জঙ্গলের পশুরাও শান্ত নীরব, কলিযুগেও প্রাচীন ঋষিদের অনুভব করা যায়
মহামতি ব্যাসদেব একে সিদ্ধ তপোভূমি বলে বর্ণনা করেছেন। ঋষিযুগে এই বনভূমিতে বাস করতেন অষ্টআশি হাজার ঋষি। যেদিকে তাকাই সেদিকেই অসংখ্য রকমের গাছ।
ভোর হতেই পুনম আবার ডাক্তার ডেকে নিয়ে এল। ম্যালেরিয়া। দ্বিতীয় রাতেও একফোঁটা ঘুমাল না পুনম। পর পর চারটে দিন কাটল এইভাবে। অনেকটা সুস্থ বোধ করলাম। পাঁচদিনের দিন আমরা হোটেল ছাড়লাম ভোরে। টাঙ্গায় করে সোজা গেলাম দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ডে। বাস ছাড়ল সকাল সাতটা দশে। যাব নিমষার। উত্তরপ্রদেশে নৈমিষারণ্যের প্রচলিত নাম নিমষার।
পুনম আর আমি বসেছি পাশাপাশি। আজ মুখখানা দেখলাম আগের মতোই। স্বস্তি পেলাম। রেললাইনের পাশে চওড়া রাস্তা। ‘চারবাগ’ পার হয়ে গেল। বাস চলল দ্রুতগতিতে। এক্সপ্রেস বাস। দুপাশে বিশাল বিশাল গাছ। পুনমের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতেই সেই প্রাণখোলা হাসি। যেটা এই কদিন ছিল না। এমন সহজ সরল শিশুর মতো হাসি আগে কখনও দেখিনি। হাসিমাখা মুখের দিকে তাকাতেই মাথাটা আমার নুয়ে এল কৃতজ্ঞতায়। পুনম হাসতে হাসতে বলল,
– দেখো, তুমি আমার বন্ধু। এটুকু তো আমার ‘ডিউটি’। আচ্ছা তুমিই বল, আমার যদি অমন হত তাহলে তুমি কি করতে? আমাকে স্টেশনে ফেলে রেখে পালাতে? আর একটা কথা মনে রেখো, অন্যের কষ্টটাকে নিজের কষ্ট বলে মনে করতে পারলে সাময়িক তোমার কষ্ট হবে। তবে পরে তাতে এক অপূর্ব আনন্দ আছে জানবে।
এ কথার কোনও উত্তর দিলাম না, নেইও। তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে। খানিক পরে বললাম,
– একটা কথা বলব পুনম?
একটু মুচকি হেসে বলল,
– কথা বলবে, এতে আবার অনুমতির দরকার আছে নাকি! একটা কেন, পথ তো এখনও অনেক, অনেক কথাই বলবে যতক্ষণ তোমার সঙ্গে আছি।
এক নজরে দেখে নিলাম মুখখানা। ভাবটা কেমন বোঝার জন্যে। তারপর এই ক’দিন ধরে চেপে রাখা মনের কথাটা এবার সোজাসুজি বলে ফেললাম,
– পুনম তোমার রূপ যৌবন দুটোই আছে। বিয়ের বয়েসও হয়েছে। ভাল এডুকেশন নিয়েছ। দেখে ‘মালুম’ হয় পারিবারিক অবস্থাও বেশ ভাল। বিয়ে না করে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াও কেন? তোমার মতো এইভাবে একা কাউকে ঘুরতে দেখিনি কোথাও। তোমার কথা কাউকে বললে সে তো বিশ্বাসই করবে না। অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেবে। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। যদি কোনও আপত্তি না থাকে তাহলে আমায় বলতে পার।
এই মুহুর্তে এরকম একটা কথা বলব, পুনম তা মোটেই ভাবতে পারেনি। আবার হাসতে লাগল। এ হাসি কথার উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার। কৌশলটা বুঝতে পেরে বললাম,
– হাসি দিয়ে কথা উড়িয়ে দিলে চলবে না। তোমাকে বলতেই হবে।
এই প্রথম দেখলাম, পুনমের মুখের ভাবটা কেমন ধীরে ধীরে বদলে গেল। পূর্ণিমার চাঁদটা মেঘে ঢাকলে যেমন হয়। বেশকয়েক মিনিট তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। পরে তাকাল আমার মুখের দিকে। বলল,
– দেখো, প্রথমেই তোমাকে বলেছিলাম সহজভাবে কথা বলব, তাই বলছি। তবে কৌতূহলটা এই ক’দিন চেপে রাখলে দেখে অবাক হয়েছি। এরজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। তবে আমি জানতাম, তুমি জানতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ চট করে সাধারণ নিয়মের বাইরে যেতে পারে না, অসাধারণ না হলে।
হাসতে হাসতে বললাম,
– তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পর সময়টা পেলাম কোথায়?
এবার শুরু করল পুনম,
– দেখো আমাদের পারিবারিক অবস্থা সত্যিই খুব ভাল। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও অভাব নেই। বাবা ব্যবসায়ী। আমরা দু-বোন, এক ভাই। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। দিল্লিতে থাকে। ভাই হলেও আমার চেয়ে বড়। তারও বিয়ে হয়ে গেছে।
শুরুতেই বাধা। বাসটা এসে ঢুকল একটা গুমটিতে। নেমে এলাম আমরা। বাসযাত্রীরা সকলে। খাওয়া হল চা জলখাবার। পয়সা দিতে গেলাম। ও কিছুতেই দিতে দেবে না। আমিও ছাড়ব না। হোটেল বাসভাড়া আর ডাক্তার ওষুধের খরচা দিয়েছে পুনম। তাই জোর করে দিতে গেলাম। পুনম বেঁকে বসল,
– তুমি যদি খাওয়ার পয়সা দাও তো এখান থেকেই ফিরে যাব আমি। কিছুতেই তুমি আটকাতে পারবে না আমাকে।
আর চেষ্টা করলাম না। পয়সা মিটিয়ে দিল পুনম। এসে বসলাম বাসে। বাস ছাড়ল। পুনমকে আগের কথার খেই ধরিয়ে দিতে বলল,
– জানো, মানুষের জীবন অনেক লম্বা হয় তবে মূল কাহিনি কিন্তু অনেক ছোট। বছরসাতেক আগের কথা। একটা অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ের ঠিক হল আমার। আমাদেরই শহরে। আশীর্বাদ হল যথারীতি। নিমন্ত্রণও করা হল আত্মীয়স্বজন পরিচিতদের।
এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ মাথাটা নিচু করে ডুকরে কেঁদে উঠল পুনম। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম আমি। সামনে পিছনে পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলাম, কেউ দেখছে কিনা। না, কেউ দেখছে না। যে যার ভাব নিয়ে বসে আছে। কোনও কথা বললাম না। ওর কথা শোনার অপেক্ষায় রইলাম। এইভাবে কাটল মিনিট কয়েক। অস্বস্তিটা কেটে উঠতে বলল,
– বিয়ের ঠিক দুদিন আগেই এল এক দুঃসংবাদ। ওদের গাড়ি ছিল। একা চালিয়ে যাচ্ছিল ওর এক বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করতে। ঠিকভাবেই ও চালাচ্ছিল। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা ট্রাক এসে শেষ করে দিল ওকে। চিকিৎসার সুযোগটুকু পর্যন্ত কাউকে দেয়নি।
এটুকু বলে পুনম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। ওর মুখের দিকে চাইতেই জলভরা চোখ দুটো ঘুরিয়ে দিল বাইরের দিকে। ব্যথা উপশমের কোনও ভাষা আমার জানা নেই তাই চুপ করে রইলাম। একটু পরে চোখের জলটা চোখেই মেরে দিল। তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এই ঘটনায় মানসিক দিক থেকে আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। মনে মনে ‘ডিসিশান’ নিলাম জীবনে আর বিয়েই করব না। ঈশ্বরের যখন ইচ্ছা নেই তখন আর সংসার করব না। তাতে যা হয় হবে।
একটু থেমে, ঘড়ির বেল্টটা নখ দিয়ে খুটতে খুটতে বলল,
– বাড়ির সকলে অনেক চেষ্টা করেছে, বুঝিয়েছেও অনেক। কিন্তু ‘না বলেছি তো’ না-ই।
এখন বয়েস কম। জীবনের অনেকগুলো দিন তো পড়ে আছে আগামী দিনের গর্ভে। ভাবলাম, এইভাবে জীবনটা কি কোনওভাবেই কাটানো সম্ভব? জানতে চাইলাম,
– দিনগুলো বাড়িতে তোমার কাটে কেমন করে?
লক্ষ্য করলাম, আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে এসেছে পুনম। মুখের গুমোট ভাবটাও কেটে গেছে অনেক। উত্তরে বলল,
– বাড়িতে আর সব মেয়েদের যেমন কাটে, আমারও কাটে তেমন ভাবে। যখন ভাল লাগে না তখনই বেরিয়ে পড়ি। কারও কোনও আপত্তি শুনি না। প্রথম প্রথম বাবা মা বাধা দিত, এখন আর দেয় না।
হাসতে হাসতে বললাম,
– আমাকে তোমার ভ্রমণসঙ্গী করলে কেন? বিশ্বাসই বা করলে কোন সূত্রে, লম্বা চুল দাড়ি দেখে?
হেসে ফেলল পুনম। হাসি ছাড়া কোনও কথা নেই ওর মুখে। বলল,
– প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে হল, ভিড়ের জন্যে তুমি উঠতে পারছ না। দেখলাম, আমাদের কামরা কিছুটা খালি আছে। একজন এসে যদি বসে তাতে আমার ক্ষতি কি? যেতে তো হবে সকলকে। দাড়ির কথা বলছ, ওটাতে তো গাল ঢাকা থাকে কিন্তু মনটা? আর বিশ্বাস, এটা তো একেবারেই ব্যক্তিগত ও অন্তরের ব্যাপার। কি করে বোঝাই বল তো?
বাস চলছে হইহই করে। অনেক কথা হল। কথা হল এক পুনমেরই। বাস এসে থামল নৈমিষারণ্যে। বেলা প্রায় এগারোটা হবে। যতদূর মনে পড়ে বাসপথে নৈমিষারণ্য লখনউ থেকে ৮৬ কিমি। ট্রেনেও আসা যায়। লখনউ-কাঠগুদাম রেলপথে নামতে হবে সীতাপুর ক্যান্টনমেন্টে। দূরত্ব ৮৯ কিমি। ওখান থেকে বাস যায়, ট্রেনও। সীতাপুর থেকে বালামৌ শাখায় নৈমিষারণ্য ৩৭ কিমি।
এখন কিছু খাওয়া দরকার। পেট ভরে খাওয়ার মতো অনেক খাবারই আছে। তবে হোটেল বলে কিছু নেই। কোথাও ভাত পাওয়া যায় না। অগত্যা দুজনে কচুরি সিঙ্গারা খেয়ে নিলাম পেট ভরে। খাবারের দোকানেই জোগাড় হয়ে গেল গাইড। একদিনে পায়ে হেঁটে সব দেখা যাবে না। কথা হল, আজ যতদূর সম্ভব দেখব, বাকিটা কাল।
চলেছি তিনজন। আমি পুনম আর গাইড। বিশাল গভীর বনভূমি। শান্ত পরিবেশ। কোনও কোলাহল নেই। এমন মনোরম বনভূমি আগে কখনও দেখিনি। অপূর্ব আনন্দময় এক অনুভূতিতে মনটা ভরে যাবে শতরূপা ও মনুর তপস্যাক্ষেত্র নৈমিষারণ্যের মাটিতে পা দিলে। মন মুহুর্তে হয়ে উঠবে ধীর স্থির অচঞ্চল।
নৈমিষারণ্যের যেদিকে তাকাই সেদিকেই অসংখ্য রকমের গাছ। আম, পেয়ারা, হরীতকী, বহেড়া আর নানান গাছে ভরা বনভূমি। কিছু চন্দন গাছ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পরিত্যক্ত যজ্ঞকুণ্ড চোখে পড়ে অরণ্যের মুক্তপ্রাঙ্গণে। ইতস্তত ঘুরছে ময়ূর। বন ভূমির বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে মাঝারি পিচের রাস্তা। এ রাস্তায় দূরত্ব দর্শনীয় স্থান পর্যন্ত, তার বেশি নয়। তবে সমতল নয়, কিছুটা মালভূমির মতো উঁচুনিচু ঢেউ খেলে গেছে। এমন ভ্রমণকারীর সংখ্যা একেবারেই কম। শীতকালে ভিড় বাড়ে। কোনও যানবাহন ঢুকতে দেয়া হয় না এখানে। বিশেষ করে মোটরযান। কাছাকাছি কোনও জনবসতি নেই। বনভূমির সৌন্দর্য রক্ষার জন্যে সরকারি কঠোর ব্যবস্থা আছে।
মহামতি ব্যাসদেব নৈমিষারণ্যকে সিদ্ধ তপোভূমি বলে বর্ণনা করেছেন। ঋষিযুগে এই বনভূমিতে বাস করতেন অষ্টআশি হাজার ঋষি। উগ্রশ্রবা নামে এক ঋষি প্রতিদিন বেদ পাঠ করে শোনাতেন তাঁদের। নৈমিষারণ্য প্রাচীনকালের শুধু নয়, আজও তপোভূমি।
হিন্দুস্তানি গাইড বলতে লাগলেন মহাভারতের কথা। প্রজাপতি মনু নারায়ণকে বললেন, কলিযুগ আসছে, নানা অনাচারে মানুষ লিপ্ত হবে। তখন আমরা, ঋষিরা তপস্যা করব কোথায়? নারায়ণ হাতের চক্র ছেড়ে দিয়ে বললেন, এক নিমেষের মধ্যে চক্র পৃথিবী থেকে ঘুরে আমার হাতে ফিরে আসবে। যেখানে এই চক্র স্পর্শ করবে, সেই স্থানটিই হবে ঋষিদের অনুকূল তপস্যাক্ষেত্র। মনু তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে মুহুর্তে দেখতে পেলেন সুদর্শন নৈমিষারণ্যের মাটি স্পর্শ করে ফিরে এল নারায়ণের হাতে। চক্র যেখানে স্পর্শ করেছিল, নৈমিষারণ্যে সেই ক্ষেত্রটি প্রাচীনকাল থেকে আজও ‘চক্রতীর্থ’ নামে প্রসিদ্ধ।
আমরা তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম সেই চক্রতীর্থে। দেখলাম বাঁধানো একটা গোলাকার কুণ্ড। কিছু তীর্থযাত্রী চক্রাকারে জলের মধ্যে পাক দিচ্ছে। তাদের বিশ্বাস, এইভাবে ঘুরলে জন্মান্তরের পাপ স্খলন হয়। এই কুণ্ডের পাড়ে ভূতনাথ, ললিতাদেবী আর ব্রহ্মামন্দির। ভূতনাথ শিবলিঙ্গের চোখদুটো দেখার মতো অভাবনীয়। এই অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ললিতা। মন্দিরে বিগ্রহটি দশভুজার। এছাড়াও আছে রামসীতা মন্দির। লোকবিশ্বাস, অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় চক্রতীর্থে স্নান করলে সর্ববিধ পাপ ক্ষয় হয়। ওই তিথিতে এখানে যাত্রী সমাগমও হয় বেশি। চক্রতীর্থের মন্দিরগুলি দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম।
পুনম এতক্ষণ চুপ করে ছিল। তবে মন্দিরে গিয়ে প্রণামে কোনও কার্পণ্য ছিল না। কি যেন একটা ভাবছিল। হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল,
– আচ্ছা বিভিন্ন তীর্থ সম্পর্কে যেসব মাহাত্ম্যকথা শোনা যায়, তাতে কি তোমার বিশ্বাস আছে?
প্রশ্নটা ছোট হলেও বড় জটিল, কঠিনও বটে। এখন পুনমের সেই আগের কথাটা ঘুরিয়ে বললাম,
– দেখো পুনম, তোমার কথা তোমাকেই বলি। বিশ্বাসটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও অন্তরের ব্যাপার। তীর্থমাহাত্ম্যর কথা অন্তর যেটুক সহজভাবে বিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে, ততটাই। তার চেয়ে বেশি একবিন্দুও নয়। হিন্দুশাস্ত্রের মধ্যে মিথ্যা কিছু নেই। আন্তরিকভাবেই তা বিশ্বাস করি। তবে যুগ ধর্ম ও কালের প্রভাবে শাস্ত্রের মূল বিষয়গুলো এবং তীর্থক্ষেত্রের মাহাত্ম্যকথা লোকমুখে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত ও অতিরঞ্জিত হতে হতে এমন একটা অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে এসে মানুষ অত্যন্ত সন্দিগ্ধচিত্ত, দিশেহারা। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে। প্রাচীন বিষয়গুলোর গোড়া ধরে যদি গভীরভাবে ভাবা যায়, তাহলে এমন দ্বন্দ্ব আর থাকবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
কথাগুলো বলে তাকালাম পুনমের মুখের দিকে। একথার কোনও উত্তর দিল না। আমরা চলতে চলতে বনের মধ্যে দিয়ে আরও শান্ত নির্জন যে জায়গাটিতে পৌঁছলাম, গাইড বললেন, এর নাম ‘ব্যসগদ্দি’।
কি বিচিত্র অধ্যাত্মভূমি এই ভারতবর্ষ। নৈমিষারণ্যের এমন সুন্দর মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে একেবারে তন্ময় হয়ে যেতে হয়। মন আমার যেন চিন্তাশূন্য হয়ে উঠল, হৃদয় ভরে উঠল এক অপার্থিব আনন্দে। হঠাৎ উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে পুনম বলে উঠল,
– তোমাকে ছেড়ে দিলে আজকে এই পাওয়াটা আমি হারাতাম। কি অপূর্ব পরিবেশ, ভাবাই যায় না, বলো!
কথাটা বলে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে হাসতে লাগল। হাসি হাসি আর হাসি। পুনম যেন জীবনের সমস্ত দুঃখ জয় করবে ওর মন মাতানো হাসি দিয়ে। এ হাসিতে কোনও কৃত্রিমতা নেই। ও যখন শিশুর মতো হাসে, তখন থকথকে কাদার উপর দিয়ে চলে যাওয়া সাপের দাগের মতো আনন্দ আর খুশির ঢেউ খেলতে থাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত। ব্যাসগদ্দির দাওয়ায় ওঠার সিঁড়িতে বসলাম একটু বিশ্রামের জন্যে। গাইড বলল,
– এই যে ছোট্ট মন্দির দেখছেন, মহাভারতীয়যুগে মৃত্যুর প্রাক্কালে রাজা পরীক্ষিতকে ব্যাসপুত্ৰ শুকদেব গোস্বামী বিভিন্ন শাস্ত্রের কূট প্রশ্নের মীমাংসা আর ভাগবত পাঠের পর তার ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছিলেন এখানে। ব্যাসদেবও কিছুকাল বসবাস করেছিলেন নৈমিষারণ্যের এই ক্ষেত্রটিতে। তাই নাম হয়েছে ব্যাসগদ্দি। শিষ্য সুমন্ত্র পৈল, জৈমিনি এবং বৈশম্পায়নকে ব্যাসদেব চারটি বেদ শিক্ষা দেন এখানে। পুরাণ আর ইতিহাস শিক্ষা দেন লোমহর্ষণ মুনিকে। আর এই যে সামনের বিশাল বটগাছটা দেখছেন, এখানে প্রাচীন কালে তপস্যা করেছিলেন ঋষি জৈমিনি। পাশে তারই প্রাচীন যজ্ঞকুণ্ড। মন্দিরে স্থাপিত মূর্তিটি ব্যাসদেবের। পাশের ও দুটি মন্দির সত্যনারায়ণ আর পঞ্চপাণ্ডবের।
দেখলাম, সুবিশাল একটি বটগাছ। অসম্ভব চওড়া। গাছের গোড়াটা বাঁধানো। তবে কোনও বিগ্রহ বা মন্দির নেই। গাছের চারপাশে ঘুরে দেখে যখন এগোতে যাব তখনই পুনম প্রশ্ন করল গাইডকে,
– আচ্ছা ভাইয়া, এই বনভূমিতে কোনও হিংস্র জন্তু জানোয়ার নেই?
মুখে হাসির প্রলেপ মাখিয়ে গাইড বলল,
– দিদি, আমার বাবা এখানে কাজ করেছেন ত্রিশবছর। বাবা মারা যাওয়ার পর কাজ শুরু করি আমি। তাও বছর পনেরো হয়ে গেল। বাবার কাছে কখনও শুনিনি, নিজেও দেখিনি কোনও মানুষকে সাপে কেটেছে কিংবা বাঘে খেয়েছে। তবে জঙ্গলটা তো দেখে বুঝতেই পারছেন ওসব এখানে থাকতে পারে। একটা কথা আছে দিদি, মানুষে মানুষে হিংসা আছে তবে এই অরণ্যে কোনও হিংসা নেই। প্রাচীন ঋষিদের তপোপ্রভাবে এখানকার শান্তি ও আনন্দ বজায় আছে আজও।
আমরা কিন্তু একনাগাড়ে চলছি না। কখনও কোনও গাছতলায়, কখনও বসছি পথের ধারে। বিশ্রাম নিচ্ছি আবার চলছি। কখনও চুপচাপ আবার কখনও কথা এইভাবে। দর্শনীয় জায়গাগুলি একটা থেকে আর একটা বেশ কিছুটা দূরে।
তিনজনে এলাম একটা গুহার মুখের কাছে। দেখলাম মুখটা বন্ধ। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায়, এটা কোনও একসময় গুহা ছিল। বেশবড়। গাইড বলল,
– বাবু, মহাভারতীয়যুগে বারোবছর বনবাসকালে তীর্থভ্রমণ করতে করতে একসময় পঞ্চপাণ্ডব নৈমিষারণ্যে এসেছিলেন দ্রৌপদীকে নিয়ে। কিছুকাল বাস করেছিলেন এই গুহায়। তাই নাম হয়েছে পাণ্ডবগুহা।
এই গুহা দেখে এগিয়ে গেলাম সামান্য ঢেউ খেলানো রাস্তা ধরে। বেশ কিছুটা হেঁটে। যেখানে এলাম, বড় নাটমন্দিরের মতো। এখানে পরপর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মাপ ও উচ্চতায় একহাজার শিবলিঙ্গ। সারাভারতে এইভাবে এক জায়গায় এতগুলি শিবলিঙ্গ থাকতে আগে কখনও দেখিনি কোথাও। প্রতিটা শিবলিঙ্গের নিয়মিত ও নিত্য পুজো হয় এখানে।