একাদশী পালনের ভুলে অধরা থাকে ফল, জানালেন ১৩০ বছরের সন্ন্যাসী
সর্ববিধ পাপ নষ্ট হয় একাদশী ব্রতপালনে। একাদশীদেবী প্রসন্ন হলে ব্যাবহারিক ও পারমার্থিক উভয় কার্যই সিদ্ধ হয় সহজে। এই ব্রত পালন করতে পারে সকলেই।
সারা দিনটা কেটে গেল দেখতে দেখতে। সন্ধে হতে এখনও কিছুটা বাকি। আমি চললাম স্বামী নারদানন্দ আশ্রমের দিকে। গাইডকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই এখানে। ধর্মশালা আছে এক আধটা, তাও অনেকটা দূরে। এই মুহুর্তে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়।
আবার শুরু হল উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা। এখন থাকব কোথায় পুনমকে নিয়ে? উৎকণ্ঠায় গলা বুক শুকিয়ে এল। এখানে বৈষ্ণবদের একটা মঠ আছে। পরমহংস গৌড়ীয় মঠ। আমি জানি দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে ওখানে গেলে এই দুজন যুবক যুবতীকে দেখে। এমনিতেই সঙ্গে পরিবার না থাকলে ভারতের সর্বত্রই থাকতে দিতে চায় না কোনও ধর্মশালায়। ভাবনাটা তাদের অনেক। না বলাই ভাল। সুতরাং অভিজ্ঞতা যখন আছে তখন অযথা ছুটোছুটি করে কোনও লাভ নেই। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধের মুখোমুখি পৌঁছলাম আশ্রমের কাছে। গাইডকে বিদায় দিলাম সকালে আসতে বলে। উৎকণ্ঠা নিয়ে পুনমকে বললাম,
– রাত তো হয়ে এল। এখন থাকবে কোথায়?
একঝলক হাসির সঙ্গে উত্তর দিল,
– কেউ যদি জায়গা না দেয় তো গাছতলায় থাকব।
এরকম হেঁয়ালি কথা আমার মোটেই ভাল লাগল না। বেশ অস্বস্তিকর একটা মানসিক অবস্থা নিয়ে এসে দাঁড়ালাম আশ্রমের গেটে। এখানে অনেক সাধুসন্ন্যাসীর বাস, গাইড আমাদের পথেই বলেছিল। এবার ভয় ও সঙ্কোচের সঙ্গে একজনকে ডেকে বললাম,
– আমরা অযোধ্যা দর্শন করে আসছি। আজ রাতে একটু থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন?
যাঁকে বললাম, পরনে তাঁর গেরুয়া বসন। মাথায় ছোট ছোট জটা। বয়েস আন্দাজ ৩৮-৪০ হবে। অবাক হয়ে কয়েক মিনিট তাকিয়ে রইলেন দুজনের মুখের দিকে। দেখলেন বেশ গভীরভাবে। কি ভাবলেন জানি না। একটু অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন ভিতরে। আবার ফিরে এলেন মিনিটখানেক পরে। একা নয়, সঙ্গে এবার আর একজন সন্ন্যাসী। তিনিও এসে দুজনকে দেখলেন বেশ ভাল করে। পরে বললেন,
– আমাদের আশ্রমে যে ক’টা ঘর আছে তাতে শুধু সন্ন্যাসীরাই থাকেন। বাইরের যাত্রীদের থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই এখানে। অনেক দূর থেকে আসছেন শুনলাম। একটু অপেক্ষা করুন, দেখা যাক কি করা যায়।
আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। উদ্বেগে গলা বুক যেন আরও শুকিয়ে এল। আবছা অন্ধকারে দেখলাম পুনমের মুখখানা। ভাবের তেমন কোনও পরিবর্তন দেখলাম না। এখন উভয়ের মধ্যে কোনও কথা নেই। ওরা দুজনে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন,
– একটা ঘর ছেড়ে দিচ্ছি, আপনারা থাকুন। ও ঘরে যে সন্ন্যাসী থাকেন, তাঁর ব্যবস্থা আমাদের সঙ্গে করে নেব অন্য ঘরে। আসুন।
বলেই ভিতরে ঢুকলেন। আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম। একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললেন,
– এই ঘরটাতে একটু কষ্ট করে থাকুন।
এই পরিস্থিতিতে সন্ন্যাসীদের কাছে কি ভাষায় যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব তা ভেবেই পেলাম না। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। আমার দেখাদেখি পুনমও করল। এই মুর্হুতে শুধু ঈশ্বরের করুণার কথা স্মরণ করে চোখে জল এল। আশ্রয় না পেলে যে কি হত তা একমাত্র তিনিই জানেন।
সারাদিনে আজ এতটুকুও বিশ্রাম পাইনি। পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এ ঘরে আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। পাতা রয়েছে একটা মাদুর। ঘরের এক কোণে ভাঁজ করা একটা বিছানা। আর এক কোণে জলের কুঁজো একটা। দুজনে বসলাম একটু আরাম করে। এতক্ষণ পর নিরুদ্বেগ পুনম বলল,
– কি ভয় কেটেছে তো?
কোনও উত্তর দিলাম না। এর মধ্যে সেই সন্ন্যাসী ঘরে এলেন। বিছানার বোঝাটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন,
– আপনারা তো বোধ হয় কিছু খাননি। যান হাতমুখ ধুয়ে নিন। আমি প্রসাদ এনে দিচ্ছি। বাইরে জল আছে।
বলে বিছানাটা নিয়ে চলে গেলেন। পুনমের মুখের দিকে তাকালাম। দুশ্চিন্তার চিহ্নটুকু নেই। হাতমুখ ধুয়ে এলাম। ফলপ্রসাদ এল। রাতে খাবারের ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়ে গেলেন সন্ন্যাসী। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রাত প্রায় দশটা। সাধুদের সঙ্গেই বসলাম প্রসাদ পেতে, তবে আলাদা সারিতে। তাও কমপক্ষে জনাপনেরো হবে। রুটি আর আলুর তরকারি। আকণ্ঠ খেলাম তৃপ্তি করে। আমাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা জেনে নিয়ে শোবার কথা বলে চলে গেলেন।
সেপ্টেম্বর মাস। ঠান্ডার একটা হাল্কা আমেজ আছে এখন। শোবার প্রস্তুতি নিলাম। পুনম ব্যাগ থেকে বেডশিটটা বের করে মাদুরের ওপর পাতলো। ফুলিয়ে নিল এয়ার পিলোটা। আমিও বের করলাম এয়ার পিলো আর বেডশিটটা। যখন আলাদাভাবে পাততে যাচ্ছি, তখনই বাধা দিল পুনম। ঝট করে বেডশিটটা কেড়ে নিল হাত থেকে। বুকটা কেঁপে উঠল আমার। সারাটা দেহে একটা রোমাঞ্চ আর শিহরণ খেলে গেল বিদ্যুতের মতো, বেডশিটের মধ্যে দিয়ে মনে। পুনমকে স্পর্শ করল কিনা জানিনা। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বালিশটা নিয়ে বিছানায় রাখল পাশাপাশি। তারপর আদেশের সুরেই বলল,
– নাও, শুয়ে পড়ো।
মনটা আমার অস্বস্তিতে ভরে উঠল। এর আগে এমন অবস্থায় পড়িনি কখনও। ভাবছি পুনমের মানসিকতা। একটা অপরিচিত যুবককে এতটা বিশ্বাস, ভাবতেই পারছি না। মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। এখন ওর রূপ যৌবন দেখে মনটা কেমন যেন একটা অব্যক্ত অস্থিরতায় ভরে উঠল। কি করব এখন? চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়লাম। এবার পুনম যা বলল তাতে আমার আর ভাবার কিছু অবকাশ রইল না।
– দেখো, মিলনমুখী হয়ে উত্তেজিত হওয়াটা যেকোনো পুরুষের পক্ষে যতটা সহজ, মেয়েদের প্রকৃতি কিন্তু ঠিক তার বিপরীত। যতই ইন্দ্রিয় সংযত পুরুষ হোক না কেন, এটা জানবে, নারীসঙ্গে অসংযত হওয়াটা অনেকক্ষেত্রে বরং সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এটা মনে রেখো, সংযত নারী, পুরুষ সঙ্গে থাকলেও কখনও অসংযত হবে না। কোনও প্রকারে কোনও নারীকে ছোঁয়াও যাবে না যদি প্রবৃত্তি না থাকে। সংসারে প্রকৃতির এই শক্তি নিয়েই জানবে প্রতিটা নারীর জন্ম।
আর কোনও কথা বললাম না। একটা বেডশিট দুজনে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম অন্তরে একটা অস্বস্তি আর আড়ষ্টভাব নিয়ে। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোর হয়েছে। আশ্রমের সাধুসন্ন্যাসীরা উঠেছেন তারও আগে। পুনম ডাকেনি আমাকে। ও আগেই উঠে গেছে। এমনিতে শরীরটা আমার দুর্বল। তারওপর পথশ্রমও গেছে বেশ। সেইজন্যে হয়তো ডাকেনি। যথারীতি প্রস্তুত হয়ে নিলাম। গাইড কিন্তু ভোরেই এসে হাজির। আজকে এখানে থাকার কথা জানিয়ে অনুরোধ করলাম সন্ন্যাসীকে। রাজি হয়ে দুপুরে প্রসাদ পেতে বললেন। আমরা বেড়িয়ে পড়লাম তিনজনে।
প্রথমে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম ঘুরে গেলাম পরমহংস গৌড়ীয় মঠে। এ দুটোই কাছাকাছি। তারপর এগিয়ে গেলাম একটা পাহাড়ি টিলার মতো জায়গায়। বেশ বড় একটা মন্দির রয়েছে এখানে। কিছু সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম মন্দিরে। হনুমান গড়ি। বিশাল হনুমানের সিঁদুর রাঙানো মূর্তি। প্রবাদ আছে, অহিরাবণকে বধ করে রামলক্ষ্মণকে কাঁধে হনুমান এখানে এসে প্রথম বিশ্রাম করেন।
মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে দেখা যায় দূরে, শান্ত স্নিগ্ধ চোখ জুড়নো গভীর অরণ্যময় নৈমিষারণ্যের বুক চিরে বয়ে গেছে গোমতী। এ নদীর পৌরাণিক নাম ধেনুমতী। বন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গোমতীর সরু জলরেখা এই টিলা খেকে যে কেমন দেখায় তা না দেখলে ভাষায় বোঝায় কার সাধ্যি। এখান খেকে গেলাম নৈমিষা আশ্রমে। পুরাণের কালে নৈমিষাঋষি তপস্যা করেছিলেন এখানে। অনেক সাধু সন্ন্যাসীরা বাস করেন এই আশ্রমে।
আমরা নেমে এলাম একটু সমতলে। গাইডের কথামতো ভাড়া করলাম একটা ভ্যান রিকশা। বসলাম তিনজনে। যাব দধীচি আশ্রমে। যেতে হবে বেশ কিছুটা পথ। চক্রতীর্থ থেকে প্রায় ৯ কিমি।
আজ পুনমকে যেন আরও বেশি প্রাণবন্ত লাগছে। ভোরে উঠে ও স্নান সেরে নিয়েছে। আমি করিনি। মনের দিক থেকে অনেক অ-নে-ক সহজ হয়ে গেছি। আগের মতো ভীতি আর জড়তা নেই। পুনম বসে আছে আমার পাশে। চলেছি বনের মধ্যে দিয়ে পাকা রাস্তা ধরে। জিজ্ঞাসা করলাম পুনমকে,
– কি ভাবছ অত?
হাসিমুখে উত্তর দিল,
– ভাবছি তোমার কথা। আজ কয়েকটা দিন ধরে আমাকে নিয়ে তোমার মনে কত দ্বন্দ্ব কত সংশ্রয় সন্দেহ। এখন তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মন ভাল আছে।
এ কথার উত্তর আমি যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারতাম। তবে সে চেষ্টা না করেই বললাম,
– আজকের রাতটুকুই শুধু তোমার সঙ্গে আছি। তারপর…
মুহুর্তে পুনম আমার মুখের উপর ওর ডানহাতটা চেপে ধরল। শেষ করতে দিল না কথাটা। একটু অভিমানের সুরে বলল,
– পরের কথা পরে ভেবো। এখন নয়।
কথাটুকু শেষ হতে দেখলাম মুখখানা মলিন হয়ে গেল। আর কোনও কথা বললাম না। ঘণ্টাখানেক পর এলাম দধীচি আশ্রমে। স্থানীয় লোকেরা বলে মিশ্রক তীর্থ বা মিশ্রী তীরথ্। বিশাল একটা দীঘি। দধীচি কুণ্ড। এরই তীরে স্মারক মন্দিরটি দধীচি মুনির।
বহুশ্রুত কাহিনি, দেবতারা উৎপীড়িত ও স্বর্গচ্যুত হলেন বৃত্রাসুরের অত্যাচারে। পরে জানতে পারলেন, এক মাত্র দধীচির অস্থি দিয়ে নির্মিত বজ্র অস্ত্র দিয়ে বৃত্রাসুরকে নিধন করা সম্ভব। তখন দেবতারা গেলেন দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে। বৃত্রাসুরকে বধ করার জন্য ইন্দ্র এসে অস্থি প্রার্থনা করলেন দধীচির কাছে। উদারচেতা মুনি দধীচি। দেবতাদের কল্যাণার্থে দিলেন প্রাণ বিসর্জন।
বিশাল কুণ্ড দেখিয়ে গাইড বলল,
– বৃত্রাসুরকে বধের জন্য পুরাণের কালে এই ক্ষেত্রটিতে দেহত্যাগ করেছিলেন দধীচি। এটি তাঁর তপস্যাক্ষেত্রও বটে।
মন্দিরের বেদিতে পাথরের সুদর্শন দধীচিমূর্তি। মনোরম আশ্রমের পরিবেশ। স্থানীয় কয়েকজন ছাড়া আর কোনও যাত্রীকে দেখলাম না। মন্দিরের চারপাশে পড়ে আছে বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ। এই আশ্রমে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা আবার উঠলাম ভ্যান রিকশায়। ফিরে এলাম স্বামী নারদানন্দ আশ্রমে।
ওই কথাটা বলার পর থেকে পুনম কেমন যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেছে। কথা না বললে কোনও কথা বলছে না। তাই বললাম,
– পুনম, আমি কি কথায় তোমাকে কোনওভাবে আঘাত করে ফেলেছি? যদি করে থাকি…
কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলল,
– তোমার একটা দোষ আছে। পরে কি হবে, কি করবে, এসব কথা আগে ভেবে নিজে যেমন কষ্ট পাও, তেমনই অন্যের মানসিক কষ্টের শেষ থাকে না।
অন্যায় কিছু বলেনি বুঝে চুপ করে রইলাম। গাইডকে পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিল পুনম। আরও বেশি কিছু দিল। গাইড তো খুব বেশি। হাতজোড় করে নমস্কার জানাল। আমরাও ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
স্নান সেরে ফেললাম। এখন বেলা প্রায় একটা। পুনম আর আমি বসে গেলাম সাধুদের সঙ্গে প্রসাদ পেতে, তবে এক সারিতে নয়। আগের রাতের মতো আসনটা একটু আলাদাভাবে পাতা। জলের গ্লাস আর পাতা দিয়ে গেলেন একজন সন্ন্যাসী। আশ্রমের অন্য সকলে বসেছেন নিজেদের থালা নিয়ে। প্রসাদ এল শুধু মশলা দিয়ে মাখা কচুরমুখি সিদ্ধ আর নারকেল দিয়ে সাবুর পায়েস। অপূর্ব স্বাদ। আমরা দুজনে প্রসাদ পেলাম পরিতৃপ্তির সঙ্গে। সন্ন্যাসীদের একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম আজ একাদশী তিথি। তাই আশ্রমে অন্নগ্রহণ নিষিদ্ধ।
একটু বিশ্রামের পর গেলাম নির্লিপ্ত সন্ন্যাসী কুমারব্রহ্মচারী স্বামী নারদানন্দ তীর্থের ঘরে। ছোট ঘর। আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। পুরনো আমলের সাধারণ চার পায়া একটা খাট। তার উপরে ভিখিরি ঘরের কাঁথা যেমন, তাই-ই পাতা একটা। নেতানো বালিশ। একটু নিচু পায়াছোট খাটের উপরে বসে আছেন তিনি।
স্বামীজি এখন অসুস্থ। মাথায় জটা নেই। গায়ের রং বেশ ময়লা। ছোট ছোট চুল। শীর্ণ চেহারা। দেখলে মনেই হয় না সন্ন্যাসী। বয়েসের ভারে একেবারে নুয়ে পড়েছেন সামনের দিকে। সন্ন্যাসী শিষ্যরা তাঁর সেবা করেন। তেমন হাঁটাচলা করতে পারেন না। এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। একটু আগে প্রসাদ পেয়ছেন। স্বামীজির বয়েস ১৩০ বছর। আমি আর পুনম নিচে মেঝেতে বসলাম প্রণাম করে। আমাদের মুখের দিকে তাকালেন স্বামীজি। কোনও কথা বললেন না। এইভাবে বসে রইলাম মিনিটপনেরো। আমিই প্রথম কথা শুরু করলাম,
– বাবা, যদি অনুমতি দেন তো একটা কথা বলি।
সম্মতি দিলেন ঘাড় নেড়ে। মুখে হাসি নেই, তবে গম্ভীরও নয়। প্রসন্ন মুখমণ্ডল। বললাম,
– আজ তো একাদশী ব্রতপালন হচ্ছে আশ্রমে। দয়া করে বলবেন, এই ব্রতপালন করা হয় কেন, এর ফলই বা কি?
কথাটা শুনে কোনও কথা বললেন না প্রায় মিনিটপাঁচেক। তারপর অতি ধীরে ধীরে একজন খুব অসুস্থ মানুষ যেভাবে, যে সুরে, যেমন করে কথা বলেন তেমন করেই বললেন,
– বেটা, দেহাদির বিষয় অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয়গণ। ইন্দ্রিয়গণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মন। আবার মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। যিনি বুদ্ধি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ – তিনিই আত্মা। মূল কথাটি হচ্ছে,আত্মিক উন্নতিকল্পে ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত বা জয় করার জন্যেই করা হয় একাদশী ব্রতপালন।
একটু চুপ করে রইলেন। আমরা কোনও কথা বললাম না। অপেক্ষায় রইলাম পরের কথা শোনার জন্যে। মিনিট কয়েক পর বললেন,
– মানুষের একাদশ ইন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যিনি, তিনিই হলেন একাদশীদেবী। দেবীর নাম অনুসারে হয়েছে তিথির নাম। একাদশী ব্রতপালনে একাদশ ইন্দ্রিয় সংযম হয়।
কথাটা শেষ হতে জিজ্ঞাসা করালাম,
– বাবা, একাদশ ইন্দ্রিয় বলতে?
স্বামী নারদানন্দ তীর্থ বললেন,
– বাচ্চা, কর্মেন্দ্রিয় পাঁচটি – বাক, হাত, পা, পায়ু ও উপস্থ। আর পাঁচটি হল জ্ঞানেন্দ্রিয় – চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক। এই দশটি ছাড়াও আছে আরও একটি – অন্তরিন্দ্রিয় মন। এই নিয়েই একাদশ ইন্দ্রিয়, যা দিয়ে গঠিত আমাদের পাঞ্চভৌতিক দেহ। আর রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ – এই পাঁচটি হল জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বিষয়মাত্র। তবে মনের সবটাই ইন্দ্রিয় নয়। মনের যে অংশ জ্ঞান ও কর্মেন্দ্রিয়াভিমুখী, তাই-ই ইন্দ্রিয়, আবার অন্যদশ ইন্দ্রিয়ের কর্তাও। কিন্তু মনের যে অংশ বুদ্ধি বা মহত্ত্বত্বের অভিমুখী, তাকে ইন্দ্রিয় বলা যাবে না। সেই অংশে চৈতন্যের প্রকাশ।
এই পর্যন্ত বলে থামতেই প্রশ্ন করলাম,
– একাদশী ব্রতপালনের নিয়মটা কি?
অতিবৃদ্ধ স্বামীজি একটু বিশ্রাম নিয়ে পরে বললেন,
– শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষের একাদশী তিথিতে ভোজন একেবারেই নিষিদ্ধ। জল পর্যন্ত গ্রহণ করা চলবে না। তবে কলিযুগে উপবাস নিষিদ্ধ। তাই অন্ন ছাড়া আর যা কিছু নিরামিষ, তা গ্রহণ করা চলে। অন্ন বলতে চাল ডাল আটা ময়দা ও সুজিকে স্মৃতিশাস্ত্রে বলা হয়েছে অন্ন। এর কোনওটি গ্রহণ করলে একাদশী ব্রত ভঙ্গ হয়। কোনও ফল হয় না।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– ফল বলতে?
আবার স্বামীজি বিশ্রাম নিলেন কিছুক্ষণ। পরে বললেন,
– সমস্ত তীর্থদর্শনে যে ফল, তা পাওয়া যায় নিরম্বু একাদশীর উপবাসে। সর্ববিধ পাপ বিনষ্ট হয় শুধু একাদশী ব্রতপালনে। একাদশীদেবী প্রসন্ন হলে ব্যাবহারিক ও পারমার্থিক উভয় কার্যই সিদ্ধ হয় সহজে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে নারীপুরুষ কুমারী সধবা বিধবা এই ব্রত পালন করতে পারে সকলে।
কথাটা শুনে পরিচিত অনেকের কথাই মনে পরে গেল। মনেমনে হাসলাম। হাসতে হাসতে বললাম,
– বাবা, একাদশীর দিন বাংলার ঘরে ঘরে প্রায়ই দেখি রুটি লুচি পরোটা খেতে। এতে কি তাদের কোনও কল্যাণ হয়?
কথাটা শুনে মুচকি হাসলেন। কোনও উত্তর দিলেন না। এতক্ষণ পর এবার আমাদের দুজনের পরিচয় জানতে চাইলেন স্বামীজি। পুনমের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থেকে শুরু করে নৈমিষারণ্য পর্যন্ত আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনার কথা জানালাম। কথাগুলো শুনে বৃদ্ধ স্বামীজি মাথাটা হাল্কা দুলিয়ে হাসতে লাগলেন আপন মনে। এ হাসির রহস্য ভেদ করতে পারলাম না।
পুনম অবাক হয়ে শুনছে আমাদের কথা। চোখ মুখের ভাবটা দেখে বুঝলাম, ঈশ্বরে গভীর বিশ্বাসী হলেও আমার পাল্লায় পড়ে ওর সাধুসঙ্গ হল এই প্রথম। এবার স্বামীজির হাসির কারণ আর মনে ওঠা একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা…
হাতের ইশারায় কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন,
– মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই ‘লেড়কি’র সঙ্গে তোর যোগাযোগটা কেন হল, কি জন্যে হল, তাই তো?
কথাটা শোনামাত্র পুনম আমার, আমি পুনমের দিকে তাকালাম। পরে হাতজোড় করে বললাম,
– হাঁ বাবা, আপনি ঠিকই বলেছেন। এ প্রশ্নের কি কোনও উত্তর আছে?
সর্বত্যাগী এই সন্ন্যাসী এবার পাশ থেকে একটা বালিশ টেনে রাখলেন কোলের মধ্যে। কনুইদুটো বালিশে ভর দিয়ে বললেন,
– বাচ্চা, আজ কয়েকদিন হল শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।
বলে চুপ করে বসে রইলেন। বুঝলাম বিশ্রাম নিচ্ছেন। কথা বলে বিরক্ত করলাম না। চেয়ে রইলাম মুখের দিকে। তিনি বললেন,
– এই বিশ্বসংসারে যা কিছু ঘটছে, যা কিছু ঘটেছে আর যা কিছু ঘটবে জানবি তারমধ্যে কোনও না কোনও কারণ একটা আছেই। তবে কিছু কারণের উত্তর আমরা খুঁজে পাই আর কিছুর পাই না। যেটার পাই না, জানবি সেটার কোনও উত্তর আছে, তবে পাই না।
আবার একটু বিশ্রাম নিলেন। আমরা দুজনে স্থির হয়ে বসে রইলাম। স্বামীজি বললেন,
– বেটা, জন্ম-জন্মান্তরের কোনও সম্পর্ক, পূর্বজীবনের কোনও যোগাযোগ সূত্র না থাকলে এ জীবনে কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ হবার নয়। প্রতিদিন তুই যার সঙ্গে কথা বলছিস, যাকে দেখছিস, যার পাশে বসছিস, একেবারে সত্য জানবি, কোনও না কোনও জীবনে, কোনও না কোনও সম্পর্ক ছিলই। তবে তারমধ্যে কাউকে দেখলে যদি ভাল লাগে, বুঝবি তার সঙ্গে প্রীতির কোনও সম্পর্ক ছিল পূর্বজীবনে। আর কাউকে দেখে ভাল না লাগলে, কথা বলতে প্রবৃত্তি না হলে বুঝবি, সম্পর্ক একটা ছিল, তবে সেটা সুসম্পর্ক নয়। একথা শুধু তোর ক্ষেত্রে নয়, মানুষ পশু পাখি জীবজগতে সকলের ক্ষেত্রেই সত্য। তবে এই যোগাযোগটা ঠিক ঠিক সময়ে নিয়মমাফিক প্রকৃতিই করিয়ে দেন তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে।
কথা বলছিলেন মাথা নিচু করে। এবার দুজনের দিকে এক নজর দেখে নিলেন। পকেটে আমার বিড়ি আছে। ধরাতে ঠিক সাহস পেলাম না স্বামীজির বার্ধক্য ও পরিবেশের কথা ভেবে। একটু বিশ্রামের পর বললেন,
– এবার আসি তোদের কথায়। তোরা দুজনেই অপরিচিত দুজনের কাছে। তুই থাকিস পাঞ্জাবে আর তুই কলকাতায়। হঠাৎ কেন এমন যোগাযোগটা হল? (পুনমকে লক্ষ্য করে) তোরই বা ওকে ভাল লাগল কেন? এত বিশ্বাসই বা করলি কেন? স্টেশনে তো অনেক লোকই ছিল, তাই না? বেটা মনে রাখিস, কার্য ও কারণ ভেদে প্রকৃতিরই এই যোগাযোগের খেলা। যেমন ধর হঠাৎ যোগাযোগে কারও কোনও ক্ষতি হল, বুঝতে হবে তার কোনও না কোনও জন্মের ঋণ মুক্তি হল।
আবার বিশ্রাম নিলেন। আমরা বসে রইলাম শান্তভাবে স্থির হয়ে। এবার মুখটা তুলে দুজনের দিকে একবার দেখে নিয়ে তিনি বললেন,
– তোদের সমস্ত কথা শুনে যা মনে হয়েছে, তাতে আমার জ্ঞানে বলে, তোদের মধ্যে এটা কোনও স্বার্থের যোগাযোগ নয়। সম্পূর্ণই মনের ও দর্শনের। কোনও না কোনও জন্মে তোদের মধ্যে স্বামী স্ত্রী, মা সন্তান, ভাই বোন, প্রেমিক প্রেমিকা বা অন্য কোনও যোগাযোগে অত্যন্ত মধুর কোনও সম্পর্ক ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রকৃতির কোনও খেলায় সেই সম্পর্কে ছেদ পড়ে। মৃত্যুকালীন তীব্রভাবে কিছু কথা বলা বা দেখার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল, এমনও হতে পারে। আবার এও হতে পারে, ওই বিচ্ছেদের পরও উভয়ে উভয়কে কাছে পাওয়া, কথা বলা বা দেখার বাসনা চলেছিল তীব্রভাবে কিন্তু প্রকৃতির ইচ্ছায় তা পূরণ হয়নি। জন্মান্তরের সেই বাসনা সংসার সঙ্গে করে এনেছিল। প্রকৃতি তাঁর সময় মতো যোগাযোগ ঘটিয়ে তা আবার মিটিয়ে দিলেন। মিলনের কোনও বাসনা ছিল না, তা থাকলে যোগাযোগটা প্রকৃতি অন্যভাবে করিয়ে দিতেন। আরও একটা কথা আছে বেটা, এটা না ঘটিয়ে দেয়া পর্যন্ত প্রকৃতিও এতদিন তোদের কাছে ঋণী ছিলেন। যোগাযোগটা ঘটিয়ে দিয়ে এবার তিনি নিজেও ঋণমুক্ত হলেন।
একথায় পুনম আমার, আমি তাকালাম পুনমের মুখের দিকে। কোনও কথা হল না। স্বামীজি অসুস্থ তাই আর বিরক্ত করলাম না। অতীতজীবন সম্পর্কেও কোনও প্রশ্ন করতেও মন চাইল না। এতক্ষণ যে দয়া করে এত কথা বলেছেন তার জন্যে আমি ধন্য হলাম। এই কথাটুকুতেই কেটে গেল কয়েক ঘণ্টা। শেষ প্রশ্ন করলাম,
– ইতনা সাল বীত গয়া বাবা, লেকিন আপকা কুছ মিলা?
স্বামীজি চুপ করে রইলেন। এমন কথায় অবাক হলেন বলেও বোধ হল না। তবে লক্ষ্য করলাম, ভাবের কেমন যেন একটা পরিবর্তন হল মুখমণ্ডলে, ধীরে ধীরে যেন নেমে এল একটা পরম তৃপ্তির ভাব। এ ভাব পার্থিব কোনও বস্তুপ্রাপ্তির নয়। আমরা বসেই রইলাম কিন্তু কোনও উত্তর নেই। এইভাবে কেটে গেল পাক্কা সাতাশ মিনিট। এবার প্রশান্ত গভীরকণ্ঠে স্বামীজি বললেন,
– বেটা, ইস জীবন সে মুঝকো মিলনে কা অউর কুছ বাকি নেহি।
শেষ প্রশ্নের শেষ কথাটা শুনলাম। আর কোনও কথা নয়। প্রণাম করলাম স্বামীজিকে। বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। স্বামীজির কথাগুলোই শুধু ভাবছি। পুনমের মুখের দিকে তাকালাম। দেখে মনে হল, ও নিজেও যেন কিছু একটা ভাবছে। তবুও ওর ভাবনায় ছেদ টেনে বললাম,
– কি ভাবছ অত? চলো আশ্রমটা ঘুরে দেখি। এখন আর আশ্রম ছেড়ে কোথাও যাব না। সন্ধ্যে তো হয়েই এল।
পুনম আমার পাশাপাশি চলছে অতি ধীরে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল শান্ত মধুরকণ্ঠে। মনে হল গলাটা যেন একটু ধরে এসেছে,
– আচ্ছা, সাধুবাবা আমাদের সম্পর্কে যা বললেন, এসব কথা কি ঠিক?
পুনমের কথাটা শুনে মনটা আমারও কেমন যেন লাগল। তবুও হাসিমুখে বললাম,
– আমি ষোলোআনাই বিশ্বাস করি। এবার তোমার বিশ্বাস তোমার কাছে।
আর কোনও কথা হল না। মৌনভাবেই ঘুরছি। স্বামীজির কথাগুলো শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতর। ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নেমে এল। দুজনে ঘরে এসে বসলাম। দেখলাম, কেমন যেন একটা ব্যথার ছাপ ফুটে উঠেছে পুনমের চোখেমুখে। মুখেও কোনও কথা নেই দেখে বললাম,
– স্বামীজির কাছে তোমাকে নিয়ে গিয়ে কি কোনও অপরাধ করেছি? তুমি যে কোনও কথা বলছ না।
পুনম একটু প্রতিবাদের সুরেই বলে উঠল,
– না না, এসব তুমি কি বলছ! তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। জীবনে এইভাবে কখনও কোনও সাধুর কথা শুনিনি আমি। তোমার জন্যেই তো আজ তা সম্ভব হল। প্রকৃতির অন্তর্নিহিত অজস্র রহস্যের একটা দিক আমার কাছে আজ খুলে গেল। তোমার কাছে এই ঋণ কোনওদিন শোধ হবার নয়।
দেখলাম পুনমের চোখদুটো ছলছল করছে। চোখাচোখি হতেই মুখটা ঘুরিয়ে নিল। ধীরে ধীরে রাত বাড়ল। যথাসময়ে প্রসাদ পেলাম সন্ন্যাসীদের সঙ্গে। এই রাতটাও কাটালাম ঠিক আগের রাতের মতো।
সকাল হল। স্নান সেরে গুছিয়ে নিলাম। স্বামী নারদানন্দ তীর্থকে প্রথমে প্রণাম করলাম। প্রণাম করলাম আশ্রমের আরও সব সন্ন্যাসীদের। অন্তরের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আশ্রম থেকে। দেখতে দেখতে দুটো রাত কেটে গেল নৈমিষারণ্যে। রাত মাত্র দুটো, কিন্তু স্মৃতি হয়ে রইল যতদিন বেঁচে থাকব।
বাস ছাড়ল। চুপ করে বসে আছি। পাশাপাশি। বাস এগিয়ে চলল। আবার এল সেই গুমটিতে। পুনম কিছু খেতে চাইল না। আমি খেলাম। জোর করেই ওকে খাওয়ালাম। দেখলাম, দেবীপ্রতিমার মতো মুখখানা ওর কেমন যেন কালো মেঘে ঢেকে রয়েছে।
বাস চলল হু-হু করে। আগেও তো বাসে চড়েছি। কই, এমন গতিতে তো চলতে দেখিনি কখনও। পথের দূরত্ব কমানোর জন্য বাসটা যেন উঠেপড়ে লেগেছে। গতি যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পুনমের সঙ্গে যেন কিছুতেই থাকতে দেবে না। ভাবছি, বাসটা যদি খারাপ হয়ে যেত তাহলে দারুণ হত। আবার যদি ম্যালেরিয়াটা ঘুরে আসত ভাল হত। যে কোনও ভাবে যদি অসুস্থ হয়ে পড়তাম, এমন আরও কত কি, হাজার কথা…
কারও মুখে কোনও কথা নেই আসন্ন নিশ্চিত বিচ্ছেদের কথা ভেবে। লখনউ যত এগিয়ে আসছে, পথের দূরত্ব যত কমছে, পুনম যেন আরও তত বেশি মনের কাছাকাছি আসছে, ভাবনার পরিব্যাপ্তি বাড়ছে তত। পুনম ‘যখন’ কাছে ছিল, ভাবনাটাও আমার, ও তো কাছেই আছে। সময় যত কমে আসছে, হারানোর ভয় তত বাড়ছে।
লখনউ এলাম। দুজনে কিছু খাবার খেলাম। পুনম একেবারে না খাওয়ারই মতো। পুনমের মুখে সেই প্রাণ উজাড় করা হাসি আর নেই। দুজনে নিঃশব্দ। তবুও যেন কত কথা হয়ে গেল।
টিকিট কাউন্টারে গেলাম। টাকা বের করেছি। পুনম মুখে কিছু বলল না। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়েই বাধা দিল। কিছু বলার নেই। নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম। দুটো টিকিট কাটল। একটা নিজের ব্যাগে রেখে দিয়ে আর একটা দিল আমার হাতে। দেখলাম – হাওড়া।
কোনও কথা আর হল না। যথাসময়ে ট্রেন এল। একটা কামরায় তুলে দিলাম। পুনম ভিতরে ঢুকল না। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইল। দেখলাম, চোখ দুটো ওর জলে ভরে গেল।
ট্রেন ছাড়ল। ধীরে ধীরে চলছে। দেখছি পুনমকে। সামান্য একটু সময়। ট্রেনের গতি আরও বাড়ল। পুনমকে আর দেখতে পাচ্ছি না। দেখছি ট্রেনটাকে। ক্রমশ আরও সরে যাচ্ছে। দেখার চেষ্টা করছি আ-র-ও। ট্রেনটাই যেন পুনমময় হয়ে উঠল। একাই দাঁড়িয়ে রইলাম। যেমন দাঁড়িয়ে ছিলাম ফৈজাবাদ স্টেশনে।
Punam devi to sanyasini
অনেক আছে একাদশী আগে করে , আবার অনেকেই আছে একাদশী এক দিন পরে করে,, শাস্ত্রে এর উপযুক্ত ব্যাখ্যা কি