সংসারে থেকেও কী করে সাধুদের মত ক্ষমতাশালী হওয়া সম্ভব
এই বলে সাধুসন্ন্যাসীরা এগিয়ে চলে নির্লিপ্ত মহাজীবনের পথে। তাদের পক্ষে অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটানোও অসম্ভব হয় না।
প্রকৃত সাধুসন্ন্যাসীদের মানসিক বিবর্তন ও পরিস্থিতি কেমন করে হয় এবং কি ভাবে হয়, এবার আসি সে প্রসঙ্গে। আমাদের জীবনে প্রতিটি মুহুর্তে ঘটে যাওয়া ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতি ঘটনার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ুকোষের মধ্যেই ঘটে। অর্থাৎ যেকোনও ঘটনাকে মস্তিষ্কের কোষগুলি গ্রহণ করে। তারপর সম্মিলিতভাবে ওই ঘটনা সম্পর্কিত চিন্তা করে এবং একমুখী করে সঠিক সিদ্ধান্তের পথে।
মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্র দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, অপরটি স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রগুলি মানুষের ইচ্ছাধীন। যেমন মশা কামড়ালে আমরা তাকে হাত দিয়ে আঘাত করি। আর স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রগুলি মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। যেমন হৃদযন্ত্রের স্পন্দন মিনিটে বাহাত্তর বার।
প্রকৃত সাধুসন্ন্যাসীরা অনেকক্ষেত্রে উক্ত দুটি স্নায়ুতন্ত্রকেই সাধনবলে নিয়ন্ত্রিত করে নিজের ইচ্ছাধীনে। এই স্নায়ুতন্ত্রকে যে যত বেশি ইচ্ছাধীন করতে পারে, সে তত বেশি উচ্চমার্গের বলে পরিগণিত হয়। যেমন অনেক সাধুসন্ন্যাসী দীর্ঘদিন না খেয়ে অথবা না ঘুমিয়ে থাকতে পারেন। বাহ্যদৃষ্টিতে এসব ঘটনার প্রকৃত কারণ ও ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু স্নায়ুতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এসব ঘটনা ঘটানো সহজ, সম্ভব।
যোগসাধনার মাধ্যমে সাধুসন্ন্যাসীরা তাঁদের আত্মিক উন্নতি ঘটিয়ে থাকেন। এটা জপের মাধ্যমেও হতে পারে। প্রশ্ন হল, যোগসাধন পদ্ধতিটা কি?
এই পদ্ধতি এমন কতগুলি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রকে এমন একটি আয়ত্তাধীন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যখন সমস্ত স্নায়ুতন্ত্র একসঙ্গে একই রকম কাজ করে। ফলে মানসিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ভুক্ত হয়, যখন তাদের মনের Positive এবং Negative Force বলে আর কিছু থাকে না। সমস্ত কিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
এইভাবেও বলা যায়, মনে যা কিছু সংকল্প আধ্যাত্মিক আধিভৌতিক আধিদৈবিক ত্রিতাপ কাম ক্রোধ লোভ বন্ধন মহারিপু মহাবন্ধন মহাদুঃখ, বিশ্বের সমস্ত দোষ, সমস্ত জগৎ, সংসার জ্বরাদি কাল মল জীব চিত্ত অহঙ্কার রূপ রস গন্ধ শব্দ স্পর্শ শীত উষ্ণ সুখ দুঃখ জয় পরাজয় আলো অন্ধকার জ্ঞান অজ্ঞান – এক কথায় এ বিশ্বের, এ সৃষ্টির যা কিছু তা সবই হয়ে যায় একাকার।
পরিণতিতে তখন সৃষ্টি হয় একমুখী ‘বল’ (Force) । মস্তিষ্কের মধ্যে স্নায়ুকোষগুলি যদি এইভাবে একমুখী ‘বল’ – এ পরিণত হয়, তাহলে ওই স্নায়ুকোষ গুলির উপর কোনও শুভ বা অশুভ ঘটনারই ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া ঘটে না। এইভাবে স্নায়ুতন্ত্রকে নিজের আয়ত্তে আনতে পারে যেসব সাধুসন্ন্যাসী, তাদের পক্ষে অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটানোও অসম্ভব হয় না। একইসঙ্গে এই সাধনবলে মানসিক বিবর্তনে সাধুসন্ন্যাসীরা এগিয়ে চলে নির্লিপ্ত মহাজীবনের পথে, পরমাত্মার সন্ধানে।
আবার এইভাবেও বলা চলে, সাধনার মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণের ফলে সাধুসন্ন্যাসীদের মনে ওই একমুখী ‘বল’ এমন এক ভাব আর তত বেশি আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করে যে, তখন তাদের মনে অনুক্ষণ চলতে থাকে ওই ক্ষমতাকে ধরে রাখার নিরন্তর প্রয়াস।
তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে স্নায়ুকোষগুলিকে সাধনার মাধ্যমে এমন একটি সংরক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যখন এবং যার ফলে সাধারণ মানুষের মতো রোগ শোক হাসি কান্না দুঃখ বেদনা ইত্যাদি কোনও রকম প্রতিক্রিয়া করতে পারে না সাধুসন্ন্যাসীদের মনের উপর। এমনকি জাগতিক কামনাবাসনা ও চাহিদাগুলির ‘বল’ ও এসব ক্ষেত্রে তাদের দীর্ঘদিনের অর্জিত স্নায়ুকোষের সংরক্ষিত একমুখী বলের কাছে পরাজিত হয়। যার জন্য প্রকৃত সাধুসন্ন্যাসীদের জীবনে আসে নির্লিপ্ত উদাসীনতা, আত্ম ও স্বার্থত্যাগ। উঠে যায় সর্ববোধ ও বন্ধনের উর্ধ্বে।