শরীর সুস্থ রাখার ও মন আনন্দময় করার উপায় জানালেন তন্ত্রসাধক
ভগবানকে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখিনি। তবে এই ছুটোছুটিরও একটা ফল আছে। মনকে করে তোলে পবিত্র নির্মল উদার ও আনন্দময়।
বদ্রীনারায়ণ মন্দির। এদিক ওদিক ঘুরছি সাধুসঙ্গ জন্য। সাধু আছে অনেক, তবে কথা হচ্ছে না। একটু বয়স্ক সাধুর খোঁজ করছি। এঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। এঁরা জীবনে অনেক পথ চলেছেন। দেখেছেনও অনেক। আমি বয়স্ক সাধুদের সঙ্গই করেছি বেশি।
এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে গেলাম অলকানন্দার ওপারে। মন্দির ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে। দেখলাম একজন সাধুবাবা বসে আছেন একটা বড় পাথরের চাঁই-এর উপরে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন অলকানন্দার দিকে। মনটা কোথায় আছে সাধুবাবার, জানি না। পরনে এবার আর আগের মতো সাদা বা গেরুয়াধারী নয়। লাল রক্তবস্ত্র। তবে টকটকে লাল নয়। অনেকবার কাচাকাচির পর গাঢ় লাল যেমন হয় তেমনই। ফ্যাকাসে লালও বলা চলে। মাতৃ উপাসক তন্ত্র সাধক বলে মনে হল। অপূর্ব লাবণ্য ও দীপ্তিময় চেহারা। তাতে বেশ আকর্ষণ আছে একটা। চোখ দুটো ফালা ফালা, টানা। রঙ শ্যামবর্ণ হলেও দারুণ উজ্জ্বল। গায়ের চামড়া একটু ঢিলে গোছের। মাথার জটা কোমর ছাড়িয়ে। গলায় রুদ্রাক্ষ, হাতেও। পাকা দাড়ি তবে ঘন নয়।
সাধুবাবার আকর্ষণে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছি সাধুবাবার পাশে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
চমকে উঠলাম সাধুবাবার কথায়। বাঙালি। তাহলে কথা বলা যাবে প্রাণভরে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
– কলকাতা।
জিজ্ঞাসা করলেন,
– তীর্থ করতে বেরিয়েছ বুঝি?
মাথাটা নেড়ে বললাম,
– না না, তীর্থ টীর্থ নয়। ভ্রমণ আমার নেশা, ভাল লাগে। প্রতি বছরই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়ি। তাই এবারও বেরিয়েছি।
কথাটুকু বলে আর কোনও প্রশ্ন করতে না দিয়ে বললাম,
– আপনার সমস্ত তীর্থদর্শন হয়েছে নিশ্চয়?
মুখে কোনও উত্তর না দিয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন সাধুবাবা। ইশারায় বসতে বললেন। বসলাম সাধুবাবাকে একটু পাশে রেখে সামনাসামনি। তারপর প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, এখন বয়েস কত হল আপনার?
কথাটা শুনে হেসে ফেললেন। উল্টে জিজ্ঞাসা করলেন,
– তুমিই বল না কত হবে?
হাসতে হাসতে বললাম,
– কি করে বলব কত হবে? আপনিই বলুন না কত হল?
ভুরুটা সামান্য একটু কোঁচকালেন। একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
– কত আর হবে, ৭০/৭২!
– আপনার আস্তানা কোথায়?
মুহুর্ত দেরি না করে উত্তর দিলেন,
– এখন বদরীনারায়ণে। কালকে কোথায় থাকব তা তো জানিনে!
আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
– তবুও কোথাও থাকার আশ্রয় তো একটা আছে!
নির্লিপ্তভাবে বললেন সাধুবাবা,
– না বাবা, থাকার আশ্রয় কোথাও করিনি, তাতে প্রতিষ্ঠায় মন যায়। ওসব আমার ভাল লাগে না। এই ভাল আছি। যেখানে যাই সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা হয়ে যায়। পনেরো বছর বয়স থেকে জীবনের এতগুলো বছর তো কেটে গেল, অসুবিধে তো হয়নি কোথাও।
সাধুবাবার কথায় গৃহত্যাগের বয়েসটা জানতে পারলাম। এবার জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, গৃহত্যাগ করলেন কেন, কি কারণে?
প্রশ্নে কণ্ঠে ফুটে উঠল একটা অসম্ভব দৃঢ়তার সুর। বললেন,
– সংসার ত্যাগ আমার হবেই, এটাই পূর্বনির্দিষ্ট, তাই হয়েছে। কারণটা কিছু নয় বাবা।
একটা বিড়ি ধরিয়ে দিলাম সাধুবাবার হাতে সম্মতির অপেক্ষা না রেখেই। বললাম,
– আপনার সঙ্গে বসে এখন যে কথা বলছি, এটাও তাহলে পূর্বনির্দিষ্ট?
হাসিমাখা প্রশান্তমুখে বললেন,
– হ্যাঁরে বাবা, তাই-ই। একটা মণির সঙ্গে আর একটা মণি যেমন সুতো দিয়ে গাঁথা হয়, তেমনই বিশ্ববিধাতার সুতোয় তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগটাও গাঁথা ছিল, তাই তো তুমি এলে আমার কাছে।
পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললাম,
– কারণটা কিছু নয় বললেন কিন্তু কারণ ছাড়া তো কোনও কাজ হয় না জানি। বাবা, আপনার ঘর ছাড়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে।
কথাটা শুনে মুচকি হেসে বললেন,
– হ্যাঁরে বাবা। মিথ্যে বলে কি কোনও লাভ হবে? হঠাৎ একদিন মনে হল ঘরে থাকব না। কোথায় থাকব, কোথায় যাব, কি খাব, কিছুই ভাবলাম না। বেরিয়েই পড়লাম।
অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম সাধুবাবার মুখের দিকে। বললাম,
– আপনার মা বাবা ভাই বোন, তাদের কথা একটু ভাবলেন না?
হাসিমুখে বিড়িতে কয়েকটা টান দিয়ে বললেন,
– না বাবা, কিছুই ভাবিনি, একটুও না।
কথাটুকু শেষ হতে বললাম,
– আচ্ছা বাবা, ঠিক যে সময় আপনি ঘর থেকে বেরলেন, ঠিক সেই সময় কি মনে সামান্যতম কষ্ট হয়নি, অন্তত মায়ের জন্য?
এ প্রশ্নে সামান্য ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম সাধুবাবার মুখমণ্ডলে। মুহুর্তে কেটেও গেল সে ভাবটা। বললেন,
– মনে বিন্দুমাত্র কষ্ট হলে কি বেরতে পারতাম!
– পরে কি কখনও মনে পড়ত রক্তের সম্পর্কে আছেন যারা, তাদের কথা?
এবার একটু উদাস ভাবেই বললেন, অলকানন্দার দিকে তাকিয়ে,
– মাঝে মাঝে মনে পড়ত বইকি। তবে মনটাকে সংযত করে নিতাম।
সাধুবাবাকে যা প্রশ্ন করছি, তার উত্তর পেতে বেগ হচ্ছে না বলে মানসিক আনন্দ আমার বেড়ে গেল। ইতিমধ্যে বিড়িটাও নিভে গেছে। আর বিড়ি ধরালাম না। জিজ্ঞাসা করলাম,
– গৃহত্যাগের পর কখনও বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করেনি?
বেশ নিচু স্বরে বললেন,
– না না, তেমন ইচ্ছা করেনি কখনও। তবে মাকে দেখার জন্য মাঝেমধ্যে মনটা আকুল হয়ে উঠত। তারপর আবার সব ঠিক হয়ে যেত।
প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলাম,
– শুনেছি গৃহত্যাগের পর নাকি জন্মভূমি দর্শন হয় সাধুসন্ন্যাসীদের। আপনি কি …।
কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বললেন,
– না বাবা, আমি যাইনি কখনও।
– বাড়ি কোথায় ছিল আপনার?
এখন দেখছি সাধুবাবার ভাবলেশহীন মুখমণ্ডল। কোনও আবিলতা নেই সুন্দর ওই বৃদ্ধ মুখখানায়। চোখ দুটো ঘুরিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
– আমি পূর্ববঙ্গের লোক।…
সাধুবাবার দেশের বাড়ি, গ্রামের কথা শোনার পর জিজ্ঞাসা করলাম,
– আচ্ছা বাবা, কেমন করে চলে আপনার? আপনি কি কোনও প্রকার আয় অর্থোপার্জন কিংবা সাধুজীবনকে ভিত্তি করে কোনও ব্যবসা করেন?
মুখে হাল্কা হাসির প্রলেপ লাগিয়ে বললেন,
– না বাবা, কিছুই করি না আমি, করিনিও কখনও।
এ কথায় কৌতূহল বেড়ে গেল। বললাম,
– তবে খান কি, কোথা থেকে পান, দেয়ই বা কে, দিনের পর দিন কেমন করে চলে আপনার?
প্রশ্নগুলো করলাম এক নিঃশ্বাসে। মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে দেখলেন। কি ভাবলেন বুঝলাম না। দেখলাম একটা নিশ্চিত বিশ্বাস আর নিশ্চিন্তভাবে ফুটে উঠল সারা মুখখানায়। বললেন,
– তা তো বাবা বলতে পারিনে। তবে প্রতিদিনই খাই। দুবেলা পেট ভরেই খাই। মা-ই জোগাড় করে দেন।
কৌতূহল আমার দ্বিগুণ বেড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম,
– গৃহত্যাগের পর কখনও না খেয়ে ছিলেন?
এবার আবেগ ভরা কণ্ঠেই বললেন,
– আজ বহু বছর হল গৃহত্যাগ করেছি। কই, সে রকম তো মনে পড়ে না। তবে মায়ের কৃপাতেই চলছে এ বিশ্বসংসার, আমিও। তাঁর কৃপাতেই জুটে যায়।
অবাক হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। ঋষিদের দেশ বলেই বোধহয় এটা সম্ভব। পাশ্চাত্যের কোনও দেশে এমনটা সম্ভব হয় কিনা জানি না। প্রসঙ্গের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম,
– সারা জীবন তো অসংখ্য তীর্থ পরিক্রমা করলেন। তীর্থ শব্দের প্রকৃত অর্থ কি আপনার জানা আছে, বলবেন দয়া করে?
প্রশ্নটা শুনে সাধুবাবা বেশ খুশি হলেন বলে মনে হল মুখের ভাবটা দেখে। বললেন,
– বাবা, তীর্থ শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে ‘তৃ’ ধাতু থেকে। ‘উত্তীর্ণ হওয়া’, মনের ত্রাণই তীর্থ। পার্থিব জীবনের যা কিছু পাপ মলিনতা কলুষতা, তা থেকে মনকে উত্তীর্ণ করার অর্থই হচ্ছে তীর্থ। তীর্থের ভাগ আছে তিনটে। যে তীর্থে দেহের রোগ দূর হয় অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর জল হাওয়া আর মনোরম স্থানকে বলে ভৌমতীর্থ। তবে মনের ক্লেশ দূর হয় না এই তীর্থে।
একটু চুপ করে রইলেন। আমিও চুপ করে রইলাম পরের কথা শোনার জন্যে। শুরু করলেন,
– আত্মিক উপলব্ধি হয়েছে এমন মহাত্মাকে বলে জঙ্গমতীর্থ। জঙ্গম শব্দে গমনশীল বুঝায়। অর্থাৎ মহাত্মা বা মহাপুরুষের দর্শন কথোপকথন ও সঙ্গলাভের মাধ্যমে মনের মলিনতা থেকে উত্তীর্ণ হওয়াই জঙ্গমতীর্থ। আর বাবা, মন যখন ত্রাণ পায় অর্থাৎ রজো ও তমোগুণকে অতিক্রম করে মন যখন সত্ত্বগুণবিশিষ্ট তখন তাকে মানসতীর্থ বলে। এক কথায় বিশুদ্ধ ও পবিত্র নির্মল মনই হল পরমতীর্থ মানসতীর্থ।
তীর্থ শব্দের প্রকৃত অর্থ শুনে প্রশ্ন এল মনে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আমরা যারা সাধারণভাবে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তীর্থের কথা বলি, তাতে আপনার বলা তীর্থের সঙ্গে তো এর কোনও সম্পর্কই নেই। তাহলে দূর দূরান্তরের তীর্থে যারা যাচ্ছে, তাদের অযথা ছুটোছুটি করে লাভটা কি?
কথাটা শুনে সাধুবাবা বললেন,
– তাতে অনেক লাভ আছে বাবা। কোনও তীর্থেই ভগবানকে পাওয়া যায় না। আমি অন্তত এত বছরের জীবনে কোনও তীর্থে ভগবানকে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখিনি। তবে জানবে বাবা, এই ছুটোছুটিরও একটা ফল আছে। বাহ্যতীর্থ মানুষের মনকে করে তোলে পবিত্র নির্মল উদার ও আনন্দময়। এই আনন্দই ভগবানের সান্নিধ্যলাভের সবটা নয়, তবে বড় একটা সোপান। তীর্থ মানুষকে ভগবানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তীর্থ কখনও দর্শন করায় না।
এ কথার উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন করলাম,
– আসলে তীর্থ একটা সোপান মাত্র, মনটাই সব, কি বলেন?
হাসি মুখে বললেন সজোরে ঘাড়টা নেড়ে,
– নিশ্চয়ই এটা কি বাবা বলার অপেক্ষা রাখে!
সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞাসা,
– বাবা, প্রতিটা মানুষের মনের ভাব তো প্রতি মুহুর্তে পরিবর্তন হচ্ছে, মনের পতনও তো হচ্ছে অবিরত। কত নোংরা চিন্তা…
আমার কথা শেষ হতে দিলেন না সাধুবাবা,
– এর জন্যই তো নিজেকে সঁপে দিয়ে সাধন ভজন করতে হয়। তারপর সব আপসে হয়ে যায়। খাটতে হয় না। এটাই সৃষ্টির নিয়ম। এ নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম নেই, হয় না, হবেও না। তবে বলা যতটা সহজ, কাজটা ততটা সহজ নয়। লেগে থাকতে হবে। হচ্ছে না বলে ছেড়ে দিলে হবে না। সবই হয়, তবে ধৈর্য নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় সাপেক্ষ।