প্রসাদের মাহাত্ম্য কথা জানালেন মা নর্মদার হাত থেকে প্রসাদ পাওয়া সাধুবাবা
এত রাতে ঘন গভীর অন্ধকারময় এই জঙ্গলে মেয়েটি কে, কোথায় থাকে এলই বা কোথা থেকে, বিস্ময়ে আমার বাকশক্তি তখন হারিয়ে ফেলেছি।
১৯৯৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। এই নিয়ে আসা হল সাতবার। ওঙ্কারেশ্বর পরিক্রমা করেছি এবার ১১ কিমি পায়ে হেঁটে। এবার অন্য কথা। ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে ওঠার ডানপাশেই শঙ্করাচার্যের তপস্যাগুহা। এর পাশ দিয়ে পরপর সিঁড়ি নেমে গেছে নর্মদার ঘাট পর্যন্ত। মন্দিরে ওঠার সিঁড়িতে পা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে ডানদিকে তাকাতেই নজরে এল এক অতিবৃদ্ধ সাধুবাবা। আর উঠলাম না, এখন নয়, পরে যাব ওঙ্কারেশ্বর দর্শনে।
ঘুরে এসে দাঁড়ালাম সাধুবাবার সামনে। সিঁড়িতে এক পাশে বসে আছেন এমনভাবে, যাতে তীর্থ ও স্নানযাত্রীদের আসা যাওয়ার এতটুকুও কষ্ট না হয়। একনজরে সাধুবাবা এইরকম। সারা মাথায় একটা কালো চুলের বংশ পর্যন্ত নেই। মাথাটা যেন শরতের কাশফুল। পাতলা ছিপছিপে চেহারা। পরনে এক টুকরো সাদা কাপড়। না পরলেই নয় এমন দশা কাপড়ের। খালি গা। বুকের লোমগুলোও ধবধবে সাদা। জীবনে যত পথচলতি সাধু দেখেছি, ঝুলি নেই এমন সাধু দেখিনি। এই প্রথমবার ঝাড়া হাত পা। গলায় একটা মালাও নেই। মুখখানা সুন্দর। সুন্দর খাড়া নাকটা। চোখদুটোও টানা টানা। গায়ের চামড়ার ভাঁজ দেখে বোঝা যায় বয়েস বেশ আঁচড় দিয়েছে। আমি যে সামনে দাঁড়িয়ে আছি, মনে হল না সাধুবাবা আমাকে দেখেছেন। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।
দেখলাম, সাধুবাবা এমনভাবে দুটো হাত দিয়ে হাতড়াচ্ছেন আমার মাথায় হাত দেওয়ার জন্য, তাতে মনে হল সাধুবাবা দৃষ্টিহীন। মাথাটা সাধুবাবার হাতে ঠেকিয়ে দিলাম। দুহাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি অবাংলাভাষী বুঝেই হিন্দিতে বললাম,
— বাবা, একটু বসব। কিছু কথা আছে।
ইশারায় সাধুবাবা বসতে বললেন। তিনি যে সিঁড়িতে বসেছিলেন ঠিক তার পরের সিঁড়িতে বসলাম পায়ের কাছে। সাধুবাবার কণ্ঠস্বরে তেমন জোর নেই। আস্তে আস্তে বললেন,
— বোল বেটা, তেরা কেয়া পুছনা হ্যায়?
বললাম,
— বাবা, আপ ইধার রহেতে হ্যায় কাঁহা?
সাধুবাবা তেমন আগের সুরেই বললেন একটা দিক নির্দেশ করে,
— বেটা, সারাটা দিন আমি ভগবান ওঙ্কারের চরণেই পড়ে আছি। সন্ধ্যার খানিক আগে প্রতিদিন যাই সিদ্ধেশ্বর মহাদেব মন্দিরে। রাতে ওখানে থাকি। সকাল হলেই চলে আসি। এখনও চলছে, এইভাবেই চলে আসছে আমার জীবন।
কথাটা শুনে কেমন যেন একটা খটকা লাগল মনে। জিজ্ঞাসা করলাম,
— বাবা, এখন বয়েস কত আপনার?
প্রসন্নতায় ভরা মুখে বললেন,
— বাবা, এখন বয়েস ১২০ বছর।
বয়েসটা শুনে আমি একটু নড়ে বসলাম। বলে কি সাধুবাবা! একশো কুড়ি! জিজ্ঞাসা করলাম,
— বাবা, আমার মনে হয়েছে আপনার দৃষ্টিশক্তি কিছুটা কমে গেছে। এত বয়েস তার উপরে চোখের এমন অবস্থা। কি করে একা একা পথ চলেন এমন পাহাড়ি পথে?
অত্যন্ত ধীর ও শান্ত কণ্ঠে তিনি জানালেন,
— হাঁ বেটা, আমি দুচোখে কিছুই দেখতে পাই না। কিন্তু গুরুমহারাজের কৃপায় আমার পথ চলতে এতটুকুও অসুবিধা হয় না। এই দেখ না। একটা লাঠি পর্যন্ত নেই হাতে।
কথাটা শুনে ভেবে অবাক হওয়া ছাড়া আমার আর কোনও গতি রইল না। জিজ্ঞাসা করলাম,
— বাবা চোখে দেখেন না অথচ পথ চলেন, এ কেমন করে হয়, কিভাবে সম্ভব?
হাসতে হাসতে সাধুবাবা বললেন,
— হাঁ, বেটা সবই সম্ভব। ভগবান শঙ্করের সংসারে সবই সম্ভব। আমি যখন পথ চলি তখন ‘বাবা ভোলেনাথ’ আমার হাত ধরে নিয়ে যায়। পাহাড়ি পথে এতটুকুও চোট লাগে না পায়ে।
এ কথা শুনে আমার মনে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস হল না। কারণ, আমার সঙ্গে ৯০ বছর বয়সের এক বৃদ্ধার অত্যন্ত প্রীতির সম্পর্ক ছিল। তিনি গোপালভক্ত ছিলেন। আমি বুড়িমা বলে ডাকতাম। বয়সের ভারে ন্যুব্জ বুড়িমা চোখে দেখতেন না, পথ চলতেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, কখনও গোপাল, কখনও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আবার কখনও মা কালীর জ্যোতির্ময় প্রসন্নমূর্তি তাঁর হাত ধরে পথচলায় সহায়তা করত। তিনি বলেছিলেন, জ্ঞাননেত্র খুলে গেলে বাবা এসব দিব্যদৃষ্টিতেই দেখা যায়। যাইহোক, বিষয়টি আমার জানা ছিল বলে আর ওই প্রসঙ্গে গেলাম না। জানতে চাইলাম,
— বাবা, আপনার বাড়ি কোথায় ছিল, কত বয়েসে এবং কেনই বা সংসার ছাড়লেন?
প্রায় সবক্ষেত্রেই দেখেছি সাধুসন্ন্যাসীরা ফেলে আসা জীবনপ্রসঙ্গ সব সময়েই এড়িয়ে চলেন। এই সাধুবাবার ক্ষেত্রে তেমনটা দেখছি না। বিরক্তিহীন মুখেই বললেন,
— মা মারা যায়। বয়েস তখন ৮-৯ হতে পারে। কেন যে সংসার ছেড়েছিলাম, তখন মনের অবস্থাটাই বা কেমন ছিল তা আমার স্মরণে নেই, বলতে পারব না।
জিজ্ঞাসা করলাম,
— বাবা, চোখে দেখেন না। কিন্তু ভিক্ষা করেন কি করে, আহার জোটান কোথা থেকে?
সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলছি শঙ্করাচার্যের তপস্যাগুহার পাশ দিয়ে নর্মদায় নেমে যাওয়া সিঁড়ির উপরে বসে। দেখছি একের পর এক আসছে অসংখ্য তীর্থযাত্রী। নর্মদায় স্নান সেরে ঘাটের পাশে বসে থাকা দোকানিদের কাছ থেকে পুজাসামগ্রী আর ফুলে ভরা ডালি নিয়ে চলেছে ওঙ্কারেশ্বর মহাদেব মন্দিরে। সাধুবাবা একভাবে বসেই কথা বলছেন। ভিক্ষার কথাটা শুনেই মুখে অস্ফুট (আঘাত পেলে যেমন হয়) বলে উঠলেন ‘হায় শঙ্কর, হায় শঙ্কর।’
একটু থেমে বললেন,
— বেটা, সংসারে মানুষের বুদ্ধি নষ্ট হয় দারিদ্রের কারণে। সমস্ত শুভ কর্মনাশ হয় অবহেলার কারণে, মানুষের জীবনে সব চাইতে বড় অসম্মানের কারণ কারও কাছে কিছু চাওয়া, প্রার্থনা করা। বেটা, এ জন্মে কারও কাছে কিছু চেয়ে নিজেকে কখনও অসম্মানের কারণ হতে দিইনি। আর আহারের কথা বলছিস? একটা তো পেট, সারাদিনে কিছু না কিছু জুটে যায় ভগবান ওঙ্কার মহাদেবের করুণায়।
সাধুসঙ্গের সময় আমার জিজ্ঞাসার কোনও মা বাপ থাকে না। আগে ভেবে রেখে পরে কোনও সাধু পেলে তাকে এইসব প্রশ্ন করব, এমনটাও থাকে না মাথায়। যখন যেটা মনে আসে সেটা বলি। তারপর কথার সুতো ধরে চলে কথা। হুট করে মাথায় এল চিমটের কথা। জানতে চাইলাম,
— বাবা, সাধুসন্ন্যাসীরা দেখেছি লোহার চিমটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই চিমটে কেন ব্যবহার করে?
সাধুবাবা কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক ছিলেন। কথাটা খেয়াল করেননি। কি জিজ্ঞাসা করলাম তা জানতে চাইলেন। আবার বললাম। উত্তরে জানালেন,
— বেটা, চিমটের প্রথম প্রয়োজন ধুনির কাঠ সাজানো। দ্বিতীয় ভজনের সময় চিমটে বাজাতে লাগে। আরও একটা বড় কাজ এতে হয়। বারোবছর হোমযজ্ঞের তাপ খেলে, অলক্ষ্যেই আপনা থেকে চিমটের মধ্যে একটা বিশেষ শক্তি সঞ্চারিত হয়ে যায়। তখন এই চিমটে স্পর্শমাত্র মানুষের রোগব্যাধিমু্ক্তি, শোকমু্ক্তি এমন নানান কাজ হয়।
বিষয়টা আমার জানা ছিল না। এবার জানতে চাইলাম,
— আমরা বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো দিয়ে যে প্রসাদ খাই তাতে কি আমাদের সত্যিই কোনও লাভ বা কল্যাণ কিছু হয়?
কথাটা শুনে মাথাটা একটু দোলালেন। কিছু একটা ভাবলেন। এতক্ষণ বসেছিলেন একটা সিঁড়িতে বসে পরের সিঁড়িতে পা ভাঁজ করে। এবার পা দুটো একটু টান টান করে মেলে ধরলেন। তারপর বললেন,
— বেটা, সাধারণত গুরু বা দেবতার উদ্দেশ্যে যে কোনও নিবেদিত বস্তুকে প্রসাদ বলে জানি। এটা গ্রহণে তাৎক্ষণিক দেহমনের কল্যাণ কিছু হয়। আসলে প্রসাদ বলতে যা, তা কিন্তু ওটা নয়। ওগুলো গুরু বা ভগবানের উচ্ছিষ্ট বস্তু। গুরুই বল আর শ্রীভগবানই বল, এঁদের দয়ালাভ, করুণালাভ, পরমানন্দলাভ, কৃপালাভকেই প্রকৃত প্রসাদ পাওয়া বলে। তবে এই প্রসাদ সহজে পাওয়া যায় না। গুরুপ্রদত্ত সমস্ত কাজগুলি যথানিয়মে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়মিত পালন করলেই এই প্রসাদ লাভ হয়।
হঠাৎ মাথায় জিজ্ঞাসা এল। জানতে চাইলাম,
— বাবা, আপনি যখন ঘর ছেড়েছিলেন, অত অল্প বয়সে সাধু হবেন এমন কথাটা তো আপনার মাথাতে ছিল না। যদি বলেন সংস্কারই আপনাকে এপথে টেনে এনেছে তাহলে বলব, পূর্বজন্মে কে কি করেছিল, তার প্রেক্ষিতে কি সংস্কার, তা আপনিও জানেন না, আমি না। এবার বলুন, কি করে, কেমন করে আপনি সাধু হলেন?
একথায় সাধুবাবার মুখখানা দেখলাম কেমন যেন একটা উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল। গোটা মুখমণ্ডলটা ভেসে উঠল দিব্য প্রসন্নতায়। হালকা হাসিতে ঠোঁটটা ভরে গেল। বৃদ্ধ বললেন,
— ঘর ছেড়ে তখন বেড়িয়েছিলাম কিসের টানে জানি না। এই জীবনে আসব এমনটা তখন ভাবিনি, এখন তো ভাবিই না। সংস্কারের ব্যাপারটা যদি উড়িয়ে দিস…
এটুক বলেই কয়েক মুহুর্ত থামলেন। তারপর বললেন,
— মেরা সাধু হোনে কা বাত ছোড় দে বেটা। ইনসান রমতে রমতে সাধু, উসকে বাদ সাধু রমতে রমতে রাম বন যাতা।
আমরা গৃহীরা প্রায় প্রত্যেকেই অন্যের কাছে সৎ ও সাধু সাজার জন্য আসল কথা গোপন করে সাধু সাজি। এই বৃদ্ধের যে সাধু সাজার কোনও ইচ্ছে নেই তা কথাতেই বোঝা গেল। সাধুবাবা যে প্রকৃতই ঈশ্বরে অনুরক্ত তার জ্বলন্ত প্রমাণ তাঁর প্রসন্ন মুখমণ্ডল, সুমধুর কথা, না এড়িয়ে কথা বলার আগ্রহ, আর কথায় ও ব্যবহারে সম্মান ও আন্তরিক স্নেহ প্রদর্শন। দু-এক কথায় ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে আমি আর ওই প্রসঙ্গে নতুন করে গেলাম না। জানতে চাইলাম,
— বাবা, প্রকৃত সাধু কে বা কারা? নানাভাবে কলুষিত আজকের এই সমাজে প্রকৃত সাধুসন্ন্যাসী কি আছে, না পেটের জন্য সাধুর ভেক ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
একসঙ্গে একরাশ প্রশ্ন। সাধুবাবার ভাবে কোনও বিকার ফুটে উঠল না। প্রায় মিনিট পাঁচসাত কিছু বললেন না। ভাবলাম, সাধুবাবা বোধহয় আমার কথা বুঝতে পারেননি। তাই আবার জিজ্ঞাসা করব বলে যেই উৎসুক হয়েছি তখন বললেন,
— বেটা, অঙ্গারের সমান গালাগালি, আগুনের সমান ক্রোধ, ধোঁয়ার সমান নিন্দা যিনি পরিহার করেছেন, গ্যাঁটে টাকা বাঁধেন না, হৃদয়ে কোনও বিষয়ে যার এতটুকুও সংশয় নেই, একটুও আকর্ষণ নেই কোনও নারীতে, সকল সুখেই যিনি সুখী, সকল দুঃখেও যিনি সুখী, মনের সমস্ত দ্বিধা মিটিয়ে যাঁরা সর্বদাই গান করেন রামরস, বেটা তারাই তো প্রকৃত সাধু।
জানতে চাইলাম,
— বাবা, বড় কোনও রোগে পড়েছেন কখনও?
মাথাটা দোলাতে দোলাতে বললেন,
— না, বেটা মহাদেব আর নর্মদামাঈর কৃপায় আজ পর্যন্ত কোনও বড় রোগ আমার হয়নি। টুকটাক শরীর খারাপ হলে ওঙ্কারেশ্বর মহাদেবের স্নানজল একটু মুখেগায়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যায়।
এবার জানতে চাইলাম,
— বাবা, নর্মদাতীরে ওঙ্কারেশ্বর মহাদেবের কোলে শুয়ে বসেই কাটে আপনার দিনগুলো। কখনও নর্মদা পরিক্রমা করেছেন?
এ কথায় একেবারে ডগমগ হয়ে উঠলেন খুশিতে। হাতদুটো হাতড়ানোর মতো করে বাড়িয়ে দিলেন। আমি মাথাটা সাধুবাবার হাতে স্পৰ্শ করাতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে প্রাণভরা আশীর্বাদ করতে লাগলেন। আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,
— বেটা, বহুত ভাগ সে ম্যায় আকেলা দো দফে নর্মদা পরিক্রমা কিয়া। আজসে কমসে কম ৮০-৯০ সাল পহলে হি কিয়া।
এখন সাধুবাবার অভিজ্ঞতার কথা জানব বলে জিজ্ঞাসা করলাম,
— বাবা, গুরুজির অপার অনন্ত করুণা না হলে এই পরিক্রমা করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। পথ যেমন দুর্গম তেমনই কষ্টকর। একটা ‘কহবত’ আছে, জরাজীর্ণ বা রোগগ্রস্ত মানুষ, পুরুষ কিংবা নারী যাই হোক না কেন, এরা শৃঙ্গার কামাদি উপভোগ করতে পারে না আবার ত্যাগও করতে পারে না, ঠিক যেমন দাঁতহীন কুকুর জিভ দিয়ে হাড় আস্বাদন করে, তেমনই আপনার মুখে নর্মদা পরিক্রমার কথা শুনে সেই রস আস্বাদন করা ছাড়া আমাদের আর গতি কোথায়? বাবা, নর্মদা পরিক্রমাকালীন আপনার নিজের চোখে অলৌকিক কোনও ঘটনা কি ঘটতে দেখেছেন?
অতিবৃদ্ধ প্ৰশান্তহৃদয় বললেন,
— বেটা, আমার পরিক্রমকালে একদিনের কথা। গভীর ঘন জঙ্গলে আমার নর্মদামাঈ ছাড়া আর কোনও সহায় নেই, সম্বল নেই। একবার পরপর একদিন দুদিন করে তিন তিনটে দিন পথে আমার আহার জুটল না। নর্মদার জল পান করেই একের পর এক জঙ্গল পার হয়ে চলেছি ক্লান্ত দেহে। চারদিনের দিন আমার দেহ প্রায় অচল হয়ে পড়ল। জঙ্গলেই অন্য কোনও পরিক্রমা করা সাধুর লতাপাতা তৈরি ভাঙা কুঠিয়াতে আশ্রয় নিলাম। রাতে জন্তুজানোয়ারের ভয়ে দিনের বেলাতেই যতটা পারলাম পুরনো লতাপাতা জোগাড় করে রাখলাম সারা রাত ধুনি জ্বালানোর জন্য। জানোয়ারেরা আগুনকে ভয় পায়। এতে প্রাণটা বাঁচবে, সাধনভজনের কাজটাও হবে। জঙ্গলে আলোটা কমে আসতেই ধুনি সাজিয়ে ধরিয়ে দিলাম।
একটানা হিন্দিভাষী একশো কুড়ির সুদর্শন সাধুবাবা একটু থামলেন। আমি এবার একটু ‘রিলিফ’ দেওয়ার জন্য তাঁর মেলে রাখা পা দুটো আমার কোলের ওপরে তুলে নিলাম। সাধুবাবার মুখখানায় দেখলাম লজ্জায়ভরা অস্বস্তি ফুটে উঠল। মুখে বলে ফেললেন,
— ‘রহেনে দে বেটা, রহেনে দে। তীরথ করনে আয়েবালা লোগ দেখ আর ক্যায়া শোচেগি?’
আমি ও কথায় কানই দিলাম না। খুব হালকাভাবে, এতটুকুও যেন ব্যথা না লাগে, এমনভাবেই পা দুটো টিপতে লাগলাম, সাধুবাবা আর বাধা দিলেন না। বুঝেছেন, বাধা দিলেও আমি শুনব না। বললেন,
— বেটা, কহবত আছে, দারিদ্র ও মৃত্যু এ দুটোর মধ্যে দারিদ্রকেই নিকৃষ্ট করা হয়েছে। তবে এখানে আমি আরও একটা যোগ করে বলতে চাই দারিদ্রের সঙ্গে ক্ষিদেটাও। মানুষের মৃত্যু খুব কম সময়েই কষ্ট দেয়, কিন্তু অনেক অ-নে-ক বেশি কষ্টদায়ক হয়ে থাকে দারিদ্র ও ক্ষুধা। বেটা, অনাহারের চার রাত চলছে। রাত তখন গভীর। বন্য জন্তু জানোয়ারের ডাক, নানান ধরনের পাখির ডানা ঝাপটানো আর উৎকৃষ্ট সুর ছাড়া চারদিক নিস্তব্ধ। ধুনিতে কাঠের জোগানের কমতি নেই। মুখে জপ চলছে অবিরত। একসময় দুচোখে নেমে এল তন্দ্রা। দেহ আর কতটা ধকল সইবে।
একটু থামলেন। কোনও কথা বলে তাঁর কথার তার কাটলাম না। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন এদিক ওদিক। কি দেখছেন বুঝলাম না। খানিক পরেই বললেন,
— বেটা, রাত তখন কটা হবে বলতে পারব না। হঠাৎ আমার তন্দ্রা টুটে গেল পায়ের শব্দে। ধুনির আগুনের আলোয় দেখি ১৩-১৪ বছরের একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল সামনে। শ্যামলা রং। একটা অপূর্ব আলোর আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে দেহ থেকে। টানা টানা ফালা ফালা চোখ। পরনে শাড়ি। পাতলা ছিপছিপে চেহারা হলেও কনুই ভরাট। একমাথা চুল পিঠ ছাড়িয়ে। এত রাতে ঘন গভীর অন্ধকারময় এই জঙ্গলে মেয়েটি কে? কোথায় থাকে এলই বা কোথা থেকে? বিস্ময়ে আমার বাকশক্তি তখন হারিয়ে ফেলেছি। বাহ্যজ্ঞান যেন লোপ পেতে চলেছে। হাতে একটা শালপাতায় গরমাগরম পুরিসবজি আর কিছু টুকরো ফল। আমার সামনে রেখে ইশারায় খেতে বলে বসলেন। আমি তাঁর ভুবনমোহিনী রূপ দেখতে দেখতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। পাখির ডাকে চোখ মেলতেই দেখলাম জঙ্গলে পাতার ফাঁকফোকর থেকে আলো ঢুকে পড়েছে। মা নর্মদার প্রসাদ পেয়ে দেহমন আমার জুড়োল।
সাধুবাবা থামলেন। দেখছি দুচোখ দিয়ে বয়ে যাওয়া নর্মদারই ধারা। চুপচাপ আছি। আমার যে কিছু বলার নেই। একশো কুড়ির প্রত্যক্ষ দর্শনের ধারায় আমি নিজেও ডুব দিয়ে নেয়ে নিলাম। তাঁর পা দুটো আমার কোলেই। বারবার প্রণাম করছি আর দুপা ঠেকাচ্ছি মাথায়। নির্বিকারভাবে বসে আছেন তিনি। পাশ দিয়ে তীর্থযাত্রীরা অনবরত যাওয়া-আসা করছে, তাতে আমাদের উভয়ের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। আমার আর সাধুবাবা কারও মুখে কোনও কথা নেই। দুজনেই কেমন যেন বুঁদ হয়ে আছি।
খানিকটা সময় কেটে গেল এইভাবে। এবার বললেন,
— বেটা, জীবনে এই প্রথমবার তোকে আমার নর্মদামাঈর দর্শনের কথা বললাম। অনিষ্ট হলে, কোনও কারণে মনস্তাপ হলে, নিজের ঘরের দোষক্রটি, কেউ বঞ্চনা কিংবা অপমান করলে কারও কাছে যেমন প্রকাশ করা উচিত নয়, তেমনই সাধুদের দর্শন ও নানা অনুভূতির কথা একান্তভাবে গোপন রাখতে হয়, প্রকাশ করতে নেই। কেন জানি না, মায়ের ইচ্ছায় তোকে ভালো লাগল তাই জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তাঁর করুণা ও মহিমার কথা তোকে বেটা বলেই ফেললাম।
সাধুবাবা থামলেন। একটা অপার্থিব আনন্দে মনটা ভরে উঠেছে। ওই কথারসের যে আনন্দ তা অত্যন্ত সুন্দরী রমণী ভোগেও হয় বলে মনে হয় না। আরও কোনও কথাই আসছে না মন থেকে। চুপ করে আছি। সাধুবাবা যেন করুণাময়ের প্রতিকৃতি বিগ্রহ। নিজেই বললেন,
— বেটা, দু-বার নর্মদা পরিক্রমা করেছি একথা তোকে আগেই বলেছি। প্রথম পরিক্রমা করে তার প্রায় বছরপাঁচেক পর আমি আবার পরিক্রমা করেছিলাম নর্মদামাঈকে। সে বার পরিক্রমাপথে এক সাধুবাবার কুঠিয়াতে আশ্রয় নিলাম। বিশ্রামের জন্যে তিনদিন ছিলাম সেখানে। প্রথম দিনেই লক্ষ্য করলাম সাধুবাবা সকাল থেকে রান্না করলেন না অথচ সন্ধ্যার পর একেবারে গরম গরম সবজি পুরি মিঠাই এনে আমাকে দিলেন, নিজেও খেলেন। ওই খাবার যেন অমৃত। বেটা আজও আমার মুখে লেগে রয়েছে।
কথায় কোনও কথা বলে অকারণ বিরক্ত করলাম না। কথাগুলো শুনছি একেবারে বিভোর হয়ে। তীর্থযাত্রীদের কোলাহল যেন কানেই ঢুকছে না। সাধুবাবা এক নাগাড়ে বলে চলেছেন,
— বেটা, মাথার মধ্যে তখন একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, সাধুবাবা যেখানে থাকেন, সেখানে লোকজন নেই অথচ খাবার পাচ্ছেন কোথা থেকে, দিচ্ছেনই বা কে? দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই সাধুবাবার প্রতিটা পদক্ষেপেই নজর রাখতে লাগলাম। দেখছি কোথায় যায়, কি করে? সারাটা দিন কাটল এরকমভাবে। সন্ধ্যা লাগার ঠিক খানিক আগেই আমাকে বললেন, ‘বেটা, তুই কুঠিয়াতে একটু বোস, আমি আসছি।’ বলে বেরিয়ে পড়লেন হাতে একটা থালা নিয়ে। আমি অত্যন্ত নিঃশব্দে অনুসরণ করলাম আশ্রয়দাতা বৃদ্ধকে।
আমার এই পক্ককেশ সাধুবাবা বলে চললেন আপনভাবে,
— বেটা, বেশ খানিকটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটার পর নর্মদার দেখা পেলাম। আরও কাছে এগিয়ে গেলেন সাধুবাবা। আড়াল থেকে আমিও। দেখলাম, সাধুবাবা নর্মদার জলে থালাটা ডুবিয়ে দিলেন। থালাটা ডুবতেই দেখি দুটো হাত জল থেকে কবজির আরও খানিকটা উপর পর্যন্ত উঠে এল একটা থালাসমেত। তাতে পুরিসবজি আর মিঠাইভরা। চোখে দেখেও চোখদুটো যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। সাধুবাবা নর্মদামাঈর প্রসাদ নিয়ে ফিরে এলেন। দিনান্তে একবার আহার করলাম পরিতৃপ্তির সঙ্গে। দু-বারে নর্মদা পরিক্রমাকালে নর্মদামাঈর এইভাবে দর্শন পেয়ে জীবনমন আমার ধন্য হয়ে গেছে, সার্থক হয়েছে আমার মনুষ্যজন্ম।
সাধুবাবার এই দুর্লভ অভিজ্ঞতার কথা শুনে জীবনমন তো আমারও ধন্য হয়ে গেল। আনন্দে জমজমাট মনটা জানতে চাইল,
— আর কোনও অলৌকিক ঘটনা ঘটেনি আপনার পরিক্রমাপথে?
সজোরে মাথাটা নেড়েও মুখে বললেন,
— না বেটা, নর্মদামাঈর আর কোনও ‘চমৎকারি’ আমি দেখিনি। সাধারণ যেসব পথকষ্ট সহ্য করতে হয় পরিক্রমাপথে তা সহ্য করেই আমার নর্মদা পরিক্রমা শেষ করেছি।