রোগমুক্ত দেহ ও দীর্ঘায়ু হওয়ার পথ জানালেন ১২১ বছরের সাধুবাবা
সারাজীবন কোনও রোগভোগ হয়নি। সাধারণ টুকটাক সর্দিকাশি জ্বর যেমন হয় তেমনটা হয়েছে। ওগুলো আপনা থেকে এসেছে, আপনা থেকেই গেছে।
অযোধ্যায় সরযূতীরে রামঘাট। ডানদিকে তাকালে শ্মশান। এই ঘাটের বাঁপাশে সাধুসন্ন্যাসীদের অসংখ্য ঝুপড়ি। ঝুপড়িগুলোর অধিকাংশ হোগলাপাতার। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রামায়ণীযুগের সরযূ। এত বয়সেও যেন পূর্ণ যুবতী। এতটুকু ভাঁটা পড়েনি দেহে। যৌবনের বান ডেকে চলেছে সরযূর বুকে। মনের সমস্ত আবিলতাই দূর হয়ে যায় সরযূর সঙ্গে দেহ মিলনে।
সরযূকে ডানপাশে রেখে চলেছি পাড় ধরে। বাঁদিকে সাধুদের ডেরা। এসে দাঁড়ালাম বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি ঝুপড়ির মধ্যে একটার সামনে। পরে একটা করে সব কটায় যাব। বাঁশের বেড়া। ছাউনি হোগলা পাতার। বেশ বোঝা যায় শীতকালে ঠান্ডা ঢোকে হু হু করে। এক পাল্লার দরজা। সেটাও বাঁশের চটার। প্রতিটা ঝুপড়ির উচ্চতা এমন, একটু ঘাড় নিচু করেই ঢুকতে হয়।
একটা ঝুপড়িতে ঢুকে পড়লাম। দেখি একজন বৃদ্ধ সাধুবাবা ফল কাটছেন। পরনে দেখে মনে হল একটা সাদা থানের দুটো টুকরোর একটা পরা। মাথায় জটা নেই। সামনের দিকের অনেকটা অংশে টাক। পিছন দিকে সামান্য চুল কাঁধের একটু উপরে। নাক টিকালো নয় তবে খাঁদাও নয়। মুখ আন্দাজে মাঝারি আকারের চোখ। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। কপালে গোপীচন্দনের তিলক, যে চন্দন অত্যন্ত প্রিয় গোপীমনোহারিণী যশোদানন্দনের। শ্রীরামজন্মভূমির সরযূতীরের সাধু যখন, তখন যে কেউ বলতে পারবে ইনি বৈষ্ণবসাধু। গাল ভর্তি পাকা দাড়ি তবে ঘন নয়। একেবারে পাতলা চেহারা, চোখে পড়ার মতো। গালে একটা দাঁতও নেই।
ঝুপড়িতে ঢোকামাত্র ফল কাটা রেখে উঠে দাঁড়ালেন। কোণ থেকে একটা চাটাই এনে পেতে দিয়ে বললেন,
– বৈইঠ বেটা বৈইঠ। কাঁহাসে আয়ে হো বেটা?
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। সাধুবাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার ফল কাটতে শুরু করলেন। ফলের মধ্যে রয়েছে একটা আপেল আর দুটো মর্তমান কলা। সাধুবাবার ডানপাশে একটা আসন পাতা। তারপাশে একটা ছোট্ট কাঠের সিংহাসনে শ্বেতপাথরের রাম লক্ষ্মণ ও সীতার বিগ্রহ। রামের নাছোড়বান্দা গোলাম বসে আছে ল্যাজ উঁচিয়ে। আর দেখলাম একটা ছোট কাঠের টুলে বসানো অতি বৃদ্ধ এক সাধুবাবার ছবি। অভিজ্ঞতায় বুঝে গেলাম এ বৃদ্ধ সাধুবাবার গুরুমহারাজ। কোথায় থাকি, কি করতে এসেছি এসব কথা বলে জানালাম, সম্পূর্ণ অযোধ্যা দর্শন করেছি এবং এখান থেকে যাব লখনউ হয়ে নৈমিষারণ্যে।
কথাগুলো শুনে সাধুবাবা বেশ খুশি হয়ে বললেন,
– বাঃ বেটা বাঃ, বহুত বড়িয়া, বহুত বড়িয়া। বেটা, একটু বোস। আমি রামজির ভোগটা লাগিয়ে দি তারপর তোর সঙ্গে ‘আরাম সে বাতচিত’ করব।
আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ালাম। সাধুবাবা অযোধ্যানাথ ও তার গুরুদেবকে ভোগ দিয়ে পরে আমাকে প্রসাদ দিলেন, নিজেও নিলেন। আমিই শুরু করলাম,
– বাবা, আপনার কপালের তিলক আর গলার কণ্ঠি দেখে মনে হয়েছে আপনি ‘শ্রী’ সম্প্রদায়ের সাধু। তা বাবা এখন বয়েস কত হল আপনার, বাড়ি কোথায় ছিল আর গৃহত্যাগ করেছিলেন কত বছর বয়েসে?
একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করলে সব সাধুরা যেমন একবার মুখের দিকে তাকায়, দেখলাম এই সাধুবাবাও ব্যতিক্রম নয়। এবার এক এক করে বললেন,
– বেটা, তুই ঠিকই বলেছিস, আমি শ্রী সম্প্রদায়ের সাধু। আমার বাড়ি ছিল মধ্যপ্রদেশের অনুপপুরে। এটুকুই মনে আছে। বাড়ি সম্পর্কে আর কিছু বলতে পারব না। সেই এগারো বছর বয়েসে গৃহত্যাগ করেছি আর এখন আমার বয়েস চলেছে ১২১ বছর।
এত বয়েস হলেও বয়েসের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাননি সাধুবাবা। জানতে চাইলাম,
– গৃহত্যাগের পর প্রথমে কোথায় গেলেন আর গৃহত্যাগই বা করলেন কেন?
সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, আমাদের সংসারে ভাইবোন মিলে আটজন। বাবা চাষের কাজ করে যা আয় করতো তাতে আমাদের সংসার চলত না। কোনও দিন অর্ধাহার, কোনও দিন অনাহারে দিন কাটতো সকলের। এইভাবেই সংসার চলত। একদিন দেখলাম এক সাধুবাবা যাচ্ছে বাড়ির সামনে দিয়ে। দেখা মাত্র মনে হল। এই সাধুবাবা তো কোনও আয় বা কাজ করে না অথচ তার তো বেশ চলে যাচ্ছে। আমি যদি সাধু হই তাহলে আমারও তো বেশ চলে যাবে। সুতরাং সংসারে থেকে দিনের পর দিন এইভাবে কষ্ট করে পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। এই ভাবামাত্র সেই সাধুবাবার পিছু নিলাম। আর ঘরে ফিরে যাইনি। সেই সাধুবাবাই পরবর্তীকালে আমার পরমাশ্রয়। ওখান থেকে বেড়িয়ে পড়লাম নানা তীর্থদর্শনে। বেটা, দেখলাম যতচিন্তা সব সংসারীদের। পেটের চিন্তা, মাথা গোঁজার চিন্তা, পরিধানের চিন্তা। সারা দুনিয়ার যত রকম চিন্তা তার সমস্ত ঠিকেদারি নিয়ে বসে আছে সংসারীরা। একমুঠো অন্ন, একটুকরো বস্ত্র আর নীল খোলা আকাশের নিচে মাইলের পর মাইল পড়ে আছে মাথা গোঁজার ঠাই। সাধুদের এই তিনটি বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়না, আপসে জুটে যায়।
একটু থেমে অতিবৃদ্ধ এই সাধুবাবা বললেন,
– এই দেখ না বেটা, এখন আমার কত বয়েস হয়েছে। বেশ কয়েক বছর হল গ্রামে আহার সংগ্রহে যেতে পারি না। রোজই কিছু না কিছু জুটিয়ে দেয় রামজি। তাঁর আশ্রয়ে তাঁকে নিয়ে পড়ে আছি। আমি অভুক্ত থাকলে রামজির নামে কলঙ্ক হবে। পাশে বসে সীতা মাঈয়া তাঁর অভুক্ত সন্তানকে দেখবে বলে তুই মনে করিস?
দৃঢ় বিশ্বাস আর আবেগে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে গেল। একটু সামলে নিয়ে চোখ দুটো মুছে বললেন,
– বেটা, নিজের ঘরে স্বয়ং ধনাধিপতি কুবের উপবাসী হয়ে থাকবে, একফোঁটা জল মিলবে না সরোবরে, সারা বন খুঁজে একটা কাঠ পাবি না যদি অযোধ্যানাথ রঘুবীর দয়া না করেন। একসময় একমুঠো অন্নের জন্য ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে ছিলাম বলে আজ বড় ভালো আছি আনন্দে আছি।
এতক্ষণ পর বৃদ্ধ সাধুবাবাকে বললাম,
– বাবা, সংসারে প্রায় প্রতিটা মানুষ অর্থ ধন সম্মান যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি ইত্যাদি চায় আকণ্ঠ। আমরা সংসারী যখন, তখন এই চাওয়াটা কি ঠিক, না বেঠিক?
কথাটা শোনামাত্র মুহুর্ত দেরি করলেন বৃদ্ধ। বললেন,
– বেটা, কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয়, এ বিচার করার মতো বোধ ও বুদ্ধি আমার নেই। ঠিক বেঠিক বিচারের মালিক আমার রামজি। তবে নিজে পথ চলে যেটুকু বুঝেছি তাতে আকাশস্পর্শী বৃক্ষ না হওয়াই ভালো। সারাজীবন অনেক অ-নে-ক ঝড়ঝাপটা সামলাতে সামলাতেই একদিন ঢলে পড়তে হবে নিরেট মাটিতে। এর চাইতে ভালো ছোট্ট একটা চন্দনগাছ হওয়া। নিজে সুগন্ধের জন্য আনন্দ পাবে, মানুষকেও আনন্দ দিতে পারবে তার সুগন্ধির জন্য।
প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,
– বাবা অসুস্থ হলে কে দেখাশোনা করে? ওষুধ আনেন কোথা থেকে?
কথাটা শুনে সাধুবাবা হেসে ফেললেন। হাসিটা দেখে মনে হল এটা সাধুবাবার কাছে ছেলেমানুষি প্রশ্ন। একভাবেই বসে আছেন তিনি। এতে বোঝা যায়, দীর্ঘকাল সাধনআসনে বসে তিনি আসনসিদ্ধ। কোনও চাঞ্চল্য ও অস্থিরতা নেই দেহমনে।
প্রসন্ন ও হাসিভরা মুখে বললেন,
– বেটা, সারাজীবন কোনও রোগভোগ হয়নি। সাধারণ টুকটাক সর্দিকাশি জ্বর যেমন হয় তেমনটা হয়েছে। ওগুলো আপনা থেকে এসেছে, আপনা থেকেই গেছে। জীবনে কখনও ওষুধ খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। এ মুহুর্তে আমার দেহ নীরোগ।
ভারতে এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রি ওষুধ। সরযূতীরে বসে ১২১ বছরের বৃদ্ধ এসব বলে কি। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, এরকম সুস্থ থাকার উপায়টা বাতলাবেন দয়া করে?
সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, আমার গুরুজি বেঁচেছিলেন ১৬০ বছর। তিনি বলতেন, মানুষ খায় বলে মরে। আমাকে বলেছিলেন, আহার ও খাদ্যদ্রব্যে লোভ ত্যাগ করলে রোগ হবে না। প্রতিদিন দুবেলা যেটুকু খেলে চলতে পারবি, দেহের অস্বস্তি হবে না অথচ মনেও তৃপ্তি হবে, ঠিক সেই পরিমাণ খাবি। এতে দেহ রোগ মুক্ত থাকবে ‘উমর বহুত লম্বি’ হবে।
সারাজীবন নিজের উপর প্র্যাকটিক্যাল করা সরযূতীরের এই বৃদ্ধ সাধুবাবা। মনে পড়ে গেল যক্ষরূপী ধর্মরাজের কথা। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অনেকগুলি প্রশ্ন করেছিলেন রাজা যুধিষ্ঠিরকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – রাজা বলতো, কি ত্যাগ করলে শোক হবে না? ক্রোধ ত্যাগ করলে শোক হবে না। কি ত্যাগ করলে মানুষ সুখী হবে? লোভ ত্যাগ করলে সুখী হবে। কি ত্যাগ করলে মানুষ ধনবান হবে? কামনা ত্যাগ করলে। বলতো রাজা, কি ত্যাগ করলে মানুষ লোকপ্রিয় হবে? অভিমান ত্যাগ করলে মানুষ লোকপ্রিয় হবে। কি ত্যাগ করলে রোগ হবে না? এর উত্তরটা সাধুবাবার মতো যুধিষ্ঠিরের প্র্যাকটিক্যাল করা ছিল না, জানা ছিল না। সেই জন্যই তো ১৯৮০ সালে বৃদ্ধের সঙ্গে যখন কথা বলেছিলাম তখন তাঁর বয়েস ১২১ আর রাজা যুধিষ্ঠির দেহ রক্ষা করেছিলেন ৯০ বছর বয়সে।
প্রসঙ্গক্রমে সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, রোগ শোক বিপদ অনুতাপ রাজরোষ (মামলা মোকদ্দমা, জেল হাজতবাস) এগুলি সব নিজ কৃত অপরাধের ফল। এগুলি খণ্ডন হয় অর্থনষ্টের দ্বারা, মানসিক কষ্ট ও ক্লেশ দ্বারা। এমন কোনও কাজ কখনও করবি না যাতে ওই বিষয়গুলির মুখোমুখি হতে হয়। এগুলি সব মানুষের শান্তিহারক।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হয়ে গেল এবার উঠতে হবে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে শেষ প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, কি দেখে বোঝা যাবে একজন মহাত্মা বা সাধুসন্ন্যাসীর জীবনে তাঁর আরাধ্য দেব বা দেবীর দর্শনলাভ হয়েছে?
কথাটা শুনে বৃদ্ধ যেন আনন্দে উথলে উঠলেন। আবেগভরা কণ্ঠে বললেন,
– বেটা, কারও কথায়, ভাবে ও আচরণে সমস্ত বনই তুলসী বন, সমস্ত পাহাড় নুড়িই শালগ্রাম, নদীনালা সাগর পুকুর শুধু নয়, সমস্ত জলই যখন অন্তরে গঙ্গাজল হবে, তখন বুঝবি তার হৃদয় আসনে রাম বসেছে, দর্শনও হয়েছে।
একটু থামলেন। মুখের দিকে তাকালেন। বললেন,
– বেটা একজনকে (গুরু) ধরে চললে সে সব কিছু পায়। যে সব কিছু নিয়ে চলে তার সব কিছু যায়। গাছের গোড়ায় জল দিলে ফুল ফল সবই পাওয়া যায়।