ছোট্ট একটা কাজই পরমানন্দ আনে সংসারে
সাধুসন্ন্যাসীদের মুখ খেকে দেবদেবীদের প্রত্যক্ষ দর্শনের কথা এইভাবে কাউকে বলতে শুনিনি। কতশত জন্মের সুকৃতি থাকলে তবে এমন স্থূলদেহে দর্শন হয় উপাস্যের।
একসময়ে দ্যূতক্রীড়ায় হেরে গেলেন পঞ্চপাণ্ডব। শর্ত অনুসারে উত্তরীয় ধারণ করে পাঁচ ভাই দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন হস্তিনাপুর (বর্তমানের মিরাট) থেকে।
কিছুক্ষণ কাম্যক বনে (হরিয়ানা রাজ্যে) বাস করার পর সকলে এলেন দ্বৈতবনে (সাহারানপুর)। এখানে আরও কিছুদিন বাস করার পর, ‘একস্থানে দীর্ঘকাল বাস করা আনন্দদায়ক হয় না’। বিশালবুদ্ধি ব্যাসদেবের এ কথায় আনন্দিত হয়ে আবার তাঁরা স্থান পরিবর্তন করলেন।
এরপর দেবর্ষি নারদ, লোমশ ও সৌম্যমুনি এবং ব্যাসদেবের উপদেশ ও পরামর্শে দ্রৌপদীসহ পঞ্চপাণ্ডব তীর্থদর্শনে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেন। যথাসময়ে লোমশ, ব্যাসদেব, নারদ ও পর্বতমুনিকে নমস্কার করে, পুরোহিত ধৌম্য ও অন্যান্য সঙ্গী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলেন সকলে।
এই যাত্রায় সঙ্গী লোমশমুনি রাজা যুধিষ্ঠিরকে তীর্থভ্রমণের উপদেশে আগেই বলেছেন, প্রতারক, ধূর্ত, সীমাবদ্ধ জ্ঞানবিশিষ্ট কিংবা সংকীর্ণমনা ব্যক্তি, আকাট মূর্খ, পাপকারী এবং কুটিল বুদ্ধি লোককে সঙ্গে নিয়ে খবরদার বেরোবে না। জানবে, এরা এক একটা জিনিস। কোনও তীর্থে গিয়ে এরা স্নান করে না। অকারণ তর্কজুড়ে তোমার শান্তির বারোটা বাজিয়ে দেবে। সুতরাং তোমার উচিত এদের পরিত্যাগ করা।
অধিকাংশ ভ্রমণকারীদের দেখা যায় একমাত্র বাড়িটা ছাড়া গোটা সংসারের মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভ্রমণে। ভাবটা এই, সেখানেও তো সংসার পাততে হবে। সুতরাং মিক্সিটা সঙ্গে নিলে ভালো হয়।
লোমশমুনি বললেন, রাজা, জানবে এরাও সিরিয়ালের এক একটা আইটেম। এদেরও সঙ্গে নিও না। নইলে ওদের বাক্সপ্যাঁটরা কাঁধে নিয়ে তোমাকে কুলিবাজি করতে হবে। ‘যুধিষ্ঠির, লঘু হও, লঘু হইলে ইচ্ছানুসারে গমন করিতে পারিবে।’ মোটের ওপর বেশি লোকজন, গাদাখানেক জিনিসপত্র নিও না। লাগেজ কম, সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্য ভ্রমণ। বোঝা বেশি, গতি কম, অশান্তি বেশি। এ্যায় কুলি, এ্যায় কুলি করে মরবে।
লোমশ আরও বললেন, যারা ক্ষুধা, পিপাসা, পথের পরিশ্রম, গ্রীষ্ম ও শীতের কষ্ট সহ্য করিতে পারে না, এদের থেকে ৩ কিমি দূরে থাকবে। আর সঙ্গে নিও না যারা সুস্বাদু বস্তু, লেহ্য পেয় ও মাংস ভোজন করে।
মনে রেখো, এরাও একটা কাটপিস। সঙ্গে নিলে তোমাকে ক্যালেন্ডার করে এরা দ্রৌপদীর ঠাকুরঘরে ঝুলিয়ে দেবে। হরিদ্বারে গিয়ে কেউ যদি আবদার করে বলে, যুধিষ্ঠির জেঠু, আজকে কচি পাঁঠার মাংস খাব। তুমি মারা পড়ে যাবে সুতরাং সাবধান।
লোমশের কথামতো মহাভারতীয় যুগ তথা দ্বাপরে চলেছিলেন রাজা যুধিষ্ঠির, কলিতে আমি চলি, আনন্দে চলি। এ যাত্রায় আমার সঙ্গী একটা জামা ও পায়জামা, একটা চাদর আর ক্যামেরা।
৭ জুলাই, শনিবার, ২০১২। এই নিয়ে হরিদ্বারে আসা হল ৮৮ বার। এসে দেখলাম বিশাল এক কাণ্ড। ৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে শ্রাবণীমেলা, চলবে ১৭ জুলাই পর্যন্ত। বিভিন্ন প্রদেশের লক্ষ লক্ষ অবাংলাভাষী তীর্থযাত্রীতে তিল ধারণের জায়গা নেই কোথাও। এরা গেরুয়া রঙের গেঞ্জি আর প্যান্ট পরা। বাংলায় শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বরে যেমন জল ঢালা হয়, ঠিক সেইরকমই এখানে গঙ্গা থেকে কলসিতে জল বাঁকে করে নিয়ে যাওয়া হয় হৃষিকেশ হয়ে রামঝোলা থেকে ২২ কিমি নীলকণ্ঠ মহাদেব মন্দিরে। ওখানে ভক্তরা জল ঢালে নীলকণ্ঠের মাথায়। কেউ কেউ তা নিয়ে যায় ‘আপনা গাঁও মে’ বাবার মন্দিরে জল ঢালতে।
শেওড়াফুলি নিমাইতীর্থের ঘাট থেকে তারকেশ্বর পর্যন্ত ভোলে বাবা পার করে গা, জটাধারী পার করে গা, ত্রিশূলধারী… এই ধ্বনিতে যেমন আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে, তেমনই এখানে, এখন হরিদ্বারের গঙ্গালহরী বয়ে চলেছে। ভোলে ব্যোম, ব্যোম ব্যোম, ধ্বনিতে অনুরণিত হয়ে।
হরিদ্বারে যত সময় কাটছে ততই ভিড় বেড়ে চলেছে নানান ধরণের সুসজ্জিত বাঁকওয়ালাদের। বাঁক দেখছি হাজার হাজার কিন্তু এক পিস সাধুও নজরে পড়ল না। আসলে শ্রাবণীমেলার সময় দূরান্তরের সাধুসমাগম হয় না বললেই চলে। যারা আছে, এখানে তাদের মধ্যে কিছু স্থায়ী বসবাসকারী। কিছু রয়ে গেছে শ্রাবণী মেলার আগে এসেছে এমন সামান্য সংখ্যক সাধু। গত দুদিন ধরে গঙ্গার ঘাট চষে বেড়িয়েছি, এমন একজনকে পেলাম না যাকে নিয়ে বসে দুদণ্ড কথা বলা যায়।
আসলে এ যাত্রায় সাধুসঙ্গ করতে আসিনি। এসেছিলাম বদরীনারায়ণে যাব বলে।
আগেও গিয়েছি এগারো বার। এবার আর যাওয়া হল না। শুনলাম বৃষ্টিতে পথে ধস নেমে ওই যাত্রাপথ বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯৯৪ সালে ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স ও হেমকুণ্ড ঘুরে বদরীর পথে এমন অবস্থার জন্য একবার ফিরে আসতে হয়েছিল আমাকে। ফলে এখন সাত সাতটা দিন কাটাতে আমার একমাত্র সাধুই সম্বল।
তৃতীয় দিনে সকাল থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছি গঙ্গার পাড় ধরে। হঠাৎ নজরে এল বাঁকওয়ালাদের থিকথিকে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এক সাধুবাবা। অনাড়ম্বর দেহ। মাথার জটা লম্বায় তেমন বড় নয়। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলাই ভালো। সুন্দর চোখ, উচ্চমার্গের সাধুদের ক্ষেত্রে যেমন হয় তেমনই। সাধুবাবা নয়, তাঁর চোখ দুটোই ধরে বসল আমাকে। খাঁড়া নাক। উচ্চতায় সাড়ে পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি হবে বলে মনে হল। কাঁধে ছোট্ট একটা ঝোলা। একটা কম্বল ভাঁজ করা। লাঠিও আছে একটা।
ভিড়ের মধ্যে একনজরে দেখেই পিছু নিলাম আমি। সামান্য একটু বসার জায়গা দেখে সাধুবাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম,
– বাবা, এখানে একটু বসবেন, দু-চারটে কথা বলব।
সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে আমার দেখানো জায়গায় ভাঁজ করা কম্বলটা রেখে তার ওপরে বসলেন। আমি বসলাম মাটিতে। প্রথমেই জানতে চাইলাম,
– বাবা, আভি আপ কাঁহাসে আয়ে?
হাসিমাখা মুখে বললেন,
– আজ দিন পনেরো হল কাঠমান্ডু থেকে হরিদ্বারে এসেছি। গেছিলাম পশুপতিনাথ দর্শনে। তবে বেটা ওখানে সাধুদের খুব যাওয়ার কষ্ট। ভিক্ষার শুধু চাউল মেলে আর আট আনা এক টাকা যা পাওয়া যায় তাতে কিছু হয় না। নেপালের লোকেরা বড় গরিব।
সাধুবাবার ভাবটা ভারী প্রসন্ন। কথা বললে একটা হাসির প্রলেপ, না বললেও ওই রেশ মুছে যায় না। এতে বোঝা যায় সুখ দুঃখে সাধুবাবার সমভাব। এর জন্যই তো উনি সাধুবাবা আর আমরা সংসারী। জানতে চাইলাম,
– বাবা, আভি আপকা উমর কিতনা। কিতনি উমরসে আপনে ঘর ছোড় দিয়া?
সহজ সরল উত্তরে জানালেন,
– বেটা, এখন আমার বয়েস চলছে ‘পয়ষাট।’ ঘর ছেড়েছি বারো বছর বয়েসে।
একটা লক্ষ্য করার বিষয়, কয়েক হাজার পথচলতি সাধুর সঙ্গ করেছি। দেখেছি শতকরা ৯৮ ভাগ সাধুদের গৃহত্যাগ হয়েছে ৯ থেকে ১২ বছর বয়েসের মধ্যে। কুমারী ও সন্ন্যাসিনী শ্রী শ্রী মুক্তিমায়াদেবী আমার গুরুমারও গৃহত্যাগ হয়েছিল ৯ বছর বয়েসে। ১৯১৮-তে জন্ম, গৃহত্যাগ ১৯২৬-এ। গৃহত্যাগের বয়সটা কেন প্রায় ক্ষেত্রেই এই বয়সের মধ্যে তার কোনও কারণ ও উত্তরটা আজও খুঁজে পাইনি। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, তখন তো অল্প বয়েস। কি এমন ঘটনা ঘটল যে আপনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন এক অনিশ্চিত জীবনপথে?
একইভাবে বসে থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেন,
– বেটা, আমার বাবা জনমজুরের কাজ করত। তাতে যা আয় হত, সেই অর্থে আমাদের সংসার চলত না। আমার জন্মস্থান জব্বলপুরে। একদিন গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে গেলাম আগ্রায়। ওখানে কিছুদিন থেকেও কোনও কাজ জোটাতে পারলাম না। চলে গেলাম মথুরায়। ওখানে গিয়ে ভিড়ে গেলাম এক সাধুর সঙ্গে। ভুলে গেলাম বাড়ির কথা। বেশ কিছুদিন থাকার পর ওদের সঙ্গেই চলে গেলাম হরিদ্বার হয়ে দেরাদুনে। ওখানে এক পাহাড়িগুহায় দীক্ষা হল এক সন্ন্যাসীর কাছে। তখন বয়েস আমার বারো। সংসার ছেড়ে জীবনপ্রবাহ চলল সন্ন্যাসজীবনের পথে।
কথা ক’টা শেষ হতে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, গৃহত্যাগের পর মায়ের কথা মনে পড়ত না। ফিরে যেতে ইচ্ছা করত না মায়ের কাছে? মন খারাপ হত না মায়ের জন্য?
নির্লিপ্ত চিত্ত সাধুবাবার। নির্বিকারভাবে বললেন,
– হাঁ বেটা, ঘর ছাড়ার পর দু-চার বছর মায়ের কথা মনে পড়েছিল। তারপর আর মনে পড়েনি।
আবার জিজ্ঞাসা,
– এখন, এই ৬৫-তে পড়ে না? মন খারাপ হয় না মায়ের জন্য?
উদাসীনতার সুরে বৃদ্ধ বললেন,
– না বেটা, মায়ের কথা আর মনে পড়ে না। এই সংসারে যার আপন বলে কেউ নেই, তার আর কিসের চিন্তা, মন খারাপই বা হবে কার জন্য? হম দুনিয়া মে এ্যাকেলা হুঁ, সদা আনন্দ মে হুঁ।
সাধুবাবার কথায় কোনও বিকার নেই। খেদ নেই এতটুকু। প্রথম থেকে কথা বলছেন একভাবে বসে। চারপাশে চিৎকার আর ক্যাসেটের আওয়াজে মনে হচ্ছে আজ ২৫ ডিসেম্বর। গঙ্গার ধারে পিকনিক করছি। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, গৃহত্যাগের পর এমন কোনও দিন গেছে, যেদিন অনাহারে ছিলেন?
অকপট সাধুবাবা জানালেন,
– হাঁ, বেটা, এমনও দিন গেছে পরপর দু-তিনদিন না খেয়ে কেটেছে। তারপর আবার আহার জুটে গিয়েছে।
– ভারতের সমস্ত তীর্থ দর্শন করেছেন?
খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,
– হাঁ হাঁ বেটা, ভারতের সমস্ত তীর্থ দর্শন করেছি। মানস ও কৈলাসে গেছি একবার। কেদারনাথ ও বদরীনারায়ণ দর্শনে আসি প্রতিবছর। অমরনাথও হয়ে গিয়েছে কয়েকবার। আমার পরশুরাম তীর্থে যাওয়া হয়নি। ‘বঙ্গালে’ গঙ্গাসাগর মেলাতে যাই, তবে ওখানকার সরকার সাধুদের থাকার জন্য একটু ভালো ব্যবস্থা করে না। খুবই কষ্ট হয় ‘সাধুলোগন কি’।
ঠিক এই মুহুর্তে মনে পড়ে গেল সাগরমেলা প্রসঙ্গে দ্বারকায় ১৯৭৭ সালে এক সাধুবাবার আক্ষেপের কথা। দ্বারকার কৃষ্ণ মন্দিরের পিছনে রয়েছে ছাপ্পান্নটা সিঁড়ি। এই সিঁড়ির পরেই গোমতীঘাট। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গোমতী। এতে কোথাও হাঁটু, কোথাও বা কোমরজল। জোয়ারে জল বাড়ে। গোমতীর বইতে যেন কষ্ট হচ্ছে। এখানে গোমতী বড় রুগ্না। দেখলেই বেশ বোঝা যায় এককালে যৌবন ছিল। রূপও ছিল। বয়েস বেড়েছে। নারী আর যৌবন মানুষ যেমন অল্পকালই ভোগ করতে পারে। তেমন অবস্থা গোমতীরও। এখন কোনও আকর্ষণই নেই। স্তনহীনা নারী যেন। গোমতী এক কালের জমিদার গিন্নি। কাল পড়ে গেছে, তবু গৌরব তো একটা আছেই। তাই মানুষ শ্রদ্ধা করে, ভক্তিও করে। স্নান করে মুক্তির আশায়।
এই গোমতীর ঘাটের পাশেই ছোট্ট একটা শিবমন্দির। এর ছোট্ট বাঁধানো চাতালে বসে আছেন এক সাধুবাবা। গায়ে গেরুয়া রঙের ফতুয়া। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত একটা কাপড় পরা একপাট করে। কাছা নেয়া নয়, বাউল কায়দায়। বেশ ফরসা গায়ের রঙ। ঝাঁকড়া চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত। পাশেই ছোট্ট একটা ঝোলা। ইহলোকের সম্বল। বসে আছেন নিজের কম্বল পেতে। সঙ্গে আর কিছু দেখলাম না। নাকচোখমুখ খুব সুন্দর। বসে আছেন আপনভাবে। বয়েসে সাধুবাবা বৃদ্ধ।
কালটা শীতের তবে এখানে শীতটা এখন কম। সমুদ্রের ধার বলে। তবুও হালকা শীতের আমেজ একটা আছেই। পাশ দিয়ে অনেকে চলেছেন স্নানে, ফিরছেন অনেকে স্নান সেরে। আরও কয়েকজন সাধুবাবা বসে আছেন একটু দূরে। এগোলাম না। বসলাম সাধুবাবারই সামনে, চাতালে। নিজের থেকেই ইশারায় বসতে বললেন কম্বলের উপর। মুখেও বললেন,
– বেটা, আমার কম্বলের উপরেই বোস।
একটু ইতস্তত করে বললাম,
– আপনার আসনে বসব, আমি তো গৃহী।
কম্বলের একপাশে একটু সরে বসে বললেন,
– বোস, বোস তাতে কিছু যায় আসে না।
এবার উঠে গিয়ে বসলাম। প্রণাম করেই বসলাম। প্রণামে বাধা দিলেন না। শুধু কপালে হাত দুটো ঠেকালেন নমস্কারের মতো করে। বললাম,
– বাবা কি দ্বারকাতেই থাকেন না অন্য কোথাও?
মুখের ভাবটা প্রসন্ন তবে হাসি নেই মুখে। সাধারণভাবে বললেন,
– এখানে এসেছি আজ দিন দশেক হল। থাকব আরও কয়েকটা দিন। বাড়ি ছিল আমার তেহেরি গাড়োয়ালে।
জিজ্ঞাসা করলাম (পরিচয়ের প্রায় ঘণ্টাখানেক পর)
– বাবা, আপনার সাধুজীবনে এমন কোনও তিক্ত বা আনন্দদায়ক ঘটনার কথা কি মনে আছে বা ঘটেছে যা কখনও ভুলবেন না। মনে দাগ কেটে রাখার মতো।
এতক্ষণ একভাবেই বসেছিলেন। এখন একটু নড়ে বসলেন। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। পরে বললেন,
– বেটা, প্রতিবছর গঙ্গাসাগর মেলায় যাই কিন্তু ওখানকার অব্যবস্থার কথা আমি ভুলতে পারি না। সাধুদের থাকার ভালো ব্যবস্থা করে না সরকার। হোগলা পাতার ঘরে ঠান্ডা হাওয়া ঢোকে হুহু করে। খাওয়ার কোনও ব্যবস্থা করা হয় না। সমস্ত ব্যবস্থাই অব্যবস্থায় ভরা।
এরপরেই যে তিক্ত অমানবিক ঘটনার কথা বললেন তা শুনতে আমারই খারাপ লাগছিল। সাধুবাবার কথায়,
– একবার শীতের সময় ফিরছি তোদের গঙ্গাসাগর মেলা থেকে। হাওড়া থেকে উঠেছি। বসে আছি ট্রেনে। অন্য যাত্রীদের কোনও অসুবিধে হবে ভেবে বসে আছি বাথরুমের কাছে। ট্রেন চলছে তখন বিহারের মধ্যে দিয়ে। পরে কোনও একটা স্টেশন থেকে উঠল একজন চেকার। সঙ্গে দুজন পুলিশ। ওরা জানে টিকিট থাকে না সাধুদের। তবুও ট্রেনে উঠেই টিকিট চাইল আমার কাছে। বললাম টিকিট নেই। এবার টাকা চাইল। বললাম টাকাও নেই। এবার ওরা আমার গায়ে জড়ানো কম্বলের ভিতরে কাঁধ থেকে টেনে বের করে নিয়ে নিল ঝুলিটা। তারপর দুজনে হাতড়ে দেখল কিছুই নেই। বেটা, দুঃখের কথা তোকে আর কি বলব? এবার পুলিশ দুটো আমার গা থেকে জোর করে কেড়ে নিল কম্বলটা। অনেক অনুরোধ করলাম। কোনও কথাই শুনল না। সোজা নিয়ে চলে গেল। নেমে গেল পরের স্টেশনে। গরমের সময় হলে কষ্ট হত না। গায়ে ঢিলপাতলা একটা জামা। শীতের রাত। ঠান্ডায় দেহটা আমার জমে এল। কাঁপতে লাগলাম ঠকঠক করে। এইভাবে দুটো রাত ট্রেনে কাটিয়ে এলাম দিল্লিতে। তুই তো জানিস, শীতকালে ওদিকটায় কেমন ঠান্ডা পড়ে। দিল্লিতে যাওয়ার পর এক ভক্ত একটা কম্বল কিনে দিয়েছিল পরে।
একটু থেমে আবার মলিন মুখে,
– ঝুলিতে দু-চার টাকা থাকলেও তাও কিছু পুলিশ, ট্রেনের চেকার কেড়ে নেয়। কিছু বলতে পারি না। টিকিট থাকে না বলে এইসব অত্যাচারী অর্থপিশাচদের অত্যাচারের প্রতিবাদও করতে পারি না। দুঃখের কথা কি বলব বেটা, অনেক সময় বিহারের কিছু পুলিশ আর চেকার আছে, যারা ভাবে সাধুরা নেংটির মধ্যে টাকা লুকিয়ে রাখে। তোর বিশ্বাস হবে না বেটা, ওইসব ডাকুরা ঝুলিতে টাকা না পেলে নেংটি পর্যন্ত খুলে দেখে। এ অভিজ্ঞতা আমার একবারের নয়, অনেকবারই হয়েছে। আমি বহু সাধুর মুখে ওদের এই ব্যবহার ও অত্যাচারের কথা শুনেছি বহু জায়গায় বহুবার। দুদিনের সুখের জন্য সাধুদের ভিক্ষে করা দু-চার টাকা কেড়ে নেয় এরা। বেটা, সাধুদের সাময়িক কিছু কষ্ট হয় ঠিকই তবে নিশ্চিত জানবি, এর ফল ওদের ভোগ করতেই হবে।
সাধুবাবা ফরসা। দেখলাম, ক্রোধে আর উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে মুখখানা। তারপর উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
– কামার্ত নারী যেমন স্থানকালপাত্র বিচার করে না কাম চরিতার্থ করার জন্য, তেমন এইসব অর্থলোভীরাও সাধুসন্ন্যাসী পরমান্নভোজীদের কথা একবারও ভাবে না অর্থের জন্য। যে কোনওভাবে অর্থলালসা চরিতার্থ করাই এদের উদ্দেশ্য। নইলে কেউ সাধুদের নেংটি খুলে দেখে, টাকা আছে কিনা?
দ্বারকা থেকে ফিরে আসি হরিদ্বারে। এবার জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, সেই বারো বছর বয়েসে গৃহত্যাগ করেছেন, এখন চলছে পয়ষাট। এই সময়ের মধ্যে জব্বলপুরে আপনার গ্রামের বাড়ি দর্শন করতে গেছিলেন?
এ প্রশ্নে সাধুবাবার মুখখানা মলিন হল মুহুর্তমাত্র। পলকে কেটে গেল সে ভাবটা। বললেন,
– বেটা, দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে কখনও যাইনি তবে বছর দুয়েক আগে গেছিলাম আমার গ্রামে। সেখানে গাঁয়ের কোনও চিহ্ন নেই। বড় বড় বাড়ি ঘর তৈরি হয়েছে। আমূল পরিবর্তন হয়েছে রাস্তাঘাটের। বেটা, কিছুই চিনতে পারলাম না।
– বাবা, আপনি এখন থাকেন কোথায়? গুরুজি কি এখনও দেহে আছেন?
এতক্ষণ পর ভাঁজ করা কম্বল থেকে নেমে বসলেন মাটিতে। আমি যেমন বসেছিলাম তেমনই রইলাম। বেশ লম্বা একটা হাই তুলে বললেন,
– আমার গুরুজির ডেরা দেরাদুনের এক পাহাড়িগুহায়। হরিদ্বারে এসে গুরুজির আস্তানায় একবার যাই। কয়েকদিন থেকে চলে আসি। বিভিন্ন তীর্থে ঘুরে বেড়াই। স্থায়ী ডেরা কোথাও নেই। জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেল এইভাবে। আমার গুরুজির দেহান্ত হয়েছে বহু বছর আগে।
শ্রাবণীমেলায় এত চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যেও আমার মন নেই অন্য কোনও দিকে। সাধুবাবার মনটাও রয়েছে আমার কথা শোনায়। বললাম,
– বাবা, আপনার জীবনে এমন কোনও ‘চমৎকারী’ ঘটনা কি ঘটেছে যা আজও আপনি ভুলতে পারেননি?
– হাঁ হাঁ বেটা, একবারই একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল আমার জীবনে। গুরুজি তখন দেহে নেই। আমি গুরুজির পাহাড়িগুহায় ছিলাম কিছুদিন। সাধনভজন করতাম। একদিন তখন বেলা সাড়ে দশটা এগারোটা হবে। হঠাৎ গুহার বাইরে ভিতরে ঘন অন্ধকার হয়ে গেল। দেখি রক্তমাংসের দেহে মহাদেব সামনে এসে হাজির। বিশাল দেহ। জ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত হচ্ছে সারাদেহ থেকে। মিনিট দুয়েক দর্শন দিয়ে মিলিয়ে গেলেন। ‘উস দিন মেরা বহুত ডর লাগা।’ তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমার জীবনে আর চমৎকারী কিছু ঘটেনি।
সাধুসন্ন্যাসীদের মুখ খেকে দেবদেবীদের প্রত্যক্ষ দর্শনের কথা এইভাবে কাউকে বলতে শুনিনি। দশনামী সম্প্রদায়ের এই সাধুবাবার উপাস্য দেবতা মহাদেব। কতশত জন্মের সুকৃতি থাকলে তবে এমন স্থূলদেহে দর্শন হয় উপাস্যের। কত ভাগ্যবান এই সাধুবাবা। তাঁর দর্শনের কথা শুনে আনন্দে আমার চোখে জল এসে গেল। বারবার প্রণাম করলাম পায়ে হাত দিয়ে। স্নেহাশীর্বাদের হাতদুটো বুলিয়ে দিলেন মাথায়। মুহুর্তের জন্যে কণ্ঠ যেন আমার রোধ হয়ে এল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললাম,
– বাবা, আপনাকে দেখে আমার মনে হয় আপনি সবসময় আনন্দে থাকেন। কি করলে মানুষ সংসারে থেকেও সদাসর্বদা আনন্দে থাকতে পারে, এমন পথটা একটু জানাবেন দয়া করে?
খুশিতে ডগমগ হয়ে সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, একা চাঁদ পারে রাতের অত্যন্ত ঘন অন্ধকার দূর করতে। আকাশের অসংখ্য তারা তা পারে না। সুগন্ধি ফুলেভরা একটা গাছই যেমন আমোদিত করতে পারে সমগ্র বনভূমি, তেমনই একমাত্র ভগবানের নামগানই পরমানন্দে আনন্দিত করতে পারে মানুষের মনোভূমি।