Mythology

ভগবানকে লাভ করার অত্যন্ত সহজ সরল পথ জানালেন সাধুবাবা

গুরুজি প্রতিদিন ঝুলি থেকে গরম পুরি সবজি মিঠাই বের করে অমরনাথজিকে নিবেদন করতেন, পরে আমরা প্রসাদ পেতাম। তখন এ খাবার কোথা থেকে আনতেন, বুঝিনি।

এরপর জিজ্ঞাসা করলাম,

– সারাটা জীবন তো পথই আপনার আশ্রয়। ঘুরেওছেন অসংখ্য তীর্থ। এখান থেকে কোথায় যাবেন, দেবপ্রয়াগে এসেছেন কোথা থেকে?


এতক্ষণ এক ভাবে স্থির হয়ে কথা বলেছিলেন। এবার পা-টা পরিবর্তন করে বসলেন বাবু হয়ে। দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে বললেন,

– চারদিন হল দেবপ্রয়াগে আছি। এসেছি জ্বালামুখী থেকে। এখান থেকে যাব বদ্রীনারায়ণ, পরে কেদারনাথজির কাছে। হেঁটেই যাব।


টুক করে প্রশ্ন এল মাথায়, করেই ফেললাম,

– বাবা, আপনার কথায় আমার মনে হয়েছে আপনার গুরুজি যোগী ছিলেন। কারণ এ যুগে ফুঁ দিয়ে লম্ফ জ্বালানোর কথা আমার শোনা নেই, এমন মানুষের দেখাও পাইনি। আপনি কি গুরুজির জীবনপ্রসঙ্গে কিছু বলবেন দয়া করে?

আমার এ জিজ্ঞাসায় বৃদ্ধের মুখমণ্ডল দেখলাম খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল। বহুদিন পর একজন সাধুবাবাকে পেলাম যিনি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলে চলেছেন তাঁর জীবনকথা। আমার মনটাও এক অপার্থিব আনন্দে ভরে উঠেছে। বারবার খালি প্রণাম করছি। এবার আর থাকতে না পেরে বলে ফেললাম,

– বাবা, আপনি কি বিড়ি খান? আমার কাছে আছে।

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। দুটো ধরিয়ে একটা দিলাম সাধুবাবার হাতে, আর একটা নিলাম নিজে। বিড়িটা হাতে নিয়ে তাঁর গুরুজির উদ্দেশ্যে নিবেদন করে প্রথমে ফুকফুক্ করে টেনে পরে বেশ লম্বা টান দিয়ে বললেন,

– বেটা গুরুজির যোগ বিভূতির কথা সারাজীবন বলেও শেষ করতে পারব না, বুঝলি! আমার দীক্ষার পর মাসখানেক ছিলাম অমরকণ্টকে। তারপর আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ভারতের নানা তীর্থপর্যটনে। একমাত্র হিংলাজ মাতার তীর্থ ছাড়া এমন কোনও তীর্থ নেই যে তীর্থে গুরুজি আমাকে নিয়ে যাননি। একবার অমরনাথ দর্শন করে ফিরব। গুহা থেকে তখনও বেরতে পারিনি। শুরু হল প্রবল তুষারপাত। এতটাই প্রবল যে, গুহার বাইরে পা রাখে কার সাধ্যি! সে বার আমি আর গুরুজি ছিলাম শেষযাত্রী। তখন তো আর এখনকার মতো রাস্তাঘাট ছিল না, যাত্রী সংখ্যাও ছিল করগোনা। ফাঁসবি তো ফাঁস আমরা দুজনেই ফেঁসে গেলাম। টানা তিনদিন পর তুষারপাত বন্ধ হল। এই তিনদিন আমরা দুজনে অনাহারে থাকিনি। গুরুজি প্রতিদিন ঝুলি থেকে গরম পুরি সবজি মিঠাই বের করে অমরনাথজিকে নিবেদন করতেন, পরে আমরা প্রসাদ পেতাম। তখন এ খাবার কোথা থেকে আনতেন, বুঝিনি। অনেক পরে তা বুঝেছি। যাইহোক, তুষারপাত বন্ধ হওয়ার পর গুরুজি বললেন, বেটা, তোর এ দেহ এখনও তুষাররাজ্যের উপর দিয়ে হেঁটে চলার মতো উপযুক্ত হয়নি, কিন্তু এইভাবে এখানে কতদিন পড়ে থাকব? এক কাজ কর, তুই আমার হাতটা ধরে চোখবুজে থাকবি। আমি যখন বলব তখন খুলবি। তোর ইচ্ছায় চোখ খুললে জানবি মৃত্যু অবধারিত। গুরুজির কথা মতো চোখবুজে হাত ধরে দাঁড়ালাম। কতক্ষণ সময় লেগেছিল বেটা বলতে পারব না। চোখ খোলার অনুমতি দিতে দেখলাম লোকালয় থেকে খানিকটা দূরে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি দু-জনে। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলাম গুরুজিকে। তবে বেটা আমার খেয়াল আছে, আমি যেমন করে হাঁটি তেমন করেই হেঁটেছিলাম সেদিন।

কথাটা শেষ হতে আমিও সাধুবাবার পায়ে মাথাটা রেখে প্রণাম করলাম। তিনি হাতদুটো আমার মাথায় রাখলেন। আনন্দে চোখদুটো জলে ভরে উঠল। ঠিক এরকম একটা ঘটনার কথা শুনেছিলাম বদরীনারায়ণ ফেরতা এক সাধুবাবার মুখে। সাধুবাবা সেদিন বারংবার বলেছিলেন,

– বেটা, এসব কথা কাউকে কোনওদিন বলবি না, কেউ তো বিশ্বাস করবেই না, সকলের কাছে উপহাসের পাত্র হবি।

এরপর সাধুবাবা বললেন,

– বেটা গুরুজির সঙ্গে থাকলে খাওয়ার চিন্তাটা থাকে না। কোনও না কোনও ভাবে জুটেই যেত। গুরুজি কারও কাছে হাত পাততেন না। আমাকেও নিষেধ করেছেন ভিক্ষা চাইতে।

আর একটা ঘটনার কথা বলি শোন। আমি আর গুরুজি সে বার গেছিলাম পঞ্চকেদারের একটা কল্পেশ্বরে। ওখানে ছিলামও কয়েকদিন। ওই সময় বয়েস কম ছিল। হঠাৎ ঠাণ্ডা লেগে যায়। কয়েক দিনের মধ্যে দেহের অবস্থা এমনই হল, বাঁচার কোনও আশা রইল না। গুরুজির সেবা ও জড়িবুটিতে কোনও কাজ হল না। এ তো আর সমতল না যে চাইলেই ডাক্তার পাওয়া যাবে। এক সময় চিন্তার চাপ ফুটে উঠল গুরুজির চোখে মুখে। সেদিন অনেক রাতে দেখছি গুরুজি গুহায় নেই। বেটা, তোকে বলে রাখি গুরুজি কখনও নির্মাণ করা আশ্রয়ে থাকতেন না। পাহাড়ে গেলে মন্দিরের দাওয়া, প্রাঙ্গণ, নইলে থাকতেন গুহায়। যাইহোক কৌতূহল হল, গুরুজি তাহলে কোথায় একটু দেখি। ভেবে বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে। দেখলাম, ঋষিদের মতো দেখতে জটাজুটধারী তিন জ্যোতির্ময় পুরুষের সঙ্গে বসে কি যেন আলোচনা করছেন। এতটাই উজ্জ্বল দেহ যে অন্ধকারেও পরিস্কার বোঝা যায়। অনেকক্ষণ ধরেই কথা হল। আমি সবই দেখছি সামান্য দূর থেকে। আলোচনা শেষ হতেই দেখলাম তিনটে দেহ মিলিয়ে গেল নিমেষে। গুরুজি গুহায় ঢোকার আগেই আমি শুয়ে পড়লাম। মহাত্মারা সেদিন কেন এসেছিলেন, কি আলোচনা হয়েছিল, গুরুজিই বা কি করেছিলেন, তা আজও আমি জানি না। তবে পরদিন থেকে দেহে আর কোনও রোগ ছিল না, আজও নেই।

এই পর্যন্ত বলে সাধুবাবা থামলেন। আমি বললাম,

– বাবা, আপনার গুরুজির আরও কিছু কথা বলুন। আমরা গৃহী। শতকরা ৯৯টা মানুষের বিশ্বাসের বড় অভাব। আমার ধারণা, মানুষের কথা একবাক্যে বিশ্বাস করা, ভগবদবাক্য এক কথায় বিশ্বাস করা, নির্বিচারে গুরুবাক্যে বিশ্বাস করা, কারও উপর বিশ্বাস করে নিজেকে সঁপে দেয়া অর্থাৎ এক-এ প্রাণমন নিবেদিত হওয়া, অন্য এক সাধুবাবার কথায়, ‘অনেক অনেক জন্মের তপস্যা, সুকৃতি ও সংস্কার না থাকলে ওটা আসে না। অবিচল ও অচঞ্চল বিশ্বাস এল মানে জাগতিক বন্ধন মুক্ত হল। বেটা, বিশ্বাস কথাটাই কঠিন। বলা যায়, সহজে হয় না।’

মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, বিশ্বাসটা মানুষের সাধনজীবনে বিচারশূন্য মনের এক বিশেষ অবস্থা। কোনও একটা বিষয়কে সার্বিক বিচার করে সেই বিষয়ে মনের দৃঢ় স্থিতি অর্থাৎ যে বিশ্বাসটা আসে তাকে বেটা জ্ঞান বলে। নির্বিচারে বিশ্বাসের নামান্তরই ভক্তি। নির্বিচারে বিশ্বাস করাটা মানুষের পক্ষে ভয়ঙ্কর কঠিন। ভগবানকে লাভ করার অত্যন্ত সহজ সরল পথ হল নির্বিচারে বিশ্বাস। এই যেমন ধর আমার গুরুজির কথা। প্রথম প্রথম তাঁর সব অদ্ভুত কাণ্ড কারখানা দেখেও তো মন তা বিশ্বাস করতে চায়নি। কোনও একটা ঘটনা ঘটতে দেখলাম কিন্তু মন বলছে এটা কি সম্ভব? কি করে হল? চোখে দেখেও মন নির্বিচারে মানতে চায় না। এই দেখ না, তোর বিশ্বাসটা সম্পূর্ণ পাকা না হলেও যথেষ্ট হয়েছে। সে জন্যই তো তোর সঙ্গে কথা বলছি, গুরুজির কথা বললাম।

এবার জানতে চাইলাম,

– বাবা, আপনি যে যোগীগুরুর শিষ্য তা তো আপনার কথাতেই বুঝেছি। দেহে যোগীর যে সব লক্ষণ থাকে তাও আমার নজরে এসেছে যখন সঙ্গমে স্নান সেরে উঠে আসছিলেন। আপনাকে একটা অনুরোধ, যোগের সহজ প্রক্রিয়ার এমন কিছু দয়া করে শেখাবেন, যা সংসারজীবনে চলার পথে সদাসর্বদা কাজে আসে।

কথাটা শুনে সাধুবাবা হাসতে হাসতে বললেন,

– গুরু যোগী হলে তাঁর চ্যালাও যে যোগী হবে এমন কোনও কথা আছে? বেটা, আমি যোগটোগ কিছু জানি না। বুঝিও না। গুরুজির দয়াতে আনন্দে আছি, আর কি চাই!

বুঝলাম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছেন। সাধুবাবা জানে না এ বান্দা কাউকে একবার ধরলে তাকে ছাড়ার পাত্র না। আর কাউকে পরিত্যাগ করলে তার ছায়া মাড়াই না। এবার আমি সাধু বশ করার কৌশলটা প্রয়োগ করলাম। খপ করে পা দুটো ধরে বললাম,

– বাবা, আপনার যোগবিভূতি দেখানোর দরকার নেই। এমন কিছু শিখিয়ে দিন যাতে সুন্দরভাবে চলতে পারি সংসারজীবনে। একটু দয়া করুন বাবা, নইলে আপনার পা আমি কিছুতেই ছাড়ব না।

সাধুবাবা প্রথমে মাথায় হাত বুলিয়ে পরে পা থেকে হাতটা সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই বললাম,

– না বাবা, আমি কিছুতেই ছাড়ব না কিছু না শেখালে। কিছু দিয়ে যান যাতে সারাটা জীবন সুন্দরভাবে চলতে পারি, প্রতিদিন যেন স্মরণে রাখতে পারি আপনাকে হিমালয়ের যোগীগুরু বলে।

পা থেকে হাতটা সরাইনি। সাধুবাবার সেই একই কথা, ‘আমি কিছু জানি না বেটা’। ওসব কথা আমাকে বললে হবে? সাধুবাবা বলছেন ‘জানি না’ আমিও ছাড়ছি না, এইভাবে মিনিট পাঁচেক কাটার পর পা ছাড়তে বললেন। আমি ছেড়ে দিলাম। এবার সাধুবাবা আমার সম্মুখে চোখ রেখে কি যেন খুঁজতে লাগলেন মনে হল। কাটল মিনিট খানেক, কি ভাবলেন জানি না। তবে বুঝেছেন, এ ব্যাটা নাছোড়বান্দা। কিছু না ছাড়লে এ ছাড়বে না। এবার যোগের খুব সহজ কয়েকটা পদ্ধতি শেখালেন যা শিখতে আমার এক মিনিটও লাগল না। মুখে বললেন, প্রথম পদ্ধতিতে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে থাকা প্রিয়জন কেমন আছে তা ঘরে বসে জানতে পারবি মুহুর্তে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে, কারও সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন হলে সে বাড়িতে আছে কিনা, গেলে দেখা পাবি দেখা পাবি কি না বা সে করবে কি তা ঘরে বসে বুঝে যাবি নিমেষে। তৃতীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাড়ি থেকে বেরলে ভগবানেরও ক্ষমতা নেই তোর কার্যসিদ্ধি রোধ করে। তবে বেটা, আমার এই যোগবিদ্যা কখনও অপাত্রে দান করবি না। আমি তোকে যোগ্য পাত্র মনে করে দিলাম, কথাটা রাখিস।

মুখ থেকে কোনও কথা সরলো না। সারা দেহমন শিহরিত হয়ে উঠল। আনন্দে ঢুকরে কেঁদে ফেললাম। বার বার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে লাগলাম। আনন্দের রেশটা কাটতেই বললাম,

– বাবা, নর্মদা মায়ের কোলে গুরুলাভ ও দীক্ষা তো হয়েছে। নর্মদা পরিক্রমা করেছেন?

মুখে কোনও কথা না বলে ঘাড় নেড়ে জানালেন নর্মদা পরিক্রমা করেননি।

বললাম,

– বাবা, এমন কোনও দুঃখ বা আনন্দের ঘটনা আপনার জীবনে কি কখনও ঘটেছে যা আজও আপনাকে দুঃখিত করে কিংবা আনন্দ দেয়?

প্রসন্নচিত্তে অতিবৃদ্ধ প্রায় নির্জন দেবপ্রয়াগে গাছের তলায় বসে বললেন,

– বেটা, যেদিন আমার গুরুলাভ হল, আনন্দময় জীবনের শুরু হল সেদিন থেকে। তাঁর কৃপাতে আজ পর্যন্ত দুঃখ বলতে যা, তা আমার জীবনে আসেনি।

সাধুবাবা হিন্দিভাষী। খুব ধীরে ধীরে কথা বলেন। বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। কাছাকাছি একটা দোকান নেই যে সাধুবাবাকে একটু খাবার এনে খাওয়াব। কিছু করার নেই। তিনি ‘কৃপা’ কথা বলাতে জানতে চাইলাম,

– বাবা, কৃপা শব্দটা ধর্মীয় পুস্তকে অসংখ্যবার দেখেছি। লোকমুখে অজস্রবার শোনা। এই শব্দের প্রকৃত মানেটা বুঝি না! কৃপা কি এবং কৃপা কাকে বলে, দয়া করে একটু বলবেন।

মন দিয়ে কথাটা শুনলেন। একটু অন্যমনস্ক হলেন। আবার ফিরে এলেন! অতি বৃদ্ধ বললেন,

– বেটা, সংসারজীবনে জাগতিক বিষয়ের কামনা বাসনা যা কিছু সদা সর্বদা মনে ওঠে, যেমন ধর, আর্থিক অনটন বা দারিদ্র থেকে মুক্তি, কোনও বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া, কোনও দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া, পার্থিবজীবনে এমন যা কিছু তা সবই ধরা হয় কৃপা বলে।

আর বেটা ‘কৃপা’ শব্দের প্রকৃত অর্থ হল, ভক্তের উপর ভগবানের বেদনা দৃষ্টিতে প্রাণে যে আনন্দলহরি বয়, সঞ্চার হয় শক্তির এবং ভক্ত বা সাধক স্বয়ং অনুভব করে, তাই-ই বেটা কৃপা বলে অভিহিত। ভগবানের কৃপালাভ না হলে ভগবানকে লাভ করা যায় না।

একটু থেমে বৃদ্ধ সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, ভগবানের কৃপা পেতে, তাঁর সান্নিধ্যলাভের জন্য রমণ সময়ে স্ত্রীলোক লজ্জা পরিত্যাগ না করলে যেমন সৃষ্টি হয় না। তেমনই সাধনজীবনে, গৃহীজীবনে, সাধুজীবনে অভিমান ত্যাগ না করলে ভগবানের সান্নিধ্যলাভ হয় না।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button