সমাজে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠার একমাত্র পথ জানালেন সাধুবাবা
জগতের সবকিছুই নিয়মের অধীন। তার বাইরে চললে কোনও কাজ হবে না। দেহে ফুটে ওঠে একটা অসাধারণ উজ্জ্বল ভাব। সে লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সুদামাপুরী মন্দিরের সামনে বিশাল ফাঁকা প্রাঙ্গণটা হাঁ করে পড়ে নেই। শত শত পায়রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দানা খাচ্ছে। এদের খাবার দিচ্ছেন তীর্থযাত্রীরা। পুণ্যলোভীর অভাব নেই এ দেশে। পশুপাখিদের খাইয়ে পরপারের কিছু পাথেয় সঞ্চয় করাই এদের লক্ষ্য। এটা হল সস্তায় বেশি পুণ্য লাভের সহজ সরল পথ। সারা ভারতে এমন জীবসেবীদের মধ্যে খোঁজ করলে দেখা যাবে এদের অনেকেই হয়ত খেতে দেয় না বাবা মাকে। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে আদর সংসার করে বসে আছে গ্যাঁট হয়ে। কারণ বাবা-মার বোঝাটা বড় বেশি। ওতে খরচা বেশি, ব্যাপারটা সারাজীবনের যে। তীর্থক্ষেত্রের পায়রা বা বানরদের খাওয়াতে খরচাটা কম। আটআনা এক আনাতেই লাভটা মোটা। তাই অনেক তীর্থক্ষেত্রে দেখা যায় এই ধরনের অসংখ্য পায়রা গরু কিংবা বানরপ্রেমিদের। কথায় আছে, তুমি যে কর্ম করবে তার ফল তোমাকে পেতে হবে। তাই যদি হয় তাহলে হয়ত এদের পরপারের সঙ্গী হিসেবে একমাত্র সহায় সম্বল হবে পায়রার ডানা, নইলে বানরের কলা। বিবেক কখনও কৈফিয়ত চাইলে এরা হয়তো কলাই দেখাবে।
পায়রা যেখানে খাচ্ছে তার পাশেই গোড়া বাঁধানো পরপর কয়েকটা গাছ। দ্বিতীয় গাছটার গোড়াতে বসে আছেন এক সাধুবাবা। দেখতে পেয়েছি সুদামা মন্দিরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। দানাদাতা আর ঝাঁক ঝাঁক পায়রাদের পাশ কাটিয়ে সোজা এসে দাঁড়ালাম গাছতলায় সাধুবাবার সামনে। অসংখ্য তীর্থযাত্রী আর স্থানীয় লোক গমগম করছে বিশাল মন্দির প্রাঙ্গণে। ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে অনেকে।
দেখলাম সাধুবাবা গাছের গোড়ায় বসে আছেন হেলান দিয়ে চোখ বুজে। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। গায়ের রং বেশ ময়লা। জটা নেই মাথায়। ময়লাতেই জটার মতো হয়ে আছে চুলগুলো। পরনে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত গেরুয়া বসন। কতকাল যে বসনটা জলের মুখ দেখেনি তা একমাত্র সাধুবাবাই জানেন। গালে দাড়ি আছে, তবে খুব বড় নয়। গায়ে একটা কাপড় জড়ানো। মুখশ্রী বেশ সুন্দর। টান আছে। ছিপছিপে চেহারায় জৌলুস নেই। পাশে একমাত্র সহায় সঙ্গী ঝুলিটা, আর সব সাধুদের যেমন থাকে। বয়েস আন্দাজ করলাম, খুব বেশি হলে বছর চল্লিশের মধ্যে।
কাছে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছি সাধুবাবাকে। চোখ বুজে বসে আছেন পরম নিশ্চিন্তে। দাঁড়িয়ে রইলাম মিনিটখানেক। তবুও তাকানোর নাম নেই। ঘুমিয়ে আছেন মনে হল না। চোখ বুজে আছেন। তাই মুখে বললাম,
– গোড় লাগে সাধুবাবা।
কথার শব্দে তাকালেন। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই আটকালেন হাত দিয়ে। সোজা হয়ে বসে বললেন,
– ঠিক হ্যায় বেটা, ঠিক হ্যায়। ভগবান তোর মঙ্গল করুন।
আমি জোর করতে বাধা দিলেন না। প্রণাম করলাম। কোনও কথা বললেন না। আমি ভাবলাম, দরকারটা তো আমারই।
– বাবার ডেরা কোথায়?
উত্তর দিলেন না। মুখের দিকে শুধু তাকালেন একবার। দাঁড়িয়ে ছিলাম। বসতে বললেন না। নিজেই বসলাম বাঁধানো গাছের গোড়ায় পা ঝুলিয়ে। অস্বস্তি হল একটু, তবুও বললাম,
– বাবা কি এখানেই থাকেন?
এবার মুখ খুললেন। বললেন,
– আমার কোনও ঠিকানা নেই। পৃথিবীতে যাদের চিঠি লেখার আছে, তাদের ঠিকানা আছে। আমাকে কেউ চিঠি লেখে না আমিও কাউকে লিখি না। তাই কোনও ঠিকানা নেই আমার।
একবার কোনও সাধুবাবা কথা বললে তাঁকে আয়ত্তে আনতে পারি। না বললে বড্ড মুশকিল হয় আমার। একটু কায়দা করে বললাম,
– বাবা কি ইউপি-র লোক?
কথাটা শুনে একটুও অবাক হলেন না। বললেন,
– হাঁ, বাড়ি একসময় আমার ইউপি-তেই ছিল।
উত্তরপ্রদেশের কথা বললাম আমি আন্দাজ করে। সাধুবাবা হিন্দিভাষী। দেখেছি সাধুসন্ন্যাসীদের মধ্যে অনেকেই বা অধিকাংশই উত্তরপ্রদেশের। আন্দাজে ছোঁড়া ঢিলটা দেখলাম লেগে গেল। আমার সুবিধা হল, তবে চোখের ভাবটা দেখে মনে হল কথা বলার ইচ্ছা নেই। এই ভাবনাটা কাটানোর জন্য সরাসরি মনের কথাটা জানালাম,
– বাবা কয়েকটা জিজ্ঞাসা আছে আমার, আপনি যদি দয়া করে উত্তর দেন তো বিষয়টা বলি।
এ কথার কোনও উত্তর দিলেন না। কাটল মিনিট চারপাঁচেক। এবার আমার কৌশলটা প্রয়োগ করলাম যেটা সাধুরা কথা বলতে না চাইলে সর্বত্রই প্রয়োগ করে থাকি। ঝপ করে পা দুটোতে হাত দিয়ে আবার প্রণাম করলাম। আমার ধারণা ভগবান ভক্তিতে, মানুষ মিষ্টি কথায় আর সাধু-সন্ন্যাসীরা বশীভূত হন প্রণামে। তাই প্রণাম করলাম। বাধা দেয়ার কোনও সুযোগই পেলেন না। শুধু একটু নড়ে বসলেন। মুখের ভাবটার যেন সামান্য পরিবর্তন হল। বললাম,
– বাবা যদি কোনও আপত্তি থাকে তাহলে বিরক্ত করব না। প্রসন্ন চিত্তে যদি উত্তর দেন তবে প্রশ্ন করব কয়েকটা।
এতক্ষণে মুখ খুললেন। গম্ভীরভাবে বললেন,
– আমার নিজের কোনো জ্ঞান নেই, লেখাপড়ার কিছু করিনি। সুতরাং তোর প্রশ্নের উত্তর দেব কেমন করে?
মুহুর্ত দেরি না করেই বললাম,
– না বাবা, আমার প্রশ্নের উত্তরের জন্য কোনও স্কুলে কলেজে পড়ার দরকার হয় না। আপনি মন থেকে যেটুকু বলবেন তাতেই তৃপ্ত হবে আমার মন।
এবার ভাবটা দেখলাম, একটু যেন ভেবে নিলেন, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন আশপাশে, কাছাকাছি কেউ আছে কিনা। হঠাৎ ডুগডুগির আওয়াজ এল কানে। আমার পিছন দিকে তাকালেন। সাধুবাবার দৃষ্টিকে লক্ষ্য করে তাকালাম আমিও। দেখলাম এক ভাল্লুকখেলায়ালা ভাল্লুক নিয়ে যাচ্ছে ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে। সাধুবাবা চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে রাখলেন আমার চোখে। বললেন, প্রশান্ত কণ্ঠে,
– কি প্রশ্ন আছে তোর?
এতক্ষণে স্বস্তি এল, মনে জোর পেলাম। কৌশলটা কাজে লেগেছে। দেরি না করে বললাম,
– বাবা শুনেছি সাধু-সন্ন্যাসীরা গৃহত্যাগের বারোবছর পর অত্যন্ত গোপনে একবার তাঁর জন্মভিটে বা ভূমি দর্শন করে আসেন, এটা নাকি নিয়ম। এ কথা কি ঠিক? সত্যি কি প্রয়োজন আছে? কেন এটা করে থাকেন তাঁরা? ফেলে আসা অতীত কালের গর্ভে চলে যায়। তাকে আবার বারো বছর পর টেনে আনা কেন?
কথা শুনতে শুনতে মাথাটা একটু নাড়তে লাগলেন। শেষ হতে বেশ পুলকিত মনে বললেন,
– এটা ঠিক, তবে বাধ্যতামূলক নিয়ম কিছু নেই যে গৃহত্যাগের পর জন্মভিটে দর্শন করতে যেতেই হবে। সংসার ছেড়ে আসার পর কিছুক্ষণ ফেলে আসা জীবনের কথা মনে পড়ে সব সাধুসন্ন্যাসীদেরই। তারপর যত দিন যায় তত বিস্মৃতি আসে সংসার জীবনের কথায়। দীর্ঘ বারোবছর এ জীবনে থাকার পরও যদি বাড়ির স্মৃতি মাঝে মধ্যে মনকে নাড়া দেয়, তাহলে একবার জন্মভূমি বা ভিটে দর্শন করে আসে সাধু-সন্ন্যাসীরা। গুরুদেহে থাকলে তাঁর অনুমতি নিয়ে যায়, না থাকলে তাঁর অনুমতি দেয়াই থাকে। যাদের বাড়ির টানটা একেবারেই কেটে যায় তারা যায় না। প্রয়োজন হয় না। টান না কাটলে, যদি সংসারচিন্তা মনকে পীড়া দিয়ে অস্থির করে তোলে তবে একটা প্রার্থনা নিয়ে জন্মভূমি দর্শন করতে যায় সাধু-সন্ন্যাসীরা।
সাধুবাবা থামলেন। কৌতূহল সামলাতে পারলাম না। দেরি না করে জানতে চাইলাম,
– বাবা কি প্রার্থনা নিয়ে সাধু-সন্ন্যাসীরা যান তাঁদের জন্মভিটে দর্শন করতে?
কথা না বলার ভাবটা এখন আর মোটেই নেই। বেশ আনন্দিত মনেই তিনি বললেন,
– বেটা, বাস্তুদেবতা যদি তাঁর সন্তানের বন্ধন মুক্ত করে না দেন তাহলে তার বন্ধন কাটেনা সংসারের। মায়া কাটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে, যতই গৃহত্যাগ করে সাধন-ভজন করুক না কেন, ঘুরে ফিরে তার ফেলে আসা সংসারের কথা মনে আসবেই আসবে সাধু জীবনে। কারণ তুমি আমি বা যে কেউ বড় হয়েছি তো তাঁরই কোলে। সুতরাং তাঁর টান থাকবে না তার উপরে। বেটা, গৃহত্যাগের বারো বছর পরেও যদি সংসারের কথা মনকে পীড়িত করে তাহলে গোপনে গিয়ে দূর থেকে বাস্তুভিটে দর্শন করে প্রার্থনা করতে হয়, ‘হে বাস্তুদেবতা, তোমার কোলেই আমার জন্ম। বড় হয়েছি। এই ঋণ কোনও জন্মেই পরিশোধের নয়। তুমি সাংসারিক বন্ধন কাটিয়ে পরমপথের সন্ধান দাও। হে দেবতা, কৃপা কর, তুমি মুক্ত কর আমাকে।’ ব্যস এতটুকু প্রার্থনাতে কাজ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে বাস্তুদেবতার করুণায় সংসারের মায়া একেবারে মুছে যায় মন থেকে। সংসারের সমস্ত টান থেকে মুক্ত হয় মন। ভজনে আর বিঘ্ন হয় না সংসার বিষয়ক চিন্তায়। বাস্তুদেবতা প্রথমে যাদের মুক্ত করেন তাদের গৃহত্যাগের পর আর জন্মভিটে দর্শনে যেতে হয় না, কারণ মনে সংশয় বা কোন মায়া থাকে না তাঁর কৃপায়।
কথাটুকু শেষ হতে একটা কথা মনে এল। জানতে চাইলাম,
– বাবা, শাস্ত্রে গুরুকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সাধু-সন্ন্যাসীরা বলেন গুরুই সব। তাঁর কৃপাতে জাগতিক বা পারমার্থিক সবকিছু লাভ করা যায়। তাই যদি সত্য হয় তাহলে গৃহত্যাগের পর সংসারের টান যদি কারও আছে, তাহলে জন্মভিটেতে বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে না ছুটে গুরুকে ধরে বা স্মরণ করে প্রার্থনা করলেই তো হয়। এত ছুটোছুটি দরকার কি? এ কাজটা সাধুসন্ন্যাসীরা যেকোনো জায়গায় থেকে তো করতে পারেন।
এমন খোঁচা মারা প্রশ্নে সাধুবাবা একটু সোজা হয়ে বসলেন। বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
– গুরুকে স্মরণ করে ঘরে বউকে রেখে দরজা বন্ধ করে স্বামী বাইরে শুয়ে থাকলে কি ‘বাচ্চা পয়দা’ হবে? গুরুর কাছে প্রার্থনায় শুধু সন্তান লাভ হতে পারে তাঁর কৃপায়। তবে স্বামীকে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করতেই হবে। ফলটা কি হাওয়া থেকে হবে? একটা কথা মনে রাখিস বেটা, জগতের সবকিছুই নিয়মের অধীন। তার বাইরে চললে কোনও কাজ হবে না।
সাধুবাবা অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রশ্ন করলাম না। মুখখানি লক্ষ্য করতে লাগলাম। উত্তেজনার ভাবটা মিলিয়ে গেল সামান্য সময়ের মধ্যে। অপেক্ষায় রইলাম। যেই মুখের দিকে তাকালেন, ওমনি প্রশ্ন করলাম,
– বাবা , দীক্ষিতরা, তারা ইষ্টমন্ত্র জপ করলে কি হয়? সকলে বলে ভগবানকে পাওয়া যায়, কিভাবে পাওয়া যায়, কেমন করে আসেন তিনি?
কথাটা শুনে বেশ অস্বস্তি বোধ করলেন মনে হল। যেন একটু ভাবলেন। বিব্রত মুখে বললেন,
– এসব ধর্মজগতের একান্ত গোপন কথা। বলা নিষিদ্ধ তাই বলব না।
কথাটা শেষ হতে বললাম,
– বাবা ধর্মের কথা যদি সব গোপনই থাকল তবে ধর্ম নিয়ে এত মাতামাতি কেন? তাহলে আপনি বা এ পথে এলেন কেন? সংসারী যারা, তারাই বা ভগবানকে ডাকবে কেন? তাঁর বিষয়ে মানুষ যদি কিছু নাই জানতে পারল তাহলে কি বিশ্বাসে তার পথ চলবে, তাঁর উপর ভরসা করবে? অন্ধকারে হাতড়ালে তো অনেক সময় কিছু হাত বাধে। এই বিষয়টা যদি সব গোপন থেকে গেল তাহলে মানুষ আর হাতড়াবে কোথায়?
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে চেয়ে রইলাম সাধুবাবার মুখের দিকে। মনে হলে কথাগুলোর যৌক্তিকতা উপলব্ধি করলেন। চুপ করে রইলেন মিনিট পাঁচেক। কি যেন সব ভেবে উত্তর দিলেন প্রশান্তচিত্তে,
– বেটা, গুরু যে মন্ত্র দেয়, সেই মন্ত্রের নামই ইষ্টমন্ত্র। জপ করলে বলবীর্য বাড়ে, কার্যসিদ্ধি ও ইষ্টলাভ হয়। ইষ্টমন্ত্র যদি নির্ভুল, মন্ত্র জপের সময় মানসিক উচ্চারণ যদি শুদ্ধ হয়, তাহলে মন্ত্ররূপী সমষ্টিগতশব্দ ক্রমশ রূপ বা আকার ধারণ করে। কারণ, ওই শব্দরূপী মন্ত্রের মধ্যে ইষ্টরূপী ভগবান বিরাজ করছেন। ইষ্টমন্ত্র কালী দুর্গা গণেশ বিষ্ণু শিব যে দেবদেবীরই হোক না কেন, জপ ক্রমশ দেহে বসতে থাকলে মন্ত্রের শব্দ (ব্রহ্ম) থেকে ক্রমশ ইষ্টের রূপের ছাপ পড়তে থাকে দেহে। মন্ত্র জপ যত বেশি চলতে থাকবে, ইষ্টের রূপ তত বেশি প্রস্ফুটিত হতে থাকবে। জপ আরও বেশি হতে থাকলে দেহের ভিতরে তখন ইষ্ট জ্যোতির্ময় হতে থাকে। জপ আরও আ-র-ও বেশি হতে থাকলে, ইষ্টনামে বিভোর হয়ে থাকলে তখন ইষ্ট মূর্তি আরও বেশি জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে। প্রথম শুরু থেকে ইষ্টের পূর্ণ জ্যোতির্ময় অবস্থায় আসা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে একই সঙ্গে মানুষের তম ও রজোগুণের ক্রিয়া লোপ পেতে থাকে। দেহমন পর্যায়ক্রমে সত্ত্বগুণে ভরপুর হয়ে ওঠে। এবার ইষ্টমন্ত্রের সাধক জ্ঞাননেত্রে (ভ্রু-মধ্যে) ইষ্টর রূপ দর্শন করে থাকে।
সাধকের সাধনা যদি আরও কঠোর, আরও জোরদার হয় তবে সাধকের ইচ্ছায় ওই রূপ জ্যোতির্ময় দেহ নিয়ে সাধকের সামনে প্রকটিত হতে পারেন, এমনকি স্থূল রক্তমাংসের দেহ নিয়েও ইষ্ট আবির্ভূত হতে পারেন। তবে বেটা, দেহের ভিতরে এসব কাণ্ড কারখানা চললেও সাধকের বাইরেটা দেখে কিছু বোঝার উপায় থাকে না। এসব সাধক বা ইষ্টনাম জপকারীর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার যে নিজেই অনুভব উপলব্ধি করে এবং দেখে। তবে একটা জিনিস যেটা বাইরে থেকে দেখলে পরিস্কার বোঝা যায়, সাধকের দেহে ফুটে ওঠে একটা অসাধারণ উজ্জ্বল ভাব। দেখলে মনে হয় যেন চোখ মুখ দিয়ে একটা আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। এই সময় সাধক বা ইষ্টমন্ত্র জপকারী খুব লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে। মন এক অনির্বচনীয় আনন্দময় অবস্থায় ভরে থাকে। ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া জাগতিক ভাবে রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে সকলেই তাঁর আকর্ষণ অনুভব করে, তাকে ভাল লাগে সকলের। যারা তার কাছে আসে, এক অদ্ভুত আনন্দলাভ করে তারাও। তবে বেটা এই অবস্থায় ইষ্টমন্ত্রের সাধক জপ ছেড়ে দিলে তখন সেই জ্যোতির্ময় রূপ ক্রমশ নিষ্প্রভ হতে থাকবে। সত্ত্বগুণের হ্রাস হয়ে ধীরে ধীরে তমো ও রজোগুণের প্রভাব বাড়তে থাকবে। তারপর এমন একটা সময় আসবে যখন দেহ থেকে একেবারেই মুছে যাবে ইষ্টের ছবি। মন ভরে যাবে তমো ও রজোগুণে অর্থাৎ যে কে সেই হয়ে যাবে। ইন্দ্রিয়ের সেই পুরনো খেলা আবার চলতে থাকবে দেহমনে। বুঝলি বেটা ইষ্টমন্ত্র জপ করলে কি হয়? এটাকে বললাম খুব সহজভাবে বোঝানোর জন্য। এটাই মূল সত্য, তবে এ বড় কঠিন ও জটিল তত্ত্ব। এটুকু জেনে কাজ করলে সব হবে, সকলের হবে, তোরও হবে। পরে বুঝতে পারবি, বিষয় রহস্যটা ভেদ হয়ে যাবে। জটিলতা আর কিছু থাকবে না। এখন যেটা শুনলি সেটা পরের মুখে ঝাল খাওয়া হল তোর।
কথাটা শুনে আনন্দে মনটা ভরে গেল। আবেগ সামলাতে না পেরে প্রণাম করলাম পায়ে হাত দিয়ে। এবার আর বাধা দিলেন না। কথাগুলো ভালোভাবে হজম করার জন্যে বসে রইলাম চুপ করে। সাধুবাবাও কথা বলে আমার মনের ভাবটা নষ্ট করলেন না। বেশ কিছুটা সময় কাটাল এইভাবে। মনে মনে তৈরি হয়ে নিয়ে বললাম,
– বাবা, সকলে বলেন জপ করতে কিন্তু অন্তর্নিহিত বিষয়টা কেউ বলেন না, বলতে চানও না। দয়া করে আপনি বললেন বলে জানতে পারলাম। এরজন্য কৃতজ্ঞ রইলাম আপনার কাছে। এবার জানতে চাই, সাধুসন্ন্যাসীদের লক্ষ্য থাকে তাঁকে লাভ করা। সাধু এবং সন্ন্যাসী উভয়ের লক্ষ্য এক অথচ ‘সাধু-সন্ন্যাসী’ কথাটা ব্যবহার করে থাকি প্রায় একই অর্থে। আমার প্রশ্ন সাধু আর সন্ন্যাসী এই দুটো শব্দের মধ্যে, তাদের কার্যকলাপের মধ্যে, জীবনধারণ ও ধারার মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে?
প্রশ্নটা শুনে সাধুবাবা বেশ খুশি হলেন বলে মনে হল। এতটুকু দেরি না করে বললেন,
– হাঁ বেটা, পার্থক্য আছে বলেই তো সাধু আর সন্ন্যাসী দুটো শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। উভয়ের লক্ষ্য থাকে এক। পার্থক্য শুধু জীবন ধারণে, চলার পথে কিছু বিধি নিয়ম নিষেধের। যারা সন্ন্যাস গ্রহণ করে তাদের ‘বিরজাহোম’ করতে হয়। আত্মপিণ্ড দান করতে হয় মাথা ন্যাড়া করে হোমের সময়। ভাবটা থাকবে এইরকম যে, পরমাত্মা এই মুহুর্ত থেকে জাগতিক সমস্ত কামনাবাসনা পরিত্যাগ করে জীবিত থেকেও মৃত হলাম আমি। সংসারের সমস্ত বিষয়ে মৃত্যু আমার। সংসারে আমার বলে কেউ নেই, মৃত্যুর পর পিণ্ডদানের জন্য রইল না কেউ। নিজের পিণ্ড নিজে দিয়ে নিজেই গ্রহণ করলাম। জীবিত থেকেও শেষ করলাম মৃত্যুর পর পারলৌকিক ক্রিয়াদি।
একটু থামলেন সাধুবাবা। এবার গাছে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
– বেটা, সন্ন্যাসজীবনের ব্রত যে কি কঠিন নির্মম তা কেউ ধারণাই করতে পারবে না। সাধুজীবন হেলায়-ফেলায় কাটানো যায় কিন্তু প্রকৃত সন্ন্যাসীর জীবন যে কী তীব্র সংযমের তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না। সন্ন্যাসীর ব্রত হবে এইরকম, যা শুনেছি আমরা গুরুজির মুখে। তিনি আমাকে বলেছেন, – বেটা আমাদের শাস্ত্র-পুরাণে আছে, এমন সুন্দর এই পৃথিবীর কোলে ভূমি শয্যা থাকতে সন্ন্যাসী বিছানায় শোবে কেন? ভূমিশয্যায় বালিশের কি সত্যিই কোনও প্রয়োজন আছে? দুটো হাত দিয়েছেন পরমাত্মা। এই হাতদুটোই প্রয়োজন মেটাবে বালিশের। লজ্জা নিবারণের জন্য তো রয়েছে গাছের বাকল, বস্ত্রের আর প্রয়োজন কী? যদি একান্তই তা না পাওয়া যায়, রাস্তায় কি কারও ফেলে দেয়া এক টুকরো কাপড় পড়ে নেই? এটুকুও যদি না পাওয়া যায় তাহলে সন্ন্যাসী পরিধান করবে শ্মশানে ফেলে দেওয়া মৃতের বস্ত্র। যদি কৌপীন বা বাকল ছাড়া অন্য কোনও বস্ত্র পড়তে একান্তই ইচ্ছা হয় সন্ন্যাসীর, তাহলে লজ্জা নিবারণ আর দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামান্য বস্ত্রটুকুও ধারণ করা চলবে না অঙ্গে।
বেটা পুরাণ বলেছে, এই বিশ্বসংসার একমাত্র বৃক্ষ, নিঃস্বার্থ নির্বিকারভাবে দান করে তার ফল আর ছায়া। সন্ন্যাসী ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত হলে ফল আর ছায়া চাইলে কি বৃক্ষ কি তাকে ফিরিয়ে দেবে? যদি তাও না জোটে তাহলে সন্ন্যাসী ভিক্ষা চাইবে সাতটি বাড়িতে। একবারের বেশি চাইবে না। অন্নাদি কিছু জুটলে তা গ্রহণ করবে। যা পাবে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। ভিক্ষান্ন না জুটলে থাকবে অনাহারে। ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হলে, সহ্য ক্ষমতার বাইরে গেলে তবেই সন্ন্যাসী কোন গৃহস্থের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট অন্ন পরমাত্মাকে নিবেদন করে পরে তা নিজে গ্রহণ করবে আনন্দচিত্তে। আগের সঞ্চয় করা কোনও খাদ্য গ্রহণ করা চলবে না। অপর কেউ এনে দিলে হবে না, প্রাণ রক্ষার্থে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে নিজেকেই।
আবার একটু থামলেন। অবাক হয়ে শুনছি প্রকৃত সন্ন্যাসীদের কঠোর জীবন ও সংযম ও নীতির কথা। হাতটা নেড়ে বললেন,
– শুধু তাই নয় বেটা সন্ন্যাসীর ভোজনের জন্যে আলাদা কোনও পাত্র থাকবে না। পাত্রের কি সত্যিই কোনও প্রয়োজন আছে? জন্ম থেকে পরমাত্মার দেয়া হাতদুটোই কি যথেষ্ট নয়? হাতের করতল সংযোজিত করে খাদ্য গ্রহণ করবে সন্ন্যাসী। আর পানের জন্য, স্নানের জন্য জল? বেটা, এ দেশের পৃথিবীর নদী-নালা পুষ্করিণী কি শুকিয়ে সব কাঠ হয়ে গেছে, হয়ে গেছে কি মরুভূমি? তা যদি না হয়ে থাকে তাহলে প্রকৃতি জীবনধারণের জন্য যা দিয়েছেন তার থেকে আর বেশি কি প্রয়োজন?
কথাগুলো শুনছি আর বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ছি। এখন কোনও দিকেই মন নেই আমার। স্থির হয়ে শুনছি সাধুবাবার কথা। তিনি বলে চলেছেন তাঁর গুরুদেবের মুখনিঃসৃত শাস্ত্রে সন্ন্যাসীর প্রকৃত সংজ্ঞার কথা।
– বেটা, সন্ন্যাস নিলে আশ্রয়হীন হয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে হবে সন্ন্যাসীকে। থাকতে হবে একাকী, কারও আশ্রয় গ্রহণ করে নয়। একরাতের বেশি কোনও গ্রামে থাকার অধিকার থাকবে না সন্ন্যাস গ্রহণের নিয়মানুসারে। যদি মনে করে একটু আশ্রয়ের প্রয়োজন, পাহাড়ের গুহা তবে তার আশ্রয়। এরও যদি অমিল হয়, বন্ধ হয়ে থাকে তাহলে নিজহাতে নির্মাণ করে লতা পাতার কুটিরে সে আশ্রয় নিতে পারে। বেটা, দেহের মলিনতা দূর করার কোনও অধিকার নেই কোনও সন্ন্যাসীর। সন্ন্যাসগ্রহণের পর সন্ন্যাসী শারীরিক সুস্থতা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পারবে না চুল নখ দাড়ির। দেহকে রক্ষা করার জন্য পরমাত্মা আছেন। তাঁর চিন্তা ছাড়া জগতের অন্য কোনও বিষয়ে মন বা ধ্যান দেবার প্রয়োজন আছে কি সন্ন্যাসীর? কমণ্ডলু আর একটি দণ্ড ছাড়া জাগতিক সমস্তকিছুই পরিত্যাগ করবে সন্ন্যাসী, শুধুমাত্র জীবন বিপন্ন না হলে। সমস্ত ঋতুতে স্নান করবে তিনবার, সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায়। শীতকালে হিমশীতল বায়ু, গ্রীষ্মকালে প্রখর তাপবদ্ধ রোদ আর বর্ষাকালে জলধারা বয়ে যাবে দেহের উপর দিয়ে। এ সবই সহ্য করতে হবে নির্বিকারচিত্তে।
কোনও কথা বললে তা সর্বদাই সত্য বলবে। মানুষ মনে বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রায় এমন কোন বাক্যপ্রয়োগ ও আচরণ সন্ন্যাসী কখনো করবে না। মৌনতা মানুষের কথার সাজা, জাগতিক সমস্ত বিষয়ে অনিচ্ছা প্রকাশই দেহের সাজা আর চিত্তের সাজা হলে প্রাণায়াম। এই তিনটি সাজা যে নিজেকে দিতে পারবে না, তার কোনও অধিকারই নেই সন্ন্যাসী হওয়ার। সন্ন্যাসীকে হতে হবে অনাসক্ত, জিতেন্দ্রিয়। পরিভ্রমণ করবে আত্মানন্দে আনন্দিত হয়ে। বেটা, সন্ন্যাসীকে শুধু ইহলোকে নয়, পরলোক বিষয়েও হতে হবে আসক্তিহীন, বিরত থাকতে হবে জগতের সমস্ত ভোগ্যবস্তু থেকে। অতি ক্ষুদ্র কামনা থেকে মুক্ত হয়, আত্মার মধ্যেই পরমানন্দ, সমস্ত জীবের মধ্যেই ব্রহ্ম অর্থাৎ আমার মধ্যে যিনি সকলের মধ্যে তিনি, এই বিশ্বসংসারে আত্মতত্ত্বে অবস্থানরত, আকাশে চাঁদ উঠলে বিভিন্ন জলপাত্রে ও জলাশয়ে যেমন প্রতিবিম্বিত হয় বিভিন্ন রূপে তেমন একই আত্মা বর্তমান আছেন সর্বভূতে ও আত্মমধ্যে এমন ভাবনায় ভাবিত হয়ে, কারও প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ তো নয়ই বরং সমদর্শী ও নারায়ণমনা হয়ে নির্বিকার নির্লিপ্ত চিত্তে যিনি চলেন তিনিই সন্ন্যাসী। বেটা এককথায় জাগতিক সমস্ত কিছু ত্যাগের নামই সন্ন্যাস।
একটু থামলেন। হালকা হাসি ফুটে উঠলো সারা মুখখানায়। এ হাসিতে রয়েছে যেন একটা প্রসন্ন রহস্য। প্রকৃত সন্ন্যাসীর কঠোরভাবে জীবন সম্পর্কে ভেবে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একটা কথাও সরল না মুখ থেকে। সাধুবাবা চুপ করে রইলেন। এমনভাবে কাটল মিনিট পাঁচেক। বললেন,
– বুঝলি বেটা, সন্ন্যাসী কে আর সন্ন্যাসজীবনটাই বা কি? এখন তুই সারা ভারতের সমস্ত মঠ-মন্দিরে আশ্রমে খুঁজে দেখতো, শাস্ত্রের নিয়মে চলা কয়েকটা সন্ন্যাসীকেও পাস কিনা? মাথা ন্যাড়া করে গেরুয়া পরে যদি সন্ন্যাসী হওয়া যেত তাহলে তো আর ভাবনা ছিল না।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা আপনি কি তাহলে বলতে চান, আমাদের দেশে এমন কঠোরব্রত পালন করা সন্ন্যাসী মোটেই নেই?
একটু গম্ভীর ভাবে বললেন,
– একেবারে নেই একথা বলার মত ধৃষ্টতা আমার নেই। থাকলেও থাকতে পারে, তবে আমার অন্তত দেখা নেই।