Mythology

ঈশ্বরের অপার করুণায় অপরিচিতা তরুণী হয়ে উঠলেন মাতৃসমা

একটি মেয়ে। সালোয়ার কামিজ পরা। দারুণ গায়ের রং। নিটোল চেহারা। হাসির স্ট্রোকগুলো আমার হৃদপিণ্ডকে যেন দুমড়ে দিচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল।

পথে বেরোলে পথই পথিককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। সে পথ যত কঠিন দুর্গম পথই হোক না কেন। পথ যত বেশি দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল হয়, তত বেশি তার মাহাত্ম্য বা আকর্ষণ বাড়ে নিবেদিত মন তীর্থযাত্রী অথবা ভ্রমণপিয়াসীদের কাছে। যারজন্যই তো দুর্গম স্থানগুলি মানুষের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়, আনন্দময়। এমনও হয়, দূরদূরান্তরের তীর্থগুলি যার পরিক্রমা করা শেষ হয়েছে, দেখা গেল তারই হয়তো কাছের কোনও তীর্থ বাদ পড়ে গেছে।

আবার এটাও দেখেছি, তীর্থ বা ভ্রমণের ব্যাপারে কারও জন্য অপেক্ষা করলে প্রায়শ সেখানে যাওয়া হয়ে ওঠে না। সুযোগ আসামাত্র বেড়িয়ে পড়লে কোনও বাধা আর বাধাই থাকে না। তবে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পরার পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত হাজার ভাবনা অস্থির করে তোলে। বাড়ি ছেড়ে গাড়িতে পা দিলেই ব্যস, সব শেষ। ঠিক কনের প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় যেমনটি হয়। বাবা গো মা গো, হাউ মাউ করে কত কান্না। যেই বরের গাড়ি ছাড়ল-ব্যস, কনে ঠিক।


তার পরের পর্ব আরও সুন্দর। ঘরের চালে ওঠা লকলকে লাউগাছটা গরুতে খেল কিনা, এমন ভাবনা আর বাড়ির টান ধরে ভ্রমণপর্ব ক্রমশ যখন শেষ হয়ে আসতে থাকে। ভাবটা তখন এমন, অনেক হয়েছে বাবা, এবার বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচি। ফেরার পথে ট্রেন ‘লেট’ করলে তো বিরক্তির আর অন্ত নেই।

তখন বয়েস সাতাশ। ভ্রমণ আমার নেশা। তাই ছুটে যাই যখন যে দিকে মন চায়। তেমনভাবে তীর্থের মানসিকতা কোনওকালেই ছিল না, আজও নেই। আর সঙ্গী, আমার সঙ্গী আমিই। আমার একমাত্র আত্মীয় আমিই। তাই কোথাও কোনও অসুবিধে বোধ করিনি। সঙ্গে ছোট্ট একটা ব্যাগ, একটা গামছা আর জামাপ্যান্ট, ব্যস।


এই নিয়েই দাঁড়িয়েছিলাম ফৈজাবাদ স্টেশনে। গতকাল শ্রীরামের জন্মভূমি দর্শন আর সরযূর নির্মল জলে স্নান সেরে স্টেশনে গেছি, তখন আর কোনও ট্রেন নেই। তাই সারাটা রাত পরেছিলাম প্ল্যাটফর্মে। কোনও অসুবিধে হয়নি রাতে।

ট্রেন এসে দাঁড়ালো স্টেশনে। ওঠার উপায় নেই। এত লোক এই দেশে। ভাবতে অবাক লাগে এ ওর ঘাড়ে। সে তার ঘাড়ে যেন যুদ্ধ লেগেছে। আমি একটা মানুষ অথচ উঠতে পারছিনা। যারা লটবহর আর বালবাচ্চা এনেছে, তাদের দেখলে দুঃখ হয়।

ট্রেনের সামনের দিকেই ছিলাম। তাই চেষ্টা না করে এগিয়ে গেলাম পিছন দিকে। একটু থমকে দাঁড়ালাম। এত ভিড়ের মধ্যেও দেখলাম এই কামরা একটু ফাঁকা। অল্পসংখ্যক যাত্রী যারা, তারা সবাই মেয়ে। তাই দাঁড়িয়ে রইলাম। উঠতে সাহস পাচ্ছিনা, ‘লেডিজ’ বলে কথা।

দেখলাম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। সালোয়ার কামিজ পরা। দারুণ গায়ের রং। পাকা গমের মতো। নিটোল চেহারা। বয়েস কত হবে? আন্দাজ চব্বিশ থাকে ছাব্বিশের মধ্যে। কমও হতে পারে, বেশি মোটেই নয়। মুখশ্রী এমন যে কোনও পুরুষেরই ভাল লাগার কথা। অন্তত সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ যদি তার কিছুমাত্র থাকে। আমার তাকানো দেখেই হয়তো আন্দাজ করেছে তাই নিঃসঙ্কোচে বলল,

– আপকা কাহাঁ জানা হ্যায়?

ভাবিনি কথা বলবে। তাই একটু অবাক হলেও চটপট উত্তর দিলাম,

– ম্যায় তো লখনউ জানেবালা হুঁ।

সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটি বলল,

– চলা আইয়ে না মেরে ডিব্বে মে।

এ কথায় বেশ অস্বস্তিতে পড়লাম। সঙ্কোচের ভাব নিয়েই বললাম,

– নেহি নেহি, ইয়ে তো লেডিজ ডিব্বা হ্যায় না, টিকট কালেক্টর আনে সে তো হামকো…

কথাটা শেষ হতে দিল না। আন্তরিকতার সুরে মেয়েটি বলল,

– ও হাম ‘ম্যানেজ’ কর লেঙ্গে। আপ চলা আইয়ে।

আর কিছু ভাবলাম না। ট্রেন ছেড়ে দেবে। উঠে পড়লাম চট করে। ছাড়ল মিনিট কয়েকের মধ্যে। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। নইলে বড় কষ্ট পেতাম। যদিও ওসব কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার আছে। দেখেছি, পথে সহযাত্রীই হয়ে ওঠে পরমাত্মীয়। হৃদ্যতা বাড়ে। আন্তরিকতায় কথা হয়। তারপর এক সময় আসে একে অপরকে ছাড়ার পালা। কিন্তু সহযাত্রী কখনও মুছে যায় না মন থেকে। অজান্তেই সে জায়গা করে বসে যায় মনে। ভোলা যায় না তাকে। কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করা যায় না ভাষায়। ও যে অন্তরের এক আনন্দময় অনুভূতি।

অনেকবারই গেছি হরিদ্বারে। একবারের কথা। উঠেছি দুন এক্সপ্রেসে। বসার জায়গা নিয়ে বাঁধল গোলমাল। কথা কাটাকাটি হল অনেক। ট্রেন ছাড়ল। ঝামেলাও গেল। তারপর ক্রমশ বাড়ল হৃদ্যতা। পরে এমন একটা অবস্থা হল যে, ওরা যা কিছু কেনে তা আমাকে না দিয়ে খায় না। সারাটা পথে একটা পয়সাও খরচ করতে দেয়নি। একের পর এক পার হল অনেক স্টেশন। এল ওদের গন্তব্যস্থল। প্রবাসী ওরা। যখন চলে যায়, তখন দেখি চোখগুলো সব জলে ভরে উঠেছে।

ট্রেন চলেছে সাধারণ গতিতে। ফৈজাবাদ বা অযোধ্যা থেকে লখনউ বেশি দূরে নয়, মাত্র ১৪৮ কিমি। সময় লাগে তিন ঘণ্টা। সোজা কলকাতা থেকে এলে একটা রাত কাটত পথে। দূরত্ব বেড়ে কলকাতা থেকে লখনউ দাঁড়াত ৯৭৯ কিমি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মেয়েটির কথায় মনটা ফিরে এল মেয়েটিতে,

– লখনউতে কি আপনার কোনও আত্মীয় আছে?

মেয়েটি পাঞ্জাবি। কামরায় আর যারা, তাঁরা কেউই বাঙালি নয়। বসেছে আমার পাশে নয়, সামনে। মুখোমুখি হয়ে। আমি বসেছি দেশওয়ালি এক বৃদ্ধার পাশে। এখন আর বসার জায়গা নেই। ফৈজাবাদ থেকে ফাঁকা সিট সব ভরে গেছে তবে দাঁড়িয়ে নেই কেউ। উত্তরে বললাম,

– না না, ওখানে আমার কেউ নেই।

গম্ভীর নয়। হালকা হাসির প্রলেপ মাখানো মুখে মেয়েটি বলল,

– তাহলে?

সাধারণভাবেই বললাম, প্রথম আলাপে মানুষ যেমন ভাবে বলে,

– আসলে ভ্রমণ আমার নেশা। ভাল লাগে। বছরে বেশ কয়েকবারই বেড়িয়ে পড়ি। এবারও তাই বেরিয়েছি। অযোধ্যা হয়ে যাচ্ছি লখনউ। আজ রাতে প্ল্যাটফর্মে কাটাব। সকালে যাব নৈমিষারণ্যে। অবশ্য এর আগে লখনউতে এসেছি তিনবার।

বলেই এবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম,

– আপনি কোথায় থাকেন?

আমাদের এই কথাগুলো শুনছে হাঁ করে সামনে, পাশে বসে আছে যারা। মেয়েটি এক কথায় প্রকাশ করল,

– অমৃতসর।

একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম,

– এদিকে গেছিলেন কোথায়?

হাসিমাখা মুখ, সুন্দর কণ্ঠস্বর। নিচু স্বরেই মেয়েটি বলল,

– বেড়াতে। এলাহাবাদ বিন্ধ্যাচল বেনারস হয়ে এখন বাড়ি ফিরছি।

একটুও দেরি না করে জানতে চাইলাম,

– ফ্যামিলি ট্যুরে বেরিয়েছিলেন বুঝি?

একেবারে সহজভাবে হাসতে হাসতে বলল,

– না না, আমি একাই। আপনার মতো, অনেক ঘুরি।

বলে কি মেয়েটা। পাগল নাকি? এত রূপ আর এই চেহারা নিয়ে একা একা বেরিয়েছে। ঠিক বিশ্বাস হল না। এতক্ষণে খেয়াল করলাম, পাশে এমন কেউ বসে নেই যাকে ওর আত্মীয় বলে মনে হয়। বাঙালি ঘরে এ তো ভাবাই যায় না। ওকে নিয়ে সবে ভাবতে শুরু করেছি। সময় দিল না। আমার ভাবটা বুঝেই জিজ্ঞাসা করল,

– কি ভাবছেন?

পরিস্কার সত্যি কথাটাই বলে ফেললাম,

– কি আর ভাববো। ভাবছি আপনার কথা। একা এইভাবে…

হেসে ফেলল। হাসল বলে শেষ করতে পারলাম না কথাটা। মেয়েটি বেশ সাহসিকতার সুরেই বলল,

– ওসব আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন কোনও অসুবিধে হয় না। ভয় করলে কি আর ভ্রমণ করা যায়।

মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম। মনে মনেই বললাম, তা সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে না কেন বাবা। তবে এর মধ্যে এটুকু বুঝেছি মেয়েটি শিক্ষিতা। প্রখর বুদ্ধি ও মানসিক শক্তিসম্পন্না। একইসঙ্গে মিশুকে। সবচেয়ে বেশি ভাল লাগল ওর সহজভাব, যা চেষ্টা করে আনা যায় না। এ ভাব বিশ্বজননীর বড় দান, যেটা সহজে কেউ পায় না। কথায় কথায় জেনে নিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ আছে। সংসার ভাল লাগে না। একমাত্র নেশা ভ্রমণ। সঙ্গী পেলে তার সঙ্গে, নইলে একা। এবার নামটা জেনে নিলাম। মেয়েটির ডাক নাম পুনম। বললাম,

– বাড়ি পৌঁছতে কাল বিকেল হবে বোধ হয়, তাই না।

মুহুর্ত দেরি না করে উত্তর দিল,

– না না, বাড়ি যাব না, যাব নৈমিষারণ্যে।

চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। বলে কি! একেবারে বিস্মিত হয়ে বললাম,

– তার মানে?

হাসি হাসি মুখে জবাব দিল পুনম,

– মানে, আমিও যাব নৈমিষারণ্যে।

এবার বুকের ভিতরটা একেবারে ধড়াস করে উঠল। শঙ্কিত হয়ে উঠলাম মনে মনে। কি মতলব আছে কে জানে। বাড়ি থেকে পালানো মেয়ে যদি ধরা পড়ে। আমি সঙ্গী, হাজতবাস হবে আমারও। কোনও খারাপ চক্রের মেয়ে হলে কোথায় কিভাবে ফাঁসিয়ে দেবে, ভেবে শিউরে উঠলাম। একে কুমারী মেয়ে, তার ওপরে ভরা যৌবনা। অন্য কোনও বিপদে পড়ব ভেবে একেবারে অস্থির হয়ে উঠলাম। তবুও মনের কথা বুঝতে না দিয়ে বললাম,

– টিকিট তো আপনার অমৃতসর পর্যন্তই কাটা আছে।

– হ্যাঁ, হ্যাঁ, তবে ওতে কিছু যায় আসেনা। সামান্য কিছু টাকা নষ্ট হবে। এই তো, আর কি!

বলেই হাসল একবার প্রাণ খুলে। পুনমের হাসির স্ট্রোকগুলো আমার হৃদপিণ্ডকে যেন দুমড়ে দিচ্ছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল। এমন অবস্থায় এর আগে পড়িনি কখনও। ছেলে হলে তো কোনও কথাই ছিল না। এ যে একেবারে পূর্ণযৌবনা। বুড়িটুড়ি হলে না হয় ঠাকুমা বলে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিতাম হাত ধরে। এর হাত ধরা তো দূরের কথা মুখোমুখি বসেছি তাই জোড়া জোড়া চোখগুলো যেন খোঁচা মেরে তুলে দিতে চাইছে। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে আমার। পুনম বুঝতে পেরেই বলল,

– তুমি ভাবছ আমি তোমার সঙ্গী। উহু, তা হবে না। তুমিই আমার সঙ্গী হয়ে যাবে। আর একটা শর্ত আছে। এখান থেকে যাবতীয় খরচা আমিই করব। কোনও বাধা দেবে না। এখন বাজে চিন্তা ছেড়ে এস সহজভাবে কথা বলি।

এবার আরও বেশি অস্বস্তিতে পড়লাম আমি। মানসিক ক্লেশও বেড়ে গেল আরও। এখন আবার আপনি ছেড়ে তুমি। এ যে একেবারে হিন্দি সিনেমার কাহিনি হতে চলেছে। মানসিক দিক থেকে একটা অসহ্য যন্ত্রণার সৃষ্টি হল। বেশ ভয়ার্ত স্বরে বললাম,

– দেখুন, একসঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি সহজভাবে নিতে পারছি না। কারণ আমার সঙ্গে মাত্র অল্প সময়ের পরিচয়। তাছাড়া আপনি বয়েসে একেবারেই যুবতী। তাতে একা। আমিও যুবক। আপনার সঙ্গে পরিবারের কেউ থাকলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যেত। আগে এরকমভাবে ভ্রমণ করিনি কখনও। এমনিতে আমার কোনও ভয় নেই। ভয়টা হল হুজ্জুতির। তাহলে কথাটা খুলেই বলি। যদি ঘর পালানো মেয়ে হন, পরে পথে যদি কোনও পুলিশ বা অন্য কোনও ঝামেলা আসে তাহলে আমার হয়রানির আর শেষ থাকবে না।

কথাটা শুনে একেবারে হো হো করে হেসে উঠল পুনম। ও যত হাসছে সারাটা দেহ যেন আমার তত বেশি করে অবশ হয়ে যাচ্ছে। কিছুই ঢুকছে না মাথায়। ভাবনার কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি না। মনটা কেমন যেন এক অজানা আতঙ্কে মুষড়ে পড়ছে। কোনও কথা বলতে প্রবৃত্তি হচ্ছে না। ভাবছি কেন মরতে উঠলাম এই কামরায়। মুখের ভাব আর অন্যমনস্কতা দেখে পুনম বলল,

– আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না বুঝি? আচ্ছা, এবার তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। সঙ্গে আমার কেউই নেই। স্টেশনে তুমি দাঁড়িয়েছিলে। আমি তোমাকে নিয়ে এলাম এই কামরায়। তোমাকে বিশ্বাস করেই আমার সঙ্গী করতে চাইছি, এতে ভয়টা তোমার বেশি হওয়া উচিত না আমার? তুমি পুরুষমানুষ, আমি মেয়ে। ক্ষতির ভয়টা তো তোমার চেয়ে অনেক অ-নে-ক বেশি আমারই। আমাকে বিশ্বাস করে, আর তোমার উপর আমার বিশ্বাস, এই নিয়ে চল না, দেখ না কি ক্ষতিটা হয় তোমার!

একটা অসহ্য মানসিক উদ্বিগ্নতা নিয়ে বললাম,

– দেখুন, আপনি…

কথাটা শেষ করতে না দিয়ে পুনম বলল,

– দেখ, তোমার কোনও ক্ষতি করে, তোমাকে বিপদে ফেলে আমার কি লাভটা হবে বলতে পার? যদি ভাবো তোমার কোনও অর্থের লোভে, না, সে কথা তো আগেই বলেছি, পথের সমস্ত খরচা আমি করব। আর বল কিসের লোভে, কি স্বার্থে তোমাকে বিপদে ফেলব? কি ক্ষতি, আর কতটা ক্ষতি তোমার আমি করতে পারি।

কোনও উত্তর দিলাম না। মানসিক ভীতিটাও পারলাম না কাটিয়ে উঠতে। পুনম অনুনয়ের সুরেই বলল,

– যদি প্রশ্ন কর যাচ্ছিলাম বাড়ি, হঠাৎ মত পাল্টে তোমার সঙ্গে যেতে চাইছি কেন? তাই তো! আরে বাবা, তোমাকে দেখেই আমার ভাল লেগেছে। পরে কথা বলে বুঝেছি, তুমি আমার সম-মানসিকতার। তাছাড়া হাতে তেমন কোনও কাজ নেই যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। ভ্রমণ তোমার নেশা, আমারও। দুদিনের সঙ্গ যদি আনন্দ দেয়, তাতে তোমার এত আপত্তির কি আছে? আর তুমি যদি প্রকৃতই ঈশ্বরবিশ্বাসী হও, তাহলে ব্যাপারটা তাঁর ওপরে ছেড়ে দাও না কেন, দেখই না আমার জন্য তোমার কি ক্ষতিটা হয়।

একথা শোনার পর এবার মনের দিকটা কিছুটা সহজ হয়ে এল। কথাগুলো যে অযৌক্তিক নয় তা বুঝলাম। তবুও ভয়টাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারলাম না মন থেকে। কেমন যেন একটা বাধো বাধো ঠেকছে। ভাবলাম, দেখি না শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায়।

লখনউ এসে গেল। দুজনে নেমে এলাম ট্রেন থেকে। ওর হাতে মাঝারি মাপের একটা ব্যাগ। ভিতরে কি আছে কে জানে? মেয়েদের যা থাকে তার চেয়ে বেশি কি আর থাকবে। চুপচাপ চলে এলাম প্ল্যাটফর্মের বাইরে স্টেশনচত্বরে। এতক্ষণ পর এবার শুধু আমার নামটা জিজ্ঞাসা করল পুনম। বাড়ি কোথায়, কি কাজ করি এসব ব্যাপারে কোনও কৌতূহলই প্রকাশ করল না। নিজেও কিছু বললাম না। এখন হাসিমুখে অভিযোগের সুরে বলল,

– তুমি আমার বন্ধু। তোমাতে আমাতে সহজভাব না এলে কথা বলব, পথ চলব কেমন করে? ভয়টা এখনও কাটেনি বুঝি? আমাকে তুমি আর কতক্ষণ আপনি বলবে?

এ কথার কোনও উত্তর দিলাম না। ভাবছি, রাত হয়ে এল। থাকব কোথায় একে নিয়ে। দুশ্চিন্তায় মনটা একেবারে মুষড়ে পড়ল। এবার আর থাকতে না পেরে বললাম,

– পুনম, রাত হয়ে এল। এখান থেকে মিটারগেজে নৈনিতাল এক্সপ্রেস ধরে সীতাপুর, ওখান থেকে বাসে যাওয়া যায় নৈমিষারণ্যে। আবার লখনউ থেকে সকালে বাসে সোজা নৈমিষারণ্যে। ট্রেনে গেলে অনেক রাতে নামতে হবে সীতাপুর। অনুসন্ধান অফিসে গেলে জানতে পারব, সীতাপুর রাত ক’টায় পৌঁছবে। কি করবে?

মিনিটকয়েক কি যেন ভাবল। পরে বলল,

– দেখো, সীতাপুর নামলেও সকালের আগে বাস পাচ্ছি না। সারারাত বসে থাকতে হবে ওখানে। সুতরাং ভোরের বাসেই সোজা চলে যাব এখান থেকে। তুমি কি বল?

সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বললাম,

– আমি তো এখন তোমার সঙ্গী। এবার বল, রাতে থাকার ব্যবস্থা তুমি করবে না আমি?

কথাটা শুনেই হো হো করে হেসে উঠল পুনম। প্রাণের হাজার দুয়ার খোলা হাসি। কোনও উত্তর দিল না। দুজনে এগিয়ে গেলাম রিটায়ারিং রুমের দিকে। অনেক চেষ্টা করলাম। কোনও লাভ হল না। জিজ্ঞাসা করলাম,

– এখন কি করবে, হোটেলে যাবে না আর সব যাত্রীদের মতো স্টেশনে পড়ে থাকবে?

একটুও না ভেবে সহজভাবে বলল,

– যা বলবে তুমি তাতেই আমি রাজি।

হাতের ইশারায় এগোতে বলে মুখে বললাম,

– চল খেয়ে আসি। রাতে প্ল্যাটফর্মেই থাকব।

খুব খুশি হল পুনম। খুশি হলাম আমিও। ভ্রমণ আনন্দময় হয়ে ওঠে সঙ্গীর গুণে, আগেই বলেছি। দুজনে খেয়ে এলাম ক্যান্টিনে। দেখলাম অনেক লোকই বসে আছে প্ল্যাটফর্মের বাইরে। রাস্তায় নয়, স্টেশনচত্বরে। কেউ আধশোয়া হয়ে, কেউ বা লোটাকম্বল নিয়ে পড়ে আছে টানটান হয়ে। তবে সকলেই প্রায় দেশোয়ালি। রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত মাঝেমধ্যে দু-চারটে কথা আবার চুপচাপ, এই করে কাটালাম। তারপর পুনমকে বললাম,

– তুমি শুয়ে পড়, আমি বসে থাকি।

ও তো কিছুতেই রাজি নয়। আমাকে বলে শুতে। ও জেগে থাকবে। কোনও ভদ্রলোকের ছেলে কি এই প্রস্তাবে রাজি হয়? আমিও হলাম না। অনেক অনুরোধের পর রাজি হল পুনম। একটা বেডশিট আর এয়ারপিলো বের করল ব্যাগ থেকে। আমার বেডশিটটাও দিলাম ওকে। গায়ে জড়িয়ে শোয়ার জন্য। শীত নেই, তবুও। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল পুনম আর সব যাত্রীদের মতো। আমার মতো বেশ কিছু যাত্রী বসে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

এদিকে রাত যত বাড়তে থাকল, আমার গা তত এলিয়ে আসতে লাগল। অকাতরে নির্ভয়ে ঘুমোচ্ছে পুনম। এইভাবে রাতটা কেটে গেল। ভোর প্রায় হয়ে এল। একইসঙ্গে বোধ হয় এল পুনমের পরীক্ষা দেয়ার পালা। আর পারছি না বসে থাকতে। পুনমকে ডাকলাম। চট করে উঠে পড়ল। বললাম,

– পুনম, শরীরটা আমার বড্ড খারাপ লাগছে। অসম্ভব শীত করছে। বসতে পারছি না।

পুনম তখন ‘কি হয়েছে’ বলে কপালে হাত দিয়েই বলল,

– আরে ব্বাপ, গা তো তোমার পুড়ে যাচ্ছে শিবশংকর। একটু বস। আমি এখনই আসছি।

বলে চলে গেল হনহন করে। আমি বসে রইলাম। প্রায় ২০-২৫ মিনিট পর ফিরে এল। সকাল হয়ে গেছে। প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে বলল,

– ওঠো ওঠো, সব ব্যবস্থা করে এসেছি, চল।

আমি চললাম ওর সঙ্গী হয়ে। দেখলাম, উদ্বেগে সারা মুখখানা ওর ভরে গেছে। একটা রিকশা করে এলাম কাছের একটা হোটেলে। আমার হাত ধরে নিয়ে গেল ভিতরে। এগিয়ে গেলাম বিবশভাবে। বিছানাটা পাতাই ছিল। তার উপরে পেতে দিল ওর বেডশিটটা। অবসন্ন দেহটা বিছিয়ে দিলাম বিছানায়। পুনম ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল বেশ কিছুক্ষণ পরে সঙ্গে ডাক্তার। দেখলেন বেশ ভাল করে। ওষুধ লিখে দিলেন। প্রয়োজন হলে আবার যেন ডাকে বলে চলে গেলেন। ওষুধও নিয়ে এল। কপালে জলপট্টি দিয়ে পাশে বসে রইল পুনম। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

বেলা তখন প্রায় একটা হবে। ঘুম ভাঙলো। দেখলাম বিছানার পাশে একগাদা ফল আর কিছু মিষ্টি। এরই মধ্যে পুনম স্নান সেরে নিয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে পোশাকের। জিজ্ঞাসা করলাম,

– কিছু খাওয়াদাওয়া করেছ?

পুনম হাতটা আমার মাথায় রেখে বলল,

– না একটু পরে খাব।

ঘরেই খাবার এল। সময়মতো ওষুধ দিতে লাগল আমাকে। একইসঙ্গে পথ্য। বিকেল গড়িয়ে রাত হল। জ্বর কিন্তু কিছুতেই কমল না। সারাটা দেহ কাঁপছে থরথর করে। আবার কখন ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল দেখি রাত দুটো। পুনম বসে আছে মাথার কাছে। বিলি দিচ্ছে চুলে। একফোঁটা ঘুম নেই চোখে। মলিন হয়ে আছে মুখখানা।

পুনমের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল আমার মায়ের কথা। তখন আমার বয়েস পনেরো হবে। সারাটা দেহ ভরে গেছে জলবসন্তে। অসহ্য ব্যথা, যন্ত্রণায় ছটফট করছি। রাতে তখন তন্দ্রা টুটেছে, তখনই দেখেছি মা আমার নিমপাতা বুলিয়ে দিচ্ছে সারাটা দেহে। পুনমের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে জল এল। ঘুমিয়ে পড়লাম।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button