Festive Mood

হ্যাপি নিউ ইয়ার!

সকালের রোদ পর্দা ভেদ করে ঘরে এসে পড়েছে। চোখে আলো পড়ছে। মুখের ওপর বালিশটা টেনে নিল রাহুল। মাথাটা ভার হয়ে আছে। চোখে ঘুমের রেশ। এমন সময় একটা চেনা গালার ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। স্ত্রী নিবেদিতার গলা। ‘ওঠ, কত ঘুমবে? সাড়ে দশটা বাজে’। সাড়ে দশটা! বলে কী? কিছুটা সচকিত হয়েই উঠে বসল রাহুল। কিন্তু মাথাটা সাথ দিচ্ছে না। ভারি হয়ে আছে। হ্যাংওভার। গতকাল রাতে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফল। তখন কিছু বোঝা যায়নি। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। নিবেদিতার হাতে একটা গরম কফির পেয়ালা। আহা। হ্যাংওভারের মোক্ষম ওষুধ! ঠিক জিনিসটা ঠিক সময়ে এনেছে পলি। পলি নিবেদিতার ডাকনাম। রাহুল ওই নামেই ডাকে। ‘কাল ক’টায় শুয়েছ জানো? রাত তিনটে! তখন তো হুঁশ ছিল না তোমার। ভাগ্যিস পাশের ফ্ল্যাট। তাই আমি আর সুপ্রিয়দা মিলে তোমায় কাঁধে করে নিয়ে নিয়ে এসে শুইয়েছি। কল্পনা বলেছিল ওদের ফ্ল্যাটেই থেকে যেতে। আমি রাজি হইনি। পাশেই নিজের ফ্ল্যাট থাকতে ওদের ফ্ল্যাটে থাকতে যাবো কেন?’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলোর বলে গেল পলি। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কথাগুলো শুনে শুধু একটা হুঁ শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হল না রাহুলের মুখ থেকে।

থারটি ফার্স্ট নাইট। আজকের বাঙালি। বলা ভাল, নব্য প্রজন্মের বাঙালি গ্লোবালাইজেশনের যুগে সারা বিশ্বের সঙ্গে পার্টি হুল্লোড়ে মেতে ওঠাটা বেজায় রপ্ত করেছে। হ্যাপি নিউ ইয়ারের আনন্দে মস্তির ককটেল। কেউ বা অফিস পার্টিতে। কেউ প্রাইভেট পার্টিতে, কেউ বা কোনও ক্লাবে। আবার কেউ বা মাতে দু’তিনজন কাছের বন্ধুকে নিয়ে ঘরোয়া পার্টিতে। রাহুলদের ক্ষেত্রে গতকাল রাতে সেটাই হয়েছিল। পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাটে দুই বন্ধুর বাস। একটায় রাহুল, অন্যটায় সুপ্রিয়। কলেজ লাইফের বন্ধু। ওরা এবার অফিস পার্টি নয়, নিজেদের মধ্যেই হুল্লোড় করবে বলে ঠিক করেছিল। সঙ্গে ছিল ওদের আর এক বন্ধু মৈনাক আর ওর বউ কমলিকা। তিনজনেরই বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েকের মধ্যে। এখনও কারো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। ফলে অনেকটাই ঝাড়া হাতপা। রাতের প্ল্যানটা ডিসেম্বরের শুরুতেই সারা ছিল। ঠিক হয়েছিল সুপ্রিয়র ফ্ল্যাটেই বসা হব। সেইমত কাল ন’টার মধ্যে সকলে হাজির হয়েছিল সুপ্রিয়র তিন কামরার ফ্ল্যাটে। তারপর শুরু থারটি ফার্স্ট নাইট পার্টি। হুইস্কি, ভদকা আর তার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে স্ন্যাকস। ডিনারে নান, মাংসের দুরকম প্রিপারেশন আর ফিস ফ্রাই। আর মহিলামহলের জন্য কোল্ড ড্রিংস। তবে পার্টির আনন্দে রাতে দু‍’এক পেগ মহিলারাও গলায় ঢালতে কসুর করেননি।


ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা। রাহুলদের পার্টি তখন জমে ক্ষীর। আনন্দ মদির রাতে সকলেই গ্লাস হাতে সকলকে হ্যাপি নিউ ইয়ার জানাল। তারপর নাচ। তবে ঘরে কোনও মিউজিক সিস্টেম চলছিল না। সামনের ফ্ল্যাটে একটা পার্টি চলছিল। সেখান থেকেই ভেসে আসছিল উদ্দাম নাচের জন্য বাছা বাছা সিনেমার গান। সঙ্গে পাঞ্জাবী পপ। তার তারস্বর শব্দে রাহুলরাও নিজের নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে একটা নায়কোচিত ভঙ্গিতে নেচে উঠল। নাহ, এমন প্রতিদিন হয়না। সব পার্টিতেও হয়না। কিন্তু এদিন নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সুরা ভেজা মন যেন এটাই চাইছিল। আর তাতে একবারের জন্যও বাধ সাধেনি কেউ। সবাই তখন আনন্দে মশগুল। বেশ কিছুক্ষণ এই যেমন খুশি নাচোর পর একসময় হাঁপিয়ে গিয়ে মেঝেতে পাতা কার্পেটের ওপরই বসে পড়েছিল সকলে।

এরপর যেটা হওয়ার সেটাই হল। রাতে ফেরার কথা থাকলেও এতটা পান করে গাড়ি চালানো প্রায় অসম্ভব। তাই মৈনাকরা সুপ্রিয়দের বাড়িতেই থাকবে ঠিক হল। ফলে রাত বারোটা পর্যন্ত ঠিক করা পার্টি শেষ হল রাত আড়াইটেয়। মহিলামহল কিছু মুখে দিতে পারলেও রাহুল, মৈনাক, সুপ্রিয় ডিনারের কিছুই মুখে তুলল না। পয়লা জানুয়ারি অফিস থাকায় বুঝে শুনেই কিছুটা কম খেয়েছিল সুপ্রিয়। ফলে হুঁশটা ছিল। অন্য দুজনকে তখন বেহুঁশ বলাই ভাল। সুপ্রিয় আর নিবেদিতাই ধরাধরি করে রাহুলকে ওর ঘরে শুইয়ে দিয়ে যায়।


আগে থেকে বলা ছিল, তাই চান সেরে একটু বেলা করেই অফিস বের হল রাহুল। মাথার হ্যাংওভারটা পুরো যায়নি। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আজ আর নিজের গাড়ি নিল না রাহুল। ট্যাক্সি ধরেই চলে যাবে ঠিক করল। যাওয়ার আগে পলি বলল, ‘আজ আর রাত কোর না। পারলে একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফির।’ মুখে কিছু না বললেও রাহুল জানে আজ মন দিয়ে কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে সন্ধের মধ্যেই ও নিজেও বাড়ি ফিরতে চায়।

রাহুল বের হতে সুপ্রিয়দের ঘরে বেল বাজাল নিবেদিতা। সুপ্রিয় অনেকক্ষণ হল অফিস বেরিয়ে গেছে। কাজের লোকটা বছরের প্রথম দিনেই ডুব মেরেছে। কল্পনা মানে সুপ্রিয়র স্ত্রী স্কুলে চাকরি করে। আজ স্কুল বন্ধ। ফলে বাড়িতে। মৈনাকরাও সকালে চা খেয়ে বাড়ি। ‘ফোন করেছিলাম ভোলার মাকে। বলল আজ আসতে পারবে না। ছেলেকে নিয়ে চিড়িয়াখানা যাচ্ছে। ওদের সব আছে বুঝলি। পুজো, পার্বণ। আমাদেরই কিছু নেই।’ বেশ রাগত স্বরেই বলল কল্পনা। নিবেদিতা দেখল, রাতের সব চিহ্নই ছড়িয়ে রয়েছে ঘরের কোনায় কোনায়। কার্পেটের ওপর ছড়িয়ে আছে পটেটো চিপস, চানাচুর, চিজ বল, কাবাবের টুকরো। দুটো গ্লাস কার্পেটের ওপর গড়াগড়ি দিচ্ছে। কার্পেটের একটা অংশ ভিজে। দুটো মদের বোতল দেওয়ালের ধারে হেলান দিয়ে রাখা। ভাগ্যিস তিন পুরুষের কেউ খাবার খায়নি। তাহলে কি যে হত কেউ জানেনা! ‘ছাড় ভোলার মার কথা, চল তুই আমি মিলেই সব পরিস্কার করে ফেলি। পার্টি তো হয়নি। তাণ্ডব হয়েছে। কাল রাতে অতটা বুঝতে পারিনি বল’, হাসতে হাসতেই কল্পনাকে বলল নিবেদিতা। দেরি না করে দু‍’জনেই ঘর পরিস্কারে হাত লাগাল।

বাঙালির নিউ ইয়ারের চিরাচরিত পার্ক স্ট্রিট আজও রঙিন আলোয় সেজে ওঠে। সরগরম হয় পার্ক স্ট্রিটের তথাকথিত সাহেবি রেস্তোরাঁগুলো। মদের ফোয়ারায় চান করেন সুরামোদী মানুষজন। রাত ১২টা বাজার কয়েক সেকেন্ড আগে কাউন্টডাউন শুরু হয়। তারপর সেকেন্ডের কাঁটা ১২’র ঘর ছুঁতেই উল্লাসে মেতে ওঠেন সকলে। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’, চলে অভিবাদন জানানোর পালা। আজকাল মোবাইলের জামানা, ফলে দূরের মানুষের সঙ্গেও চলে শুভেচ্ছা বিনিময়। সব মিলিয়ে থারটি ফার্স্টের অছিলায় একটা মনে রাখা রাত জীবনকে নতুন উদ্দীপনায় ভরিয়ে তোলে। প্রাণরসে ভরপুর হয়ে ওঠে দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবন‌যুদ্ধে রণক্লান্ত মন। এমন রাত বছরে একবারই আসে। তাই এই আনন্দ থাকুক। এই হুল্লোড় থাকুক। বেঁচে থাকুক মানুষের এই কিছুটা সময়কে রঙিন করে তোলার ভরপুর ইচ্ছাশক্তি। তারপরই তো পুরনো বছরের সব গ্লানি মুছে পূব আকাশে উঁকি দেবে এক নতুন সূর্য। নতুন বছরের সূর্য কিরণ সকলকে বলবে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’, সব দুঃখ মুছে নতুন বছর সকলের জীবনে আনুক খুশি। আনন্দে থাকুক বিশ্ববাসী।

(চিত্রণ – সংযুক্তা)

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button