কবে, কখন, কি দিয়ে গণেশ পুজোয় উন্নতি, জানালেন সাধুবাবা
গণেশজি হলেন এক মহাশক্তি, সাফল্য ও কার্যসিদ্ধির দেবতা। মানুষের জাগতিক ও পারমার্থিক পথের বাধা ও বিপত্তিনাশক তিনি।
নয়নলোভন কাশ্মীর উপত্যকার সমস্ত বাসই ছাড়ে শ্রীনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে। সুসজ্জিত শ্রীনগরের কোল ছেড়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বাস এসে দাঁড়াল তুল্লামুল্লা গ্রামে। দূরত্ব ৪০ কিমি। বাস থেকে নেমে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালাম ক্ষীরভবানী মন্দিরের সামনে। এর ঐতিহাসিক নাম ভূক্ষীর বাটিকা। অতি প্রাচীন এই তীর্থের কথা উল্লিখিত হয়েছে ‘রাজতরঙ্গিণী’-তে।
আমলকি আর চিনার গাছে সাজানো ছোট্ট দ্বীপের মধ্যেই মন্দির। সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত মন্দিরটি মাঝারি আকারের। সোনার পাতে মোড়া মন্দিরের চুড়ো। প্রস্রবণে ভরা একটি কুণ্ড রয়েছে মন্দিরের সামনে। কুণ্ডের বাইরে বিশাল প্রাঙ্গণ। রেলিং রয়েছে কুণ্ডের পাড়ে। কুণ্ডটি প্রায় ত্রিশ ফুট সমচতুষ্কোণ। প্রাচীন এই কুণ্ডের নাম ক্ষীরসাগর। এরই জলে রেলিং-এর বাইরে থেকে তীর্থযাত্রীদের অনেকেই দুধ আর ক্ষীর অর্ঘ্য দেন দেবী ক্ষীরভবানীর উদ্দেশ্যে। এই কুণ্ডের সঙ্গে যোগ রয়েছে ঝিলমের।
মূল ভবানী মন্দিরের একদিকে পাণ্ডাদের বাড়ি ও দোকান, আর একদিকে পাশাপাশি রয়েছে মহাবীর, দেবী দুর্গা আর বুদ্ধদেবের মন্দির।
ধীরে ধীরে এলাম মূল মন্দিরের দোরগোড়ায়। আকর্ষণীয় মন্দিরটি নির্মাণ করেন তৎকালীন মহারাজ প্রতাপ সিংহ। শ্বেতপাথরের শিবলিঙ্গ আর কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত পার্বতীর বিগ্রহে গর্ভমন্দির জমজমাট। পার্বতী এখানে ভবানী নামেই নিত্য পুজো পেয়ে থাকেন।
ক্ষীরভোগ দেওয়া হয় বলেই দেবীর নাম হয়েছে ক্ষীরভবানী। মন্দিরে স্থাপিত দেবীর বিগ্রহটি পাওয়া যায় ক্ষীরসাগর কুণ্ডে। কাশ্মীরের প্রধান রইস পণ্ডিত বৃদ্ধলাল ধর। তিনিই গত শতকে কুণ্ডের পঙ্কোদ্ধারকালে দেবী মূর্তিটি পান। আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে এই তীর্থের উদ্বোধন ও সংস্কার করেন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ কৃষ্ণ পণ্ডিত তপিলু।
কুণ্ডের বাইরে বিস্তৃত প্রাঙ্গণের একপাশে একটা গেরুয়ায় চোখ পড়ল। দেখলাম বসে আছে একজন সাধুবাবা। এখন অমরনাথের মরশুম, সেই জন্য হয়ত বাবাজির এখানে আসা। তা না হলে ক্ষীরভবানীতে দূরের যাত্রী ও সাধুসমাগম প্রায় নেই বললেই চলে।
সাধুবাবার কাছাকাছি যেতে তাকালেন মুখের দিকে। গেরুয়ায় মোড়া দেহ। বয়েস আন্দাজ ৭০/৭৫ হবে। মেয়েদের ওড়নার মতো এক ফালি গেরুয়া মাথায় ফেটি করে বাঁধা। দাঁড়ালে লম্বাই লাগবে। পাতলা চেহারা। গায়ের রঙ ফরসা নয়, তবে কালোও বলা যাবে না। চোখদুটো সুন্দর। ফালা ফালা। একটা পটলের দুটো ফালি। সারা জীবনের সম্বল কমণ্ডলু আর ঝোলা রয়েছে পাশে। এই বয়সে এখনও লাঠি ধরতে হয়নি। মাথায় আর দাড়িতে বয়েস এক কোটো সাদা বার্ণিশ ঢেলে দিয়েছে।
সাধুবাবার মুখোমুখি বসে প্রথমেই আমার বদঅভ্যাস প্রণামের কাজটা সেরে নিলাম। সাধুবাবা মাথায় হাতটা দিলেন। মুখে উচ্চারণ করলেন ওঁ নমো নারায়ণায়।
আমিই শুরু করলাম,
– বাবা, আপনি কি অমরনাথ দর্শন করে মা ক্ষীরভবানীর দর্শনে এসেছেন?
কথাটা শুনে যেন বেশ পুলকিত হয়ে উঠলেন। বললেন,
– হাঁ হাঁ বেটা, ম্যায়নে অমরনাথজি কো দর্শন করকে আয়া। হিয়াসে ম্যায় অমরকণ্টক যাকে নর্মদামাঈকো দর্শন করুঙ্গা।
এবার জানতে চাইলাম,
– বাবা, আপকা ডেরা কাঁহা? আপকা সম্প্রদায় ক্যায়া হ্যায়? আভি উমর কিতনা চল রহা হ্যায়?
প্রথম পরিচয়ে একসঙ্গে এতোগুলো প্রশ্ন শুনে সাধুবাবা এক ঝলক মুখের দিকে তাকালেন। চোখ দেখে মনে হল বিরক্ত হলেন না তবে একটু অবাক হলেন বলে মনে হল। প্রশান্ত চিত্তে হালকা হাসিমাখা মুখে বললেন,
– বেটা, তুই কোথায় থাকিস? কী করিস? এখানে কোথায় এসেছিস? আমাকেই বা এসব জিজ্ঞাসা করছিস কেন?
আমার বিষয়ে সব কথা বলে জানালাম,
– বাবা, সাধুসন্ন্যাসীদের জীবনকথা ও দর্শন জানার জন্য আমার সাধুসঙ্গ করা আর সেই জন্যই ওই জিজ্ঞাসা।
কথাটা শুনে মাথাটা দোলাতে লাগলেন। কথার সত্যতা নিরীক্ষণ করার জন্য মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছেন মুখের দিকে। মিনিট খানেক কাটার পর বললেন,
– বেটা, আমি রাজানুজ সম্প্রদায়ের সাধু। এখন আমার বয়েস আশি। মেরা কহি ডেরা নেহি হায়। যাহা যাতা হু, ওহি মেরা ডেরা হো যাতা হ্যায়। অভি মা কা মন্দির মেরা ডেরা হ্যায়।
এরপর কথায় কথায় গৃহত্যাগের কারণ, কত বছর চলেছে সাধুজীবন, বাড়ি কোথায় ছিল, সাধুজীবনে বিশেষ সুখ বা দুঃখের কথা, ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি, এমন আমার যত জিজ্ঞাসা ছিল তা সবই জেনে নিয়ে বললাম,
– বাবা, সংসার জীবনের কিছু জিজ্ঞাসা আছে যদি দয়া করে তার উত্তর দেন তো কৃতজ্ঞ থাকব।
সাধুবাবা খুব উৎসাহিত হয়ে বললেন,
– বল না বেটা, বল বল। কি জানতে চাস তুই?
সাধুবাবার করুণাভরা একথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। শুরু করলাম এইভাবে,
– বিভিন্ন কালীমন্দির বা দেবদেবীর মন্দিরে ব্যবসায় উন্নতির উদ্দেশ্যে অনেকে গণেশজি ও লক্ষ্মীমাতার (খাতাপুজো) করে থাকেন। এই পুজোতে কতটা ব্যবসায়িক জীবনে সাফল্য আসে বা উন্নতি হয়?
কথাটা বললাম বটে তবে ১লা বৈশাখ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না বলে জানালেন। সাধুবাবাকে বোঝানোর জন্য হিন্দিভাষীদের দীপাবলির দিন লক্ষ্মীগণেশের পুজো করার উদাহরণ দিয়ে বলতেই বুঝলেন। আনন্দে ডগমগিয়ে উঠে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
– বেটা, আমি যতটা জানি, শাস্ত্রে ১লা বৈশাখ বা দীপাবলিতে ব্যবসায় সাফল্যের জন্য গণেশলক্ষ্মী পুজোর কথা বলে আছে বলে আমার জানা নেই। গণেশচতুর্থীতেই গণেশ পুজোর বিধি। তবে দেশাচার, লোকাচার, প্রথা বা পরম্পরাকে উপেক্ষা করা যাবে না। শাস্ত্র বহির্ভূত হলেও এগুলি সিদ্ধ হয়ে যায়। প্রার্থীকে শুভ ফল দান করে থাকে।
ঘোর অমাবস্যায় দীপাবলিতে গণেশ পুজোর কথা শাস্ত্রে কোথাও বলা নেই। যেহেতু পরম্পরা বা দেশাচার তাই ব্যবসায়ীদের গণেশ পুজোর পক্ষে ১লা বৈশাখ বা দীপাবলির অমাবস্যাই মঙ্গলজনক। যারা এটা মেনে আসছে তাদের পক্ষে কল্যাণপ্রদ। মেনে আসা ব্যবসায়ীরা এটা না করলে তার অমঙ্গল কিছু হবে না।
এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন। এতক্ষণ বসেছিলেন উবু হয়ে। এখন আরাম করে বসলেন বাবু হয়ে। মিনিট কয়েক চুপ করে থেকে বললেন,
– বেটা, শিব ও পার্বতীর প্রিয়পুত্র গণেশ সিদ্ধিদাতা। সমস্ত কর্মের প্রারম্ভে পুজো করা হয় গণেশের। গণেশজি মঙ্গল ও সিদ্ধিরজনক বলে সমস্ত দেবতার আগে পুজো করা হয় তাঁকে। বিভিন্ন দেবদেবীর বিশেষ বর ও শক্তি নিহিত রয়েছে গণেশে। তিনি বিঘ্ননাশক ও সর্বসিদ্ধিদাতা। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে মহাদেব গণেশকে বর দিয়েছিলেন, যে গণেশকে স্মরণ করে কাজ করবে, তার সেই কাজে সাফল্য আসবে।
বছর শুরুর প্রথম দিনে গণেশস্মরণ ও পুজো ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যসিদ্ধি ও কর্মে সাফল্যের নির্দেশ করে। বেটা, ব্রহ্মার আশীর্বাদে জগতের সমস্ত মানুষের কল্যাণকর হলেন গণেশ। ভগবান বিষ্ণুর বরে গণেশ হলেন বিদ্যা ও বুদ্ধিদাতা। আশীর্বাদ ও বরদানে মা লক্ষ্মীও কম গেলেন না। তিনি জানালেন, তিনলোকে যেখানে যেকোনও শুভ কাজ হবে, সেখানে যে দেবতারই পুজো হবে, সবার আগে পুজো হবে গণেশের। তা না হলে শুভ কাজ ও পুজোর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও নিষ্ফল হবে। এই পুঁজি নিয়েই গণেশজি বসে আছেন। যারা তাঁকে স্মরণ করে, তাদের আশীর্বাদী পুঁজি থেকে তিনি অঢেল দিয়ে থাকেন।
সাধুবাবা একটু থামলেন। কোনও কথা বললাম না। তাহলে কথার তার কেটে যাবে। মিনিট খানেক থামার পর বললেন,
– বেটা, গণেশজি হলেন এক মহাশক্তি, সাফল্য ও কার্যসিদ্ধির দেবতা। মানুষের জাগতিক ও পারমার্থিক পথের বাধা ও বিপত্তিনাশক তিনি। তবে এখানে একটা কথা আছে বেটা। সংসারীদের সাদা গণেশের পুজো করতে নেই। ব্যবসায়ী বা গৃহীরা হাল্কা গোলাপি, গোলাপি কিংবা লাল গণেশ পুজো করলে ভালো। ডাইনে মোড়া শুঁড় আর চন্দনকাঠের মালা পরানো গণেশ সুখ সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য বৃদ্ধি ও সম্মানের সঙ্গে অর্থাগম করায়। স্থাপত্যশিল্প ও সম্পদের দেবতাও তিনি। আরাধনায় প্রসন্ন গণেশজি এসবই অকাতরে দিয়ে থাকেন তাঁর উপাসক বা ভক্তদের।
পাঁচজন প্রধান দেবতার মধ্যে অন্যতম বলা হয় গণেশকে। অন্য চারজন হলেন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর ও দুর্গা। এঁদের একত্রে পুজো করাকে পঞ্চায়তন পুজো বলে। প্রেমিককবি তুলসীদাস কাশীতে এই পুজো করতেন নিয়মিতভাবে। বেটা, দুর্গানন্দন গণপতি বাবাজির অত্যন্ত প্রিয় রক্তপুষ্প। যুথিকা (যূথী), চামেলি (জাতিপুষ্প) ও মল্লিকা গণেশপুজোর বিহিত ফুল। কুন্দ, টগর, অশোক ফুল, তুলসী ও বেলপাতা নিষিদ্ধ। শিবের রুদ্রাক্ষ, বিষ্ণুর তুলসী আর গজাননের প্রিয় চন্দনকাঠের মালা। গণেশজির প্রিয় ও মনপসন্দ একমাত্র লাড্ডু (মোদক)। সঙ্গে একটু খই ভোগ দিলে আরও ভালো হয়।
প্রতিদিন গণেশপুজো বা আরাধনা করলে জাগতিক ও পারমার্থিক উন্নতি পথের বাধা দূর করে গনেশজি বাঞ্ছিত আশার সিদ্ধিদান করেন। গণেশের উপাসনায় অন্তরে আনন্দ বৃদ্ধি, কামনাপূরণ, বিদ্যার্থীর বিদ্যালাভে বাধা কেটে বিদ্যালাভ, অর্থবৃদ্ধি, সন্তানহীনের সন্তানলাভ, চলার পথের বিঘ্ননাশ, অবিবাহিতের মনমতো স্ত্রী বা স্বামীলাভ, এমন জাগতিক সমস্ত আশা বা প্রার্থনাই মঞ্জুর করেন একদন্তজি।
শ্রাবণ, ভাদ্র, অগ্রহায়ণ কিংবা মাঘ মাসে শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে গৃহী কিংবা ব্যবসায়ীরা বাড়িতে গণেশের বিগ্রহ নির্মাণ করে পুজো করলে সমস্ত বাসনা বা কার্যসিদ্ধি হয়।
কথায় কথায় অনেক কথা হল সাধুবাবার সঙ্গে। নানান বিষয়ে কথা হল প্রায় দু-ঘণ্টা। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলাম। উঠে দাঁড়ালেন। দু-হাত প্রসারিত করে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়। সাধুবাবার দুচোখ ভরা জল আমার চোখে ভরে নিয়ে ফিরে এলাম শ্রীনগরে।