম তেলে বেগুনি ছাড়তে ছাড়তে ঠাকুর বলল, ‘এবার সকলে বসে পড়েন।’ আর অচিন্ত্যকাকু হাতে ভাতের বালতি নিয়ে নেমে পড়ল পরিবেশনে।
ঘোরাঘুরি অ্যালাও করলেও পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে অন্তরা, রিমঝিমের বসা হল না। কয়েকবার মিনমিন করে একসঙ্গে খাওয়ার কথাটা পেড়েছিল কৌশিক। কিন্তু ধোপে টেকেনি। এক কথায় সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল প্রণবদা। অগত্যা প্রথম ব্যাচেই খাওয়া শেষ করতে হয়েছিল অন্তরাদের। এদিকে মেয়েদের খাওয়া শেষ হওয়ার পর বসল ছেলেরা। প্রথমে বড়রা। তারপর কমবয়সীদের দল। মেয়েরা বা বয়স্করা মেপে খান। ফলে মাংসের হাঁড়িতে তখনও অর্ধেক মাংস পড়ে। ছেলে ছোকরাদের মধ্যে শুরু হল মাংস খাওয়ার কম্পিটিশন। আর সেই কম্পিটিশনকে আরও উস্কে দিলেন আপাত রাশভারী সিধু জেঠা স্বয়ং। রীতিমত সকলের মাঝে বসে ছেলেদের উৎসাহ দিলেন। সিধু জেঠার উস্কানিতে শুরু হল কব্জি ডুবিয়ে মাংস খাওয়ায় প্রতিযোগিতা।
খাওয়া শেষ হতে হতে বিকেল তিনটে। এরমধ্যে পাশের গ্রামের দুটি লোক আমাদের সঙ্গে এসে ভিড়েছিল। ফাইফরমাইস খাটবে। নিজেরাই এসে বলেছিল। তার বদলে দিনের শেষে কিছু টাকা আর একটু খাবার চাই ওদের। গরিব গ্রাম। বাবুদের পিকনিকে একটু পেট ভরে যদি খেতে পায়। সঙ্গে পরিবারের জন্য কিছু রোজগার। সিধুজেঠা না করেননি।
খাওয়া সারার পর এঁটোগুলো ওই গ্রামের দুজনই কোথায় একটা ফেলে এল। যা কিছু খাবার বেঁচেছিল তা সিধুজেঠাই ওদের বাড়ির জন্য দিয়ে দিলেন। বাড়ির জন্য খাবার পেয়ে সেকি আনন্দ লোক দুটোর। একজন সিধুজেঠার কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘বাবু ছেলেটা কতদিন মাংস খায়নি। আজ আপনি দিলেন বলে ওর মুখে একটু ভাল খাবার দিতে পারব।’ কথাগুলো শোনার পর এক মুহুর্তের জন্য মনটা কেমন ভারি হয়ে গেল। কিন্তু তারপরই সকলের হৈচৈয়ে মেতে সে ভার উধাও। বামুন ঠাকুরকে বলতে হয়নি। বিকেল চারটের ঘরে ঘড়ির কাঁটা যেতেই শেষ আঁচে গরম জল করে ফেলেছিল সে। তারপর তাতে চায়ের পাতা ফেলে, গুঁড়ো দুধ দিয়ে জমে গেল চা। যে কটা ছোট এলাচ বেঁচেছিল তাও থেঁতো করে চায়ে ফেলে দেওয়ায় নদীর পাড়ে শেষ বিকেলে ইলাইচি চা টা মনে হল যেন অমৃত।
শীতের বিকেল। ফলে সন্ধেটা ঝুপ করে নামে। পৌনে পাঁচটা বাজতেই সিধু জেঠা বলে দিলেন এবার সকলে গুছিয়ে নাও। বের হতে হবে। সব গোছগাছ করে তোলা হল গাড়িতে। তারপর একে একে সকলে উঠে পড়ল। গাড়ি ছাড়ার আগে সেই দুজন গ্রামের লোকের হাতে কিছু করে টাকা গুঁজে দিল অচিন্ত্যকাকু। তারপর নদীর পাড়কে টাটা করে আমরা রওনা দিলাম ঘরের পানে। পিছনে পড়ে রইল প্রকৃতির বুকে একটা সুন্দর দিন। বেশকিছু মন ভাল করা স্মৃতি। আর একটা মনে রাখার মত চড়ুইভাতি। — চিত্রণ – সংযুক্তা