এত বয়েসেও দাঁতগুলো সব সাজানো ঝকঝক করছে। একটাও পড়ে যায়নি। শুকনো গালে চোয়াল নজরে পড়ার মতো। নাকের ডগাটা সামান্য মোটা, থ্যাবড়ানো নয়। বোঝা যায় বুকের ছাতি পেটানো। বাহুদুটো বুক অনুসারে মানানসই। হালকা লাল চোখদুটো বসে গেছে। ভরপেট গাঁজা খাওয়া চোখ তবে কুতকুতে নয়। নাথ সম্প্রদায়ের যোগীদের মতো কানের লতিতে কুণ্ডল নেই। লতিদুটো সামান্য লম্বা। মাথা কাঁচাপাকায় খিচুড়ি। হাতের, পায়ের পাতার শিরাগুলো যেন হামলে পড়েছে। চামড়ায় এতটুকুও শিথিলতা আসেনি। ঘাড়টা খুব লম্বা নয়। ধোয়া গেরুয়াবসন বাউল কায়দায় পরা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালার সঙ্গে লাল হাকিক পাথর লাগানো। ঠোঁটের নিচ থেকে দাড়ি নেমে এসেছে হৃদয়ের কাছাকাছি। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ না বলে তার চাইতে আর একটু চাপা বলাই ভাল। কালো বলতে যা, তা নয়। উচ্চতায় সাড়ে পাঁচ ফুটের সামান্য একটু বেশি হবে বলে মনে হল। মাথায় চিরাচরিত জটা নেই। লম্বা চুলে ছোট্ট ঝুঁটি। সাধুদের সঙ্গের সাথী ঝোলাটা কিন্তু সঙ্গেই আছে।
কালভৈরব মন্দিরে উঠতে গেলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙেই উঠতে হয়। সিঁড়ির পাশে গাছের গোড়াগুলো সব শানবাঁধানো। ছায়াছন্ন শীতল পরিবেশ। তীর্থযাত্রীদের ক্যাঁচক্যাঁচানি নেই। সাধুবাবা গাছে ঠেস দিয়ে বসে আছেন ঝোলাটা পাশে রেখে।
কালভৈরবকে সুরাভোগ দিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসার সময় নজর পড়ল সাধুবাবার উপরে। যাওয়ার সময় তেমন লক্ষ্য পড়েনি, খেয়ালও করিনি। আমি সোজা এসে প্রণাম করলাম পায়ে হাত দিয়ে। একটু নড়ে বসলেন। কোনও কথা বললেন না, মাথায়ও হাত দিলেন না। আমি কোনও কথা না বলে ঝোলাটা ছেড়ে বিঘতখানেক দূরে বসলাম পা ঝুলিয়ে। সাধুবাবাও বসে আছেন ওইভাবে। কথা শুরু করলাম এইভাবে,
– বাবা, আপনি কি এখানে কোনও ডেরায় থাকেন, না কালভৈরব দর্শনে এসেছেন?
সহজভাবে বললেন,
– না বেটা, এখানে আমার কোথাও ডেরা নেই। কয়েকদিন হল এসেছি ‘ভৈরোনাথ’কে দর্শন করতে।
এবার আসরে জাঁকিয়ে বসতে হবে। পকেট থেকে বিড়ি বের করলাম। সাধুবাবা দেখলেন। দুটো ধরালাম। কিছু বললেন না। বুঝলাম আপত্তি নেই। তা থাকলে বলত। একটা হাতে দিতে মুখে দিয়ে বারকয়েক টানলেন। আমিও দু-টান দিয়ে বললাম,
– বাবা, ভারতের সমস্ত তীর্থই কি দর্শন করেছেন?
এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বললেন,
– না বেটা, অসংখ্য তীর্থ ঘুরেছি তবে কিছু বাকিও রয়ে গেছে। উত্তরাখণ্ডের চারধাম কেদার বদরী যমুনোত্রী গঙ্গোত্রী প্রতিবছরই পায়ে হেঁটে করি। তবে একবার তা হয়নি। গাড়িতে গেছিলাম। বদরীনারায়ণের পথে খানিকটা চলার পর একটা গাড়ি এসে থামল আমার সামনে। পিছনে দুজন সওয়ারি। সামনের সিট ফাঁকা। আমাকে বলল আমি বদরীনারায়ণের যাত্রী কি না? আমি হ্যাঁ বলতেই গাড়িতে তুলে নিল। বেটা, অনেক সময় দেখেছি গাড়িতে লোক কম থাকলে পথে এইভাবে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেয়। খেতে দেয়।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, গঙ্গাসাগর গেছেন?
মাথাটা নেড়ে ও মুখে বললেন,
– হাঁ বেটা, তিনবার গেছি। বহু বছর হল আর যাই না। এখন প্রতিবছর মকরসংক্রান্তিতে প্রয়াগে মাঘমেলায় যাই। এক মাস থাকি। সঙ্গমে স্নান করি। আনন্দেই কেটে যায় আমার।
কালভৈরব মন্দিরঅঙ্গনে যাত্রীদের আনাগোনায় কোনও বিরাম নেই। আসছে পুজো দিচ্ছে, চলে যাচ্ছে। সব তীর্থ যেমন কোলাহল মুখরিত, এখানে তেমনটা নেই। জানতে চাইলাম,
– বাবা, আপনি কোন সম্প্রদায়ের সাধু? আপনার ডেরা কোথায়?
বিড়িতে শেষ টানটা দিয়ে বললেন,
– আচার্য শঙ্করের দশনামের জঙ্গম সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী আমি। আমার ডেরা উত্তরপ্রদেশের… জেলায়… গ্রামে।
সাধুবাবার উচ্চারণে জেলা আর গ্রামের নামটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তাই আবার জানতে চাইলাম। উত্তর ও উচ্চারণ ঠিক আগের মতোই হল। বুঝতে পারলাম না। তৃতীয়বার একই কথা জিজ্ঞাসা করলাম না বিরক্ত হবেন ভেবে। কোনও একটা গ্রাম বা জেলা তো হবে, ও দিয়ে তেমন প্রয়োজন নেই। সাধুসন্ন্যাসীদের জীবনবিষয়ে জিজ্ঞাসা আমার অসীম, শেষ হওয়ার নয়। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনার দীক্ষালাভ কত বছর বয়েসে, ঘর ছাড়লেন কোন বয়েসে, এখনই বা বয়েস কত?
একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন করায় আমার মুখের দিকে তাকালেন। তবে চোখমুখে অস্বস্তির কোনও ছাপ নেই। খুব সহজভাবে হিন্দিভাষী সাধুবাবা বললেন,
– মেরা উমর অভি পয়ষট চল রাহা। আঠারোতে গৃহত্যাগ, দীক্ষা আমার আঠারোতেই।
কথায় আছে, সুযোগ সন্ধানী একবার সুযোগ পেলে সে সমানেই সুযোগ নিতে চায়। সাধুসঙ্গের সময় আমি ওই গোত্রের। বললাম,
– ঘর তো ছাড়লেন অল্প বয়েসে। যৌবনের জোয়ার সবে আসতে শুরু করেছে দেহমনে। ওই বয়েসে বাইরের এমন কোন জোয়ারের ঢেউ এসে গায়ে লাগল যে এক ধাক্কায় ঘর ছেড়ে পথে?
সোজাসাপটা কথা না বলে ঘুরিয়ে কথা বলার কায়দাটা দেখে সাধুবাবার মুখে হালকা একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। বুঝলাম কথায় বড় রসিক মানুষ। কথার চালাকিটা ধরে নিয়ে তিনি সরাসরি বললেন,
– ফেলে আসা জীবন, সংসার, আত্মীয় পরিজন, নামধাম এসব কথা সন্ন্যাসজীবনে এসে কাউকে বলা বারণ। আর ওসব কথা তোর জেনে তো কোনও লাভ নেই। সুতরাং ‘বীতগয়া জিওন কো যানে দে’।
অনুরোধের সুরেই বললাম,
– তবুও বলুন না বাবা, কেন সংসার ছেড়ে এলেন এক অনিশ্চিত জীবনে?
এখন সাধুবাবা নড়েচড়ে বসলেন। পায়ের উপর পা তুলে সাদাকালো দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে আমার কথার রেশটা ধরে বললেন,
– কোন মানুষের জীবনটা নিশ্চিত দেখছিস? সাধুসন্ন্যাসী বল, গৃহী ভিখারি রাজাউজির বল আর বাঘভাল্লুক পিঁপড়ে বল, কার জীবনটা নিশ্চিত? পরমাত্মার দরবারে সকলেই নিশ্চিত, জীবনপ্রবাহের গতি প্রকৃতি সুনিশ্চিত, সুনির্দিষ্ট। এতটুকু এদিক ওদিক হওয়ার উপায় নেই। জীবজগতের ওই বিষয়টা জানা নেই বলে পরমাত্মার সুনির্দিষ্ট নিশ্চিত গতি ও জীবনপ্রবাহ, মানুষের কাছে একেবারেই অনিশ্চিত। এই যে আমার সঙ্গে বসে কথা বলছিস, এটাই তাঁর হিসাবে নিশ্চিত ও সুনির্দিষ্ট। এখান থেকে উঠে কোথায় যাবি, কোন পথে যাবি, কাল তো দূরের কথা, মুহুর্তমাত্র পরে কি হবে তা তুইও জানিস না, আমিও না। সেইজন্যই তো বেটা মানুষের জীবনপ্রবাহের গতি অনিশ্চিত বলে ধরে নিয়ে চলা।
দেখলাম সাধুবাবা আমার আসল কথায় এলেন না। আবারও সেই একই প্রশ্ন করলাম,
– দয়া করে বলুন না বাবা, ঘর ছাড়লেন কেন?
সাধুবাবা বুঝেছেন আমি নাছোড়। আর প্যাচাল পাড়লেন না। চারদিকে চোখদুটো একবার বুলিয়ে নিয়ে বললেন,
– বেটা, সংসারে আমার তিনভাই। আমি ছোট। সামান্য বিষয়সম্পত্তি আর ক্ষেতিজমি ছিল আমাদের। আমার পনেরো বছর বয়েসের মধ্যে মা বাবা দুজনেরই ‘দেহান্ত’ হয়। ভাইরা আমাকে বঞ্চিত করল সম্পত্তি থেকে। কুকুরের মতো থাকি তাদের আশ্রয়ে পেটের দায়ে। এইভাবে কাটতে লাগল দিনগুলো। মন থেকে মেনেও নিতে পারছি না এই জীবন। সংসারের প্রতি একটা বিতৃষ্ণার ভাব যে কখন জমে পাহাড় হয়েছিল অন্তরে তা নিজেও টের পাইনি। একসময় বেরিয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে। তখন বয়েস ১৭/১৮ হবে। গৃহত্যাগের বছরেই আমার গুরুলাভ হয়।
এই পর্যন্ত বলে থামলেন। মুখমণ্ডলে এমন একটা ভাব ফুটে উঠল সেটা হতাশা, না পাওয়ার বেদনা, আত্মীয় পরিজনদের উপরে ক্ষোভ, ভাবটা যে কি তা বুঝে উঠতে পারলাম না। মনেমনে হিসাব করে দেখলাম আর তিনটে বছর হলে গৃহত্যাগের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে।
সাধুবাবা অনেককালই পথে পথে। পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছি সাধুসন্ন্যাসীরা অনেকে গুরুপরম্পরা আবার অনেকে বিভিন্ন সাধুর সঙ্গকালীন লোককল্যাণে নানান ধরনের বিদ্যালাভ করে থাকেন। তাই এই সময় আর অন্য বিষয় নিয়ে খোঁচাখুঁচি না করে জানতে চাইলাম,
– বাবা, আপনি তো অনেক কিছুই জানেন। আমাকে কিছু দেবেন যাতে সংসারজীবনে চলার পথে আপনার দেয়া বিদ্যায় আমার কিছু কল্যাণ হয়।
কথাটা শুনে সাধুবাবা মুখের দিকে চেয়ে রইলেন একদৃষ্টে। কেটে গেল প্রায় মিনিটদেড়েক। আমিও দেখলাম অপলক দৃষ্টিতে। এমন দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী। চোখদুটোতে যেন এক্স-রে মেশিন লাগিয়েছেন। আরও খানিকটা সময় এইভাবে কাটার পর জানতে চাইলেন আমি কি করি, কোথায় থাকি, কালভৈরবে কি করতে এসেছি, এখান থেকে কোথায় যাব, বাড়িতে কে কে আছে এমন শত প্রশ্ন। প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিলাম। সব শুনে মিনিটপাঁচেক কি ভেবে নিয়ে সামুদ্রিক বিদ্যা অর্থাৎ চেহারার বিভিন্ন লক্ষণ দেখে শুভাশুভ বলা এবং ক্রিয়াযোগের ছোট্ট একটা বিষয় জানালেন, যা আমার আজও প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজে লাগে। সমস্ত বিষয়গুলো ঝড়ের বেগে নোট করে নিলাম। সাধুসঙ্গের সময় কাগজ কলম সঙ্গেই থাকে। সংসারে সুখ থাকার জন্য আরও কিছু বিষয় জানালেন। কথা শেষ হতেই সাধুবাবার পা দুটো মাথায় নিয়ে কেঁদে ফেললাম আনন্দে। এ যে আমার এক অপ্রত্যাশিত পাওয়া।
সাধুবাবা বাহুদুটো ধরে ‘ওঠ ওঠ বেটা, ওঠ’ বলে তুলে ইশারায় শান্ত হয়ে বসতে বললেন। চোখের জল মুছে তাকিয়ে রইলাম মুখের দিকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনও ভাষা এল না মুখে। বললেন,
– বেটা, তোর পূর্বজন্মের কর্মফলে আমার কাছে এই বিদ্যা তোর ভাগ্যে প্রাপ্তি ছিল তাই পেয়েছিস। এখানে আমার বা তোর কোনও কেরামতির কিছু নেই। কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরও কোনও প্রশ্ন আসে না। না পাওয়ার থাকলে পেতিস না। সুতরাং এ বিষয়ে আর কোনও কথা বলে লাভ নেই। পরমাত্মার দরবারে আজ এটাই নিশ্চিত সুনির্দিষ্ট ছিল, বুঝেছিস বেটা!
সাধুবাবা জানালেন মানুষের চেহারা দেখে শুভাশুভ বলার বিদ্যা
শিরোনাম টা দেওয়া শুভংকরের ফাঁকির মতন হল
মনে হয়।
লেখাতে কিছু দেহের শুভাশুভ লক্ষন দেওয়ার দরকার ছিল
তাহলে শিরোনামের যাথাযথ হত।
সেটাই যখন লেখা হয়নি
তাহলে নিচে লেখার দরকার ছিল
জানতে হলে চেম্বারে দেখা করুন
ওমক খানে ওমুক জায়গায়