হিন্দুদের কেন দাহ করা হয়
আসলে বেটা মা আমাদের দয়া করে দর্শন দিলেন তোকে অসুস্থ করার ছল করে। সারা জীবনের সাধনা আমার সার্থক হল তোর মতো শিষ্য পেয়ে।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, বয়েস তো আপনার অনেকই হল। সারাটা জীবন অনেকটা পথই তো চললেন। এই চলার পথে এমন কোনও সুখ বা দুঃখ কিংবা এমন কোনও দুর্লভ অভিজ্ঞতা কি হয়েছে, যে অভিজ্ঞতার কথা আজও মনে আছে আপনার।
মন দিয়ে কথাটা শুনলেন। কথা বলছি সাধারণ স্বরে, চেঁচিয়ে নয়। প্রতিটা কথার উত্তর দিচ্ছেন ঠিক ঠিক। বুঝে গেলাম ভগবানের দয়াতে শ্রবণশক্তিটা আজও ঠিক আছে। সাধুবাবা হাসিমাখা মুখে বললেন,
– বেটা, সাধুজীবনটাই তো মানুষ হয়ে জন্মানোর পর একটা দুর্লভ জীবন। ক-জনা পায়? গৃহত্যাগের পর, আমার বয়েস তখন কুড়ি হবে, আজ থেকে প্রায় ১১৩ বছর আগে গুরুজির সঙ্গে গিয়েছিলাম হিংলাজমাতার দর্শনে। ওই তীর্থটা বেটা পাকিস্তানে। মরুভূমির উপর দিয়ে যেতে হয়। খুব কষ্টকর যাত্রা। তখন যাত্রী সংখ্যা যেমন কম তেমন পথে জল আহার ইত্যাদির অভাবটাও ছিল যথেষ্ট। ওখানে ‘দুর্গামাঈর’ ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল। যাওয়ার সময় কোনও অসুবিধা হয়নি। আসার সময় মরুভূমিতে তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারালাম। পথে তখন না সাহায্যকারী লোকজন, না ওষুধপত্র। গুরুজির এক অসহায় অবস্থা। সেই সময় প্রকাশ্য দিনের বেলায় অত্যন্ত রূপসী এক রমণী ফাঁকা ধু-ধু প্রান্তরে ওষুধ আর পথ্য দিয়ে গেলেন গুরুজির হাতে। যাওয়ার সময় মাথায় তাঁর বুলিয়ে দেওয়া হাতের স্পর্শে আমার চেতনা ফিরতে দেখলাম সেই রমণীকে। এরপর হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা দূরে গিয়ে মিলিয়ে গেলেন। আমি ওষুধ ও পথ্য খেয়ে সুস্থ হয়ে উঠলাম। পরে গুরুজিকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, নির্জন মরুভূমিতে পরমাসুন্দরী ওই মহিলা কে, কোথা থেকে এলেন?
উত্তরে গুরুজি বললেন,
– বেটা, তোর উপর হিংলাজমাতা স্বয়ং দুর্গামাঈ করুণা করে ওষুধ ও পথ্য দিয়ে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে বললাম,
– বাবা, ‘দুর্গামাঈ’ হিংলাজমাতা রক্ত মাংসের দেহে এইভাবে আসতে পারেন? বাস্তবে এটা কি সম্ভব?
সেদিন গুরুজি নির্বিকার ও অম্লান বদনে বলেছিলেন,
– বেটা, আমরা তো তাঁর সন্তান। তাঁকে ছাড়া আমাদের তো জগতে কিছু চাওয়ার নেই, পাওয়ারও নেই। ঝোলাসম্বল আমাদের জীবন। গুরুজি ছাড়া, মা ছাড়া, ভগবান শঙ্কর ছাড়া কে-ই বা আছে? সন্তানের প্রয়োজনে রক্তমাংসের দেহে ভগবানের আসাতে বাধাটা কোথায়? আসলে বেটা মা আমাদের দয়া করে দর্শন দিলেন তোকে অসুস্থ করার ছল করে। সারা জীবনের সাধনা আমার সার্থক হল তোর মতো শিষ্য পেয়ে।
এই পর্যন্ত বলে গুরুজি আমার উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। আমি তখন শুধু তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে মাখতে লাগলাম সারা গায়ে মাথায়। ধন্য হল আমার জীবন মন মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে। বেটা, এর থেকে আর দুর্লভ অভিজ্ঞতা এ জীবনে কি হতে পারে বলতে পারিস?
সাধুবাবার এই অতি অতিদুর্লভ দর্শনের কথা শুনে আনন্দ ও আবেগে আমার দুচোখে জল এল। বারবার প্রণাম করতে লাগলাম একশো তেত্রিশকে। তিনিও তাঁর আশির্বাদী হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন মাথায়। হঠাৎ সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, একটা জায়গায় যাবি আমার সঙ্গে তাহলে একটা দুর্লভ বিষয় দেখতে ও জানতে পারবি। তবে এখান থেকে কয়েক মাইল হাঁটতে হবে। আমি সেখানে নিমন্ত্রিত। আমার সঙ্গে তুই গেলে কোনও অসুবিধা হবে না। যদি যাস তো চল, ঠিক বেলা বারোটায় কাজটা হবে।
আমি আর কোথায় কি ও কেন এসব জিজ্ঞাসা না করে উঠে দাঁড়ালাম। বৃদ্ধের হাতদুটো ধরলাম উঠে দাঁড়ানোর কষ্ট লাঘবের জন্য। এই মন্দিরচত্বর ছেড়ে হাঁটতে লাগলাম সীতারামদাস ওঙ্কারনাথজির আশ্রম যে দিকে, সেদিকটায়। খানিকটা চলার পর বাঁপাশে গঙ্গাকে রেখে হাঁটতে লাগলাম। বৃদ্ধ বাবা বললেন,
– আমরা যে দিকে ছিলাম ওদিকে গঙ্গার গভীরতা কম, বুঝলি? যেখানে যাচ্ছি সেখানে গভীরতা অনেক বেশি। আমাদের সম্প্রদায়ের এক সন্ন্যাসী গুরুভাই-এর দেহান্ত হয়েছে। আজ তাঁর সলিলসমাধি দেওয়া হবে। সেখানেই যাচ্ছি।
মিনিট কুড়ি চলার পর গঙ্গার ধার ঘেঁষে সাধুবাবা অনেকটা নিচে, খানিকটা সমতল জায়গায় নামলেন, সঙ্গে আমিও অনুসরণ করলাম। জায়গাটা বেশ নির্জন। জলস্রোত আর চেহারা দেখে মনে হল গঙ্গা এখানে বেশ গভীর। এবার দেখলাম বয়স্ক একজন সন্ন্যাসীর মৃতদেহ শোয়ানো আছে। পাশে রয়েছে বেশ কিছু ফুলের মালা, জনা কুড়ি বিভিন্ন বয়েসের সন্ন্যাসী। একশো তেত্রিশ পৌঁছনোর পর সন্ন্যাসীরা সকলে মিলে মৃতদেহকে ধরে বসালেন। পরে পা-দুটোকে পদ্মাসনের মতো করে বসিয়ে দিলেন, তবে কয়েক জন ধরে রইলেন দেহটাকে। এবার সন্ন্যাসীরা ফুলের মালা গলায়, জটায়, বাহু ও কোমরে পরালেন। পাশে দড়ি ও মাঝারি আকারের পাথর ছিল। এরপর পাথরের সঙ্গে দড়ি বেঁধে সেই দড়ির অংশ তাঁরা বেঁধে দিলেন মৃতদেহের বিভিন্ন অংশে। এই কাজগুলো সম্পন্ন হলে আরতি করা হল ধূপকাঠি জ্বালিয়ে। এবার বৃদ্ধ সাধুবাবা সুর করে এক ধরনের মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। সেই মন্ত্রই উপস্থিত সন্ন্যাসীরা বলতে লাগলেন। এই পর্বটা শেষ হলে কয়েকজন সন্ন্যাসীকে সুন্দরভাবে বসা অবস্থায় তুললেন, অন্যেরা এক একজনে পাথরের টুকরোগুলো হাতে নিয়ে সকলে নেমে গেলেন তরতরিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গায়। সকলেই নামলেন প্রায় কোমরজলে। এবার দেহ ও পাথরগুলো ছেড়ে দিলেন ধীরে ধীরে। ক্রমে দেহটা তলিয়ে গেল জলে। সন্ন্যাসীরা সকলে গুরুর উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে জয়ধ্বনি করে উঠে এলেন উপরে। এরপর সকলে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেলেন যে যার পথে।
পড়ুন : সুখ ও দুঃখ কী, কয়েক শব্দে জানালেন ১৩৩ বছরের সাধুবাবা
আমি আর সাধুবাবা আবার চললাম বিশ্বনাথ মন্দিরে। বৃদ্ধ বললেন,
– বেটা, সলিলসমাধি দেখলি? ওই সন্ন্যাসী উচ্চমার্গের মহাত্মা ছিলেন। মৃত্যুর আগে জানিয়েছিলেন দেহটা না পুড়িয়ে ‘গঙ্গাজিতে’ যেন জলসমাধি দেওয়া হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করা হল।
এই পর্যন্ত বলে থামলেন। আমরা দু’জনে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। সাধুদের মৃত্যুর পর তাঁদের দেহের শেষ পরিণতি প্রসঙ্গে বহু বছর আগে প্রভাসতীর্থে এক বৃদ্ধ সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
– বাবা, সাধুজীবনে যখন আছেন তখন নিশ্চয়ই জানেন, আপনার মতো পথচলতি সাধু যাঁরা তাঁদের কোনও আশ্রয় নেই – নেই কোনও ঠিকানা। আজ এখানে কাল সেখানে, এইভাবেই কেটে যায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমার জিজ্ঞাসা, শেষ দিনটাকে নিয়ে। দেহত্যাগের পরে কে বা কারা তাঁদের দেহটাকে দাহ করে বা সমাধি দেয়?
প্রশ্নটা শুনে একটা অদ্ভুত প্রসন্নতার ভাব ফুটে উঠল সাধুবাবার মুখখানায়। একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
– বেটা, যেসব সাধুসন্ন্যাসীরা মঠ মন্দির আশ্রমে আশ্রয় নিয়ে আছেন, তাঁদের দেহত্যাগের পর মৃতদেহ দাহ করে বা বিশেষ নির্দেশ থাকলে সমাধি দিয়ে দেয় তাঁর ভক্ত শিষ্যরা। সমাজে এটা হয়তো দেখে থাকিব। আর আমার মতো ‘রমতা’ সাধু যাঁরা, তাঁরা বেওয়ারিশই বলতে পারিস। কিন্তু এঁদের এমনই ভাগ্য, তাঁর নামে পড়ে থাকায় তাঁর এমনই কৃপা এঁদের উপরে, একটু খোঁজ নিলে দেখতে পাবি এঁরা সচরাচর হাসপাতালে মারা যান না। দেহটাও পচে গলে পড়ে থাকে না মর্গে, পথেঘাটে। ‘গণদাহ’-র মতো পুড়িয়েও দেয়া হয় না এঁদের মরদেহ। দৈবাৎ কখনও এক-আধটা হলেও হতে পারে তবে হয় না বললেই চলে। আমি অন্তত এই বয়েস পর্যন্ত দেখিনি কখনও।
একটু থামলেন। এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নিলেন একটু। কথায় কথা টেনে এনে ছেদ টানলাম না কথায়। সাধুবাবা বললেন,
– পথচলতি সাধুদের দেখবি, সবসময়েরই কোনও না কোনও তীর্থে অবস্থান করেন তাঁরা। বেটা, মন থেকে সব সাধুরা সবকিছু ছাড়তে পারে কিনা জানি না, তবে সব ছাড়তে পারুক বা না পারুক, ভগবানের নামে পড়ে থাকার ফল তো একটা আছেই আছে। সারাজীবনে অনেকটা পথই তো চললাম। এই চলার পথে দেখেছি, প্রায় সব ‘রমতা’ সাধুদের মৃত্যু হয় অতি সামান্য রোগে ভুগে। রমতা সাধু দীর্ঘকাল ভুগে ভুগে মারা গেছে এমন তুই পাবি না। আমি নিজেও দেখিনি কখনও। ভগবানের কত দয়া! দেখেছি, মৃত্যুর সময় কোনও ভালো মানুষকে তিনি পাঠিয়ে দেন মৃত্যুপথযাত্রী সাধুর কাছে। পাঠিয়ে দেন তাঁর শেষ সেবাটুকু আর শেষকৃত্যাদি সম্পন্ন করার জন্য। আর্থিকসম্পন্ন হলে সে নিজেই বহন করে সমস্ত খরচা। নইলে সে এবং স্থানীয় আর সকলে মিলে সাহায্য তুলে শেষ করে শেষ কাজটা। কখনও কোথাও কোনও সাধুর শেষকৃত্যাদি সম্পন্ন করতে অসুবিধে হয়েছে এমনটা দেখিনি। খুব আর্থিক অসুবিধে হলে পথচলতি সাধুর দেহটাকে নদী কিংবা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় সাধারণ মানুষ তবে সারাজীবনে এমন ভাসিয়ে দিতে দেখেছি এক-আধবার।
একটু থেমে কি যেন একটু ভাবলেন। তারপর বললেন,
– তবে গিরি সম্প্রদায়ের সাধুদের অনেকের দেহকে দেখেছি সলিলসমাধি দিতে। দেহরক্ষার পর মৃতদেহে পরিয়ে দেয়া হয় নতুন বসন। তারপর সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেয়া হয় ফুলের মালা দিয়ে। এবার ভারী ভারী পাথর বেঁধে দেয়া হয় মরদেহে। এসব কাজ শেষ হলে দেহটাকে নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হয় মাঝগঙ্গায়। যেখানে গঙ্গা নেই সেখানে কোনও নদীতে। নৌকার মধ্যে আসন অবস্থায় বসিয়ে পরে দেহটাকে ধরে ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয়া হয় জলে। তারপর দেখতে দেখতে তলিয়ে যায় দেহটা। এইভাবেই দেয়া হয় সলিলসমাধি। কথাটা শেষ হতে জানতে চাইলাম,
– বাবা, এইভাবে জলসমাধি দেয়া হয় কেন? এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে, আপনি কি জানেন বা শুনেছেন কিছু?
একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
– হিন্দুদের দেহ পুড়িয়ে ফেলা, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের কবর দেয়ার রীতিই প্রচলিত আছে। জলসমাধি দেয়াটা গিরি সম্প্রদায়ের একটা রীতিই বলতে পারিস। অবশ্য এর পিছনে কোনও কারণ থাকলেও থাকতে পারে। ঠিক বলতে পারব না। আমার ধারণা, জলসমাধি আর কিছু কিছু হিন্দু সাধুর মরদেহ সমাধি দেয়ার পিছনে একটা কারণ, সাধনভজনে দেহটা নামময় হয়ে যায় বলে। তবে বেটা, হিন্দুদের মৃত্যুর পর দেহটা পুড়িয়ে ফেলার একটা বড় কারণ আছে। সেটা কি জানিস? মৃত্যুর পর আত্মা দেহ ছেড়ে চলে গেলেও জাগতিক বিষয় ও দেহটার উপর আকর্ষণ একটা থেকে যায় প্রথম অবস্থায়, যদি উন্নত ও মুক্ত আত্মা না হয়। দেহ সমাধি দিলে আত্মা ওই দেহের উপর আকর্ষণ অনুভব করে যতদিন না দেহটা মাটিতে মিশে যাচ্ছে, যতদিন না মুক্তি পাচ্ছে বা পুনর্জন্ম হচ্ছে সেই আত্মার। এতে আত্মার কষ্ট বাড়ে। দেহটা পুড়িয়ে ফেললে প্রথম আকর্ষণ দেহটার উপর মায়া কেটে যায় অতিদ্রুত। আত্মার পরিতৃপ্তির জন্যই মৃত্যুর পর দেহ পুড়িয়ে ফেলার রীতি। বেটা, মৃত ব্যক্তির ফটোও ঘরে রাখা উচিত নয়, প্রকৃতই মানুষ যদি তাঁর স্বজনের আত্মিক কল্যাণ চায়। মৃত ব্যক্তির ছবিও আত্মার মায়া ও কষ্ট বৃদ্ধির কারণ জানবি।