সামান্য কাজটা করলেই মানুষ সবসময় সুখী হতে পারে
আমরা সংসারী। হাজার রকম অশান্তি নিয়ে পড়ে আছি। এর থেকে বেড়িয়ে আসা, সুখ তো একটু পাওয়া যেতে পারে, কি করলে ও কি ভাবে?
চৌষটযোগিনী মন্দিরে যাওয়ার সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠেছিলেন এক সাধুবাবা। আমি তখন অনেক সিঁড়ি নিচে। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি গেরুয়াতে মোড়া দেহটা। মাথায় খুব বড় চুল নয়। আধা-পাগড়ি করে মাথায় বাঁধা একটা কাপড়ের ফেটি। ফতুয়ার মতো জামা একটা গেরুয়াতে ছোপানো। লাঠির উপরে ভর দিয়ে সিঁড়ি ভাঙছেন। কাঁধে ঝোলা একটা। এ সবই আমার অনেক সিঁড়ি নিচের থেকে দেখা পিছনের অংশ। তাই বয়েসটা আন্দাজে এল না। কথায় আছে, মানুষের জ্বর চিন্তা, স্ত্রীর জ্বর স্বামীর মন ভরানো সোহাগ না পাওয়া আর আমার জ্বর সাধুসঙ্গ না হওয়া। না চাইতে পাওয়া এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়? দেহে এখনও কোনও রোগের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। একটা সিঁড়ি বাদ দিয়ে টপকে টপকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এসে দাঁড়ালাম সাধুবাবার মুখোমুখি হয়ে। মুখের দিকে তাকাতেই আমার দেহ মনে আনন্দ যেন উথলে উঠল। সাধুবাবা দাঁড়িয়ে গেলেন। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। মাথায় হাতটা বুলিয়ে দিলেন।
এখন চোখমুখের কথা, সামনের অংশ। কপালে গালে বলিরেখায় ভরা। বয়স আশির নিচে হবে বলে মনে হল না। বয়েসের ভারে ঘাড়টা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়েছে। এককালে যে ফরসা ছিল রোদে জলে পোড়া এখনকার তামাটে রঙ দেখলে তা বেশ বোঝা যায়। চোখ আর চোখের সন্ধিস্থলে বয়েসের ভারে চোখদুটো বেশ চেপে বসে আছে। নাকখানা ভারী সুন্দর। উচ্চতায় সাধুবাবা যে খুব লম্বা তা নয়। আন্দাজ, সাধারণ মানুষের উচ্চতা। গাল ভর্তি দাড়ি। চোখ কুতকুতে নয়। রুদ্রাক্ষ বা তুলসীর মালা নেই গলায়। বললাম,
– বাবা, এখনও অনেক সিঁড়ি বাকি আছে। একবারে উঠতে গেলে হাঁপিয়ে যাব। আসুন, সিঁড়ির একপাশে বসে একটু বিশ্রাম করেনি।
বলেই হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে এলাম সিঁড়ির পাশে। ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সাধুবাবাকে বসালাম। বাঁপাশে বসলাম আমি। বললাম,
– বাবা এখন আসছেন কোথা থেকে?
অসংকোচে বললেন,
– জ্বালামুখী মায়ের দর্শন করে আসছি।
আমরা দুজনে বসে আছি। তীর্থযাত্রীদের আনাগোনায় কোনও বিরাম নেই। অনেকেই আমাদের দেখতে দেখতে যাচ্ছে। অবশ্য এমন জায়গায় বসে আছি যে সকলের চোখ পড়বে। সাধুবাবা জানতে চাইলেন আমি কোথায় থাকি, কি করি ইত্যাদি। সব বলে জানতে চাইলাম,
– বাবা, আপনার ডেরা কি জ্বালামুখীতে না অন্য কোথাও?
হাসিমাখা মুখে বললেন,
– বেটা, ডেরা বলতে যা বোঝায়, তা আমার কোথাও কিছু নেই। যখন যে তীর্থে যাই তখন সেখানে কোনও আশ্রম বা ধর্মশালায় রাত কাটাই। কোনও কারণে জায়গা না পেলে স্টেশনে রাতে পড়ে থাকি। তবে বেটা গুরুজির দয়াতে আশ্রয় একটা জুটে যায়, সেই ‘বচপন সে’ তখন আমার বয়েস আর কত হবে, দশ বারো, সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত থাকার জায়গা আর একমুঠো অন্নের অভাব কখনও হয়নি, গুরুজির করুণায় বাকি জীবনটায়ও অভাব হবে না।
জানতে চাইলাম,
– এখানে আগে এসেছেন, না এই প্রথম?
মাথা নেড়েও মুখে বললেন,
– আগে কয়েকবার এসেছি বেটা, আবার এলাম।
কথা বলে এটুকু বুঝলাম এই সাধুবাবার সঙ্গে আমার জমবে। অনেক কথা বলা যাবে। বললাম,
– বাবা, আমরা সংসারী। হাজার রকম অশান্তি নিয়ে পড়ে আছি। এর থেকে বেড়িয়ে আসা যে মুশকিল তা ভালো করেই জানি। শান্তিটা দুর্লভই বটে তবে সুখ তো একটু পাওয়া যেতে পারে, কি করলে কি ভাবে?
হঠাৎ করে এরকম একটা প্রশ্ন করায় সাধুবাবার চোখমুখের ভাবটা কেমন যেন হয়ে গেল। এতক্ষণ পর আমার মুখের দিকে তাকালেন ভালো করে। চোখ নামালেন। মিনিট পাঁচসাতেক চুপ থেকে বললেন,
– বড় কঠিন প্রশ্ন। আমার বোধ বুদ্ধিতে যেটুকু বুঝেছি, সেটুকুই তোকে বলতে পারি। বেটা, প্রচুর অর্থ ধনসম্পদ নানা বিপদ ও অশান্তির কারণ। রোগ শোক অনুতাপ বন্ধন ও বিপদ হল মানুষের নিজের রোপণ করা অপরাধ বৃক্ষের ফল। এগুলো সকলকেই ভোগ করতে হয়। তবে সংসার জীবনে মানুষ সবসময় সুখী হতে পারে বিষয় ভোগের বাসনা, সম্মানলাভের আশা, লোভ, ক্রোধ আর অহংকার পরিত্যাগ করলে। বেটা সংসার দুঃখময়, এখানে সুখ বলে কোনও বিষয় নেই, না আছে কোনও বস্তু। একটা বিশেষ শব্দ অতি দ্রুত ও খুব সহজেই মানুষ অনুভব করতে পারে, যে শব্দের নামটা হল দুঃখ। সংসারে যাবতীয় দুঃখের যেটুকু উপশম, সেইটুকু মানুষ সুখ বলে ধরে নেয় এবং সেটা একেবারে ক্ষণস্থায়ী। কারণ আবার তা ঢেকে দেয় দুঃখ। এই নিয়মেই চলে মানুষের জীবন, যার ব্যতিক্রম নেই। মানুষের লাভ বা লোকসানের হিসাব যতক্ষণ, সংসারে দুঃখভোগও ততক্ষণ জানবি।
বৃদ্ধ সাধুবাবা একটু থেমে বললেন,
– বেটা, চল উঠে পড়ি। এখনও অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হবে।
আমরা দুজনে উঠে পড়লাম। এবার চলতে চলতে কথা বললাম,
– সমস্ত তীর্থপরিক্রমা করেছেন নিশ্চই। সবচেয়ে বেশি মনকে স্পর্শ করেছে কোন তীর্থ?
উত্তরে জানালেন,
– বেটা, ঠিক ওরকমভাবে বলা মুশকিল। যখন যে তীর্থে গেছি তখন সেই তীর্থের তীর্থদেবতার করুণা অনুভব করেছি। সুতরাং আলাদা করে ভালোলাগার কথা বলতে পারব না।
জানতে চাইলাম,
– বাবা, তীর্থদেবতার করুণা বলতে কি বোঝাতে চাইছেন? আপনি কি তাঁর দর্শন লাভের কথা বলতে চাইছেন?
দাঁড়িয়ে পড়লেন, আমিও। ‘না’ সূচক মাথাটা নেড়ে বললেন,
– না না বেটা, দর্শনটর্শন নয়। এই যেমন, সুন্দরভাবে তাঁর বিগ্রহ দর্শন, কোথাও এতটুকু থাকার কষ্ট না হওয়া। প্রাণভরে প্রসাদ পাওয়া। দেহ সুস্থ ও মনে আনন্দ থাকা। এ সব তীর্থদেবতার করুণা বলেই আমার মনে হয়েছে।
বয়েস তো হয়েছে অনেক তাই সাধুবাবা সিঁড়ি ভাঙছেন ধীরে ধীরে। জানতে চাইলাম,
– বাবা, সাধুসঙ্গ করলে কি সত্যি কিছু লাভ হয়? যদি হয় তবে সেই লাভটা কি?
সাধুবাবা না দাঁড়িয়ে চলতে চলতেই বললেন,
– বেটা, বিশেষ বিশেষ তিথি উৎসবে বিভিন্ন তীর্থে সাধুদের দেখা পাবি। এঁরা বেশিরভাগ থাকেন একান্ত নিরালায় কিংবা আপন সাধন কুটিরে। তাই অল্প সংখ্যক মানুষই তোর মতো সাধুসঙ্গ করতে পারে। (এই মুহুর্তে এক নজরে আমার মুখখানা দেখে মুচকি হেসে নিলেন।) এটাও মাথায় রাখিস, সাধুসন্ন্যাসীদের বোকা ভাবিস না। তারা পাত্র বুঝে সঙ্গ দেয়। এদের সঙ্গ করলে মানুষের জাগতিক দুঃখের অনেক হ্রাস হয়। জীবন বিষয়ে, সংসার বিষয়ে, মনের বিষয়ে অনেক অ-নে-ক সংশয়ই কেটে যায়।
এগুলো কেমন করে হয় জানিস? তিনিই সাধু, যার ভিতরে থেকে তিনিই নিজের বিশেষ শক্তি বা বিশেষ ভাব প্রকাশ করে তাঁরই উদ্দেশ্য সাধন করে নিচ্ছেন অলক্ষ্যে, এমন মূর্তি বা দেহকে বলে সাধু। বেটা, সাধুসঙ্গ করলে কর্মক্ষয় হয়।
একটু থামলেন। বিড়ি দেয়ার প্রবৃত্তি হল না এই মুহুর্তে। কথায় ছেদ টানলাম না। শুরু করলেন,
– অত্যন্ত বিষয়ী ও কামনাবাসনা জর্জরিত নারীপুরুষের কোনও সম্মানজ্ঞান থাকে না, এদের সঙ্গ করবি না। লোভীরা অত্যন্ত নির্লজ্জ হয়, এদের ছায়া মাড়াবি না। গুরুজন জ্ঞান থাকে না ক্রোধীদের, এদের এড়িয়ে চলবি। সবসময় অস্থির চিত্তদের জ্ঞানের অভাব থাকে। এদের সঙ্গ করবি না। যারা জপতপ করে না, ভক্ত নয় অন্যের মন বা কথার রক্ষার্থে দেবালয়ে যায়, অন্তর থেকে চায় না, তাদের সঙ্গও করবি না। এদের সঙ্গ করলে তমো ও রজোগুণের প্রভাব তোর মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে ওদের ওই ভাবগুলো মধ্যে ক্রিয়া করবে। সাধন ভজন শিকেয় উঠবে। গুরু বা সাধু সঙ্গ করলে সঙ্গের গুণে নারীপুরুষের মন চলে যায় বিজ্ঞানময় কোষ থেকে আনন্দময় কোষে। তখন সদাসর্বদা পাওয়া যায় আনন্দ। গুরু বা সাধুসঙ্গে এই ফলটা পাওয়া যায় মনটা শুদ্ধ হলে। বেটা, নারীর চোখে কাজল যেমন শোভা বৃদ্ধি করে তেমনই গুরু ও সাধুসঙ্গ, তাঁর নাম ভজন শান্তি ও তেজ বৃদ্ধি করে মানুষের।
অথচ বেটা, সংসারে একশ্রেণির মানুষ আর গুণহীনরা যেমন গুণবানদের গুণকে ছোট করে দেখে, তেমন সংসারীদের অধিকাংশই প্রায় সব সাধুসন্ন্যাসীদের ভণ্ড বলে মনে করে।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এখন ইশারায় বসতে বললেন। আমরা চৌষটযোগিনী মন্দিরে যাওয়ার সিঁড়িতে তীর্থযাত্রীদের যাওয়ার পথ রেখে দুজনে বসলাম এক পাশে। মাথায় ঢুকে আছে ‘আনন্দ’ আর ‘মন শুদ্ধ হলে’। বললাম,
– বাবা, মানুষের মনটা শুদ্ধ হয় কি করলে?
সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, জাতিধর্মনির্বিশেষে নারীপুরুষের জলের দ্বারা দেহ শুদ্ধ হয়, দেহ পবিত্র হয় গুরুসেবাতে, হাত পবিত্র হয় দানে। তীর্থভ্রমণে চরণ পবিত্র হয়, মুখ পবিত্র হয় ভগবানের নামে আর সত্যের দ্বারা শুদ্ধ হয় মানুষের মন।