Mythology

নারীসঙ্গের তাড়নায় সংযম ভাঙল তন্ত্রসাধকের, অবিস্মরণীয় এক ঘটনা

বেশ কিছুদিন ধরে মনে হতে লাগল জীবনে তো কখনও নারীসঙ্গ করিনি, নারীসঙ্গের স্বাদও পাইনি। ভাবলাম, যাই না একবার, দেখি ওর ভিতরে কি আছে।

এই পর্যন্ত বলে চুপ করলেন। মুখের ভাবের পরিবর্তন ঘটল এবার। দেখে মনে হল, কি যেন একটা চিন্তা করছেন। কথা বলে আর চিন্তায় ছেদ টানলাম না। নিজের থেকেই বললেন,

– তবে একটা কথা আছে বাবা, আর যাকে বিশ্বাস করতে হয় কর, মনকে কখনও বিশ্বাস কোরো না, যত সংযমেই থাক না কেন! ওই মনের পতনের কথা বললে, তাই বললাম।


কথাটার মধ্যে কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেলাম। এতটুকু দেরি না করে প্রশ্ন করে বসলাম,

– সারাটা জীবন তো বাবা সাধনভজন আর তীর্থ দর্শন করেই কাটালেন। আপনার কি কখনও মনের পতন ঘটেছে?


অলকানন্দার পাড়ে বসেই আমরা কথা বলছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি এল ঝমঝম করে। পাহাড়ে বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। টুকরো মেঘের বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি থেমে যায়। সাধুবাবা আর আমি পাশে একটা আশ্রমের বারান্দায় এসে বসলাম। দুজনে আধভেজা হয়ে গেছি। একটু শীতশীত করতে লাগল।

কথায় এত মশগুল হয়েছিলাম যে অনেকক্ষণ বিড়ির কথা ভুলেই গেছিলাম। সাধুবাবাকে একটা দিয়ে নিজেও ধরালাম একটা। তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কথা শোনার জন্যে। বিড়িতে বেশ লম্বা করে একটা টান দিয়ে বললেন,

– আমি বাবা মিথ্যে কথা বলিনে। এই জীবনে এসে মিথ্যে বলব কেন! মনের একবার পতন হয়েছিল, কি রকম হয়েছিল বলি।

কোনও কথা বললাম না। একইভাবে চেয়ে রইলাম মুখের দিকে। সাধুবাবার ভাবান্তর কিছু হল না। বললেন,

– আমার বয়েস যখন ৫০/৫৫ তখনকার কথা। সে সময় বেশ কিছুদিন ধরে মনে হতে লাগল জীবনে তো কখনও নারীসঙ্গ করিনি, নারীসঙ্গের স্বাদও পাইনি। তাই ভাবলাম, যাই না একবার, দেখি ওর ভিতরে কি আছে! আবার ভাবছি নাহ, সাধুজীবনে এসব কথা ভাবাই পাপ। এতদিনের সংযম তপস্যা আমার সব নিষ্ফল হয়ে যাবে। একবার ভাবছি যাই, আবার ভাবছি – না, একাজ আমাকে শোভা পায় না। তাহলে আর এ পথে এলাম কেন, গৃহী হতে দোষ ছিল কোথায়? কেউ তো আমাকে বাধা দেয়নি।

এই সব ভাবনা আমাকে বিষমভাবে অস্থির করে তুলল দিনের পর দিন। একদিকে সাধনা আর একদিকে অনাস্বাদিত নারীসঙ্গ আমাকে দোটানায় ফেলল।

সাধুবাবা আধবোজা চোখে অতীত স্মৃতি মন্থন করে বলে চললেন,

– যাব কি যাব না, এই রকম ভাবতে ভাবতে বাবা একদিন সত্যিই চলে গেলাম। যখন বেশ্যাবাড়ি ঢুকতে যাব তখন মনে হল, এটা ঠিক কাজ হচ্ছে না। আবার ভাবলাম, ধুর যাই না, দেখি না কি আছে? দোটানা মন নিয়ে বাবা একেবারে ঢুকেই পড়লাম।

কোনও প্রশ্ন করলাম না। একই সুরে বললেন,

– ওখানে ঢোকামাত্রই বাড়িময় একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। এ ঘর ও ঘর থেকে মেয়েরা সব ছুটে এল। প্রথমে আমি কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম। ওদের ভিতর থেকে একটা মেয়ে এগিয়ে এসে আমাকে তার ঘরে নিয়ে বসাল। প্রণাম করল। আমি খুব অস্বস্তি বোধ করতে থাকলাম। এরপর মেয়েটি কিছু মিষ্টি আর জল এনে দিল আমাকে।

খাব কি আমি – ভাবছি, কি জন্যে এলাম, কেন এলাম এখানে? সাধু হয়ে মনের এ কি পতন ঘটল আমার! এসব ভেবে একেবারে অস্থির হয়ে উঠলাম। মেয়েটি আমাকে মিষ্টি খেতে বলল। আমি অন্যমনস্কভাবে খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষ হতে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল,

– সাধুবাবা, এত রাতে এখানে এসেছেন কেন?

চুপ করে রইলেন, মুখখানা দেখলাম অন্ধকার হয়ে গেছে। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– আপনি কি বললেন বাবা?

মিনিটখানেক চুপ করে থাকার পর বললেন,

– মুখ থেকে আমার একটা কথাও বেরল না। মাথা নিচু করে বসে রইলাম। আমার উদ্দেশ্যের কথা কিছু বলতে পারলাম না। তখন মনে হতে লাগল, এখানে না এলেই ভাল করতাম। খুব ভুল হয়ে গেছে। এ রকম সাত-পাঁচ ভাবছি। মেয়েটি মনের কথা বুঝতে পেরেই হয়ত বলেছিল,

– ‘সাধুবাবা, এ পথ তো আপনার নয়, কেন এলেন এখানে?’

আমি নির্বাক। বসেই আছি। না পারছি কিছু বলতে, না পারছি উঠে চলে যেতে। এই ভাবে কাটল কিছুটা সময়। হঠাৎ দেখি দুজন পুলিশ এসে হাজির। ভয় পেয়ে গেলাম। ওদেরই কেউ হয়ত খবর দিয়েছিল।

এবার সাধুবাবার মুখখানা যেন আরও মলিন হয়ে উঠল। কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে পরে বললেন,

– ওরা আমাকে সোজা নিয়ে গেল থানায়। অফিসারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কেন গেছিলাম ওখানে? আমি বাবা মনের সব কথাই খুলে বললাম ওনাকে। একটা কথাও মিথ্যে বলিনি। শুনে অফিসারবাবু তো অবাক! আমাকে কিছু বললেন না। ছেড়ে দিলেন। থানা থেকে বেড়িয়ে এলাম রাস্তায়। রাত তখন অনেক।

কথাগুলো শুনে আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। সাধুবাবা কপালে হাতদুটো ঠেকিয়ে নমস্কার করে বললেন,

– মায়ের ইচ্ছা নেই বাবা, তাই তিনিই আমাকে রক্ষা করলেন। নইলে এত বছরের সংযমতার জীবন আমার একদিনেই শেষ হয়ে যেত। তাঁর করুণাতেই বাবা ব্রহ্মচর্যব্রত রক্ষা পেল।

সাধুবাবার জীবনের এই ঘটনা শুনে ভাবলাম, সংযমী জীবনে মনের যদি এমন হতে পারে, তাহলে আমরা যারা গৃহীজীবনে আছি, প্রতিনিয়ত মনের ভাবগতি বিভিন্নমুখী হয়ে আরও কত কোন নরকে পতন হচ্ছে বা হবে, তা ভেবে একেবারে শিউড়ে উঠলাম।

সাধুবাবা আর আমি গুম হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। এর মধ্যে বৃষ্টিও থেমে গেছে, আবার বিড়ি ধরালাম দুটো। সাধুবাবার হাতে একটা দিয়ে বললাম,

– আমরা যারা আপনাদের মতো যাদের দেখি, তাদের সাধু বলেই জানি ভাবি এবং শ্রদ্ধা করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাধু কে, সাধু কাকে বলে?

মুখের সেই মলিন ভাবটা কেটে গেছে। প্রশ্নটা শুনে বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেন,

– বাবা, আমাদের মতো যাদের, আমার মতো যাদের তোমরা দেখ, তারা কেউই বলতে পার সাধু নয়। বলতে পার গৃহীজীবন থেকে এটা একটা আলাদা জীবন, তবে ‘সাধু’–এ জীবন নয়।

কথাটা শুনতে কেমন যেন লাগল! কথার অন্তর্নিহিত ভাবটা ধরতে না পেরে বললাম,

– তার মানে?

– মানেটা অতি সহজ বাবা। সাধু হওয়া কি মুখের কথা! ‘যিনি সদাসত্য কথা বলেন, কৃপালু কারও অনিষ্ট চিন্তা করেন না, সকল দোষ হতে মুক্ত, সকলের প্রতি ক্ষমাশীল, যথাশক্তি সকলের উপকার করেন, যিনি সুখে দুঃখে সমবুদ্ধি তিনিই সাধু। যথার্থ সাধু যারা, তারা মানুষ পশু পাখি কীট পতঙ্গ, বৃক্ষলতা সকলেরই শিষ্যত্ব স্বীকার করেন। আর সদা সকল শাস্ত্রের প্রতিই শ্রদ্ধাবান।’

ঠান্ডায় বিড়ির আগুনটা নিভে গেছে। পোড়া দিকটা আশ্রমের মেঝেতে ঘষতে ঘষতে বললেন,

– এবার ভাব প্রকৃত সাধু কে? সাধু যাঁরা তাঁরা ধৈর্যশীল, গম্ভীরাত্মা ও অপ্রমত্ত হন। ক্ষুধা তৃষ্ণা শোক মোহ জরা ও মৃত্যু তাঁর বশীভূত। তিনি অমানী অথচ অপরকে সম্মান দান করেন। তিনি করুণ হৃদয়, দয়ালু ও জ্ঞানবান। সকলের প্রতিই মৈত্রীভাবাপন্ন। এবার বল, যাদের তোমরা দেখ তাদের মধ্যে এসব গুণগুলোর কতটুকুই বা আছে! তাই বললাম, এটা একটা আলাদা জীবন, তবে সাধুজীবন নয়।

সাধুর প্রকৃত সংজ্ঞা জানতে পারলাম সাধুবাবারই মুখে। প্রশ্ন এল মনে। বলে ফেললাম,

– আচ্ছা বাবা, ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতে লিঙ্গপুরাণ তো সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। সেখানে বলা হয়েছে, কলিযুগে নতুন নতুন সাধুসন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হবে। এরা গৃহীদের বিভ্রান্ত ও বিপথে পরিচালিত করবে। আরও মজার কথা হল, এইসব সাধুসন্ন্যাসীরা হবে প্রবল ধনশালী আর শিষ্যরা হবে দারিদ্র ক্লিষ্ট। এ কথার সত্যতা সম্পর্কে আপনার মত কি?

কথাটা শুনলেন মন দিয়ে। বেশ বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন,

– দেখ বাবা, লিঙ্গপুরাণের সঙ্গে আমার মতের কোনও পার্থক্য নেই। পুরাণ তো ঠিকই বলেছে। যার সত্যতা তো সমাজের বুকে দেখতেই পাচ্ছ। বড় বড় মঠ মন্দির আর আশ্রম করে একশ্রেণির সাধুসন্ন্যাসীরা বসে আছে টাকার উপরে আর দরিদ্র গৃহীরা লাইন দিয়ে নিচ্ছে দীক্ষা। প্রকৃত সাধুসন্ন্যাসীদের কোনও প্রতিষ্ঠা থাকবে না। জীবিকা নির্বাহের পথ হবে ভিক্ষা, আকাশবৃত্তি। আজকাল সাধুদের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেও কি তুমি লিঙ্গপুরাণকে অস্বীকার করতে পার?

কথাগুলো শুনলাম সম্মোহিতের মতো। আর মনে মনে হরিদ্বারের প্ল্যাটফর্মের সেই সাধুবাবার কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানালাম, ‘বেটা, আজকাল তো সাধুয়োঁ মে ভি পরিবর্তন আ গয়া হ্যায়। সাধু লোগ তো কুত্তে কি তরহা হো গয়ে হ্যায়।… সাধুলোগ গাঁও মে পরিবার রখকে আতে হ্যায় অউর সাধুকা ভেক পকড় কর রূপেয়া কমাতে হ্যায় অউর ফির ঘর ভেজতে হ্যায়।… খুদ আপনে আঁখো সে দেখো কি বাতানুকুল কমরে মে সাধুমহারাজ আরাম সে বয়ঠে হুয়ে মৌজ মস্তি কর রহে হ্যায়। ক্যা তুম উসকো আপনে আত্মাসে সাধু কহোগে ইয়া ভোগী?’

অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথাই হল। আকাশও বেশ পরিস্কার হয়ে গেছে। বেলাও বেড়েছে অনেক। এবার উঠতে হবে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম,

– একটা কথা বলব বাবা?

প্রসন্ন মনেই বললেন, যেমনটা দেখেছিলাম একেবারে প্রথমে,

– বল না।

কোনওরকম ভণিতা না করে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,

– প্রকৃত সত্য কথা বলতে পারেন, ঈশ্বর কে, কোথায় আছেন বা কোথায় থাকেন?

কথাটা শুনে সাধুবাবা বেশ কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। পরে মিষ্টি হাসি হেসে পিঠ চাপড়ে বললেন,

– বাবা, পৃথিবীর কোনও মানুষ কোনও দিনও বলে দিতে পারবে না ঈশ্বর কে, কোথায় আছেন বা কোথায় থাকেন? যখন সময় হবে তখন আপনিই বুঝে যাবে, তিনি কে, কোথায় আছেন বা কোথায় থাকেন?

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button