গীতায় বলা শ্রীকৃষ্ণের মনকে স্থির করার পথ বোঝালেন সাধুবাবা
কেষ্টঠাকুর যত সহজে কথাটা বলেছেন, কাজটা তত সহজ নয়। গরুর শিং-এর উপর একটা সর্ষের যতক্ষণ স্থায়িত্ব, ততটুকু স্থিতি মনের নেই।
এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে ফুল্লরায়। নাটমন্দির, মন্দির, পথঘাটের আমূল সংস্কার হয়েছে। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অনেক হারিয়েছে ফুল্লরা। সালটা সম্ভবত ১৯৮৩। মন্দিরে যাত্রীসংখ্যা করগোণা। শনি মঙ্গলবারে ভিড়টা হয় বেশি। বারটা ছিল বুধ। ফলে লোক সমাগম একেবারেই অপ্রতুল। প্রসাদের দক্ষিণা জমা দিয়ে ভাবলাম মন্দিরের সামনে ঘাট বাঁধানো একটা বড় পুকুর আছে, ওখানে গিয়ে বসি। পায়ে পায়ে পুকুর ধারে আসতেই ‘যোগায় চিন্তামণি’ হয়ে গেল।
দেখছি এক বৃদ্ধ সাধুবাবা আপনমনে বসে আছেন বাঁধানো সিঁড়িতে। আর কেউ নেই। মনে হল তারাপীঠ থেকে লাভপুর হয়ে হয়তো যাবেন অন্য কোথাও। পরনে তারাপীঠের এক শ্রেণির লম্পট মদ্যপ ভণ্ড তান্ত্রিকের মতো লালবসন নয়। গেরুয়া বসন বহুবার কাচলে রঙের যে দশাটা হয় তেমন। পোশাকই বলে দিল, এ সাধু এ তল্লাটের নয়। মাতৃদর্শনে এসেছে, আবার চলে যাবে কোথাও। চেহারা দেখে মনে হল সাধুবাবা ষোলোআনা বাঙালি। কাঁচাপাকায় গালভরা দাড়ি। ‘সাজন’-এ মাধুরীর চুলের ছাঁট যেমন কাঁধ বরাবর, সাধুবাবার বিনা ছাঁটে দাড়ি পেট বরাবর। চেহারাটা তপোদগ্ধ। কালো না বলে বলি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। নির্মেদ ক্যাটরিনা চেহারা। বয়স আন্দাজ ৬৫/৭০-এর কাছাকাছি। এসব দেখছি পাশ থেকে। চোখদুটো মনে হচ্ছে টানাটানা। নাকটা তো বোঝাই যাচ্ছে টিকালো। বসা দেখে উচ্চতা বুঝতে না পারলেও আমার ধারণা সাড়ে পাঁচ ফুটের উপরে যাবে না, কমতে পারে। একটা ঝোলা, বড় একখানা ডাব্বা আর লম্বা ঢেউ খেলানো লাঠি একটা শোয়ানো আছে পাশে। এই পর্যন্ত আমার দেখা সাধুবাবা। এবার সামনাসামনি হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই মাথায় হাত দিলেন। পরে হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন। পাশে বসলাম। বললাম,
– বাবা, এখানে কোথাও থাকেন না মা ফুল্লরার দর্শনে এসেছেন?
প্রসন্ন হাসিভরা মুখে বললেন,
– না বাবা, আমি এখানে কোথাও থাকি না। আমি বৈষ্ণব সাধু। গুরুর আস্তানা বৃন্দাবনে, তবে আমার কোনও ডেরা নেই। নানা তীর্থে ঘুরে বেড়াই। তারা মাকে দর্শন করে আজই এলাম মা ফুল্লরার দর্শনে। এখানে এসেছি বেশ কয়েকদিন হল। বীরভূমের চারটে পীঠস্থান দর্শন করেছি। এখান থেকে কঙ্কালীতলা হয়ে বোলপুরে যাব। তারপর চলে যাব মন যেখানে চায়।
ছোটবেলার মুখস্থ বিদ্যার মতো গড়গড় করে বলে গেলেন সাধুবাবা। বুঝে গেলাম কথা বলে মজা হবে। সাধুসন্ন্যাসীরা কেউ মুখ খুলতে চান না। পায়ে ধরে, কয়েক গ্যালন তেল মাখানোর পর মুখ খোলেন। আনন্দে মনটা আমার ভরে গেল। ভাবলাম, কথা হবে অনেক। বললাম,
– বাবা, আপনি কি এখানে আজ প্রসাদ পাবেন?
সাধুবাবা বললেন,
– হ্যাঁ বাবা, আমি নাম লিখিয়ে আমাকে মানুষের দান করা টাকা প্রসাদের জন্য মূল্য হিসাবে দিতে গেলাম, মন্দিরের পূজারি তা নিলেন না, বললেন প্রাণভরে যেন মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করি।
এবার একসঙ্গে প্রশ্ন করলাম অনেক,
– বাবা দয়া করে কিছু মনে করবেন না, কয়েকটা জিজ্ঞাসা আছে আমার। এখন বয়েস কত হল? বাড়ি কোথায় ছিল? কত বছর বয়েসে গৃহত্যাগ করেছেন?
কোনও রকম সঙ্কোচ না করে সাধুবাবা বললেন,
– বাবা, আমি তো লেখাপড়া জানিনা। সাল তারিখের হিসাব করতে পারব না। যখন দেশ স্বাধীন হয় তখন আমার বয়স একুশ। এটুকুই বলতে পারব। আমার বাড়ি আর জন্মস্থান পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলায়। যতদূর মনে পড়ে, পনেরো থেকে আঠারোর মধ্যে বাবা মা দু’জনেই গত হন। আমি তাদের একমাত্র সন্তান। স্বাধীনতার বছরে আমি জায়গা জমি ফেলে দিয়ে চলে এলাম এদেশে। আসার সময় ভাবলাম, সংসারে আমার আপন বলতে যখন কেউ রইল না, তখন সংসারে থেকে লাভটা কি, আর কাকে নিয়ে থাকব? পূর্ববঙ্গ থেকে এদেশে এসে ধাক্কা খেতে খেতে একসময় পৌঁছে গেলাম বৃন্দাবনে। তবে বৃন্দাবনে আমার ভেবে যাওয়া নয়, কিভাবে যেন চলেই গেলাম। ওখানে গিয়ে এক সাধুবাবার আশ্রয় পেলাম। তিনি আমার গুরু মহারাজ। তাঁর সঙ্গে দিনের পর দিন চলল ভারতের নানা তীর্থ পর্যটন। জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেল এইভাবে। বড় ভালো আছি বাবা, বড় আনন্দে আছি।
কথাগুলো বলে হাতজোড় করে কোনও এক অদৃশ্যদেবতার উদ্দেশ্যে নমস্কার জানালেন। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনার জীবনে এমন কোনও অলৌকিক ঘটনা আছে যা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস অনেক দৃঢ় করে তুলেছে।
কথাটা শোনামাত্র উচ্চস্বরে ‘জয় গুরুমহারাজ কি জয়’ বলে ধ্বনি দিয়ে বললেন,
– বাবা, গৃহত্যাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত অর্থোপার্জনের জন্য কোনও কাজ করিনি। কোনও সঞ্চয় নেই আমার। রাতে কি খাব, কোথায় থাকব জানি না। জীবনের এতগুলো বছর আমার কেটে গেল এইভাবে। আজ পর্যন্ত ভিক্ষে করিনি অথচ ভুল করেও মনে পড়ে কোনও দিন অভুক্ত থেকেছি। প্রতিদিন কোনও না কোনওভাবে আহার আমার জুটে গেছে বিনা চেষ্টাতে। এর থেকে বড় অলৌকিক ঘটনা এ জগতে আর কি হতে পারে, বলতে পারিস বাবা?
একথা শুনে মনে মনে বললাম। সাবাশ সাধুবাবা, তুমি যে অলৌকিকতার উদাহরণ দিলে তার জবাব নেই। এরপর আর কোনও কথা হয় না। বললাম,
– বাবা আমরা তো সংসারী তাই এমন একটা সুন্দর কথা বলুন, যে কথা শুনলে বা পালন করলে গৃহীদের কল্যাণ হয়।
কথাটা শুনে সাধুবাবা একগাল হাসতে হাসতে বললেন,
– বাবা, আমি লেখাপড়া জানি না। তোরা লেখাপড়া জানিস, তোরাই তো বলবি সুন্দর কথা। তবে একটা কথা বলি শোন, মেয়েরা অত্যন্ত সুন্দরী হলেও স্বামী ছাড়া কোনও রমণীই যেমন সুন্দরী নয়, মরাল মরালি ছাড়া জলাশয় যেমন সুন্দর নয়, বসন্তে কোকিলের কণ্ঠস্বর ছাড়া বসন্ত যেমন সুন্দর নয়, তেমনই মানুষের আকৃতি হলেও সেই নারীপুরুষ কোনও ভাবেই নারী বা পুরুষ নয়, যদি তার গুরুকরণ না হয়ে থাকে, নিত্য সাধনভজন না করে। নারীর স্বামীই যেমন অলঙ্কার তেমনই সাধুসন্ন্যাসী ও সংসারীদের ইহকাল পরকালের মনের একমাত্র অলঙ্কার তার ইষ্টমন্ত্র বা গুরু। সুতরাং আর যাই করিস, দীক্ষা না হয়ে থাকলে গুরুকরণ করে নিস।
এখানেই থামলেন না বৃদ্ধ। একদমে বলে গেলেন,
– বাবা, পৃথিবীতে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে বড় মূর্খ যে নিজেকে পণ্ডিত বা সবজান্তা মনে করে, সেই ব্যক্তিই বড় অসাধু যে সৎ বা সাধু মনে করে নিজেকে। সুতরাং ভুল করেও ওসব কথা ভাববিনে কখনও। মা যেমন রেখেছে তেমন থাকবি, তেমন ভাববি। দেখবি হাল ছাড়া, পাল ছাড়া, মাঝি ছাড়া তরী আপনি চলবে তরতরিয়ে। আর বাবা, ধৈর্যটা রাখবি। সংসারীদের ধৈর্যটা বড় কম। সব ব্যাপারটা এখনই, এই মুহুর্তে চাই, এখনই হলে ভালো। তা বাবা হয় না কখনও। ধৈর্যই জানবি সিদ্ধি লাভের কারণ।
থামলেন। এতক্ষণ বসেছিলেন সিঁড়ির দু-ধাপে পা ঝুলিয়ে। এবার বাবু হয়ে বসে চোখ বুলিয়ে নিলেন এদিক ওদিক, তবে শূন্যদৃষ্টি। আমি কোনও কথা বললাম না। সাধুবাবাই বলে বললেন,
– সাধুজীবনে দীর্ঘ পঞ্চাশটা বছর কেটে গেল। দেখলাম, তাঁর দর্শন তো দূরের কথা, অন্তরে তাঁর কোনও অনুভূতিও নয়। ভাবলাম, এবার সাধনভজন সব ছেড়ে দেব। আবার ভাবলাম, ধৈর্য ধরে চালিয়ে যাই, দেখি না গুরু করে কি? ধৈর্য ধরে লেগে থাকলাম, একসময় দেখলাম, যা চেয়েছি তার চাইতে বেশি পেয়ে গেছি। যা চাইনি তার চাইতে অনেক বেশি গুণ পেয়ে বসে আছি। যাদের ধৈর্য কম তারা জাগতিক ও পারমার্থিক কোনও কাজে সিদ্ধিলাভ করতে পারে না। একমাত্র মানসিক শান্তিহীন জীবনই তাদের চলার পথের, জীবনপথের সঙ্গী।
কথা কটা শেষ হতেই জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনার কথা শুনে মনে হল, ধৈর্য ধরে সাধনভজন করে আপনার আরাধ্য দেবতা তথা ইষ্টলাভ হয়েছে। সত্যি কথা বলছি বাবা, জপে বসলে সারা দুনিয়ার চিন্তা মনের মধ্যে পিকনিক করতে থাকে। মন অস্থির হয়ে ওঠে। তখন মনে হয় কতক্ষণে আসন ছেড়ে উঠবো। কি করলে জপের সময় মনের স্থিরতা আসবে, দয়া করে বলবেন?
হাসিভরা বৃদ্ধমুখের কথা,
– বাবা, গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘বহ্নির যেমন উষ্ণতা তেমন চঞ্চলতাই মনের ধর্ম। যোগ ও অভ্যাসের দ্বারা মনকে সংযত করতে হয়।’ বাবা, কেষ্টঠাকুর যত সহজে কথাটা বলেছেন, কাজটা তত সহজ নয়। গরুর শিং-এর উপর একটা সর্ষের যতক্ষণ স্থায়িত্ব, ততটুকু স্থিতি মনের নেই। নিয়মিত কিছু অভ্যাসযোগের মাধ্যমে মনের স্থিরতা এনে সাধনজীবনে সহজেই অনেক উন্নতি করা ও অগ্রসর হওয়া যায়।
কথার মাঝে কথা বলে কথার তারটা কাটলাম না। সাধুবাবা এবার চোখ বুজে বললেন,
– বাবা, জপের বিষয়ে কয়েকটা নিয়ম মেনে চললেই মনের অস্থিরতা কেটে তাঁর কাছে পৌঁছনোর পথ সুগম হয়। যেমন, দীক্ষালাভের পর যে আসনে বসে জপ করবি, সেই আসন কখনও পরিবর্তন করতে নেই। একই আসনে বসে উত্তর কিংবা পূর্বদিকে মুখ করে জপ করতে হয়। পূর্বদিকে মুখ মানে প্রতিদিন পূর্বমুখেই বসতে হবে। দিকের কোনও পরিবর্তন করা যাবে না। প্রতিদিন একই ঘরে, সম্ভব হলে একই জায়গায় বসতে হবে নিয়মিতভাবে। বসার স্থান পরিবর্তন করা যাবে না। বাবা, আর একটা কথা অত্যন্ত জরুরি হল, প্রতিদিন একই সময়ে জপ করতে হবে। আজ সকাল আটটা, আর একদিন সাড়ে আটটা নটা করলে চলবে না। প্রতিদিন আটটা মানে আটটা। এই নিয়ম অর্থাৎ এই অভ্যাসযোগে জপ করলে অতি দ্রুত মনের অস্থিরতা কাটবে, আসবে চিত্তের স্থিরতা। এর অন্যথা হলে মনের অস্থিরতা কাটার নয়।
কথা প্রসঙ্গে আরও নানা কথায় অনেকটা সময় কেটে গেল। মন্দিরে প্রসাদ পাওয়ার ডাক এল। সাধুবাবাকে প্রণাম করলাম। তিনি আমার মাথায় প্রথমে ব্রহ্মতালুতে, পড়ে দু-গালে আশীর্বাদী চুমু খেলেন। আনন্দে দেহমন আমার মাতোয়ারা হয়ে উঠল। আমরা দু-জনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম প্রসাদ পাওয়ার ঘরে।
opekhai thaki kobe wednesday aasbey, excellent