Mythology

সারাক্ষণ মাথায় নগ্ন চিন্তা, সমাধান দিলেন সাধুবাবা

নারী পুরুষ সকলেরই যৌবনে এমনটা হয় তবে কারো কম কারো বেশি। এমন অসংখ্য রমণীই মাথায় চক্কর খায়। অনেক রকমের নগ্ন চিন্তাও মাথায় ঢোকে।

প্রথম থেকে এতটুকু বিরক্ত না হয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। এতে আমার বেশ আনন্দ হচ্ছে। এমন সাধু খুব কমই পেয়েছি জীবনে। বললাম,

– বাবা, আমার রাগ আর অভিমান বড্ড বেশি। কি করলে এর থেকে মুক্তি পেতে পারি। এর জন্য প্রায়ই মনের শান্তি নষ্ট হয়। এ রোগের দাওয়াইটা একটু বলবেন দয়া করে?


কথাটা শুনে সাধুবাবার মুখে হাল্কা হাসির একটা রেখা ফুটে উঠল। হাসিমাখা মুখে বললেন,

– বেটা, টাকা থাকলে মানুষের অভিমান হয় আবার না থাকলেও হয়। সেটা অন্যের অর্থ দেখলে। তুই কি এর কোনওটার মধ্যে পড়িস?


মাথা নেড়ে বললাম ‘না’। সাধুবাবা বললেন,

– বিদ্যাতে মানুষের অভিমান হয়। আবার মূর্খের অভিমান হয় অন্যের বিদ্যালাভ দেখলে। এর মধ্যেও পড়িস?

মাথা নেড়ে বললাম এর কোনওটাতেই পড়ি না। সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, অভিমানের নামান্তর অহঙ্কার। অহঙ্কার তোর নেই বললি। রাগ খুব বেশি আছে বলেছিস, ওটা ঠিক আছে। ওটা অনেকেরই থাকে, কারও কম কারও বেশি। ওটা থাকাও ভাল না। আসলে তুই বলতে চাইছিস সামান্য ব্যাপারে তোর কোনও না কোনও ভাবে মনোবেদনার সৃষ্টি হয়। বিষয়টাকে তুই অভিমানের ঘাড়ে চড়িয়ে দিয়েছিস, তাই তো?

কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আসল বক্তব্যটাই এই অথচ বলছি অভিমান। আমার আছেটা কি যে অভিমান করব? গরিব ছেলের কখনও অহঙ্কার হয় নাকি? কথাগুলো মনে মনে ভাবলাম। অন্তর্যামী সাধুবাবা বুঝলেন হয়ত। বললেন,

– বেটা তোর যেটা হচ্ছে সেটা একান্তই ঠুনকো মনের সমস্যা। এটা ছোট ও নিচ মনের পরিচায়ক। যেকোনো গাছের ফল ধীরে ধীরে বড় হলে ফুল যেমন আপনা থেকে ঝরে যায় তেমনই মন বিস্তৃত হলে মান অভিমান রাগদ্বেষ কামনা বাসনা, যা কিছু মনকে আবিল করে কলুষিত করে, তা আপনিই খসে পড়ে যাবে। এরজন্য অত চিন্তার কি? মনটা বড় করে মেলে ধর, ও সবই তোর চলে যাবে। মনের দীনতা নষ্ট করে অভিমান। যার যত বেশি অভিমান, সে তত বেশি দূরে সরে আছে ভগবানের কাছ থেকে।

সাধুবাবা থামতেই জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, আপনি তো মনটা বড় কর বলে খালাস হয়ে গেলেন। মনটা বড় করার উপায় অন্তত বাতলান।

হাসতে হাসতে বললেন,

– বেটা, সব কিছু কি আর এমনি এমনি হয়? মনটাকে রত্ন দিয়ে সাজিয়ে দে, দেখবি কত বড় হয়ে গেছে মনটা তোর।

থামলেন। একটু থেমে বললেন,

– বেটা, রাতে আকাশের রত্ন চন্দ্র, কানের রত্ন যেমন ভগবানের নাম শোনা, শয্যার রত্ন যেমন সুন্দরী রমণী, তেমনি মানুষের মনের রত্ন হল গুরুপ্রদত্ত ইষ্টনাম। এই রত্নে সাজিয়ে ফেল মনটাকে, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

কোনও কথা বললাম না। অন্তর দিয়ে গভীরভাবে বোধে আনতে চেষ্টা করছি কথাগুলোকে। এবার আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,

– বেটা, এখন তোর বয়েস খুবই কম। আর সময় নষ্ট না করে সাধনে লেগে যা। যৌবনকালই সাধনভজনের সময়। বৃদ্ধ বয়েসে যুবতী স্ত্রী সম্ভোগ যেমন অসম্ভব তেমনি সম্ভব নয় বৃদ্ধ বয়েসে সাধনভজন। তখন তো চলে রোগের ভজন।

প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,

– বাবা, গৃহত্যাগের পর থেকে দীর্ঘ এতগুলো কখনও অনাহারে কেটেছে? আগামিকাল, এমন কি বুড়ো বয়েসে দেহ যখন অপটু হয়ে যাবে, তখন কি ভাবে চলবে, আহার জোটাবেন কি ভাবে, সেসব কথা কি কখনও ভেবেছেন?

এ জিজ্ঞাসার উত্তরে বললেন,

– বেটা, ভবিষ্যৎ ভাবনাটা সাধুদের জন্য নয়, ওটা সংসারীদের জন্য, গৃহীরা ভবিষ্যৎ সুখ বা দুঃখের কথা আগাম ভেবে বর্তমানে আনন্দিত বা দুঃখিত হয়। ফলে প্রায়ই মনের শান্তি অকারণ ক্ষুণ্ণ হয়। সাধুদের জীবনে সুখ দুঃখের আগাম ভাবনার এতটুকু অবকাশ নেই, তাই মনের শান্তিও ক্ষুণ্ণ হয় না। আর খাবার জোগাড়ের কথা বললি, তুই বলতো বনের পশুপাখিরা যখন চাকরিবাকরি করে না তখন আমার কি চিন্তা করার কোনও কারণ আছে?

আগেও বলেছি, আবারও বলছি, যখন সাধুসঙ্গ করি তখন মনে সাজানো গোছানো কোনও প্রশ্ন থাকে না। কখনও কথার সূত্র ধরে কথা, কখনও মনে হুটপাট যা প্রশ্ন এল তাই-ই করি। জানতে চাইলাম,

– অতিরিক্ত কোনও কিছু ভাল না এটা তো আমি নিজেই জানি। অনেকে শুনি অতিরিক্ত ঘুমায়, এটা তো খারাপ। খারাপ ফলটা কি আপনার জানা আছে?

সাধুবাবা বললেন,

– তমো, রজঃ আর সত্ত্ব এই তিনটে গুণই মানুষের সঙ্গের সাথী। সবচেয়ে নিকৃষ্ট গুণ হল তমোগুণ। অতিরিক্ত ঘুম হয় তমোগুণের প্রভাবে। সংসারে আসক্তি ও মোহ বেশি হয় যাদের ঘুম বেশি। এরা কামুক, অত্যন্ত বিষয়ী ও স্বার্থপর হয়। সংসার জীবনে এরা শান্তি পায় না। ঘুম যত ত্যাগ হবে তত ত্যাগ হবে মোহ। মোহ ত্যাগ না হলে কোনও কিছুর উপরে আসক্তি ত্যাগ হবে না। ওটা ত্যাগ না হলে সাধনভজন জীবনে এগোতে পারবে না। ও পথে না এগোলে সারাটা জীবন সংসার ঠেলবে আর অশান্তি ভোগ করবে। দিনে ঘুমনো একেবারেই উচিত না। এতে বুদ্ধি নষ্ট ও আয়ুক্ষয় হয়। বেটা, মানুষ না চেয়ে অতিরিক্ত যেটা পায় সেটা দুঃখ। মানুষের অতিরিক্ত ঘুম সংসারজীবন ও দুঃখেরই কারণ।

সাধুবাবার বয়েসটা খুব বেশি নয় বটে তবে জ্ঞানের নাড়িটা বেশ টনটনে। দেখেছি, এটা হয় সাধুরা চলার পথে আর পাঁচটা সাধুসঙ্গ করে। কথা শেষ হতে না হতেই প্রশ্ন তৈরি। জানতে চাইলাম,

– বাবা, আমরা সংসারে আছি। মনের উত্থানপতন হচ্ছে অবিরত। নানান স্বার্থচিন্তায় মন জর্জরিত। সব সময় মন কোনও না কোনও ধান্দায় লেগেই আছে। মন ভগবানকে ডাকে বলতে পারেন বুড়িছোঁয়ার মতো। তবুও তার মধ্যে থেকে মনের উন্নতি হয়েছে কিনা কি করে বোঝা যায়?

মুহুর্ত দেরি করলেন না। বললেন,

– বেটা, আমার মনের অবস্থা বলতে পারিস তোরই মতো। তোর এই প্রশ্ন আমার মনেও একদিন এসেছিল। গুরুজির কাছে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘ অন্তরে যখন সমস্ত পাহাড় পর্বতকে নারায়ণশিলা, সব বনকে তুলসীবন, সব জলকে ‘গঙ্গাপানি’ বলে অনুভূত হবে, তখনই বুঝবি হৃদয়মন্দিরের আসনে ভগবানের অধিষ্ঠান হয়েছে, কালিমালিপ্ত মন উন্নত ও আবিলতামুক্ত হয়েছে।

জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, সাধুসঙ্গ করলে কি হয়?

এ কথা শুনে হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন,

– এতক্ষণ পর একটা মজাদার প্রশ্ন করেছিস বটে। শোন বেটা, সাধুর পোশাকে আছি তবে আমি সাধুপদবাচ্য নই। গুরুজি বলতেন, সাধুসঙ্গ করলে মন নিষ্কলুষ হয়, মনে সঞ্চার হয় করুণা। পৃথিবীতে চন্দন শীতল, তার থেকে শীতল চন্দ্রের আলোক, এদের থেকেও শীতল সাধুসঙ্গ। বেটা, বট গাছের ছায়া, ইটের তৈরি বাড়ি, কূপের জল আর মধ্য যৌবনের পত্নী, এগুলো শীতকালে উষ্ণ থাকে, শীতল হয় গরম কালে। অর্থাৎ সমস্ত ঋতুতেই এরা সুখদায়ক। গঙ্গাজল পাপাহরণ করে, জগতের উত্তাপ যেমন হরণ করে চাঁদের শীতল কিরণ, তেমনই মানুষের পাপতাপ দুঃখ দৈন্য দূর হয় সাধুসঙ্গ করলে। বেটা, পান মানুষের মুখকে অলংকৃত করে, দুটো ঠোঁট লাল করে শোভা বৃদ্ধি করে সুন্দরী মুখকে। সৎ বাক্যের দ্বারা মানুষের মনকে অলঙ্কৃত করে সাধু সন্ন্যাসী ও মহাপুরুষেরা।

এতক্ষণ পর এদিক ওদিক একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন,

– বেটা, এবার আমি উঠব।

দেরি না করেই বললাম,

– আর একটু বসুন। আর দু-চারটে কথা বলে আপনাকে ছেড়ে দেব। বাবা, মন প্রায়ই বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। জপতপে মন কিছুতেই বসে না। পারিবারিক কোনও কারণে নয়, এমনিতেই হয়ে পড়ে। একটা সত্যি কথা বলছি বাবা, ধরুন রাস্তা দিয়ে চলছি। কোনও সুন্দরী রমণী চোখে পড়ল। দেখলাম মাত্র, মনে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া হল না কিন্তু যত গোল বাধে জপ করতে বসলে। তখন তার রূপের পসরা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনেক রকমের নগ্ন চিন্তা মাথায় ঢোকে। ওসব ভাষায় বলতে পারব না। এর থেকে মুক্তির উপায় কি?

কথাগুলো মন দিয়ে শুনে একটু মুচকি হাসলেন। হাসিমাখা মুখে প্রসন্ন মনে বললেন,

– বেটা, তোর এখন বয়েস কত?

মুখে ‘সাতাশ’ বলে মুখের দিকে তাকালাম, সাধুবাবা খুব হাল্কাভাবে মাথাটা দোলাতে দোলাতে বললেন,

– বেটা, এটা বয়েসের ধর্ম। নারী পুরুষ সকলেরই যৌবনে এমনটা হয় তবে কারো কম কারো বেশি। এপ্রকৃতিরই খেলা। ভেবে লাভ নেই। জীবন তো এখনও অনেক পড়ে আছে, এমন অসংখ্য রমণীই তোর মাথায় চক্কর খাবে। বেটা, নদী যেমন সমুদ্রে তৃপ্ত হয় না, আগুন কাঠের দ্বারা তৃপ্ত হয় না, তেমনই পুরুষেরা এক রমণীতে তৃপ্ত হয় না। এটা বয়সের ধর্মে হবে আবার ওই একই নিয়মে এগুলো আপনা থেকেই পরিত্যক্ত হয়, ভার্যার যেমন বৃদ্ধ স্বামীকে কিছুতেই আলিঙ্গন ও শৃঙ্গার করতে ইচ্ছা করে না, পরিত্যাগ করে। একইভাবে মা লক্ষ্মীও অধ্যবসায়হীন, অলস প্রকৃতির, ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল, উদ্যম ও সাহসশূন্য মানুষকে আশ্রয় করতে ইচ্ছা করেন না।

একটু থেমে বললেন,

– বেটা, অত ভাবনার কিছু নেই। কখনও কোনও কারণে জপতপে মন না বসলে কাউকে কিছু খাবার খাইয়ে দিয়ে অথবা প্রণাম করলে ধীরে ধীরে আবার জপে মন বসে, ভাবও আসে।

কথাটুকু শেষ করে আর দেরি করলেন না। উঠে দাঁড়ালেন। বুঝলাম, কোনও কথা বলে বা অনুরোধ করে লাভ নেই। সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, কিছু মনে করিস না, একটু তাড়া আছে। যেতে হবে অনেক দূর।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। সাধুবাবা দুটো হাত মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

– বেটা, তোর পরমানন্দ লাভ হোক, পরমানন্দ লাভ হোক, পরমানন্দ লাভ হোক, এই প্রার্থনা আমার গুরুজির কাছে।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button