Mythology

নারীর সংস্পর্শে সাধুদের মনে কী ধরনের চিন্তা ও কামনার উদ্ভব হয়

সাধুসঙ্গের সময় নেহাতই কৌতূহলবশত জেনেছি সাধুসন্ন্যাসীদের কথা। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সঙ্গ করেই জেনেছি তাঁদের মনের গোপন কথা।

ভ্রমণকালে সাধুসঙ্গের সময় নেহাতই কৌতূহলবশত জেনেছি সাধুসন্ন্যাসীদের যৌন চিন্তাভাবনার কথা। এ বিষয়ে সহজে মুখ খুলতে চাননি কেউই। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সঙ্গ করেই জেনেছি তাঁদের মনের গোপন কথা। সাধুসঙ্গের সময় যৌন চিন্তাভাবনা বিষয়ক একই প্রশ্ন করেছি শতশত সাধুসন্ন্যাসীকে। যেখানে সাধুবাবার সঙ্গে এসব কথা হয়েছে, প্রায় সবক্ষেত্রে সব সাধুদের সঙ্গে কথা হয়ে মূল উত্তর পেয়েছি সব একই। তফাৎ হয়েছে শুধু ভাব আর ভাষায়।

অষ্টভুজা পাহাড়। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হয় মন্দিরে। ডানদিকটায় বেশ জঙ্গল। যাত্রী সংখ্যা খুবই কম। সিঁড়ির শেষ ধাপের কয়েকটা ধাপ নিচে বসে আছেন এক সাধুবাবা। ফরসা নয় তবে কালোও বলা যাবে না। মাথায় জটা নেই। দীর্ঘকাল না আঁচড়ানো চুলের দশা যেমন হয় তেমনই। চুলের রঙ কালো নয়, খয়েরি বা লালচে ভাব। গলায় হাতে রুদ্রাক্ষ বা তুলসীমালা নেই। একটা স্ফটিকের মালা রয়েছে গলায়। পরনে গেরুয়া বসন। তাতে একটু লালচে ভাব আছে। দোহারা চেহারা বেশ শক্ত সমর্থ। মুখসৌন্দর্যে বেশ আকর্ষণ আছে একটা। আমার ধারণায় বয়েস পঞ্চাশের বেশি হবে না। পাশে একটা ঝোলা, অন্য সব সাধুদের যেমন থাকে। কমণ্ডলু আর চিমটেও দেখলাম। চালভর্তি কমণ্ডলুর উপর দেখি গাঁজার কল্কে একটা।


সাধুবাবা যে সিঁড়িতে বসে আছেন তার পরের ধাপে বসলাম আমি। প্রণাম করে পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে হাতে দিলাম। কোনও কথা না বলেই নিলেন হাসিমুখে। দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে দিলাম। নিজেও ধরালাম একটা। প্রথম কথা শুরু করলেন সাধুবাবাই,

– কোথায় থাকিস বেটা?


মুখে একটু হাসির প্রলেপ লাগিয়ে বললাম,

– বাড়ি আমার কলকাতায়। বেনারসে এসেছি। ওখান থেকে বিন্ধ্যাচল দেখে তারপর এলাম এখানে।

বিড়িতে টান দিয়ে বললেন,

– চাকরি করিস না ব্যবসা?

আমার কাজের কথা বলতেই খুব হাসলেন। আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রশ্ন করলাম,

– বাবা, আপনি কি এখানেই থাকেন না অন্য কোথায় ডেরা আছে আপনার।

বিড়িটা নিভে গেল। ভারতীয় বিড়ির দোষ এটাই, বারবার না টানলে নিভে যাবে। তাই আবার ধরিয়ে দিলাম। দু-তিনটে টান দিয়ে বললেন,

– না বেটা, আমার কোথাও ডেরা নেই। এই জায়গাটা একটু নির্জন তাই এখানে আছি কিছুদিন। বেশি দিন আর থাকব না। যাব একটু নর্মদায়।

কথা শেষ হতে জানতে চাইলাম,

– বাড়ি কোথায় ছিল আপনার?

এতক্ষণ বসেছিলেন উবু হয়ে। আবার বাবু হয়ে বসে হাঁটুর উপর হাতটা রেখে বললেন,

– নাসিকে।

চটপট উত্তর দিচ্ছেন দেখে মনে খুব আনন্দ হল আমার। দেখছি মন্দিরের যাত্রীদের অধিকাংশই হিন্দিভাষী। আছে সব বয়েসের। কেউ কেউ দু–চারটে পয়সাও ছুঁড়ে দিচ্ছে সাধুবাবাকে লক্ষ্য করে। প্রশ্ন করলাম,

– বাবা, আপনার ঘর ভালো লাগত না বলেই কি ঘর ছেড়েছেন?

এ কথায় মুখখানা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। গম্ভীর সুরেই বললেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে,

– কেন, তোর কি দরকার?

কৃত্রিম হাসি মুখে রেখে বললাম,

– এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম, এটা আমার কৌতূহল।

একটু বিরক্তির সুরে বললেন,

– কৌতূহল ভাল, তবে সাধুদের এসব কথা জিজ্ঞাসা করা ভাল না। এতে সাধুমনের শান্তি নষ্ট হয়, চাঞ্চল্য বাড়ে।

কোনও উত্তর দিলাম না। নিজের বোকামিটা বুঝে গেলাম। একলাফে লঙ্কা পার হওয়ার চেষ্টা বৃথা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন,

– গাঁজা খাস?

হেসে উত্তর দিলাম,

– না বাবা, আমার ওসবে অভ্যাস নেই তবে আপনার কথা রক্ষার্থে এক আধ টান দিতে পারি।

সাধুবাবাকে খুশি করে তাঁর জীবন সম্পর্কে জানার জন্যই বললাম কথাটা। আর কোনও কথা বললেন না। গাঁজা বের করলেন ঝোলা থেকে। সাজালেন বেশ সুন্দর পরিপাটি করে।

মুখে কল্কে ধরতেই আগুন ধরিয়ে দিলাম আমি। দেখে মনে হল সাধুবাবা বেশ খুশি হলেন। প্রথম কয়েকটা টান দিলেন ফুকফুক করে। তারপর একটা টান দিলেন বেশ লম্বা করে। হু হু করে ছাড়লেন ধোঁয়া।

এবার ছিলিমটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। এ অভ্যাস আমার নেই, তবে কখনও কখনও সাধুসঙ্গে খেতে হয়েছে জানার খাতিরে। নইলে সাধুদের অনেকেই মুখ খুলতে চান না। তাই ছিলিমটা নিয়ে হালকা একটা টান দিয়ে এগিয়ে দিলাম সাধুবাবার দিকে। ছিলিমটা ধরতে বললাম,

– বাবা…

ইশারায় হাত দিয়ে বাধা দিলেন কথায়। তারপর কেটে গেল মিনিটখানেক। একটু আমেজ আসার পর বললেন,

– আমাকে এসব কথা কেউ জিজ্ঞাসা করেনি কখনও। জীবন এসব কথা বলিনিও কাউকে। তোর উপর আমি প্রসন্ন হয়েছি। যা কিছু জিজ্ঞাসা আছে কর, উত্তর দেব।

বুঝলাম কৌশলটা বেশ কাজে লেগেছে। জানা যাবে অনেক কথা। তবুও চুপ করে বসে রইলাম আমি। আগের প্রশ্নের উত্তরে শুরু করলেন সাধুবাবা,

– পারিবারিক অবস্থা আমাদের খুব খারাপ ছিল। এক একদিন খাওয়াই জুটতো না। অনেকগুলো ভাইবোন আমরা। লেখাপড়া কিছু শিখিনি, সংসার চলে না দেখে বাবা আমাদের গ্রামের একটা অবস্থাপন্ন ঘরে আমার একটা কাজ ঠিক করে দিলেন। কাজটা রান্নার। আমরা ব্রাহ্মণ। তাই কাজটা পেতে কোনও অসুবিধে হল না। যদিও রান্না আমি কিছু জানতাম না। অল্প দিনের মধ্যে শিখে নিয়েছিলাম। পেটের জন্য এই কাজ দিয়েই শুরু হল আমার জীবন।

আবার ফুকফুক করে টেনে পরে লম্বা করে একটা টান দিলেন। তারপর ছিলিমটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। ইশারায় জানালাম খাব না। ছিলিমটা হাতে রেখে ভুসভুস করে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,

– বছর পনেরো বয়েসে আমিও রান্নার কাজে ঢুকি। এইভাবে কাটতে লাগল দিনগুলো। একদিন আমার মালিক বাড়ির সকলকে নিয়ে গেলেন এক আশ্রমে। সঙ্গে নিলেন আমাকেও। ওরা মাঝেমধ্যেই যেতেন। আমাকে নিয়ে গেলেন এই প্রথম।

গাঁজায় আবার দম দিলেন। সাধুবাবা অভ্যস্ত। কথায় আড়ষ্টতা ও ভাবের কোনও পরিবর্তন নেই। পাকা নেশাড়িদের যেমন কোনও বিকার হয় না। আমি কোনও কথা বলছি না। চুপ করে বসে রইলাম। সাধুবাবা বলে চললেন,

– আশ্রমে যাওয়ার পর দেখলাম বিভিন্ন বয়েসের অনেক সন্ন্যাসী রয়েছে সেখানে। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। ওদের দেখা মাত্র আমার মনে হল, এরা তো লোকের দাসত্ব করছে না অথচ প্রতিদিন এদের আহার জুটছে আবার ভগবানের নামও করছে। আর আমি কিনা সামান্য পেটের জন্যে লোকের বাড়িতে এইভাবে পড়ে আছি! মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, ভগবানের নামে পড়ে থাকব আমিও। এদের যখন আহার জুটছে তখন আমারও কিছু জুটবে। দাসত্ব করতে হয় তো ভগবানেরই করব।

এই পর্যন্ত বলে ছিলিমের পোড়া ছাইটুকু মাটিতে ঠুকে ঠুকে ফেলতে লাগলেন। জিজ্ঞাসা করলাম,

– তারপর কি করলেন আপনি?

হাসি নেই মুখে। চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। গম্ভীরভাবে বললেন,

– ওদের সঙ্গে ফিরে গেলাম বাড়িতে। তারপর বেটা একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। আর কি, দেখতে দেখতে তো এতগুলো বছর কেটেই গেল। রান্নার কাজ করেছিলাম বছর তিনেকের মতো।

গাঁজা খাওয়ায় মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে। জিজ্ঞাসা করলাম,

– আচ্ছা বাবা, গৃহত্যাগের পর আপনার কখনও এমন মনে হয়েছে, এর চাইতে বিয়ে করে সংসার করলেই ভাল হত। কামভোগের বাসনা তো মনে একটা ছিলই।

মুখটা দেখে বুঝলাম, সাধুবাবার আমেজটা বেশ ভালই এসেছে। এ কথার উত্তরও দিলেন বেশ প্রসন্নভাবে,

– ঘর ছাড়ার বেশ কয়েক বছর পর মাঝেমধ্যে কখনও কখনও মন হয়েছে, তবে সে ভাবটা স্থায়ী হয়নি।

এবার যে প্রশ্নটা করব তার জন্য আগাম অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন মনে করে বললাম,

– বাবা, যদি কোনও অপরাধ না নেন একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।

মুখে কিছু বললেন না। গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। অভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, বিরামহীন চলা আপনার। এক তীর্থ থেকে আর এক তীর্থে, এইভাবে অনেক পথই তো চললেন। এই চলার পথে অনেক সুন্দরী মেয়ে এবং ঘরের বউদের দেখেন। অনেক সময় তারা আসেনও আপনাদের সান্নিধ্যে। কেউ সাধুসঙ্গের জন্য, কেউ আশীর্বাদ পেতে। তখন তাদের রূপ যৌবনভরা সুন্দর দেহ দেখে আপনার মনে কি কখনও কাম বা যৌনচিন্তার উদ্রেক ঘটেছে, ঘটে কখনও?

কথাটা শুনেই সাধুবাবা কেমন যেন ‘থ’ হয়ে গেলেন। একটু সময় নিয়ে কি যেন ভাবলেন। সেটাও বেশ ফুটে উঠল সারা মুখমণ্ডলে। তারপর নিঃসঙ্কোচে মাথাটা সামনে পিছনে দোলাতে দোলাতে বললেন,

– হাঁ হাঁ বেটা, কভি কভি হোতা হ্যায়।

মুহুর্ত দেরি না করে জিজ্ঞাসা করলাম,

– কি রকম সে চিন্তা, কি মনে হয় তখন?

কয়েক মিনিট চুপ করে রইলেন। পরে বললেন,

– বেটা, সত্যি কথা বলতে গেলে তো অনেক কথাই বলতে হয়। তবে তোর কাছে মনের কোনও কথা গোপন করব না। জানিস বেটা, যে কোনও নারী, সে কুমারী বা সধবা যাই হোক না কেন, দেখামাত্র প্রথমে মনে আসে রূপের চিন্তা। রূপ মহামায়ার এক অদ্ভুত সৃষ্টি। জগতের রূপ দিয়েই তাঁর প্রথম আর বড় শক্ত খেলা শুরু। একজনের রূপ আর মন দুটোই সুন্দর, মহামায়া এ খুব কমই সৃষ্টি করেছেন। এই দেখ না, চেহারাটা আমার সাধুর মতো অথচ কত নগ্ন চিন্তা করে মনটা। কেউ কি বাইরে দেখলে বুঝবে?

কোনও কথা বলে ছেদ টানলাম না সাধুবাবার কথায়। বসে রইলাম চুপ করে। তিনি বলতে লাগলেন,

– খুব সুন্দর তরতাজা ফুল দেখলে সকলের মনে যে ভাবের উদয় হয়, ঠিক তেমন। যেমন ধর, প্রথমে তার সৌন্দর্য তারপর রঙ আকৃতি গঠন, ঠিক সেই রকম। কোনও নারী সুন্দরী হলে বয়েস তার যাই হোক না কেন, দেখামাত্রই মনে উদয় হয়, কি সুন্দর দেখতে। রূপের সঙ্গে রঙের যোগাযোগটাও কাজ করে একই সঙ্গে, পরে সৌন্দর্যের প্রতিফলন ঘটায় মনের উপর।

সুন্দরী না হলে ঠিক বিপরীত ভাবের সৃষ্টি হয় মনে। কিন্তু এখানেই শেষ নয় বেটা, সুন্দরী বা কুৎসিত, রূপ যাই হোক না কেন, তারপর দেহে তো চোখ পড়েই। তখন আর মুখসৌন্দর্য মনের উপর কাজ করে না, কাজ করে দৈহিক গঠন আর আকৃতি, তার মধ্যে স্তনটাই মনের উপর প্রতিফলিত হয় বেশি করে। তবে জানবি বেটা, এসব চিন্তা সাময়িকভাবে তাৎক্ষণিক মনকে নাড়া দেয় মাত্র।

কথা শেষ হতে প্রশ্ন করলাম,

– আচ্ছা বাবা, এই দেখামাত্র রূপসৌন্দর্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যে চিন্তার সৃষ্টি হয় মনে, তাতে কি ভোগের বাসনা জাগে আপনার? অর্থাৎ বলতে চাইছি ‘একটু ভোগ করতে পারলে ভাল হত,’ এমন চিন্তা।

একটু মুচকি হেসে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– না বেটা, তা আমার জাগে না। তবে সব সাধুর মানসিক ভাব তো আর এক নয়, তাই অন্যের কথা আমি বলতে পারব না। তবে একথা সত্য, কখনও কখনও দেহ মন আমার কামচিন্তায় একেবারে অস্থির হয়ে ওঠে। সে সময় কোনও নারীমূর্তি সামনে থাকুক বা না থাকুক। তবে পরিবেশ ও তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি অনুসারে ওই চিন্তা মন থেকে সৃষ্টি হয়ে আবার মনেই লয় হয়ে যায়।

এখন সাধুবাবার মানসিক ভাবটাকে আরও বেশি করে জানার জন্য, আরও এগিয়ে গেলাম কথায়,

– বাবা, সাধুজীবনে যদি কখনও কোনওভাবে নারীদেহ ভোগের সুযোগ আসে, তাহলে সে সুযোগ ব্যবহার করবেন, না উপেক্ষা?

কথাটা শুনে বেশ কয়েক মিনিট চিন্তা করলেন সাধুবাবা। মুখের ভাবটাও এল গম্ভীর হয়ে। এদিক ওদিক একটু তাকালেন। পরে বললেন,

– বেটা, তোর এ প্রশ্নের কোনও উত্তর আমি দিতে পারব না। মন বড় ‘বদমাশ’। কখন কি করবে, কোথায় নিয়ে ফেলবে তা কি বলা যায়? আর ভবিষ্যতে কি হবে, কি করব, এসব আগাম চিন্তাভাবনার কাজ তো সাধুদের নয়। তবে একটা কথা জানবি বেটা, সাধু যত উন্নত স্তরেরই হোক না কেন, নারীর রূপ আর দেহের দর্শনে মনে সাময়িক, ক্ষণিকের জন্য হলেও যে চিন্তা আসে, তা ভোগের চিন্তা না হলেও ইন্দ্রিয় তমোগুণের ক্রিয়া তো করেই। এ কথা যে অস্বীকার করে, সে সাধু হয়ে সত্যকেও অস্বীকার করে।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button