Mythology

অগাধ ধনদৌলত ও সুন্দরী স্ত্রীকে ভোগ করতে চান সাধুবাবা

অগাধ টাকা পয়সা ধন দৌলত যেন আমার হয়। অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী যেন ভোগ করতে পারি। চরম ভোগবিলাসেই যেন আমার জীবন কাটে।

এখানে, এই গোমুখে সাধুদর্শন হল অনেক। কথাও হল। তবে নিজেকে নিয়েই এরা যেন বড় বেশি ব্যস্ত, হয়ত মুক্তির জন্যে। আমরা গৃহী, ও জীবনের কথা ভাবতেও পারিনে। এরাও মানুষ – মানুষ আমরাও কিন্তু মনের কত পার্থক্য। ওদের খাওয়ার ঠিক নেই – নেই থাকার। চলারও বিরাম নেই অথচ নির্বিকার নির্লিপ্ত জীবন।

এদের লক্ষ্য হয়ত, যিনি প্রকৃত জ্ঞান ও সত্যের উপলব্ধি করার ক্ষমতা প্রদান করেন, যিনি সাধকের সাধনায় আনেন শান্ত সমাহিত ভাব, যিনি পার্থিব সর্বপঙ্ক থেকে উদ্ধার করে গৃহী জীবনেও দেন মোক্ষের সন্ধান, যিনি হৃদয়ার্ণবে প্রবাহিত করেন সত্ত্বগুণ প্রস্রবণ, যিনি আত্মজ্ঞানের আলোকস্তম্ভ রূপে সদাই দীপ্যমান, যিনি আত্মসাধনার উচ্চতম শিখরে আরূঢ় করেন সাধককুলকে, যিনি শুদ্ধসত্ত্ব ও শক্তিমান সাধকের আকারে অকৃপণ করে ঢেলে দেন সাধন ঐশ্বর্য, যিনি সাধকের অন্তরের হৃদয়পদ্মে প্রতিষ্ঠিত করেন অদ্বৈত ব্রহ্মজ্ঞান, যিনি ঋগ্বেদের মূলমন্ত্র ‘আত্মিক উপলব্ধি’ বোধ মানব হৃদয়কন্দরে শরতের হিমস্নাত প্রস্ফুটিত শিউলির মত বিকশিত করে তোলেন, যিনি নিয়ে যান পূর্ণানুভূতির সার্থক সিদ্ধির সাগর পারে, যাঁর কিঞ্চিৎ পরিমাণ কৃপাসম্পাত লাভ না করলে জগতের কেউই কোনও সাধনায় মেতে উঠতে পারে না, যাঁর কৃপায় মনের প্রতিটি সূক্ষ্মতম কোণে চিরন্তন অবিনাশী হয়ে ওঠে অতীন্দ্রিয় আনন্দময় অনুভূতি, প্রজ্ঞা শক্তির আলোকছটা আর আত্মজ্ঞানের মাধুর্যে ভরে ওঠে মন, যাঁকে লাভ করার জন্য তপস্বীগণ করেন কঠোর তপস্যা, ব্রহ্মচারীগণ করেন দুশ্চর ব্রহ্মচর্য আচরণ, সেই পরমপ্রাপ্তির আশায় হয়ত এই জীবন, সাধনা। কিন্তু আমরা?


কথাগুলো ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম এক সাধুবাবার কাছে। গোমুখের বরফগলা জলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে স্নান সেরে সবে উঠেছেন।

সাধুবাবা বয়সে বৃদ্ধ। বয়স আন্দাজ ৬০/৬৫ হবে। তার কম নয়, বেশিও হতে পারে। মাথায় জটা নেই, খোলা চুল কাঁধ ছাড়িয়ে এসেছে পিঠের মাঝামাঝি। গালভর্তি দাড়ি। অধিকাংশই পাকা, কাঁচাও আছে কিছু। এক কালের হৃষ্টপুষ্ট দেহ কালের প্রভাবে শুকিয়ে গেলে যেমন হয়, তেমনই সাধু বাবার দেহ। হাঁটুর উপরে উরু শুকিয়ে যাওয়ায় মালাইচাকিটা চোখে পড়ছে বেশি করে। গালটা ভাঙ্গা। গায়ের রঙ তামাটে। ঝোলা আর কম্বলটা তো আছেই। দেখলাম একটা লোটার গলায় দড়ি বাধা। বোধ হয় কাঁধে ঝোলানোর সুবিধার জন্য। আর চিমটে আছে একটা। এগুলো রয়েছে বড় একটা পাথর খণ্ডের উপরে।


প্রাথমিক কাজটা সেরে নিলাম। প্রণাম করলাম। কোনও কথা বললেন না সাধুবাবা। হাতজোড় করে ইশারায় দেখিয়ে বললাম,

– বাবা, চলুন না ওই পাথরের চাঁইটার উপর একটু বসি।

এবারও কোন কথা বললেন না শুনলেন। দুজনে গিয়ে বসলাম মুখোমুখি হয়ে। চারিদিকে বরফে ঢাকা পর্বতমালা। প্রকৃতি তার ভাণ্ডার উজাড় করে সাজিয়ে তুলেছে গঙ্গাবতরণক্ষেত্র। বেশ ঠান্ডা হাওয়াও বইছে দামালের মতো।

আর গঙ্গা, গঙ্গা এখানে যেন প্রথম মিলন রাত্রির আবেগ মত্ততায় লজ্জাহীনা। আমাদেরই পাশ দিয়ে প্রকাশ্যে বয়ে চলেছে সঙ্গমের আশায়, যমুনায়। সাধুবাবার কাছে জানতে চাইলাম,

– বাবা, আপনার বাড়ি ছিল কোথায়?

এক কথায় উত্তর দিলেন একটু গম্ভীর সুরে,

– পাঞ্জাব।

কিছু শুকনো খাবার ছিল আমার কাছে। বের করলাম। হাতদুটো টেনে দুহাত ভরে দিয়ে অনুরোধ করলাম খেতে। ধীরে ধীরে খাওয়া শুরু করলেন সাধুবাবা। আমি শুরু করলাম কথা,

– বাবা, কিসের আকর্ষণে, কি পাওয়ার আশায় আপনি গৃহত্যাগ করেছেন?

কথাটা শোনা মাত্র কেমন যেন ফ্যাকাসে মলিন হয়ে গেল মুখখানা। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই ছলছল করে উঠল চোখদুটো। মনে হল, কোথাও যেন আঘাত করে ফেলেছি। হাতজোড় করে বললাম,

– বাবা, অজান্তে আপনার অন্তরে আঘাত করে থাকলে সন্তানের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।

সাধুবাবা নীরব। আরও করুণ হয়ে উঠল সারা মুখমণ্ডল। এ অবস্থায় আমি নিজেও পড়ে গেলাম একটা অপ্রস্তুত মানসিক সংকটে। হাতের খাবার রয়ে গেল হাতে। করুণ কণ্ঠে বললেন,

– বেটা, তোর জানতে ইচ্ছা করেছে তাই জিজ্ঞাসা করেছিস। এতে তোর কোনও অপরাধ হয়নি।

কথাটুকু বলে একটু চুপ করে রইলেন। কোনও কথা বললাম না আমি। মলিন মুখেই শুরু করলেন সাধুবাবা,

– আমার তো বেটা ভগবানকে পাওয়ার আশায় গৃহত্যাগ নয়। তোরা যাঁকে ভগবান বলিস, আমি তাঁকে কখনও পাওয়ার আশা করিনি, করিও না। আমি তো তাঁকে চাই না বেটা।

বিস্ময়ে একটা কথাও সরল না মুখ থেকে। বলে কি সাধুবাবা! কি চায়, কিসের জন্য এই কঠোর কষ্টকর জীবনযাপন? এই বয়েসে এত দূরের তীর্থে এসে বরফগলা জলে স্নান, কোন উদ্দেশ্যে, কার উদ্দেশ্য? কি প্রার্থনা করল মনে মনে? অসংখ্য প্রশ্ন এল মনে। কোনও কথা বললাম না। মুখের কোনও পরিবর্তন হল না সাধুবাবার। বললেন,

– বেটা, ভগবানকে পাওয়ার সাধনা আমি করি না। আমার ভিতর থেকে ভোগের বাসনা যায়নি এখনও। তাই সাধনা আমার ভোগের।

এ কথায় আরও অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,

– সাধনাই যখন আপনার ভোগের, তাহলে সংসার ত্যাগ করে কঠোর কঠিন এ জীবনকে বেছে নিলেন কেন?

এবার সাধুবাবা তার অতীত জীবন সম্পর্কে যে কথাগুলো বললেন, তাতে বিস্ময়ের আর সীমা পরিসীমা রইল না। বললেন,

– বেটা, তখন আমার বয়েস আর কত হবে, কুড়ি–একুশ। আমাদের পাশের গাঁয়ের একটা মেয়েকে ভালবাসতাম। আন্তরিকভাবেই ভালবাসতাম। লেখাপড়া না জানলেও মেয়েটি ছিল সুন্দরী। ওদের পারিবারিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। আমাদেরও খুব একটা ভাল ছিল, তাও না। ছোটখাটো কাজ একটা করতাম। আয় ছিল সামান্য। বছর দুয়েকের ভালবাসায় আন্তরিকতা আরও বেড়ে গেল। একসময় বিয়ের ব্যাপারে রাজি হলাম উভয়েই।

কথাগুলো বলে একটু দম নিলেন। এখানে যেমন ঠান্ডা তেমনই বেশ কষ্ট হয় শ্বাস নিতে। গোমুখে অক্সিজেন কিছুটা কম। তাই প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠতে হয়। কৌতূহলী হয়ে বললাম,

– তারপর কি হল বাবা?

মুখমণ্ডলে মলিনতার ছাপ রয়েই গেল। আমার দেয়া খাবার এখনও খাওয়া হয়নি সাধুবাবার। সেটাও রয়েছে হাতে। তিনি বললেন,

– বিয়ের কথা ভেবে একদিন মায়ের কিছু গয়না চুরি করে ওকে দিলাম। সামান্য আয় থেকে বাঁচিয়ে কিছু কিছু টাকাও জমাতাম ওর কাছে। সংসার করব, পাছে কোনও অসুবিধে না হয়।

কথায় ছেদ টেনে জিজ্ঞাসা করলাম,

– আপনারা কি প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ করতেন?

সাধুবাবা বললেন,

– না না, ওরা থাকত আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। মাসে আমরা দু-তিন দিন দেখা করতাম।

আর কোনও প্রশ্ন করলাম না। একটু ধরা গলায় বললেন,

– বেটা, সংসারে কি বিশ্বাসের কোনও মূল্যই নেই – নেই ভালবাসার? তলে তলে ও যে অবস্থাপন্ন আর একজনকে ভালবাসত, তা আমি মোটেই জানতাম না। যেমন যাই তেমনই একদিন দেখা করতে গিয়ে শুনলাম, ও সেই ছেলেটাকে বিয়ে করে চলে গেছে গাঁ ছেড়ে। কথাটা শুনে মর্মান্তিক আঘাত পেলাম। মানসিক দিক থেকে একেবারে ভেঙেই পড়লাম। তখন মনের অবস্থাটা যে কি হয়েছিল তা বেটা তোকে আমি বোঝাতে পারব না।

এই পর্যন্ত বলে চুপ করে রইলেন। দেখলাম, শোকার্ত গৃহীর মতো ঝরঝর করে জল পড়ছে চোখ থেকে। মনে হল সামনে বয়ে যাওয়া গঙ্গার তীব্র স্রোতের মতো সাধুবাবার বুকের ভিতরেও যেন বয়ে চলেছে তীব্র বিরহব্যথার স্রোত। আমার কিছু বলার নেই। খানিক পরে নিজেকে সংযত করে বললেন,

– বেটা তখন ভাবলাম, এ জন্মে আর সংসারই করব না। ব্যস, ওখান থেকে আর বাড়ি ফিরলাম না। ভিক্ষাকে জীবিকা করে সোজা চলে গেলাম জ্বালামুখীতে। ওখানে ছিলাম কিছু দিন। তারপর একের পর এক সমস্ত তীর্থ ভ্রমণ করতে লাগলাম। এই ভ্রমণের সময় দীক্ষা হল বেনারসে। এইভাবেই চলছে আমার জীবন। গোমুখে আমি আগেও এসেছি কয়েকবার।

আবার সেই একই প্রশ্ন করলাম,

– বাবা, একটু আগে বললেন ভগবানকে লাভ করার আশায় এ জীবন আপনার নয়। তাহলে কিসের আশায় এইভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? সাধন ভজনই বা কার উদ্দেশ্যে করে থাকেন।

আমার এ প্রশ্নে মুখের মলিনতা কেটে গেল মুহুর্তের মধ্যে। দেবতাদের বিচরণক্ষেত্র হিমালয় আর পুণ্যতোয়া গঙ্গাকে যেন স্তম্ভিত করে দিয়ে উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললেন সাধুবাবা,

– বেটা, আমি তীর্থ তীর্থে যাই, দেবতাদের মূর্তি দর্শন করি। ভগবান আছে কি নেই জানি না। জানার চেষ্টাও আমি করি না। তবে যেখানে যাই, অন্তরে শুধু একটাই প্রার্থনা করি, ‘হে পরমাত্মা, হে ঈশ্বর, হে তীর্থদেবতা, জানি না তোমাদের কোনও অস্তিত্ব আছে কিনা, সত্যিই যদি থাকে, তাহলে আমার যেন আবার জন্ম হয়। আমি যেন ধনীর ঘরে জন্মগ্রহণ করি। অগাধ টাকা পয়সা ধন দৌলত যেন আমার হয়। অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী যেন ভোগ করতে পারি। চরম ভোগবিলাসেই যেন আমার জীবন কাটে। গরিব দুঃখীদের যেন দান করতে পারি। হে পরমাত্মা, তোমাকে জানার বাসনা আমার নেই, দর্শনপ্রার্থীও আমি নই। এইটুকু কৃপা আমাকে কর।’ বেটা, গৃহত্যাগের পর থেকে নিরন্তর এই প্রার্থনা করি যখন যে তীর্থে যাই সেই তীর্থদেবতার কাছে। এটাই আমার একমাত্র সাধনা।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললেন। আর কোনও প্রশ্ন করে বিব্রত করার মানসিকতা হল না। কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইলাম দুজনে। গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, সাধুবাবার বর্তমানকে উপেক্ষা করে অতীত ও অনাগত অনিশ্চিত জীবনভাবনার কথা।

এইভাবে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আবার ফিরে এলাম ভুজবাসায় লালবাবার আশ্রমে। সারাটা পথ চলতে চলতে ভেবেছি শুধু সাধুবাবার কথা। আর ভাবছি গোমুখের কথা। আর কখনও আসা হবে না হয়ত, হতেও পারে। তবে আজকে যেটুকু পেলাম, তাই-ই স্মৃতিতে বয়ে নিয়ে বেড়াব সারাটা জীবন। এটাই বা আর কম কি।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button