কামাখ্যায় অপরূপ সুন্দরী উপদেবী মধুমতীর সিদ্ধি দেখালেন তন্ত্রসিদ্ধ সাধুবাবা
একনজরে দেখলাম অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে। এমন রূপ কোনও মানুষের হয় বলে মনে হয় না। আমি অন্তত দেখিনি। তাঁরই সারাদেহ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো।
হাতে ঘড়ি নেই। বুঝতে পারছি না রাত কত হল। বেশ খিদেও পেয়েছে। সাধুবাবা যে রান্না করে খান এমন লক্ষণ কিছু দেখতে পেলাম না আশপাশে। পেটের চিন্তা মাথায় আসতেই বললেন,
– খিদে পেয়েছে? ভাবিস না। সময় মতো খাবার এসে যাবে। আমার সাধনের সিদ্ধি দেখানোর জন্যই তো তোকে নিয়ে এলাম এখানে।
এই কথাটুকুতে বুঝলাম আজ একটা কিছু ঘটবে। ভিতরে একটু ভয়ভয় ভাব এল। কিছু বললাম না। সাধুবাবা বললেন,
– ভয় কিরে বেটা, কিছু ভয় নেই। আর কি জানতে চাস, বল?
একটু অভয় পেয়ে বললাম,
– বাবা, আপনার ফেলে আসা জীবনের কথা জানতে ইচ্ছে করছে। কেমন করে, কেন এলেন এপথে?
এ কথায় মুখখানা মলিন হয়ে গেল সাধুবাবার। চুপ করে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। মনে হল, ভেবে নিলেন আমাকে তার অতীত জীবনকথা বলা ঠিক হবে কিনা। কাটল আরও কিছুটা সময়। পরে বললেন,
– ভগবানকে লাভ করব এমন কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি এপথে। ঘর ছেড়েছি বড় দুঃখে। মা বাবা ভাই বোন এই দুনিয়াতে কেউই নেই আমার। আমি যখন মায়ের পেটে তখন বাবা মারা যায় সাপের কামড়ে। বাপের অবর্তমানে এলাম পৃথিবীতে। জন্মের পর তিনমাস যেতে না যেতেই মা-ও গেলেন কলেরায়। একেবারে বাপ-মা খেগো ব্যাটা আমি। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে।
লম্ফর আলোতে লক্ষ্য করলাম সাধুবাবার সজল চোখ দুটো। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
– পৃথিবীতে এসে বাবাকে তো দেখলামই না। চিনতে পারলাম না মাকেও। গ্রামের এক দুঃস্থ পরিবারে বেড়ে উঠলাম কোনও রকমে। ইস্কুলের মুখ দেখিনি আমি। লোকের লাথিঝাঁটা খেয়ে বেওয়ারিশ জীবনের বারোটা বছর আমার কেটে গেল। বাপমায়ের মৃত্যুর কথাটা শুনেছি জ্ঞান হলে যাদের বাড়িতে বড় হয়েছি অতিকষ্টে, তাদেরই কাছ থেকে।
সাধুজীবন অথচ দুচোখ থেকে টপটপ করে নেমে এল কয়েক ফোঁটা জল। তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে, আমিও। বললেন,
– তখন আমি তো একেবারেই বাচ্চা। কাজ করব কি? কিছু করতাম না বলে মারত। একদিন বেদম মার মারল আমাকে যাদের কাছে থাকতাম তারা। মার খেয়ে ভাবলাম ‘দূর শালা, সংসারে যখন আমার কেউ নেই, কিছু নেই তখন এখানে পড়ে শুধু শুধু মার খাই কেন? বেরিয়ে পড়লাম একদিন। আর ফিরে গেলাম না গ্রামে। কার কাছেই বা ফিরব, কে ছিল আমার?
এতক্ষণ স্থির হয়ে বসেছিলেন সাধুবাবা। এবার হাতদুটো চোখের পাতা স্পর্শ করে নেমে এল হাঁটুতে। এই অবস্থায় নিজেরই কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। তবুও জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাড়ি ছিল কোথায়, এখন বয়েস কত হল আপনার?
মিনিট কয়েক পর উত্তর দিলেন,
– তিরুচিরাপল্লী। ঘর ছেড়েছি পঞ্চান্ন বছর আগে, তখন বয়েস আমার বারো।
উদ্বেগহীন মনে বললাম,
– বাবা, আপনি তো তাহলে দক্ষিণ ভারতের মানুষ। এত সুন্দর হিন্দি শিখলেন কি করে? আপনার কথা শুনে ভেবেছিলাম বোধ হয় বিহার ইউপির হবে।
এই কথাটুকুতে মলিন মুখে সামান্য হাসি ফুটে উঠল সাধুবাবার। মুহুর্তে তা মিলিয়েও গেল। বললেন,
– বেটা, মাতৃভাষাটা ভুলে গেছি আমি। গ্রাম ছাড়ার পর এখানে ওখানে ভিক্ষে করেই খেতাম। কুবুদ্ধি আর পথ, এদুটোর কোনও অন্ত নেই। পথই ধরলাম পথে নেমে। তাছাড়া আর উপায় কি? পালে হাল আর মাঝিহীন তরীতে একা বসে ধাক্কা খেতে খেতে একদিন এসে গেলাম গয়ায়। যোগাযোগ হল এক সাধুবাবার সঙ্গে আকাশগঙ্গা পাহাড়ে। রয়ে গেলাম তার কাছে। তিনি ভিক্ষে করতেন, সঙ্গে থাকতাম আমি। থাকা খাওয়ার চিন্তাটা গেল। সেই সাধুবাবার কাছেই দীক্ষা হয়েছে।
গুরুজির বাড়ি ছিল উত্তরপ্রদেশে। গুরুজি আমার ভিখারির মতোই থাকতেন কিন্তু এতবড় মহাত্মা ছিলেন যে, দেখলে কারও বোঝার উপায় ছিল না। তেরোবছর বয়স থেকে কথা বলে আসছি হিন্দিতে। সেই জন্যে তো বুঝতে পারিসনি।
সাধুবাবার গৃহত্যাগের ঘটনা শুনলাম। বলে গেলেন নির্বিকারভাবে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– আপনি তো এখানে আছেন বছরখানেক হল। এর আগে ছিলেন কোথায়?
এখন মুখের মলিন ভাবটা একেবারেই কেটে গেছে। বললেন,
– স্থায়ীভাবে কোথাও বাস করি না, থাকিও না। যখন যেখানে যে তীর্থে মন চায়, সেখানে চলে যাই। ডেরা কোথাও করিনি, মনও চায় না।
প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,
– সমস্ত তীর্থ ভ্রমণ করেছেন নিশ্চয়ই?
খুশির ভাব নিয়ে বললেন,
– হ্যাঁ বেটা, ভারতের প্রায় সমস্ত তীর্থই ঘুরেছি আমি। তবে মানস সরোবর কৈলাসে যাইনি এখনও।
– এসব তীর্থ কি পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন, না ট্রেনে বাসে?
একটু অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– যেখানে ট্রেন বা বাসের দরকার সেখানে তাতেই চড়েছি। যেখানে হাঁটাপথ সেখানে গেছি পায়ে হেঁটে।
কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– ট্রেনভ্রমণে টিকিট কাটেন কখনও?
এ কথায় হেসে ফেললেন সাধুবাবা। বললেন,
– না, টিকিট কাটি না, কাটিনিও কোনওদিন। কোথাও যাওয়ার দরকার হলে ট্রেনে উঠে বসে থাকি। অনেক ‘টিকিটবাবু’ ট্রেনে উঠলে টিকিট চায় না। সাধু বলে ফিরেও তাকায় না। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে কতদূর যাব? বলি, কিছু বলে না। চলে যায়। আবার কিছু কিছু ‘টিকিটবাবু’ আছে যারা নামিয়ে দেয় ট্রেন থেকে। নেমে পড়ি, কিছু বলি না। বসে থাকি স্টেশনে। পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করি। এইভাবে পৌঁছে যাই এক তীর্থ থেকে আর এক তীর্থে।
একটু থেমে খুব হাসতে লাগলেন। হাসির কারণ জানতে চাইলে বললেন,
– বেটা, একটা মজার কথা শোন। একবার দ্বারকা থেকে আসছি বৃন্দাবনে। আমেদাবাদ থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে আগ্রা হয়ে যাব বৃন্দাবনে। ট্রেনে তো বসে গেছি বেশ ‘আরামসে’। আগ্রা স্টেশনে শুরু হল ‘মেজিস্টর চেকিং’। টিকিট নেই। ধরে নিয়ে গেল আমাকে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন ভাড়া আর জরিমানা দিতে পারব কিনা?
বললাম, আমার কাছে একটা পয়সাও নেই। তিনি আমায় সাতদিনের জেল দিলেন। কি আর করব। চলে গেলাম জেলে। ওখানে আমাকে দেখে তো সবাই অবাক। কারণ জানতে চাইল, জেলখানায় সাধুবাবা কেন, বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়েছি, সত্যি কথাই বললাম।
পুলিশ আর কয়েদিরা খুব শ্রদ্ধাভক্তি করত। কেউ কোনও কাজ করতে দেয়নি আমাকে। দেখতে দেখতে কেটে গেল সাতটা দিন। যেদিন ছাড়া পেলাম সেদিন জেলারসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন জেল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাব? বৃন্দাবনের কথাই বললাম। আমাকে একটা ‘পরচা’ দিয়ে তিনি বললেন, ট্রেনে যদি কোনও চেকার ধরে তাহলে এটা দেখালেই ছেড়ে দেবে। আমার ঝুলিটা জমা দেয়া ছিল। সেটা ফিরিয়ে দিলেন। যখন চলে আসছি তখন জেলারসাহেব আর কয়েকজন পুলিশ এসে প্রণাম করল। অবাক হয়ে গেলাম। তারপর জোর করেই কিছু টাকা হাতে দিয়ে বললেন, ‘যাও সাধুবাবা এটা তুমি পথে খরচা করো’। বেটা, আশীর্বাদ করার ক্ষমতা আমার নেই। ভগবানের কাছে শুধু প্রার্থনা করে বললাম, সুখে রেখো, আনন্দে রেখো ওদের।
প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়া মানে সরকারকে ফাঁকি দেয়া। আইনের চোখে এটা অপরাধ। সারাজীবনই তো বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়ে সরকারকে ফাঁকি দিয়েছেন। এতে কি আপনার পাপ হয়নি?
হাসিমুখে বললেন,
– বেটা, সবক্ষেত্রে আমি মনে করি, যার অনেক আছে তার দেয়া উচিত। যার কিছু আছে তার কিছু দেয়া উচিত। থাকা সত্ত্বেও না দেয়াটা অপরাধ, পাপ। আমার তো দেবার মতো কিছুই নেই। আমি তো চলি মানুষের দয়ার উপরে। তাঁরা দিলে খাই, না দিলে খাই না। বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়লে আমার আর পাপ পুণ্যের কি আছে?
এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, এ তো গেল ট্রেনের কথা। বাসে কোথাও যাওয়ার দরকার হলে তখন কি করেন?
এবারও সেই গালভরা হাসি। বললেন,
– পয়সা না থাকলে ড্রাইভার বা কন্ডাকটারকে বলি। নিয়ে যেতে রাজি থাকলে উঠে পড়ি নইলে আরেকটা বাসে। কেউ না কেউ নিয়ে যায়। অনেক সময় কিছু না বলেই উঠে পড়ি। কন্ডাকটার ভাড়া চায় না, কিছু বলেও না। জায়গা মতো নেমে পড়ি। ওঠার পর কেউ কোনও আপত্তি করলে নেমে যাই, তবে সে রকম কেউ করে না।
কথা শুনে বুঝি সাধুবাবার কথায় কপটতা নেই। জানতে চাইলাম,
– এটা তো আপনার কাছাকাছি কোথাও যাওয়ার কথা বললেন। ভাড়া কম, তাই কিছু বলে না। বাসযাত্রা যদি দূরপাল্লার আর ভাড়া যদি অত্যন্ত বেশি হয় তখন তো কন্ডাকটার মেনে নেয় না। সেক্ষেত্রে কি করেন?
একটু মুচকি হাসি হেসে বললেন,
– প্রথমে কন্ডাকটারকে কাছাকাছি একটা জায়গার নাম বলি। রাজি হয়, উঠে পড়ি। ঠিক সেই জায়গা এলে নেমে পড়ি। আবার ওই একই কায়দায় পরের বাসে উঠি। এইভাবে কয়েকবার বাস পাল্টে পাল্টে গন্তব্যে পৌঁছে যাই। দূরপাল্লায় তো ভাড়া বেশি, তাই একটা বাসে টানা যাওয়া যায় না। নিয়েও যায় না। নিজেরও বলতে লজ্জা করে। তাতে অনেকসময় গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হয়। একদিনের জায়গায় দু-তিন দিন লেগে যায়, তবে না করে না কেউ। শরীর ঠিক থাকলে অনেক সময় পায়ে হেঁটে চলে যাই।
এই পর্যন্ত বলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে,
– বেটা, অনেক রাত হল। কথাও হল অনেক। এখন কিছু খাওয়া দরকার, কি বলিস?
খিদে তো পেয়ে বসে আছে। সামান্য ঘুমঘুম ভাবও আসছে। তাই সম্মতি জানালাম ঘাড় নেড়ে। কিন্তু অনেক আগেই লক্ষ্য করেছি গুহায় খান কয়েক মড়ার খুলি ছাড়া খাবারের কোনও বালাই নেই। অন্তত আশপাশে তেমন কিছু দেখছি না। সাধুবাবা বললেন,
– কি খেতে চাস বল? খাওয়ার কোনও চিন্তা নেই। এখানে যা খেতে চাইবি, তাই-ই পেয়ে যাবি।
একটু অবাক হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। বলে কি সাধুবাবা। এখন গভীর রাত। নির্জনে বসে আছি পাহাড়ের গুহায়। এখানে যা খেতে চাইব তাই-ই পাব। ভাবলাম অসম্ভব, আবার ভাবছি হতেও পারে। তুকতাক করে কিছু আনলেও আনতে পারে। তবে অবিশ্বাসের ভাবটাই এল বেশি করে। মনের কথাটা যেন টের পেলেন। বেশ জোর দিয়েই বললেন,
– হাঁ বেটা, যো কুছ তু মাঙেগা ওহি অভি মিল যায়গা। বোল বেটা কৌনখানা তু খানে মাঙতা, বোল।
হতবাক হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। কথা সরছে না মুখ থেকে। মিনিটখানেক কেটে গেল এইভাবে। একটু ভেবে নিয়ে বললাম,
– কিছু মিষ্টি আর তালশাঁস খাওয়াতে পারেন?
তালশাঁস বললাম এই কারণে এটা মার্চমাস। ওটার এখন অফসিজিন। তাছাড়া গাছ থেকে তাল পেড়ে কেটে তবে তার শাঁস আনতে হবে, যা এইমুহুর্তে একেবারে অসম্ভব। জাগতিক কোনও শক্তিতেই সম্ভব নয়। খাবারের ফরমাস শুনে হাসতে হাসতে বাবা বললেন,
– কোই বাত নেহি বেটা, অভি জরুর মিল যায়েগা, এক মিনট্।
বলে চোখ বুঝলেন। বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়তে লাগলেন বুঝলাম না। চোখ খুললেন মিনিটদুয়েক পর। পাশ থেকে তুলে নিলেন একটা মড়ার খুলি। তার পাশে ছিল কমণ্ডলু। একটু জল ঢাললেন তাতে। এবার খুলির জলটা ঢাললেন ধুনীতে। অদ্ভুত ব্যাপার, জল দিলেন অথচ ধপ্ করে আগুন জ্বলে উঠে নিভে গেল। নিভিয়ে দিলেন লম্ফটা। কয়েকমুহুর্তের মধ্যে দেখলাম গুহার অন্ধকার ধীরে ধীরে কেটে গেল। ভরে উঠল আলোয়। তীব্র নয় অথচ অসম্ভব কমনীয় উজ্জ্বল আলো। চমকে উঠলাম। ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সারা গায়ে। সমস্ত সত্ত্বা যেন লোপ পেয়ে গেল। অথচ ভিতরে জ্ঞান আছে। আলো কোথা থেকে এল বুঝলাম না। মনে হল পিছন থেকে। ফিরে তাকালাম মুহুর্তমাত্র। এবার সাধুবাবার দিকে। প্রসন্ন হাসিতে ভরা মুখখানা।
একনজরে দেখলাম অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে। এমন রূপ কোনও মানুষের হয় বলে মনে হয় না। আমি অন্তত দেখিনি। তাঁরই সারাদেহ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো। বয়েস আঠারো কুড়ি বাইশের মতো হবে। এটা আমার ওই একনজরের আন্দাজ। তীব্র উজ্জ্বল ফরসা। রক্তমাংসের দেহ বলেই তো মনে হল। করুণায় ভরা চোখ দুটো ফালাফালা। কাজল পরা মনে হল। চোখদুটো থেকে দয়া যেন উপচে পড়ছে। টিকালো নাক। সর্বাঙ্গ গোলাপি শাড়িতে ঢাকা। একনজরে পা পর্যন্ত দেখতে পাইনি, কোমরের একটু নিচ পর্যন্তই। দেহে এতটুকুও উগ্রতা নেই। নিটোল স্নিগ্ধ দেহ। রূপের আলোয় গুহা যেন ভেসে যাচ্ছে। প্রকৃত রূপের যে কি আলো হয় তা এঁকে দেখেই আমার প্রথম ধারণা হল। দেখলাম দুহাতে দুটো থালা। মুহুর্তের দেখায় এইটুকুই, তাকাতে পারিনি ভয়ে। ইশারায় রাখতে বললেন। পিছনে থালা রাখার শব্দটা পেলাম। তারপর ধীরে ধীরে আলোটা মিলিয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল গুহা। আবার লম্ফ ধরালেন। ভাবতে লাগলাম কে এই মেয়েটি, কোথায় থাকে, কি সম্পর্ক এই সাধুবাবার সঙ্গে? কোথা থেকে এল মুহুর্তের মধ্যে, পলকে গেল কোথায়? অসংখ্য প্রশ্ন আসছে মাথার মধ্যে। বাহ্যজ্ঞান লোপ পেতে বসেছে। আমি নির্বাক। সাধুবাবা ইশারাতে বললেন থালাটা সামনে নিতে। পিছন ফিরে দেখলাম কেউ নেই। বসা অবস্থায় থালাদুটো এনে দিলাম। একটা নিজের সামনে রাখলেন। একটা দিলেন আমাকে।
থালার একপাশে মিষ্টি সাজানো। আর একপাশে একেবারে কচি ছাড়ানো তালশাঁস ছ’খানা। অপূর্ব গন্ধ বেরোচ্ছে। একেই বোধহয় দিব্যগন্ধ বলে। খাব কি। ভুলেই গেলাম খাওয়ার কথা। দেখছি আর ভাবছি, অন্তহীন ভাবনা। ভাবছি মেয়েটির রূপের কথাও। বাপরে এত রূপ। মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সাধুবাবার কথায় হোঁচট খেল চিন্তাগুলো। হাসতে হাসতে বললেন,
– খেয়ে নে। তোর তালশাঁসটা আছে তো? শোন বেটা, ওর নাম মধুমতী। ওই আমার জীবনের সব প্রয়োজন মেটায়। সব কাজই ও করে দেয়।
একটা কথাও সরল না মুখ থেকে। বিস্ময়ে অভিভূতই হয়ে আছি। তিনি বললেন,
– অনেক সাধনার কথা আছে তন্ত্রে। তার মধ্যে আছে মধুমতী সাধনা। মধুমতী হলেন উপদেবী। সাধক যে ভাব-এ উপাসনা করেন দেবী সেই ভাব-এ সাধকের মনোবাসনা পূর্ণ করে দান করেন বাঞ্ছিত ভোগৈশ্বর্য। এ সাধনায় আমি সিদ্ধিলাভ করেছি। তোকে দেখানোর জন্যেই তো এখানে এনেছি। নে বেটা, খেয়ে নে। যা দেখলি এসব কথা কাউকে বলিস না যেন। কেউ বিশ্বাস করবে না। বলবে গাঁজাখুরি গল্প। মাঝখান থেকে তুই উপহাসের পাত্র হবি। কথাটা মনে রাখিস।
ভাবনার শেষ নেই আমার। ভাবতে ভাবতেই শুরু করলাম খাওয়া। অসংখ্য প্রশ্ন এল মনে। কোন কথাটা যে আগে জিজ্ঞাসা করব তা বুঝে উঠতে পারলাম না। ফস করে বলে ফেললাম,
– মধুমতী থাকেন কোথায়?
এবার খাওয়া শুরু করলেন সাধুবাবা। অপূর্ব স্বাদ আর গন্ধ। এমন স্বাদের মিষ্টি জীবনে কখনও খাইনি। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে এক অদ্ভুত আনন্দের সঞ্চার হল। সাধুবাবা বললেন,
– আমি যখন যেখানে থাকি তখন সেখানেই থাকেন মধুমতী। আমি যে ওঁকে লাভ করেছি সাধনায়।
কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম,
– মধুমতীর যে দেহটা দেখলাম তা কি সত্যিই রক্তমাংসের? দেখে তো তাই-ই মনে হল আমার।
পরিতৃপ্তির হাসিতে ভরা মুখখানা। বললেন,
– তুই যে দেহটা দেখেছিস তা রক্তমাংসেরই। আবার ও দেহ দিব্যদেহও করে দেখাতে পারে।
একের পর এক অসংখ্য প্রশ্ন কিলবিল করছে মাথার মধ্যে। ঠিক মতো করে উঠতে পারছি না। বললাম,
– বাবা মধুমতী সাধনায় সিদ্ধিলাভের ব্যাপারটা আমার জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি কি দয়া করে বলবেন?
একথা শুনে কেমন যেন মিইয়ে গেলেন সাধুবাবা। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে বললেন,
– তুই সংসারে আছিস। বয়সও অনেক কম। তাই এ ব্যাপারে তোকে কিছু বলব না। তবে মধুমতী সাধনা গুরুজি আমাকে শেখায়নি। বছরখানেকের উপর হল, অত দিন তারিখ মনে নেই। এসেছিলাম কামাখ্যামায়ের দর্শন আর একটা বিশেষ সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য। প্রতিদিন ব্রহ্মপুত্রে স্নান করে এসে মায়ের পুজো দিতাম। একদিন স্নান সেরে উঠছি এমন সময় ডাকলেন এক সাধুবাবা। তিনি ঘাটেই বসেছিলেন। স্নানে নামবার সময় অত খেয়াল করিনি। ডাকতেই চোখ পড়ল। বৃদ্ধ, অতি বৃদ্ধ, অশীতিপর বৃদ্ধ সেই সাধুবাবা কাছে ডেকে বললেন,
– বেটা একটা সিদ্ধি নিয়ে আছি বহুকাল। আজ এই ব্রহ্মপুত্রেই ‘দেহ ছাড়ব আমি’।
বলে মধুমতী সাধনায় সিদ্ধিলাভের মন্ত্র ও কৌশলটা শিখিয়ে দিলেন আমাকে। একরকম জোর করেই শিখিয়ে দিলেন। ওসবে আমার কোনও ইচ্ছে ছিল না। তারপর আর কি? সাধন যখন নিলাম তখন লেগে গেলাম সাধনে। এসব সাধনে সিদ্ধি আসতে বেশি দেরি হয় না।
এই পর্যন্ত বললেন তবে একনাগাড়ে নয়। একটু থেমে একটু খেয়ে এইভাবে। শেষ হল খাওয়া। থালাটা রেখে বললেন,
– মধুমতী সাধনার প্রক্রিয়াটা শিখিয়ে দিয়ে সাধুবাবা নেমে গেলেন জলে। ঘাটে বসেই লক্ষ্য করছি। ডুব দিলেন। এক মিনিট দু মিনিট করে কেটে গেল ঘণ্টাখানেক। তিনি আর উঠলেন না জল থেকে। এমন ঘটনায় বিস্মিত হয়ে গেলাম। আগাগোড়া ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল ভাববার কোনও অবকাশই পেলাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফিরে এলাম মন্দিরে। ওনার কথা মতো সাধন করে সিদ্ধি পেলাম। রোজ ভুবনেশ্বরী মন্দিরের ওখানে বসে থাকি। লোক আসে অনেক, কিন্তু কাউকে পছন্দ হয় না। আজ তোকে বেশ ভালো লাগল তাই নিয়ে এলাম।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা আমি আপনার কাছে গেলাম। আপনি তাকানোর সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত ইচ্ছাশক্তি লোপ পেল আমার। কেমন যেন বিবশভাবে চলে এলাম আপনার সঙ্গে। আপনি কি তখন বশীকরণ করেছিলেন আমাকে?
কথাটা শুনে খুব হাসলেন। বললেন,
– না না বেটা, ওসব কিছু জানি না আমি। সাধনভজনে থাকলে, তপস্যা করলে দৃষ্টি ও মনের শক্তি অনেক বেড়ে যায়। নিয়মিত সাধনভজন ও তপস্যায় আছেন যাঁরা তাঁদেরই এটা হবে, হবে আপনা থেকেই। তোর থেকে অনেক বেশি আমার দৃষ্টি ও মনের শক্তি। ফলে তোর দিকে তাকানো মাত্রই আমার ইচ্ছাশক্তি তোর ওপর প্রভাব সৃষ্টি করল। তোর শক্তি পেরে উঠল না। তাই বিবশভাবে সুড়সুড় করে চলে এলি আমার সঙ্গে।
এখন যে প্রশ্নটা করলাম তা নিজেও ভাবিনি। হঠাৎই করে ফেললাম।
– আচ্ছা বাবা, মধুমতী কি আপনাকে ক্যাশ টাকা দিতে বা ছাপতে পারে? তা যদি পারে তাহলে আনে সে কোথা থেকে? যদি না পারে তাহলে কেন সে পারে না? মধুমতী তো অনেক ক্ষমতারই অধিকারিণী? টাকার প্রয়োজন হলে সে কেমন করে টাকা দেয় আপনাকে?
প্রশ্নটা শুনে হালকা একটা হাসির ঢেউ খেলে গেল মুখখানায়। একের পর এক এত প্রশ্ন করছি অথচ কোনও বিরক্তি নেই সাধুবাবার। প্রশান্ত মনেই উত্তর দিচ্ছেন সমানে। বললেন,
– না বেটা, মধুমতী টাকা ছাপতে পারে না। টাকার প্রয়োজন হলে লোকালয়ে বা কোনও মন্দির চত্বরে বসে থাকি। তার আগে মধুমতীকে জানিয়ে রাখি আমার প্রয়োজনের কথা। এবার আমার প্রয়োজন মতো যার টাকা আছে এমন ব্যক্তিকে মধুমতী তার প্রভাবে প্রভাবিত করে নিয়ে আসে আমার কাছে। তারপর সে আপনা থেকে বিবশভাবে প্রয়োজনের অর্থ দিয়ে যায়। এটা সকলের অলক্ষ্যেই করিয়ে দেয় মধুমতী। এইভাবে আমি অর্থ পেয়ে থাকি। যেসব জিনিস মানুষের সৃষ্টি, সেসব মধুমতী দেয় মানুষের মাধ্যমে তার শক্তির প্রভাবে। আর যা কিছু প্রকৃতির সৃষ্টি তা অতি সহজেই দিতে পারে নিজে।
আরও নানান প্রসঙ্গে অনেক কথাই হল। কেটে গেল অনেকক্ষণ। শেষে বললেন,
– বেটা, ভোর হতে আর অল্প কিছু সময় বাকি আছে। মনে যদি কোনও জিজ্ঞাসা থাকে, বলতে পারিস। আর কি জানতে চাস বল?
কোনও রকম দ্বিধা না করে বললাম,
– মধুমতী সাধনায় সিদ্ধির ব্যাপারটা তো বাবা দেখতে পেলাম হাতেনাতে। এটা তো হল বছরখানেক। তার আগে ছোটবেলা থেকে এতগুলো বছর তো কেটে গেল সাধনভজনে। ঈশ্বরপ্রাপ্তির সাধনায় কি সিদ্ধিলাভ হয়েছে?
এ প্রশ্নে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না সাধুবাবা। একটু অস্বস্তিও বোধ করলেন না। উত্তর দিলেন স্বাভাবিকভাবে,
– বেটা, যতক্ষণ এ দেহ আছে ততক্ষণ সব পেয়েছি বলি কি করে? দেহটা যত ক্ষয় হতে থাকবে ততই তাঁর কাছে পৌঁছতে থাকব।
আমি সোজাসুজি বললাম,
– অত মারপ্যাঁচের কথা বুঝি না বাবা। সহজ করে বলুন তো দেখি তাঁর দর্শন পেয়েছেন কি না?
স্বতঃস্ফূর্ত হাসিতে ভরে উঠল সাধুবাবার উজ্জ্বল মুখখানা। নির্বিকারভাবে বললেন,
– বেটা, খাওয়ার পর যতক্ষণ না আবার খিদে পাচ্ছে ততক্ষণ বুঝতে পারা যায় না হজম হয়েছে কিনা? এখন আমার সেই অবস্থা।
শেষ কথাটা এই পর্যন্ত। আর একটা কথাও হল না। বসে শুধু ভাবতে লাগলাম। কেটে গেল কিছুটা সময়। সাধুবাবা বললেন,
– চল বেটা, তোর হয়ে এল।
বলে উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ালাম আমিও। প্রণাম করলাম দুপায়ে হাত দিয়ে। প্রথমে তিনি হাতদুটো জোড় করে ঠেকালেন কপালে। পরে দুহাত মাথায় স্পর্শ করে আশীর্বাদ করলেন। মুখে কিছু বললেন না। গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম দুজনে আবছা অন্ধকারে। ভোর হতে তখনও একটু বাকি। হাঁটতে লাগলাম পাশাপাশি। ভাবতে ভাবতেই চলছি রাতের কথা। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন সাধুবাবা। ইশারায় কামাখ্যামন্দিরে যাওয়ার পথটা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন হাসিমুখে।