কোন মন্দিরে কি প্রার্থনা করলে ঈশ্বর মঞ্জুর করেন
একই দেববিগ্রহ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন গুণে বা ভাবে প্রকাশমান। এই দেবদেবীরাই কোনও কোনও বিশেষক্ষেত্রে একই সঙ্গে ওই তিনটে গুণেই প্রকটিত।
আমার তো সাধুসঙ্গের সময় প্রশ্নের ঠিক থাকে না, তাই যখন যেটা মনে আসে সেটাই করে ফেলি। বললাম,
– সারা ভারতের বিভিন্ন তীর্থে প্রচুর অবাংলাভাষী সাধুসন্ন্যাসীদের বছরের বিভিন্ন সময়ে যখন গেছি তখনি দেখা পেয়েছি। অথচ সারা বাংলায় তীর্থের সংখ্যা তো খুব একটা কম না। তার মধ্যে কালীঘাট, তারকেশ্বরের মতো কত প্রসিদ্ধ তীর্থ আছে। শুধুমাত্র গঙ্গাসাগর মেলার সময় স্নান সেরে কিংবা স্নানে যাওয়ার আগে কালীঘাটে এসে ঘুরে যান সাধুরা। বছরভর তেমন কোনও সাধুসন্ন্যাসী চোখে পড়ে না বলা যায়। কেন বাবা, বেশিরভাগ সাধুসন্ন্যাসীরা বাংলায় আসে না কেন?
কথাটা শোনামাত্র সাধুবাবা যেন মুখস্থ বলে গেলেন,
– বেটা, কথাটা তুই ঠিকই বলেছিস। ভারতের সমস্ত সম্প্রদায়ের সাধুসন্ন্যাসীদের সাগরমেলার সময়টুকু ছাড়া বাংলার প্রতি টান খুব কমই বলতে পারিস, নেই বললেই চলে। আমি সাগরমেলা উপলক্ষে তিনবার বাংলায় গেছি। বেটা, খুব কষ্ট পেয়েছি। ভাল ধর্মশালা বা আশ্রম নেই। দু-চারটে থাকলেও তার হদিস পাওয়া যায় না। ভিক্ষা চাইলে অবজ্ঞা করে। সাধু ভাবে না, কেউ ভণ্ড ভাবে, কেউ বা ভিখিরি ভেবে অশ্রদ্ধায় ভিক্ষে দেয়। মোটের উপর মাথা গোঁজার ঠাঁই আর নির্জন জায়গার বড় অভাব। দু-দশ দিন থেকে যে একটু জপতপ করব তার কোনও উপায় নেই। তাই সাধুসন্ন্যাসীদের তেমন নজর কাড়ে না কলকাতা।
এবার প্রশ্ন এল মনে। বললাম,
– বাবা, ‘স্থানমাহাত্ম্য’ বলে একটা কথা আছে। এ কথার প্রকৃত অর্থটা কি আর সত্যিই কি তা আছে?
সাধুবাবা দাঁড়ালেন। একটু জিরিয়ে নিয়ে বললেন,
– হাঁ বেটা, স্থানমাহাত্ম্য তো আছেই। নানান দেবদেবী বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেন। এক একটি স্থানে থেকে বিশেষ বিশেষ ভাবের প্রকাশ ও শক্তির ক্রিয়া করাকে স্থানমাহাত্ম্য বলে।
কথাটা ঠিক ধরতে বা বুঝতে না পেরে বললাম,
– বাবা, একটু খোলসা করে বলুন, কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
এবার আমাকে বোঝাতে সাধুবাবা দাঁড়ালেন। ইশারায় সিঁড়ির একদিকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। বুঝলাম, আমার সাধুর আসরটা বেশ জমে উঠেছে। মুখোমুখি হয়ে বললেন,
– বেটা, বিভিন্ন তীর্থে বা দেবস্থানে তিনটে ভাবের প্রকাশ ঘটে দেবদেবীদের। ভাবগুলি হল তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক। একই দেব বা একই দেবীবিগ্রহ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন গুণে বা ভাবে প্রকাশমান। যেমন, কোথাও তামসিক, কোথাও রাজসিক, কোথাও বা সাত্ত্বিক গুণের ক্রিয়া করে ভক্ত বা তীর্থযাত্রীদের মনোবাসনা পূরণ করেন। আবার এই দেবদেবীরাই কোনও কোনও বিশেষক্ষেত্রে একই সঙ্গে ওই তিনটে গুণেই প্রকটিত।
তবে একটা কথা আছে বেটা, যে সব তীর্থক্ষেত্র বা দেবস্থানে ভক্তপ্রাণ তীর্থযাত্রীদের আগমন সংখ্যায় অতিমাত্রায় এবং কামনাবাসনা বিজড়িত প্রার্থনা অতিরিক্ত, সেখানে বেটা দেবদেবীরা কিন্তু সত্ত্বগুণে প্রকাশিত হন না। তামসিক ও রাজসিক ভাব বা গুণের প্রকাশ করে কামনা পূরণ করেন ভক্তজনের।
একটু থামলেন। গালভর্তি দাড়ির ডানপাশটা একটু চুলকালেন। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
– যেমন ধর বদরীনারায়ণে স্বয়ং নারায়ণের অবস্থান সত্ত্বগুণে বিকশিত হয়। সেখানে ভগবান শ্রীহরি মুক্তিকামী ভক্তের সাংসারিক বন্ধন মুক্তির প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। ওখানে জাগতিক যেকোনও কামনাবাসনা নামঞ্জুর। কারণ স্বয়ং নারায়ণ বদরীনারায়ণে সাত্ত্বিকভাবে মুক্তিদাতা হিসাবে বিরাজমান। একেবারে যে হয়না তা নয়, তবে সেটা ক্ষেত্র ও ভক্তের আধার বিশেষে তাঁর একান্ত করুণার উপরেই প্রার্থনা পূরণ হওয়াটা নির্ভরশীল।
দেওঘরে বাবা বৈদ্যনাথের কথা বলি। ওখানে ভগবান শঙ্কর ভক্তদের রোগব্যাধি দূর করার জন্যেই প্রকট হয়েছেন। নামও সেই কারণে বৈদ্যনাথ। তামসিক ও রাজসিকভাবে তিনি মানুষের জন্মান্তরের কর্মফলানুসারে রোগব্যাধির উপশম বা আরোগ্য করে চলেছেন ভক্তদের। ওখানে গিয়ে মুক্তি বা ধনদৌলতের কামনা করলে তা মঞ্জুর হবে না। স্থানমাহাত্ম্যে ওখানে রোগ আরোগ্য হবে।
এবার বলি মহাবীর হনুমানজির কথা। রামভক্ত হনুমানজি সাত্ত্বিকভাবে সর্বদাই রয়েছেন অযোধ্যায়। সেখানে ভক্তিদান করেন প্রার্থনাকারী বা ভক্তদের। অথচ ওই মহাবীরজি তামসিক ও রাজসিক গুণধারী হয়েও সঙ্কটমোচন নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বনাথক্ষেত্র কাশীধামে। সেখানে তিনি ভক্তদের ভক্তি নয়, সমস্ত বিপদ ও নিদারুণ সঙ্কট থেকে মুক্ত করেন, তাই তো তিনি কাশীধামে সঙ্কটমোচন। মহাবীরজি বেটা সত্ত্বগুণের আধার। স্থানবিশেষে তমো ও রজোগুণের ভাব নিয়ে প্রকাশিত হন। এইভাবেই নানান তীর্থ বা দেবস্থানের মাহাত্ম্যকথা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করলে বুঝবি স্থানমাহাত্ম্য কি এবং কাকে বলে!
এসব কথা শুনে মনটা আমার এক অপার্থিব আনন্দে ভরে গেল। এমন সুন্দর কথা, এত সুন্দর ব্যাখ্যায় চোখদুটো জলে ভরে উঠল। টপটপ করে নেমে এল কপোল বেয়ে। বৃদ্ধ সাধুবাবা এ ভাবটা লক্ষ্য করলেন। মাথাটা সাধুবাবার দুচরণে ঠেকিয়ে ঢুকরে কেঁদে ফেললাম। যে কোনও তীর্থ বা দেবস্থানের এমন অন্তর্নিহিত সত্যের কথা তো আমি আগে শুনিনি। কোনও ধর্মগ্রন্থে থাকতে পারে কিন্তু আমার মতো কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে সমস্ত ধর্মগ্রন্থ পড়া ও জানা কি কখনও সম্ভব? পথ চলতে চলতে যেটুকু মাধুকরী পাই, তাই-ই আমার লাভ।
মানসিক আনন্দের রেশটা সামলে মিনিটখানেক কাটার পর বললাম,
– বাবা একটা কথা বলি। সংসারী আমরা যারা, গুরুই বলুন আর শ্রীভগবানই বলুন, তাঁকে ডেকে ও ধরে রাখা সত্ত্বেও চরম দুঃখ কষ্টে দিন কাটাই, সেটা সাংসারিক মানসিক কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, কেন এমনটা হবে? তাঁকে ধরে রাখার ফল কি তাহলে এটাই হওয়া উচিত, না হবে? যারা নানা অন্যায় অপরাধ করছে তারাই দেখছি রাজসিক সুখভোগ করছে, এটা বাবা ভগবানের কোন দেশি বিচার?
কথাটা শুনে সাধুবাবা মিনিটখানেক ভাবলেন। মুখের দিকেও তাকালেন বেশ কয়েকবার। কি দেখলেন জানি না। মুচকি হেসে বললেন,
– বেটা, দেখছি সরস্বতীকে বেশ করে বেঁধে ফেলেছিস। আর তোকে ফেলে পালিয়ে যেতে পারবে না। তবে লক্ষ্মী এখনও ধরা দেয়নি। তোর কাছে ‘লছমী মাঈয়া’ও ধরা দেবে, বাঁধাও পড়বে। এখন ছুটে বেড়াচ্ছে, বেড়াতে দে। ঘাবড়াও মত।
একথার মানেটা বোঝার জন্য সাধুবাবাকে খোলসা করে বলতে বললাম। তিনি আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে অনেক কথা বলে পরে বললেন,
– বেটা কর্মফল, সেটা সুখ হোক বা দুঃখের, ভোগ ছাড়া কিছুতেই ক্ষয় হবার নয়। পূর্বজন্মের কর্মফলের ভোগ যদি খুব কষ্টকর হয় তাহলে পরমাত্মার শরণাগত হলে, তাঁর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস ভক্তি এলে অনেক সময় সঞ্চিত কর্মফল অত্যন্ত দ্রুত ক্ষয় করিয়ে তাঁর ভক্তসন্তানকে মুক্ত করে দেন। সেইজন্য তো তাঁকে যারা চায় তাদের আপাত দুঃখী বলে মনে হলেও জানবি ভগবানের করুণাধারা অলক্ষ্যেই তাদের ভিতরে প্রবহমান।
সাধুবাবার কথাতে ভক্তিবিশ্বাস কথাটা এল বলে জানতে চাইলাম,
– বাবা, আমরা ধর্মবিষয়ক কোনও কথা আলোচনা করলে কথা প্রসঙ্গে বারংবার এসে পড়ে ভক্তি আর বিশ্বাসের কথা। এই শব্দ বা কথাদুটোর প্রকৃত অর্থ কি আপনার জানা আছে, দয়া করে একটু বলতে পারেন?
এতক্ষণ সিঁড়ির ধাপে বসে কথা হচ্ছিল। এবার ঝোলাটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি টুক করে ঝোলাটা আমার কাঁধে নিলাম। নিলাম এই কারণে, সাধুবাবা হাল্কা হলে কষ্টটা কম হবে, কথা বলতে পারবেন বেশি। এবার আমার ডান কাঁধে তাঁর বাঁ হাতটা রেখে আর একহাতে লাঠি ভর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। কয়েক ধাপ উঠে শুরু করলেন,
– বেটা, বিশ্বাস আর ভক্তি এ দুটো কথার ‘বহুত, বহুত’ ফারাক। প্রথমে বলি বিশ্বাসের কথা। বিশ্বাস মানে ইষ্ট দেবতা বা ভগবানের বিষয়, ভগবৎ সংক্রান্ত বিষয়ে যা কিছু, তার সমস্ত কিছুতেই শুদ্ধ নির্মল কপটতাশূন্য খাদহীন স্থির ভাবনার নামই বিশ্বাস।
সাধুবাবার বয়েস তো আর কম হল না। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে একটু জিরিয়ে নেন। একটু থেমে বললেন,
– তবে এখানে একটা কথা আছে বেটা। জাগতিক বা পারমার্থিক যেকোন বিষয় বা বস্তুতে বিচার বিশ্লেষণ করার পর যে সিদ্ধান্তে মানুষ উপনীত হয়, সাধারণভাবে তা হল বিশ্বাস। এখানে শেষ হল না, এটা কিন্তু বিশ্বাস নয়, মনে হওয়া। এটাকে বেটা জ্ঞান বলে। একেবারে নির্বিকার ও নির্বিচারে শ্রীভগবানকে বিশ্বাস করলে একটা মহিমময় ভাবের উদয় হয় অন্তরে। ওই ভাবটাকেই বেটা পারমার্থিক জগতের ভাষায় বলে ভক্তি। তবে বাচ্চা, এসব কথা শুনে, কথার মানে বুঝলে মনে তাৎক্ষণিক একটা জানার আনন্দ হয় বটে, কিন্তু ওই ভাব ভিতরে আসা এবং তাতে প্রতিষ্ঠিত থাকা ‘বহুত বড়া মুশকিল বাত।’
কথায় যে কথা বাড়ে এ কথাটা ঠিক। বললাম,
– বাবা নির্বিকার বা নির্বিচার কথাটা বললেন, এর সরল ব্যাখ্যাটা কি?
জিজ্ঞাসা শুনে একটু হাসলেন। পরে বললেন,
– তোকে একটু আগে বললাম না, সরস্বতীর করুণাটা পেয়েছিস, ঠিকই বলেছি। আর পেয়েছিস বলেই এই সব জিজ্ঞাসাগুলো তোর অন্তরে আসছে। আজকাল এসব কথা কেউ জিজ্ঞাসা করে না। তোর প্রশ্নে মনটায় আমার বেশ আনন্দই হচ্ছে।
তোর জিজ্ঞাসার উত্তরে বলি, যেকোনও একটা কর, হয় শ্রীভগবানে (গুরুতে) ভালমন্দ কোনও বিচার না করে (নির্বিচার), অন্তরে কোনও বিকার না রেখে সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে (তিনিই করাচ্ছেন) কাজ করে যা, তাতে লাভ ক্ষতি যা হয় হয়ে যাক। কোনও কিছু ভাববার দরকার নেই। এটা করলে তাঁকে পাবি। তা যদি না পারিস তাহলে শ্রীগুরু যা যা বলেন তা নির্বিকারে নির্বিচারে অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে তাতেই সব হবে। এটা করব না, ওটা করব, করলে চলবে না। ও দুটোর একটা কিছু কর, তা না হলে ভুগতে ভুগতে চল। বেটা, নির্বিকার আর নির্বিচার কথার অর্থটা কি তোকে বোঝাতে পারলাম?
কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নত হয়ে এল। ‘বুঝেছি’ মাথাটা নেড়েও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সাধুসন্ন্যাসীদের অনেক কঠিন শব্দের অর্থ খুঁজতে কোনও ডিকশনারি কিংবা নারীর প্রয়োজন হয় না। সহজ সরলভাবে এমন করে বুঝিয়ে দেন, অন্তর ভরে যায় এক অনাবিল আনন্দে। বললেন,
– তবে বেটা এখানে একটা কথা আছে, তিনিই সব করাচ্ছেন, তাঁর উপরে এই সব ছেড়ে দেয়ার ভাবটা অনেক অ-নে-ক জন্মের সুকৃতি থাকলে তবেই আসে মানুষের। আসাটা শুধু কঠিন নয় বেটা, সুকঠিনও বটে। ‘তিনিই সব করাচ্ছেন’ এই ভাবটা আসে না সব আধারে। তবে এলে এবং ভাবটা ঠিক ঠিক ধরে রাখতে পারলে বেটা কেল্লাফতে। এই ভাবে মনটা দৃঢ় রেখে সমস্ত কাজ করতে পারলে বেটা সত্যি জানবি, তিনিই করান।
কথা শেষ হতে দাঁড়ালেন। আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমি দেখলাম সাধুবাবার চোখদুটো জলে ভরে গেছে। বুঝলাম, আমাকে বলা কথাগুলো তাঁর মজ্জায় মিশে গেছে, তাই তাঁর চোখে জল। খানিক পরে বললেন,
– বেটা, মানুষের যা কিছু নতুন ভাবনা, যা কিছু নতুন সৃষ্টি তা ‘তিনিই সব করাচ্ছেন’ কিভাবে জানিস?
মাথাটা নেড়ে বললাম ‘জানি না’। সাধুবাবা বললেন,
– বেটা মানুষের মধ্যে ভগবান তাঁর বিশেষ শক্তি সঞ্চারিত করেন সৃষ্টির প্রয়োজনে, তাঁর নিয়মে যথাসময়ে, তাঁরই উদ্দেশ্য সাধনে।
একটু থেমে বললেন,
– এ সব কথার অর্থ ধর্ম বা শাস্ত্রগ্রন্থের পাতা ওল্টালে হয়ত পেয়ে যাবি, তবে পড়ে জানা আর সাধুসঙ্গ করে জানা, দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। সাধুদের কথা গেঁথে যায়, পড়া কথা কখনও কখনও স্মৃতি থেকে লোপ পায়। সেইজন্যে একটা ‘কহবত’ আছে, পাখা যেমন মানুষের দেহের উত্তাপ দূর করে, বিদ্যা কোনও রত্নের দ্বারা তৈরি না হয়েও মানুষের অলঙ্কার, তেমনি সাধুসঙ্গ মানুষের অন্তরের অপাপবিদ্ধ রত্নালংকার।
জিজ্ঞাসার আর শেষ নেই। বললাম,
– সেই ছোটবেলা থেকে সারাটা জীবনই তো আপনার কেটে গেল সাধনভজন আর আনন্দময় সন্ন্যাসজীবনে। একা মানুষ আপনি। চাওয়া পাওয়ার কোনও বালাই নেই। আমরা সংসারী। সাংসারিক ক্ষিদে অফুরন্ত, যার শেষ নেই। তবু তার মধ্যে থেকে মনকে একটু স্থির করে তাঁর স্মরণ করা যায়, এমন একটা পথ বাতলান না! আর কি করলে বুঝব যে সাধন ভজনে খানিক এগোলাম?
মন দিয়ে কথাটা শুনলেন। এখন কথা হচ্ছে চলতে চলতে, চৌষটযোগিনী মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে। আমাদের চলাটা একেবারেই ধীর গতিতে। আবার তাকালেন মুখের দিকে। কি যে দেখেন বুঝি না! বললেন,
– বেটা, মনকে স্থির করা খুব শক্ত ব্যাপার। এ কাজ শক্ত হলেও সম্ভব। মনকে স্থির করার নাম হল ধ্যান। আলাদাভাবে ধ্যান না করলেও চলবে। প্রাচীন ভারতের ঋষিরা দেবদেবীদের মন্ত্র এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, যা জপ করলে ধ্যান ও হোমের কাজ হয়ে যায় এসঙ্গে। তবে বেটা মনকে বাগে আনার জন্য স্থির করতে হলে প্রথমে চাই ধৈর্য। সমস্ত বিষয়ে ধৈর্য ধরতে পারলে মন ভগবানের করুণায় একসময় স্থির হয়ে আসবে আপনা হতে। এর জন্য আলাদা করে কোনও ‘কসরত’ করতে হবে না। সংসারে যা কিছু দুঃখ চাওয়া পাওয়া, সব কিছুকে উপেক্ষা করলে তবেই মন নিজের অধীন হবে, স্থির হবে।
বেটা, সাধনভজন করতে গিয়ে ধর্মের ভান করলে কিন্তু সব মাটি হয়ে যাবে। ভগবানের নাম স্মরণ করাকে ভজন বলে। শুধু ভজন করলে হবে না, সেটা অন্তরে প্রীতির সঙ্গে হতে হবে। কারণ প্রীতি থেকেই উপাস্য দেব বা দেবীর স্মরণ আর চিত্ত নির্মল ও শুদ্ধি হয় স্মরণ থেকে। চিত্ত শুদ্ধি হলে বাহ্য দেহে ও অন্তরে প্রকাশ পায় উপাস্যের রূপ। তবে সেটা ভজন তুমি যতই কর না কেন, নিষ্ঠা ছাড়া কোনও কিছু হওয়ার নয়।
এবার একটু থামলেন। দেখলাম যেন একটু হাঁপিয়ে পড়েছেন সাধুবাবা। আমি কোনও কথা বললাম। শোনার অপেক্ষায় রইলাম। মিনিট তিনেক পর কথার খেই ধরে বললেন,
– বেটা, কোনও বিষয়কে, কোনও অবস্থাতে, কোনওভাবে পরিত্যাগ না করে আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ আশ্রয় করাকেই বলে নিষ্ঠা। এককথায় গুরু মহারাজ বা ইষ্টের ভজনে অবিরত নিরবিচ্ছিন্ন স্থিতি হল নিষ্ঠা। মানুষের মন কোনও একটি মাত্র লক্ষ্যে একাগ্র ও একনিষ্ঠ হয় একমাত্র নিষ্ঠায়। বেটা, মন একাগ্র হল মানেই মনস্থির হল। মন স্থির হল মানে জানবি পরমাত্মা গুরু বা ইষ্ট যাই বলিস, তাঁর সঙ্গে তুমি যুক্ত হলে। জাগতিক ও পারমার্থিক যা কিছু আছে, সমস্ত বিষয়ের শুদ্ধি শুধুমাত্র নিষ্ঠা ছাড়া আর অন্য কোনও কিছুতেই হবে না। একটা কথা মনে রাখিস, প্রকৃত বুদ্ধিমান মানুষ যেমন জলপিপাসা পেলে মরুভূমিতে যায় না, তেমনি নিষ্ঠাবান সাধনশীল মানুষ কখনও ভোগের পিছনে ছোটে না।
জীবনে বহুবার অভিজ্ঞতায় দেখেছি সাধুসন্ন্যাসীদের যদি মনের মতো হওয়া যায় আর ঠিকঠাক জায়গায় খোঁচাটা যদি মারা যায়, ব্যস আর কিছু করতে হয় না, আপনা থেকেই কথা চলতে থাকে। এখন আমার এই সাধুবাবার সেই অবস্থা। বললেন,
– বেটা, আজকাল দেখবি ধর্মপথে মানুষ আসতে চায় না, এলেও কিংবা দীক্ষিত হলেও তাঁদের দেখবি মন বসে না, কেন জানিস?
মাথাটা নেড়ে বললাম জানি না। মনে মনে বললাম, জেনেই যদি ফেলতাম তাহলে সাধুদের পেছনে এই ভাবে পড়ে থাকতাম! দুজনের সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠা চলছে। আর অল্প কিছু উঠলে চৌষটযোগিনী মন্দিরঅঙ্গন। বললেন,
– বেটা, জাতিধর্মনির্বিশেষে সমস্ত সম্প্রদায়ের সাধুসন্ন্যাসী বল আর সংসারী নারীপুরুষই বল, কাউকে বাদ দিয়ে বলছি না, যাদের অন্যের দোষ দেখা ও ধরার অভ্যাস বেশি, একটু খেয়াল করলে দেখবি, বাইরে লোকদেখানো একটা ব্যাপার থাকে তাদের কিন্তু আসলে তারা ধর্ম পথ থেকে সরেই আছে। যাদের যাদের এই অভ্যাসটা আছে তবে কিছুটা কম, তারা কিছুটা আছে এপথে। যাদের পরের দোষ দেখা ও ধরার অভ্যাস কম তারা ভগবানের আরও কাছে, ধর্মপথে আরও বেশি আছে। বেটা, যাদের ওই অভ্যাসটা নেই, সংসারের বাইরে থাকলে সে প্রকৃত সন্ন্যাসী, সংসারে থেকেও সে নির্লিপ্ত সাধু। বেটা, এমন সংসারী মানুষ সংসারে প্রায় দুর্লভই বটে। সাধুসন্ন্যাসীদের মধ্যে এমন অবস্থার সন্ন্যাসী অবশ্যই আছে তবে সংখ্যায় কম। প্রকৃত এ পথের পথিক যারা, অন্যের কোনও দোষ ধরা পড়ে না তাদের চোখে। কেন জানিস বেটা, সাধুসন্ন্যাসীরা যে সত্ত্বগুণের কারবারি, ওই গুণের দরবারিও বটে। মানুষের দোষ মেরে গুণ নিয়েই যে খেলা তাদের। সারা পৃথিবীর সমস্ত নারীপুরুষের মধ্যে ঈশ্বরীয় শক্তির পরমানন্দময় স্ফুরণ যেটা, সেটাকেই তো গুণ বলে বেটা।
কথা শেষ হল। আমরা দুজনে সমস্ত সিঁড়ি ভেঙ্গে এসে দাঁড়ালাম চৌষটযোগিনী মন্দিরপ্রাঙ্গণে। সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, মুঝে মাফ কর দে না। এখন এখানে আমার কিছু কাজ আছে, তাতেই মনটা আমার দিতে হবে। কিছু মনে করিস না মেরা বেটা।
এ কথার পর আমার কিছু বলার রইল না। এইভাবে দয়া করে, এই বয়েসে এতগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে সমানে কথা বলার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর মতো কোনও ভাষা কি পৃথিবীর কোনও অভিধানে আছে? এরপর কোনও অনুরোধ করলাম না। যা পেয়েছি তা অনেক। এমনটা ক-জনা পায়! ও ঋণ কি কখনও পরিশোধের? কোনও কথা বললাম না। দুচোখ জলে ভরে গেল। সাধুবাবার চোখের দিকে তাকাতে দেখলাম আমার মতো তাঁরও দু চোখের অবস্থা। তাঁর কপোল বেয়ে নেমে এল কয়েক ফোঁটা। একটা কথাও সরল না মুখ থেকে। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালাম। মাথায় দুটো হাত রেখে বললেন,
– বেটা, আশীর্বাদ করি তোর মৃত্যুর দিন তোর গুরুজি যেন তোর হাত ধরে নিয়ে যায় তাঁর পরমধামে। তোর ইষ্টলাভ হোক। পরমানন্দে থাক।