খাওয়ার উচিৎ ও অনুচিত, প্রসাদ পেলে কি করতে হয়, জানালেন সাধুবাবা
নানা জায়গায় খেয়ে থাকি। হোটেলে, পথেঘাটে দোকান থেকে খাবার কিনে, কখনও কারও বাড়ি কিংবা কোনও নিমন্ত্রণে খেয়ে থাকি। এই খাওয়াটা কি উচিত, না অনুচিত।
সারাজীবনে যেসব সাধু-মহাত্মাদের সঙ্গ করেছি তাঁদের মধ্যে এক-আধজন ছাড়া সকলেই বয়স্ক। কারণ, এঁদের জীবনে চলাটা বেশি, সঙ্গে দেখাটাও। অল্প বয়সীদের চলাটা কম, ফলে দেখাটাও কম। আর বলে রাখি মোক্ষভূমি হরিদ্বার আমার জীবন, হরিদ্বার আমার মন, হরিদ্বার আমার দেহ সব, সব। যতবার গেছি হরিদ্বারে, কখনও বিমুখ করে ফিরিয়ে দেয়নি। হরিদ্বারে মা গঙ্গা হাত উপুড় করতে জানে, হাত পাততে শেখেনি।
হর-কি-পেয়ারি সব সময় কোলাহলমুখর। হরিদ্বার সুন্দর, আরও সুন্দর করে তুলেছে তরতরিয়ে বয়ে যাওয়া অমৃতবাহী গঙ্গা। অসংখ্য মানুষের মধ্যেও আমার চোখ পড়ল অতি বৃদ্ধ এক সাধুবাবার উপর। কাছাকাছি হয়ে মুখে ‘গোড় লাগে বাবা’ বলেও প্রণাম করলাম পায়ে হাত দিয়ে। তাঁর শীর্ণ হাতটা মাথায় স্পর্শ করে মুখে বললেন,
– আনন্দ্ মে রহো বেটা।
সাধুবাবার মাথায় বাঁধা একটা পাগড়ি। বয়সের ভার চোখে পড়ার মতো। তামাটে রং। মাঝারি গড়ন। সারা জীবনের সম্বল ঝোলাটা সাধুবাবার সঙ্গেই আছে। জিজ্ঞাসার উত্তরে হিন্দিভাষী সাধুবাবা জানালেন,
– বেটা, আমি গিরি সম্প্রদায়ের সাধু। বয়েস এখন ১২০ বছর। গেছিলাম বদরীনারায়ণে। আজই ফিরেছি। দু-চারদিন থাকব হরিদ্বারে তারপর ফিরে যাব ডেরায়।
মলিন বেশধারী সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা ডেরা কোথায় আপনার? বদরীনারায়ণে কি বাসে করে গেছিলেন?
সাদা কালো দাড়িভরা একগাল হাসিভরা মুখে বললেন,
– না না বেটা গাড়িতে নয়। পায়ে হেঁটেই গেছিলাম নারায়ণদর্শনে। (এবার চোখ বুজে) সেই দশবছর বয়সে গৃহত্যাগের পর প্রথম আমি বদরীজি দর্শন করি গুরুজির সঙ্গে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিবছর নারায়ণের দর্শনে যাই পায়ে হেঁটে। আজ পর্যন্ত একবারও বাধা পড়েনি। তখন হিমালয়ের পথ যে কি দুর্গম ছিল তা তুই কল্পনাতেও আনতে পারবি না।
কথাটা শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। সাধুবাবার বয়েস এখন ১২০। তার মানে ১১০ বার বদরীনারায়ণ দর্শন করেছেন পায়ে হেঁটে। আনন্দে মাথাটা সাধুবাবার পায়ে ঠেকিয়ে বার বার প্রণাম করতে লাগলাম। তিনিও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আনন্দে জল বেড়িয়ে এল দুচোখ বেয়ে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললাম,
– বাবা, আজ থেকে ১০০ বছর আগে ওপথে তো এখনকার মতো খাবার পাওয়া যেত না, কি খেতেন? খাবার জুটত কোথা থেকে?
প্রসন্নচিত্ত সাধুবাবা বললেন,
– খাওয়ার ব্যাপারটায় আমার কোনও চিন্তা থাকত না। গুরুজিই জোগাড় করতেন।
জানতে চাইলাম,
– তখন তো পথে তেমন কোনও চটি বা দোকানপাট, এমন কি কাছে পয়সা থাকলেও তো জিনিস পাওয়ার উপায় ছিল না, খাবার জুটত কোথা থেকে?
এতক্ষণ বেশ খই ফুটছিল মুখ থেকে। এখন আর কোনও কথা বলছেন না। বুঝলাম, এবার হাঁড়ির খবর বলতে হবে তাই সাধুবাবা চুপ করে আছেন। এ বান্দা যে কি, পেটের কথা কিভাবে বের করতে হয় সে বিদ্যেটা আমার ভালোই জানা আছে। রমণীকুল বশ হয় আদরে, সাধু বশ হয় আমার আবিষ্কারে পায়ে ধরলে। খপ করে পা দুটো ধরে বললাম,
– বাবা, দুর্গম পথে খাবার জুটত কিভাবে তা না বললে আপনার পা ছাড়ব না।
সাধুবাবা ফিসফিস করে বললেন,
– বেটা, পা দুটো ছেড়ে দে। লোকেরা দেখলে কি ভাববে বলত!
আমার ওই একই কথা, না বললে ছাড়ব না। এইভাবে মিনিট পাঁচ সাত কাটার পর সাধুবাবা পা থেকে হাতটা সরিয়ে দিতে আর জোর করলাম না। সোজা হয়ে বসলাম। বুঝলাম, ওষুধটা কাজে লেগেছে। এবার সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
– আমার কথায় তোর কতটা বিশ্বাস হবে জানিনা তবুও বলছি। আমার গুরুজি মহারাজ যোগী ছিলেন। এমন কোনও কাজ ছিলনা যা তাঁর অসাধ্য। পথে কোথাও খাবার কিছু জুটলে তা গুরুজি ভিক্ষে করে আনতেন, গ্রাম পড়লে সেখানেও গৃহস্থের বাড়ি গিয়ে ভিক্ষে করতেন।
যখন এসবের সুযোগ থাকত না তখন তিনি আমাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে যেতেন জঙ্গলের মধ্যে। সামান্য সময় পরে ফিরে আসতেন আটা সবজি নিয়ে। তারপর আমরা ‘রোটি সবজি পাকিয়ে খেতাম’। তখন বয়স কম। অত কিছু বুঝতাম না। পরে বুঝেছি যোগ প্রভাবেই তিনি আহার সংগ্রহ করতেন, তবে অকারণ ‘যোগশক্তি’ প্রয়োগ করতেন না।
একথা শুনে আনন্দে মনটা আমার ডগমগ হয়ে উঠল। বুঝলাম, যোগীর চ্যালা যখন, তখন সাধুবাবাও এ বিদ্যায় কম যায় বলে আমার অন্তত মনে হয় না। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, সমস্ত তীর্থদর্শন করেছেন?
সাধুবাবা এতক্ষণ বসেছিলেন বাবু হয়ে। এখন ডান পা-টা মোড়া অবস্থায় বাঁ পায়ের উরুতে তুলে দিয়ে বললেন,
– হাঁ বেটা, ভারতের সমস্ত তীর্থদর্শন করেছি। এমনকি সাধুজীবনের প্রথম অবস্থায় আমার গুরুজির সঙ্গে ‘মানব-কৈলাস অউর হিংলাজমাতাকো ভি ম্যায়নে দর্শন কিয়া’।
শতশত পথচলতি সাধুসঙ্গ করেছি তবে হিংলাজ গেছেন, এমন সাধুজীবনে পেয়েছি মাত্র দু-একজন। জানতে চাইলাম,
– আপনি যখন গুরুজির সান্নিধ্যে এলেন তখন আপনার গুরুজির বয়স কত?
‘জয় গুরু মহারাজ কি জয়’ বলে একটা ধ্বনি দিয়ে দুহাত জোড় করে গুরুজির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে বললেন,
– ওই সময় গুরুজির কাছে শুনেছি বয়স তখন তাঁর প্রায় ১৪০ বছর। যোগীদেহ ছিল তাঁর। চেহারা দেখে বোঝার উপায় ছিল অত বয়েস হয়েছিল।
এরপর নানান বিষয় ও প্রসঙ্গে অনেক অ-নে-ক কথা হল। কথা প্রসঙ্গে বললাম,
– আমরা গৃহী। বিভিন্ন সময় নানা জায়গায় খেয়ে থাকি। এই যেমন ধরুন, হোটেলে, পথে ঘাটে চলতে চলতে কোনও দোকান থেকে খাবার কিনে, কখনও বন্ধুর বাড়ি কিংবা কোনও নিমন্ত্রণে খেয়ে থাকি। এই খাওয়াটা কি উচিত, এতে কি কোনও অকল্যাণ হয়?
প্রায় ঘণ্টাদুয়েক কথা হল। একের পর এক প্রশ্ন করছি তাঁর ফেলে আসা জীবন প্রসঙ্গে অথচ চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ নেই এতটুকু। কথার শুরু থেকে এই পর্যন্ত সাধুবাবার হাসি মাখা মুখ। এমনটা গৃহীদের নয়, সাধুদেরই হয়ে থাকে। উত্তরে জানালেন,
– বেটা, যে কোনও দ্রব্য অর্থের বিনিময়ে কিনে খেলে কোনও দোষ হয় না। পরিশ্রমের অর্থ দ্রব্যের দোষ নষ্ট করে দেয়। যে কোনও সাধনভজনশীল মানুষের হাতের খাবার খেলে কোনও দোষ হয় না। আর দোষ হয় না দীক্ষিতদের হাতের খাবার খেলে।
একটু থামলেন। একনজর দেখে নিলেন বহমান গঙ্গা আর হর কি পিয়ারীতে চলমান তীর্থযাত্রীদের। আমার কোনও দিকে নজর নেই। সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, এ ছাড়া আর কোনওভাবে কারও হাতে স্পর্শকরা খাবার না খাওয়াই ভালো। স্পর্শজনিত কারণে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে স্পর্শকারীর কামনাবাসনা ও রিপুর প্রভাব মুহুর্তে সংক্রামিত হয় গ্রহীতা ওই খাবার খেলে। এটা কিন্তু কথার কথা নয়। জ্ঞাননেত্র না খুললে এই সংক্রমণটা দেখা যায় না খালি চোখে। স্পর্শদোষের কারণে মনের অস্থিরতা বাড়ে অন্যের রিপুর প্রভাবে। ভগবানে নিবেদিত দ্রব্য গ্রহণে বাধা নেই। সাধারণ গৃহীদের সাধনভজনের মাধ্যমে যথেষ্ট শক্তি হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা কম। ফলে তাঁদের দেহমনের ক্ষেত্রে বিষয়টা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ভিতরে শক্তি এসে গেলে তখন আর সে ভয়টা থাকে না। তখন কোনও বিচার না করেও খাওয়া যায়। স্পর্শদোষ ভিতরে ক্রিয়া করা বা দাঁড়াতে পারে না।
আবার একটু থামলেন। এখন আমার চোখে চোখ রেখে হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
– বেটা, যে কোনও দেবদেবীর প্রসাদ যেকোনও মানুষ দিলে তার কোনও বিচার করতে নেই। দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রসাদে তাঁরই গ্রহণজনিত ভগবদশক্তি পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকে, যদি তা শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে নিবেদিত হয়ে থাকে। তাই প্রসাদ পাওয়ামাত্র গ্রহণ করতে হয়। নইলে ভগবানের শক্তিকে ছোট করে দেখা হয়। তবে বেটা এখানে একটা কথা আছে। তোরা তো ‘বঙ্গালী’, মাছ মাংস খেয়ে থাকিস। ‘কালীমাঈয়ার’ ভোগে লোকে পাঁঠাবলিও দিয়ে থাকে। বৈষ্ণবরা, এমনকি বাঙালিদের অনেকেই মাছ বা মাংস খায় না। তাদের কাছে মাছ বা মাংস প্রসাদ এলে তা স্পর্শ করে নমস্কার ও শ্রদ্ধা জানাবে কিন্তু গ্রহণ করবে না। অবজ্ঞা তো কখনওই নয়। একথাটা বেটা স্মরণে রাখিস।
নির্লিপ্ত সাধুবাবা বলে চলেছেন নির্বিকারভাবে। জানতে চাইলাম,
– বাবা, ভক্তি আর বিশ্বাস, এ দুটো কথার প্রকৃত অর্থটা কি বলবেন দয়া করে?
মাথাটা দোলাতে দোলাতে বললেন,
– বেটা, আমরা কথায় কথায় বিশ্বাস ভক্তি কথাটা প্রায়ই বলে থাকি বটে তবে শব্দ দুটোর অর্থের অনেক ফারাক। যেমন, বিশ্বাস মানে ভগবান বিষয়ে, ভগবৎ বিষয়ে যা কিছু, তার সমস্ত কিছুতেই অমলিন কপটতাশূন্য নির্মল ও নিখাদ স্থির ভাবনার নাম বিশ্বাস। বেটা, আমরা বিশ্বাস কথাটা বলি বটে, তবে শব্দটা বড় কঠিন।
জগতের যে কোনও বিষয় বা বস্তুতে বিচারের সঙ্গে বিশ্লেষণ করার পরে অন্তরে যে বিষয়টা আসে, সেটা কিন্তু বিশ্বাস নয়, জ্ঞান বলে তাকে। একেবারে নির্বিচারে ভগবানকে বিশ্বাস করলে অন্তরে যে ভাব পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত হয় সেটা হল ভক্তি। বুঝলি বেটা?
মাথাটা সজোরে নেড়ে বললাম বুঝেছি। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা সাধুসঙ্গ করলে কি ফল হয়?
আমার সঙ্গে কথা চলছে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে। এবার লম্বা একটা হাই তুলে বললেন,
– বেটা, আগুনের তাপে যেমন জল শুকিয়ে যায় তেমনই সৎসঙ্গ, সাধুদর্শন ও সাধুসঙ্গ করলে কর্মক্ষয় হয়। বৃক্ষ নদী আর সাধু, এ তিনের স্বভাব এক। বৃক্ষ কখনও ফল খায় না। ফল দান করে। নদী জল সঞ্চয় করে না, জল দান করে। সাধুজীবন অন্যকে অনন্ত সত্যের পথ দেখানোর জন্য। বেটা, নিয়মিত সাধুসঙ্গ করলে তার জাত যায়, কুলও হারায়, যেমন গঙ্গা জলে পড়লে অত্যন্ত মলিন ও অপবিত্র জলও গঙ্গাজল হয়ে যায়।
আমার কথা শেষ হবে না, না মরলে। আরও অনেক কথা হল সাধুবাবার সঙ্গে। এক সময় প্রণাম করে ফিরে এলাম আমার অস্থায়ী ডেরা মিশ্রভবনে।
(ছবি – শিবশংকর ভারতী)