শান্তি ফিরে আসবে জীবনে, সহজ কাজটি জানালেন সাধুবাবা
অস্থির হয়ে পড়তাম। কোথাও শান্তি পেতাম না। অতি অল্প দিনেই আমার শোক সংবরণ হল। তারপর ধীরে ধীরে ভাবনা মুছে গেল মন থেকে। এখন আর কোনও কষ্ট হয় না।
কেদারনাথে দ্বিতীয় দিন। বিকেলে বসে আছি মন্দির অঙ্গনে। আমার মতো বসে আছেন আরও অনেক তীর্থযাত্রী ও সঙ্গীরা। বেশ কয়েকজন সাধুও ইতস্তত বসে আছেন লোটাকম্বল নিয়ে। তাদের মধ্যে চোখ পড়ল আমার এক অতি বৃদ্ধ সাধুর দিকে। চুলদাড়িতে বয়েস যেন এক কোটো সাদা বার্ণিশ রঙ ঢেলে দিয়েছে। পরনে এক টুকরো কাপড় যা পড়লে দেহের অনেক অংশই দাঁত বেড় করে খিলখিল করে আসে। বুড়ো বয়েসে সম্বলটা ঠিক আছে। নাকটা বেশ খাড়া রবি ঠাকুরের মতো। বসা অবস্থায় গায়ে মোটা কম্বল জড়ানো সত্ত্বেও ছেঁড়া কাপড়টা দেখা যাচ্ছে। মাথায় হাত দেড়েক লম্বা চুলগুলো দেখলে মনে হবে জটা, তবে জটা নয়। কয়েকদিন স্নান না করার জন্য চুলগুলো জট পাকানোর মতো হয়ে আছে। দাড়ির নীচের অংশটুকু কম্বলে ঢাকা। বাকি অংশটুকু বেরিয়ে আছে কম্বলের উপরে। চোখদুটো বড় সুন্দর, অপূর্ব। গায়ের চামড়া বেশ কুঁচকে গেছে। কপাল ও মুখখানায় বলিরেখা বেশ ফুটে উঠেছে।
টুটুকে বললাম,
– টুটু ‘কুইক’ চলে এস। সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলব। তুমি হিন্দিটা নোট করবে, পরে লিখে নেব।
টুটু ‘রেডি’। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সাধুবাবার কাছে। মুখে ‘গোড় লাগে বাবা’ বলেও প্রণাম করলাম পায়ে হাত দিয়ে। বসলাম মুখোমুখি হয়ে। বসল আমার ভ্রমণ পথের পথসঙ্গিনী টুটুও। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপকা ডেরা কাঁহা?
কোনও দ্বিধা না করে উত্তর দিলেন সাধারণভাবে,
– রাজস্থান।
জানতে চাইলাম,
– ঘর কাঁহা থা?
সংক্ষেপে স্বাভাবিকভাবে বললেন,
– কেরল।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– আপকা আভি উমর কিতনা বাবা?
মুখ দেখে বেশ মনে হল, এবার যেন একটু অস্বস্তি বোধ করলেন সাধুবাবা। তবুও মুখের ভাবটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললেন,
– আভি তো বেটা নব্বই বরস হো চুকা হ্যায়।
বিড়ি বের করলাম পকেট থেকে। ইশারায় চলবে কিনা জিজ্ঞাসা করায় সম্মতি জানালেন ঘাড় নেড়ে। একটা বিড়ি ধরিয়ে হাতে দিয়ে বললাম,
– বাবা, আপ তিরথ করনে আয়া ক্যা পয়দল সে?
খুশিতে সামান্য হাসি ফুটে উঠল মুখে। বললেন,
– বেটা, ম্যায় তো হরদুয়ার সে হি পয়দল ইতনি দূর আয়া হু, অউর চারো ধাম কা দর্শন ভি ম্যায়নে পয়দল হি কিয়া হ্যায়।
বলেই বিড়ি টানতে লাগলেন সাধুবাবা। ঠান্ডায় বিড়ির চেয়ে বড় বন্ধু বোধ হয় আর কেউ নেই। সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, আপনে ঘর ছোড়া কিউ?
এতক্ষণ মুখখানা মোটামুটি প্রসন্নই ছিল। এ প্রশ্নে মনে হল একটু বিরক্ত হলেন। ভাবটা বুঝতে পেরে পায়ে হাত দিয়ে বললাম,
– বিরক্ত হবেন না বাবা, এটা আমার কৌতূহল। অনুগ্রহ করে যদি বলেন তাহলে কৌতূহলটা মেটে।
পা থেকে হাতটা সরিয়ে দিলেন। একটু উদাসীনতার সুরে বললেন,
– কিউ ছোড়া বেটা ইয়ে তো পাতা নেহি হ্যায়।
কথার ভাবে বুঝলাম, ঘর ছাড়ার কারণটা যেন গোপন করতে চাইছেন। তবু অনুরোধের সুরে বললাম,
– দয়া করে বলুন না বাবা, কেন ঘর ছাড়লেন? নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে নইলে ঘর ছাড়লেন কেন!
কোনও উত্তর দিলেন না। মনে হল তিনি যেন অতীতে ফিরে যেতে চাইছেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। সাধুবাবাও চুপ। এইভাবে কেটে গেল কিছুটা সময়। প্রসঙ্গে পাল্টে বললাম,
– বাবা, সব তীর্থ দর্শন হয়েছে আপনার?
এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন,
– হাঁ বেটা, সমস্ত তীর্থদর্শনই আমার হয়েছে। মরুতীর্থ হিংলাজ গেছি একবার। মানস কৈলাসেও গেছি একবার। তাছাড়া ভারতবর্ষের যে প্রান্তে যেসব তীর্থ আছে সেখানেই গেছি। কোথাও একবার, কোথাও দুবার তিনবার। বাকি রাখিনি কোথাও।
নিভে যাওয়া বিড়িটা ফেলে দিলেন। এদিক ওদিক চাইলেন একবার। তারপর আমার দিকে। বললাম,
– আহার-অর্থ কোথায় পান, কেমন করে চলে আপনার?
ভাবটা এখন অনেক প্রসন্ন হয়েছে, প্রসন্ন মনেই বললেন,
– বেটা, আকাশ বৃত্তিতেই জীবনধারণ করি আমি।
সাধুসন্ন্যাসীদের জীবনধারণের জন্য বৃত্তি প্রসঙ্গে আকাশবৃত্তি, খেচর বা পক্ষীবৃত্তি এবং অজগর বৃত্তির কথা বলা হয়েছে পুরাণে। আকাশবৃত্তি হল পরমাত্মার উপর নির্ভর করে থাকবে। কারও কাছে কিছু চাইবে না। যদি কিছু জোটে তবে সন্তুষ্ট চিত্তে প্রথমে পরমাত্মাকে নিবেদন করে পরে নিজে তা গ্রহণ করবে। কিছু না জুটলে অনাহারেই থাকবে।
খেচরবৃত্তিতে ভিক্ষা করা চলবে তবে সঞ্চয়ের কোনও স্থান নেই। পাখিদের যেমন কোনও সঞ্চয় থাকে না তেমন সাধুসন্ন্যাসীদেরও থাকবে না। ভিক্ষা লব্ধ অন্নের উদরপূর্তিটুকু ছাড়া অতিরিক্ত যা, তা বর্জনীয়, পরিত্যাজ্য। আগামিকাল বা আজ বিকালে কি খাবে তা পরমাত্মার ইচ্ছার উপরেই নির্ভর করবে। অজগরবৃত্তি প্রধানত কঠোরতপা সাধুসন্ন্যাসীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অজগর যেমন মুখের কাছে আসা খাদ্য গ্রহণ করে এবং একবার গ্রহণের পর দীর্ঘদিন আহার করে না, তেমন জীবনধারণের বৃত্তিই হল সাধুসন্ন্যাসীদের অজগর বৃত্তি।
কৌতূহলের শেষ নেই আমার। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আকাশবৃত্তিতে এমন কোনও দিন গেছে যেদিন কোনও আহারই জোটেনি আপনার?
ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে উত্তর দিলেন বেশ প্রীতির সঙ্গে,
– বেটা, পরমাত্মার ইচ্ছায় প্রতিদিন আমার কিছু না কিছু আহার জুটেই যায়। অনাহারে থাকিনি কখনও। তবে এমন হয়েছে, সারাদিন কিছু জোটেনি কিন্তু সন্ধ্যা বা রাত্রে কিছু আহার এসে গেছে, কেউ না কেউ দিয়ে গেছে।
কথাটা শুনে মনটা আনন্দে ভরে গেল। আমার বিশ্বাসের মূল আরও দৃঢ় হল। বিশ্বজননীর এমনি করুণা, এমনই তাঁর মহিমা যে তাঁর সন্তানকে কখনওই অভুক্ত রাখেন না। একথা ধনী নির্ধন জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই সত্য। এবার পা দুটো ধরে সেই একই প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, দয়া করে বলুন না, কেন ঘর ছাড়লেন আপনি?
সাধুবাবার মুখের ভাবটা এবার একেবারে মলিন হয়ে গেল। আনন্দের ভাবটাও যেন কোথায় গেল মিলিয়ে। বেশ কয়েক মিনিট তাকিয়ে রইলেন মন্দাকিনীর বয়ে যাওয়া তীব্র স্রোতের দিকে। পরে একটু উদাস ভাবেই বললেন,
– তোর কি লাভ হবে আমার জীবন কথা জেনে?
পা থেকে হাতদুটো সরিয়ে নিয়ে বললাম,
– বাবা, ক্ষতি তো হবে না কিছু।
আর কথা না বাড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
– বেটা, একটা দুঃখময় অধ্যায় আছে আমার জীবনে। আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি সে কথা। আমার সাধু জীবনে তুই-ই প্রথম যাকে বলছি। পারিবারিক অবস্থা আমাদের অত্যন্ত ভালো ছিল। বাবা ও ভাই বোনেরা সকলে প্রতিষ্ঠিত। ভাইদের মধ্যে আমি মেজ। নিজেও ভাল চাকরি করতাম। সকলকে নিয়ে সুখের সংসার জীবন ছিল আমাদের।
কোনওদিকেই মন নেই আমার। চুপ করে বসে আছি। সাধুবাবা স্মৃতিচারণ করে বলে যেতে লাগলেন তাঁর ফেলে আসা জীবনকথা।
– ছোটবেলা থেকেই একটা মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম ছিল। আন্তরিকভাবে ভালবাসতাম তাকে। বয়স তখন আমার একুশ হবে। বাড়ির সকলের মতে একদিন বিয়ে হল আমার সঙ্গে যাকে ভালবাসতাম। বেশ ধূমধাম করেই হল। স্ত্রী আমার অত্যন্ত সুন্দরী ছিল।
এই পর্যন্ত বলে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। চোখমুখের ভাবটা দেখে মনে হল, অতীতের ছবি যেন তাঁর চোখে ভাসছে। আমি নীরব রইলাম। সাধুবাবা একমনে বলে চললেন,
– বিয়ের পর দিনগুলো বেশ আনন্দেই কাটতে লাগল। কিছুদিন পর স্ত্রীর গর্ভে সন্তানও এল। বাড়ির মেয়েরা বলত ছেলে হবে। প্রাণে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। মুখে কাউকে কিছু বলতাম না। এগিয়ে এল প্রসবের দিন। তখনকার দিনে এত ডাক্তার কবিরাজ ছিল না। বাড়িতে প্রসব হবে। স্ত্রীর প্রসব যন্ত্রণা শুরু হতেই ডাকা হল বুড়ি দাইকে। সন্তান প্রসব করানোর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুবই পারদর্শিনী। স্ত্রী একটা আলাদা ঘরে আর বাড়ির সবাই উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছি বাইরে।
লক্ষ্য করলাম, সাধুবাবার চোখ দুটো ছলছল করছে। উদাসীনতায় মুখখানা ভরে উঠেছে আরও। কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে বললেন,
– এইভাবে কেটে গেল ঘণ্টা খানেক। তারপর বেটা সমস্ত উৎকণ্ঠার অবসান ঘটল আমাদের। স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গেল চিরকালের মতো। ছেলে হয়েছিল তবে জন্মের কয়েক ঘণ্টা পর সেও চলে গেল। সংসার জীবন আমার মাত্র দেড় বছরের। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে শুকিয়ে মরু হয়ে গেল আমার সুখের স্রোতবতী সংসার নদী।
এ কথা শোনার পর মনটা আমার অনেকটা দমে গেল। ভাবলাম, এই জন্যই হয়তো সাধুবাবা ফিরে যেতে চাইছিলেন না তার অতীত জীবনকাহিনীতে। একটু ভেবে বললাম,
– এর জন্যে সংসার ছাড়লেন কেন, আবার তো বিয়ে করতে পারতেন?
চোখ দুটো মুছতে মুছতে বললেন,
– বেটা, বিধাতার ইচ্ছার বাইরে কি কারও যাওয়ার উপায় আছে, না যেতে পারে কখনও? তখন মানসিক দিক দিয়ে একেবারেই ভেঙ্গে পড়লাম। বাড়ির সকলে আবার বিয়ে করে সংসার করতে বলল। কিছুতেই রাজি হলাম না। এই ঘটনার পর বাড়িতে একা নিঃসঙ্গই বসে থাকতাম। সংসার জীবনে আমার প্রথম শোকের ধাক্কা আমি সামলে উঠতে পারলাম না। স্ত্রীর ব্যবহৃত জিনসগুলো দেখতাম আর যন্ত্রণায় ছটফট করতাম। আমাকে নিয়ে তার সুখে সংসার করার কথাগুলো মনে পড়ত, অঝোরে কাঁদতাম। একদিন মানসিক দিক থেকে আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। সকলের অলক্ষ্যে বেরিয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে।
সাধুবাবার দুচোখ বেয়ে নেমে এল জলধারা। এই মুহুর্তে কোনও কথা বলতে ইচ্ছা হল না। মিনিট কয়েক পর বললাম,
– সেই সময় কি ‘সাধু হব’ এই মানসিকতা নিয়ে বেরিয়েছিলেন?
মাথাটা নেড়ে মুখেও বললেন,
– না না বেটা, ওসব কথা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। ওই জন্যেই তো তোকে প্রথমে বলেছিলাম ‘কিউ ঘর ছোড়া ইয়ে তো পতা নেহি হ্যায়’। তারপর তীর্থ আর পথ, এখানে সেখানে করেই জীবনের এত গুলো বছর আমার কেটে গেল।
সাধুবাবার জীবনে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের কথা ভেবে অবাক হয়ে গেলাম। প্রশ্ন করলাম,
– গৃহত্যাগের পর পুরনো স্মৃতি কি আপনার কখনও মনে পড়ত?
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
– মাঝে মাঝে মনে পরত। তখন অস্থির হয়ে পড়তাম। কোথাও শান্তি পেতাম না। তারপর ভাগ্যক্রমে দীক্ষা হল আমার। ওই সময় গুরুজিকে সব বললাম। শোক নিবারণের জন্য প্রতিদিন আমাকে এক অধ্যায় করে গীতা পাঠ করতে বললেন। তাই করতে শুরু করলাম। অতি অল্প দিনেই আমার শোক সংবরণ হল। তারপর ধীরে ধীরে ও ভাবনা মুছে গেল মন থেকে। এখন আর কোনও কষ্ট হয় না। ভুল করেও মনে পড়ে না। তবে তোর জন্য পুরনো স্মৃতিটা একটু কষ্ট দিল আমাকে।
একথা শেষ হতে জিজ্ঞাসা করলাম,
– গৃহ ত্যাগের পর কখনও বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়নি?
লক্ষ্য করলাম, সাধুবাবার মুখের ভাবে একটু স্বস্তি ফিরে এসেছে। অনেকটা সহজ হয়ে এসেছেন আগের থেকে। বললেন,
– না বেটা, সে ইচ্ছে করেনি আর কোনও আশা নিয়েও আমি ঘর ছাড়িনি।
জানতে চাইলাম আমার মনের শেষ কথাটা,
– এতগুলো বছর তো কেটে গেল আপনার সাধন ভজন আর তীর্থদর্শনে। যাঁর জন্য এসব করা তাঁর দর্শন কি পেলেন?
কথাটা শুনে সাধুবাবার স্বস্তির ভাবটা মুহুর্তে মুছে গেল। মুখখানা যেন আরও মলিন হয়ে উঠল। এরকম প্রশ্নটা করব হয়ত ভাবতেই পারেননি, কারও কাছে শোনেননিও হয়ত। মাথাটা নিচু করে বসে রইলেন মিনিট খানেক। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
– নেহি বেটা, মুঝে ইতনা সৌভাগ প্রাপ্ত নেহি হুয়া। অগর উনকা দর্শন করলেতা তো কয়া ম্যায় উনহে কভি ছোড়তা? ম্যায় তো ব্যস বেটা, ইস হিমালয় মে মূর্তিয়ো কা দর্শন করনে আতা হু। ব্যস, ইতনা হি কহ সকতাহু কি, ইয়ে হিমালয় মনুষ্য কো আপনি ঔর খিঁচতা হ্যায়। একবার আও তো বার বার আনে কা মন হোতা হ্যায়। মুঝে তো বেটা ইস মে ভগবান হ্যায় এয়সা বিশওয়াস হ্যায়। তব বেটা এক বাত হ্যায়। ইস জীবন মে মেরে কো বহুত বহুত আনন্দ মিলা। বেটা, আনন্দ হি ভগবান হ্যায়।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঠান্ডাও পড়েছে অসম্ভব। প্রণাম করলাম সাধুবাবাকে। সকলে গেলাম মন্দিরে। এবার আরতি দেখার অপেক্ষা। রাজবেশ পরানো হল কেদারনাথকে। সাজানো হল সমস্ত দেহ রূপোর অলঙ্কার আর বড়বড় রূপোর সাপ দিয়ে। মন্দিরের হাল্কা আলোয় যে রূপ প্রকাশিত হল কেদারনাথের তা লিখে বোঝানো যাবে না। তবে যারা তারকেশ্বর কিংবা কাশীতে বিশ্বনাথের আরতির সময় রাজবেশ দেখেছেন ঠিক তেমনই। একটুও পার্থক্য নেই কেদারে, কেদারনাথের রাজবেশে। পার্থক্য শুধু সমতলের সঙ্গে হিমালয়ের ধ্যান গম্ভীর ভক্তি মধুর মৌনী পরিবেশের।
সকাল সাড়ে সাতটা। রওনা দিলাম কেদারনাথ থেকে। গৌরীকুণ্ডে এলাম বেলা সাড়ে এগারোটায়। এখানে দুপুরের খাওয়া সেরে ট্যাক্সিতে এলাম শোনপ্রয়াগে। বেলা দেড়টা। এখান থেকে যাব ব্যাসতীর্থ বদরীনারায়ণে।
এখানেই আমাদের ভ্রমণসঙ্গী টুটু আর আশিদার ভ্রমণ শেষ। ওরা ফিরে যাবে লখনউ নিজেদের বাড়িতে। কেদার বদরি ওদের আগেও ঘোরা। আবার এসেছিল। ওরা যে ভ্রমণপিয়াসী, তাই এসেছিল। আবারও আসবে বলেছে।
এমন আনন্দপূর্ণ ভ্রমণের ‘তার’ যেন এখানেই কেটে কেটে গেল। যেন বলব না। একেবারে কেটেই গেল। শুধু আমার মন নয়, সঙ্গীদেরও। পথের সাময়িক পরিচয় মানুষকে দারুণভাবে বেঁধে ফেলে মায়ার বাঁধনে। বেঁধে ফেলেছিল আমাদেরও। বিশেষ করে এ বাঁধন দৃঢ় হয় তখনই, যদি প্রবাসীদের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে জাতিধর্মনির্বিশেষে মায়া জড়িয়ে পড়বেই, অবশ্য মন বলে যদি কোনও পদার্থ থাকে।
আমরা অনন্তকালের – অনন্ত পথের যাত্রী। পরম পদচ্যুত ভ্রান্ত পথিক। যতদিন পর্যন্ত না সেখানে ফিরে যাব, ততদিন পর্যন্ত চলতে আমাদেরই হবেই। পথে ক্ষণকালের জন্য চটিতে বিশ্রাম, আবার চলা।
কারও মুখে কোনও কথা নেই। একে অপরের মুখে চাওয়া চাওয়ি করছি আর ভাবছি, রক্তের সম্পর্কে ওরা আমার কেউই নয়, পথেই পরিচয় ঘনিষ্ঠতা। এই মুহুর্তে ছাড়াছাড়ির পালা। আমার লেখায় ওরা অনেক সাহায্য করেছিল। অপূর্ব ওদের উদার আচরণ, সুন্দর মানসিকতা। আমাদের বাস ছাড়ার সময় শুধু মনে হয়েছিল, খুব আপনজনকে যেন হারালাম, নিরপরাধ কাউকে সারাজীবনের জন্য হিমালয় গহনে দিয়ে গেলাম নির্বাসন।
মহাকালের স্রোতে আমরা প্রত্যেকেই ভেসে চলেছি। কবে – কোথায় – কোন কূলে গিয়ে ঠেকবো তা বলতে পারিনে। আর কখনও দেখা হবে না হয়ত – হতেও পারে। সবই কালের নিয়ন্ত্রণাধীন। শুধু স্মৃতি মনের মণিকোঠায় ভরে সময়ের অপেক্ষায় দিন গোনা।