Mythology

দৃষ্টিদোষের অশুভ প্রভাব এড়ানো ও মুক্তি পাওয়ার পথ দিলেন সাধুবাবা

কথাটা শুনে অবাক হলাম, আমার ফেলে আসা অতীত জীবন সম্পর্কে একটা কথাও জানাইনি। তিনিই গড়গড় করে বলে গেলেন দুঃসহ জীবনকথা।

হিমালয়ের কোলে নেপাল যেন মায়ের কোলে ছোট্ট শিশু। নেপাল উপত্যকা। চারদিক পর্বতে ঘেরা। চির তুষারাবৃত এর শিখরমালা। নৈসর্গিক শোভাই ছড়িয়ে আছে এর চারপাশে। এটাই যে নেপালের চিরকালের সম্পদ।

শহর কাঠমান্ডুর উপকণ্ঠের নাম মৃগস্থলী। এরই বুক চিরে বাগমতী বয়ে চলেছে ভগবান শঙ্করের প্রশস্তি গেয়ে। এর এক তীরে স্বয়ং পশুপতিনাথ, অপর পারে ছোট্ট টিলার উপরে দেবী গুহ্যেশ্বরী। বাগমতীর বামতটে দেবীমন্দির। দেবীর নামেই গুহ্যেশ্বরী ঘাট।


দক্ষরাজকন্যা সতীর একান্নপীঠের একটি। গুহ্যঅঙ্গ পড়েছিল এই বাগমতী তীরে। সতী এখানে প্রসিদ্ধিলাভ করেছেন গুহ্যেশ্বরী নামে। দেবীর ভৈরব স্বয়ং পশুপতিনাথ।

কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠলেই মন্দিরের প্রবেশদ্বার। পরে মন্দিরচত্বর। এরই মাঝে সুদৃশ্য মন্দির প্যাগোডা ধাঁচের। সোনা রুপোর পাতে মোড়া মন্দিরের দরজা, চূড়া। সর্বাঙ্গ কারুকার্যখচিত। ভিতরে আকারহীন পাথরের খণ্ড সিঁদুর রাঙানো, ফুল বেলপাতায় ঢাকা। এখানেই দেবীর অবস্থান। স্কন্দ ও কালিকা উভয় পুরাণেই উল্লিখিত হয়েছে দেবী গুহ্যেশ্বরীর কথা। এই মন্দিরের দরজার উপরে আঁকা আছে কিছু নগ্ন, অর্ধনগ্ন ও ভীতিপ্রদ চিত্র।


মূলমন্দিরের পাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। নামলেই গর্ভগৃহ। সোনারপাতে বাঁধানো চাতাল। উন্মুক্ত আকাশ। তারই নিচে সামান্য উঁচু একটি ত্রিকোণাকৃতি বেদী। মাঝে একটি গর্ত, সোনার ঢাকনায় ঢাকা গর্তটি। পুরোহিত সেটি তুললেই জল ওঠে বুদবুদ করে। এ জল কোথা থেকে আসছে তা জানা নেই কারও। এমন আসছে শতশত বছর ধরে। বেদীর পাশেই দেবীর ভৈরব। সেটিও বেদী, মূর্তি নয়। ছোট্ট চাতালের পাশে পাথরের দেওয়াল। তাতে খোদিত অষ্টনাগের ছোটছোট সুদর্শন মূর্তি। ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত বর্তমান মন্দিরটি। লেখা আছে প্রবেশদ্বারের দেওয়ালে।

এই শক্তিপীঠে প্রতিদিন দেবীর ভোগ হয় ডিম মদ ও মুরগী বলি দিয়ে। অধিকাংশ যাত্রীদের দেখলাম ডিমভোগ দিয়ে পুজো দিতে। নেপালের অধিষ্ঠাত্রী দেবী স্বয়ং গুহ্যেশ্বরী। তাই একটি প্রথা আছে, প্রথমে গুহ্যেশ্বরী দর্শন করে পরে দর্শন করতে হয় পশুপতিনাথ। তবে এই প্রথা মেনে চলতে দেখলাম না কাউকে। বিষয়টা জানতে পারলাম পশুপতিনাথ দর্শন করে আসার পর পূজারির কাছে। আমার দশা আর সকলেরই মতো।

গুহ্যেশ্বরী মন্দির এলাকাটি মোটামুটি ফাঁকা। উৎসব অনুষ্ঠানে হয়তো ভিড় বাড়ে। কোনও দোকানপাট নজরে পড়ল না। দু’চার জন নেপালি মেয়ে বসে আছে ফুল নিয়ে যদি তীর্থযাত্রীরা পুজোর জন্য কেনে, এই আশায়।

দেবীমন্দির থেকে বেরিয়ে ফুলওয়ালিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নজরে পড়ল এক বৃদ্ধকে। যখন মন্দিরে যাই তখন অত নজর করিনি। এখন দেখামাত্র দাঁড়িয়ে গেলাম। তাকালাম বৃদ্ধের চোখের দিকে। চোখদুটো নামিয়ে নিলেন। বুঝে গেছেন তিনি ধরা পড়ে গেছেন আমার কাছে। একসময় আমার গুরুর কাছে নারীপুরুষের চোখের ভাষা পড়াটা শিখেছিলাম। সারাজীবন তা আমার কাজেও লেগেছে। চোখ দুটো একেবারে যোগীচক্ষু।

ভিক্ষে নয়, ঝোলাঝুলি নিয়ে একটু আলাদাভাবেই বসে ছিলেন বৃদ্ধ সাধুবাবা। মাথায় নানান আকারের সরু মোটা জটা। কোনওটা ছোট, কোনওটা কাঁধ ছাড়িয়ে। পরনে আধময়লা কাপড়টা বাউল কায়দায় পরা। গায়ে শতধোয়া গেরুয়া ফতুয়ার উপরে একটা কম্বল জড়ানো। এখন এখানে শীতের হালকা কামড় একটা চলছে। কম্বলে অনেকটা ঢাকা বলে গলায় কোনও মালা পরা আছে কিনা বোঝা গেল না। খ্যাদা নাকের সাধু আজও আমার চোখে পড়েনি। টিকালো নাক। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। বৃদ্ধের বয়েসটা এই মুহুর্তে আন্দাজ করতে পারলাম না। কাঁচায় পাকায় দাড়ি গালভরা।

সরাসরি গিয়ে বসলাম সাধুবাবার মুখোমুখি হয়ে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। মুখে কিছু বললেন না। ডানহাতটা মাথায় বুলিয়ে দিলেন। তিনিই প্রথম কথা বললেন হিন্দিতে,

– কোথায় থাকিস বেটা?

সাধুবাবা যে বেশ মিশুকে তা কথাতেই বুঝলাম। উত্তরে জানালাম,

– কলকাতায় থাকি। নেপালে এসেছি পশুপতিনাথ দর্শনে। ওখানে দর্শন সেরে এখানে এলাম গুহ্যেশ্বরী মায়ের দর্শনে।

এবার আমিই জানতে চাইলাম,

– বাবা, আপনার ডেরা কোথায়? কোন সম্প্রদায়ের সাধু আপনি? এখানে আছেন কত দিন?

মুখের দিকে তাকালেন। একটু মুচকি হেসে বললেন,

– বেটা, স্থায়ী ডেরা বলতে যা, তা আমার নেই। বিভিন্ন তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াই তাই ডেরার কথা আলাদা করে কখনও ভাবিনি। আমি নাথ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী। দিন পনেরো হল এসেছি। এখানে আসার আগে কামাখ্যায় ছিলাম কিছুদিন। থাকব আরও দিন পনেরো। তারপর কোথায় যাব তা গুরুজির ইচ্ছা।

এই সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলে বেশ আনন্দ পাচ্ছি। জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিতে দ্বিধা নেই। বললাম,

– বাবার এখন বয়েস কত হল? কত বছর বয়েসে গৃহত্যাগ করেছেন?

এ কথাটা শুনে বৃদ্ধ বললেন,

– সাধুসন্ন্যাসীদের পূর্বাশ্রমের কথা বলতে নেই। এতে মন বড়ই বিক্ষিপ্ত হয়। মায়ের থানে বসে আছি, তুই জিজ্ঞাসা করলি তাই বলছি। বেটা, মহারাষ্ট্রের নাসিকে আমার জন্ম। যখন গৃহত্যাগ করি তখন আমার বয়েস ১২/১৪ হবে। এখন তিরানব্বই।

সাধুবাবা থামতেই জিজ্ঞাসা করলাম,

– তখন কি এমন ঘটনা ঘটল যে অতটুকু বয়েসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন?

কোনও রকম ভণিতা না করেই বললেন,

– বেটা, আমি কেন ঘর ছেড়েছি, সে কথা বললে তোর বিশ্বাস হবে না। আমাদের পরিবার খুবই সচ্ছল। আমরা দু-ভাই, এক বোন। বাবা মাকে নিয়ে পাঁচজন। গাঁয়ের মধ্যে আমরাই এক ঘর ব্রাহ্মণ। আমাদের বাড়িতে গরু ছিল। প্রতিদিন সকালে আমি মাঠে নিয়ে যেতাম ঘাস খাওয়াতে। একদিন মাঠে গিয়ে গরুটাকে ছেড়ে দিলাম। তারপর হঠাৎ মনের যে কি হল তা তোকে বোঝাতে পারব না। ভাবলাম, আর বাড়ি যাব না। কোথায় যাব তাও ভাবলাম না। শুধু হাঁটতে লাগলাম। একের পর এক গ্রাম পার হয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম একটা স্টেশনে। খাওয়া দাওয়া নেই। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করার পর একটা ট্রেন এল। উঠে বসলাম। বেটা, এই হল আমার গৃহত্যাগের কথা। কেন যে ঘর ছাড়লাম, তখন মনের কি যে হয়েছিল, তার কোনও কারণ খুঁজে পাইনি আর কখনও ফিরেও যাইনি ঘরে।

বৃদ্ধ থামলেন। ভাবলাম, এ এক অদ্ভুত গৃহত্যাগ! ভাবতেই পারছি না। এ সময় ঠান্ডার একটা আমেজ আছে নেপালে। এবার বললাম,

– বিড়ি আছে আমার কাছে, খাবেন একটা?

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। দুটো ধরিয়ে একটা নিলাম নিজে, আর একটা দিলাম সাধুবাবার হাতে। তিনি খুশিতে টানতে লাগলেন। ধুনিতে চিমটে দিয়ে একটু খুঁচিয়ে ধুনো ছড়িয়ে দিলে তা আপনিই বেশ জ্বলতে থাকে। আমি বৃদ্ধ তিরানব্বইকে একটু খুঁচিয়ে দিলাম,

– তারপর কি হল বাবা?

বিড়িতে লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন,

– বেটা, ঘর ছাড়ার পর আজ এখানে, কাল সেখানে, এইভাবে লাথ খেতে খেতে কেটে গেল চারটে বছর। কোনও একসময় পৌঁছে গেলাম এলাহাবাদে। তখন শীতকাল, মাঘমাস। প্রতিবছর মাঘমাসে ওখানে একমাস মাঘমেলা হয়। অসংখ্য সাধুসন্ন্যাসীদের সমাগম ঘটে। ওই সময় মেলায় আমি নাথ সম্প্রদায়ের এক যোগী সন্ন্যাসীর নজরে পড়ে গেলাম। আমার জীবনপ্রবাহের ধারা গতিপথ বদলে ছুটল অন্য পথে। বিধিনির্বন্ধ না থাকলে যে এ পথে কোনও মানুষ সহসা আসতে পারে না সে কথা আজ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি।

সাধুবাবা খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন। প্রকৃত ভদ্র যারা তারা খুব আস্তেই কথা বলে থাকেন। অভদ্র ছোটলোকদের চিৎকার করে কথা বলাটাই সহজাত। এখানে ফুলওয়ালি নেপালি মেয়েরা বসে রয়েছে পাশে, তাই প্রাণখুলে কথা বলতে পারছি না। ফট্ করে সাধুবাবার পা দুটো ধরে একটা জায়গা দেখিয়ে বললাম,

– বাবা, ওখানে একটু ফাঁকা আছে। যদি যান তো মন ভরে কথা বলতে পারি।

সাধুবাবা আপত্তি না করে উঠে দাঁড়ালেন। আমি তাঁর ছোট্ট ঝোলাটা কাঁধে নিলাম। এবার ডান হাত দিয়ে তাঁর বাম হাতটা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বসলাম দুটো প্যাগোডা শৈলীর বুদ্ধমন্দিরের সামনে। সাধুবাবা বসলেন, পরে মুখোমুখি হয়ে বসলাম আমি। এতক্ষণে আমার যুত হল। বললাম,

– বাবা, অদ্ভুত গৃহত্যাগ আপনার। এসব কথা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবে না, আপনি কি বলেন?

স্বল্পভাষী সাধুবাবা বললেন,

– হ্যাঁ বেটা, তুই ঠিক বলেছিস। কেউ কল্পনাই করতে পারবে না। ‘তু তো লিখা পড়া হ্যায়। তু জাদা সমঝতা ভি হ্যায়’ তবুও তোকে বলি, প্রতিটা বিষয়, প্রতিটা ক্ষণ জানবি নির্দিষ্ট হয়ে আছে। এই দেখনা তোর জীবনটা। ছোটবেলায় অন্যের বাড়ি থেকে পড়াশুনো…। অত কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিস। আগে তো দুবার ট্রেন-বাসে গুঁতিয়ে এসে পশুপতিনাথজির দর্শন করেছিস। এবার তো ‘আরাম সে বেটা আয়া প্লেন মে’। এসব কি তুই কখনও ভেবেছিস? ভাবিসনি। এটাই বেটা ভগবানের লিখন। তুই ভেবে কিছু করতে পারবি না। পৃথিবীর কোনও মানুষ কোনও দিন কোনও কিছু ভেবে করতে পারে না। তিনি যেটা করানোর, সেটাই সময় মতো তিনি ভাবিয়ে করে দেন, করিয়ে থাকেন। বেটা, কিচ্ছু ভাববি না, তিনিই ভাববেন। তিনিই করিয়ে নেবেন যেটায় তোর ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ হয়।

একটু থামলেন। কথাটা শুনে অবাক হলাম, আমার ফেলে আসা অতীত জীবন সম্পর্কে একটা কথাও জানাইনি। তিনিই গড়গড় করে বলে গেলেন দুঃসহ জীবনকথা। এর আগে নেপালে ট্রেন ও বাসে দুবার আসা আর এবার আসা প্লেনে এসব কথা কিছুই বলিনি। তিনি বলে গেলেন। বুঝে গেলাম সাধুবাবা উচ্চমার্গের মহাত্মা। অতএব ছাড়া নেই। জানতে চাইলাম,

– বাবা, দীক্ষার পর কি করলেন?

হাসিমাখা মুখে প্রশান্তচিত্ত বৃদ্ধ বললেন,

– বেটা, মাঘমেলা শেষ হওয়ার পর গুরুজি আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন গুজরাটে জুনাগড়ের পাহাড়ে এক গুহায়। ওই গুহাই ছিল গুরুজির ডেরা। প্রতিদিন আমাকে শাস্ত্র ও যোগ শিক্ষা দিতেন। দীক্ষার পর টানা পাঁচবছর আমি পাহাড়ের বাইরে লোকালয়ে কোথাও যাইনি। একটা মানুষের মুখও আমি দেখিনি। একটানা পাঁচবছর কাটার পর গুরুজি আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন তীর্থপরিক্রমায়। নাথ সম্প্রদায়ের বিখ্যাত যোগী দাদাগুরুজি গম্ভীরনাথজি। তিনি একসময় নর্মদা পরিক্রমা করেছিলেন। আমাকে নিয়ে সোজা গেলেন অমরকণ্টকে। টানা প্রায় সাড়ে তিনবছর পরিক্রমা করলাম আমি আর গুরুজি। তারপর অমরকণ্টকে ফিরে এলাম বিস্ময়কর অভিজ্ঞতায় ভরা ডালি নিয়ে।

একথা শুনে এখন মনে হল ইনি উচ্চমার্গের যোগী ও পরম সৌভাগ্যবান। গুরুজির সঙ্গে নর্মদা পরিক্রমা করাও বড় ভাগ্যের কথা। যেমন বড় সৌভাগ্যের কথা পুরীতে গুরুর সঙ্গে গোবিন্দ (জগন্নাথ) দর্শন করা। এবার কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য শুরু করলাম,

– গুরুজির সঙ্গে বললেন প্রায় সাড়ে তিনবছর নর্মদা পরিক্রমায় ছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে যেসব দুর্লভ অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেইসব কথা কিছু বলুন না বাবা?

অতিবৃদ্ধ এই সাধুবাবা মালাইচাকিতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,

– বেটা, তখন আমার বয়েস কম। সাধনজগতের রহস্য আমি কিছুই বুঝি না। শুধু অবাক হয়ে দেখেছি গুরুজি আমার কি ভীষণ শক্তিধর মহাপুরুষ ছিলেন। শুনলে তুই অবাক হবি, নর্মদা পরিক্রমাকালীন সাড়ে তিনবছরের মধ্যে অধিকাংশ দিনই আমরা ফল খেয়ে থাকতাম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করতাম, যখন কোথাও বিশ্রাম করে আহার করব বলে গুরুজি মনে করতেন, সেখানে গিয়ে দেখতাম শত শত গাছের মধ্যে মাত্র একটা গাছে অজস্র পাকা সুস্বাদু ফলের ছড়াছড়ি। আহার ও বিশ্রামের পর যখন সেই স্থান পরিত্যাগ করতাম তখন দেখতাম গাছটা আছে তবে একটা ফলও নেই। প্রথম প্রথম কিছু বুঝতাম না। ভাবিনিও কিছু, পরে এ ব্যাপারটা নিয়ে গুরুজিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, ‘বেটা, কুছ শোচনা মত্ ইয়ে ফল নর্মদা মাঈকি কৃপাসে আতা হ্যায়, যাতা ভি হ্যায়।’

একটু থামলেন। একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ডাইনে বায়ে সামনে। হাতটা বুলিয়ে নিলেন কাঁচাপাকা দাড়িতে। আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,

– বেটা, নর্মদা পরিক্রমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা পথটাই আমার জীবনে ছিল বিস্ময় আর অলৌকিকত্বে ভরা। নর্মদা মাঈর করুণা ছাড়া ওই গভীর জঙ্গলে একটা পা-ও কেউ এগোতে পারবে না। বিষধর সাপ, হিংস্র চিতা সামনে দিয়ে চলে গেছে। ফিরেও তাকায়নি। এটা সম্ভব হয়েছে গুরুজির যোগপ্রভাবে। জঙ্গলে প্রবেশের আগে গুরুজি অমরকণ্টকে বলে দিয়েছিলেন, ‘পথে কোনও হিংস্র জীবজন্তু দেখলে তাড়ানোর জন্য যেন মুখ থেকে কোনও শব্দ না করি। যেমন, হ্যাট্‌ হ্যাট্‌ বা ভাগ্‌ ভাগ্‌ ইত্যাদি। তাহলেই বিপদ হবে। বাঁচাতে পারব না।’ সারাটা জঙ্গলে প্রতি পদক্ষেপেই বলতে পারিস নানান বিপদের সামনে পড়েছি কিন্তু গুরুজি আর নর্মদা মাঈর কৃপায় কোনও বিপদই হয়নি। বেটা, আমার মনে হয় অন্য কারও এমন হলে সে কিছুতেই বেঁচে ফিরতে পারত না।

এখন বেলা প্রায় এগারোটা। ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের আনাগোনায় বিরাম নেই। সাধুবাবা মাঝেমধ্যে দেখছেন তাদের যাতায়াত। দেখে বোঝা যায় অধিকাংশই গুহ্যেশ্বরী মন্দিরের যাত্রী। একটু থামার পর বললেন,

– বেটা, আমরা রাতে যেসব ঝুপড়িতে বিশ্রাম করতাম, সেখানে সন্ধ্যার খানিক আগেই পৌঁছতাম। শুনলে তুই অবাক হবি, ঝুপড়িতে গিয়ে দেখতাম দুটো পাতার থালাভর্তি গরম গরম পুরি সবজি মিঠাই। মাটির গ্লাসে নর্মদার ঠাণ্ডা জল। খাবারগুলি সব অত্যন্ত সুস্বাদু। জনমানবহীন গভীর ঘন জঙ্গলে এসব কোথা থেকে আসতো, কে রেখে যেত তা ভেবে পেতাম না। এমনটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সারাটা পরিক্রমা পথেই হয়েছে। গুরুজিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি শুধু একটা কথা বলতেন, ‘গুরুমহারাজ অউর নর্মদামাঈকি কৃপা সে হামলোগকা খানা আতা’। আমি শুধু ভাবতাম কি পদ্ধতিতে এই খাবার এখানে আসছে। অনেক পরে বুঝেছিলাম, গুরুজির মুখেও শুনেছিলাম, এই খাবার গুরুজি আনতেন তাঁর যোগপ্রভাবে।

মনে মনে ভাবলাম, গুরু যখন যোগী তখন তাঁর চেলাও যে যোগী এতে কোনও সন্দেহ নেই তবে এখনই যদি ওই ব্যাপারে কোনও কথা বলি তাহলে সাধুসঙ্গটাই গেঁজিয়ে যাবে। ও প্রসঙ্গে আসব পরে। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, আমরা একটা কথা শুনে থাকি, একদিন অমুকে আমাদের বাড়ি এসেছিল, আমার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তোমার বাচ্চাটা কি সুন্দর দেখতে। তারপর থেকে বাচ্চাটা নানান রোগে ভুগে একেবারে সারা হয়ে গেল। আমার জিজ্ঞাসা, দৃষ্টির কারণে কি এটা হতে পারে বা হয়?

কথাটা শোনামাত্র বৃদ্ধ সাধুবাবা মাথাটা দোলাতে দোলাতে বেশ জোর দিয়েই বললেন,

– হাঁ হাঁ বেটা, হোতা হ্যায়, জরুর হোতা হ্যায়। প্রতিটা মানুষের মধ্যেই শক্তি নিহিত আছে, কারও কম, কারও বেশি। সেই শক্তি শুভ ও অশুভ দুই –ই। সাধন ভজন করা নারীপুরুষের সাধনপ্রভাবে দৃষ্টিশক্তিতে অশুভত্বের প্রভাব অনেক কম থাকে। তাই ক্ষতি কিছু হয় না।

যাদের দৃষ্টিশক্তিতে অশুভত্ব দোষ বেশি তাদের দৃষ্টিতে ক্ষতি কিছু হতেই পারে। এঁকে দৃষ্টিদোষ বলে। এতে শুধু বাচ্চাসন্তান নয়, ফলন্ত গাছ মরে যেতে পারে, গাভীর বাঁটভরা দুধ শুকিয়ে যেতে পারে। রোগগ্রস্ত হয়ে রূপসীর সৌন্দর্য নষ্ট, রান্না করার আগে দৃষ্টি দোষে খাদ্যবস্তুর রান্নার পরে স্বাদ নষ্ট, এমন অসংখ্য বিষয়ে ক্ষতি হতে পারে। এটা যে বেটা দৃষ্টিদানকারী ইচ্ছে করে করছে তা কিন্তু মোটেই নয়। সে নিজেও জানে না তার দৃষ্টিদোষের কথা। আবার শুভদৃষ্টির প্রভাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে মানুষের নিরানন্দ মন ভরে উঠতে পারে অনাস্বাদিত আনন্দে।

একটু থেমে বললেন,

– বেটা, প্রতিটা মানুষ বল বা যে কোনও বস্তু বল, প্রত্যেকের মধ্যেই একটা শক্তি নিহিত আছে এবং সেই শক্তি কোনও না কোনও ভাবে বিচ্ছুরিত হচ্ছে বা ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে আমরা সকলেই যে যার কাছে যাচ্ছি, তার শক্তি নিয়ে আসছি, দিয়েও আসছি, সে শক্তি শুভ বা অশুভ যাই হোকনা কেন! বেটা, দৃষ্টিশক্তির প্রভাবে যেমন মলিনতা সংক্রামিত হতে পারে তেমন এইভাবে মলিনতা আসতে পারে স্পর্শের প্রভাবে, তবে অনেক বেশি শক্তি সংক্রামিত হয়ে থাকে স্পর্শে। যার জন্য তো অনেকে প্রণাম নিতে চায় না। সদগুণ বা প্রবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের স্পর্শে তাঁর ওই গুণগুলিই সংক্রামিত হয়।

সাধুবাবা থামতেই জানতে চাইলাম,

– বাবা, মানুষের দৃষ্টিদোষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়টা বলবেন?

মুচকি হেসে বললেন,

– বেটা, এর কোনও প্রতিকার নেই। যদি কখনও কারও দৃষ্টিদোষ আছে জানতে পারিস তাহলে তাকে যতটা সম্ভব ঘৃণার চোখে না দেখে এড়িয়ে চলবি। এছাড়া আর কোনও ভাবে রক্ষা পাওয়ার পথ আছে বলে আমার জানা নেই। তবে শিশুদের দৃষ্টি দোষের কারণে অসুস্থতার থেকে মুক্তি পেতে ‘কছুয়ার’ (কচ্ছপের) খোলার ছোট্ট একটা চাড়া ফুটো করে কোমরে কিংবা গলায় কালো কার দিয়ে পরিয়ে রাখলে দৃষ্টিদোষ থেকে রক্ষা পাবে।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button