১৯৭০ সাল থেকেই লেখক ও পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতীর ভ্রমণ ও সাধুসঙ্গের জীবন শুরু, যা আজও জারি আছে। আসমুদ্র হিমাচলের প্রায় সব জায়গায় ঘুরেছেন। প্রায় পাঁচ হাজার পথচলতি (রমতা সাধু) বিভিন্ন বয়স ও সম্প্রদায়ের সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।
সাধুসন্ন্যাসীরা কেন ঘর ছেড়েছেন, কিসের আশায়, কিভাবে চলছে তাঁদের, কেমন করে কাটে জীবন, এমন অসংখ্য কৌতূহলী প্রশ্নই লেখককে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে ভারতের অসংখ্য তীর্থে, পথে প্রান্তরে। এসব প্রশ্নের উত্তরই আছে এ লেখায়। একইসঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের দেখা ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে অনুভূত ও উপলব্ধ মতামত।
তাঁদের জ্ঞানের পরিধির বিশালতা উপলব্ধি করে বারবার মুগ্ধ হয়েছেন লেখক। যাঁকে প্রথমে নিতান্তই ভিখারি ভেবেছেন, পরে কথা বলে পেয়েছেন অগাধ জ্ঞানের পরিচয়। অশিক্ষিত অক্ষরজ্ঞানহীন সাধুদের এমন সব তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ কথা, যা অনেক পণ্ডিতমনাদের ধারণায় আসবে না। তাঁদের কাছে পর্যায়ক্রমে কথোপকথন, বিভিন্ন তত্ত্বের বিশ্লেষণ, যা অধ্যাত্ম্যজীবন, ভারতীয় দর্শন ও জীবনধারার পরিবাহক।
এ লেখায় কোনও মঠ, মন্দির, আশ্রমের সাধুসন্ন্যাসীদের কথা লেখা হয়নি। কারণ অধিকাংশই তাঁরা গৃহীজীবনের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে জড়িত। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের উপর নির্ভরশীল। এখানে সেইসব পথচলতি সাধুদের কথা আছে, যাঁদের জীবন জীবিকা চিন্তাভাবনা ইত্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে সম্পূর্ণই অজ্ঞাত। যাঁরা সংসারের গণ্ডী ভেঙে বেরিয়েছেন এক অজানা অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্যে। যাঁদের কৌতূহলী অন্বেষণ নেই। চাওয়া পাওয়ার বাসনায় যাঁরা নির্বিকার অথচ আত্মতৃপ্ত। এ লেখায় তাঁদের কথাই লিখেছেন পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতী।
এবার এলাম সাধুবাবার ব্যক্তিগত জীবনপ্রসঙ্গে,
– কোথায় বাড়ি ছিল আপনার?
একটু আরামের ভঙ্গিতে গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বললেন,
– এলাহাবাদে।
– মা বাবা ভাই বোন তো ছিল আপনার?
ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন। মুখে উত্তর দিলেন না। জিজ্ঞাসা করলাম,
– তাঁদের ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন কেন?
কথাটা শুনলেন। কোনও কথা বললেন না। দেখেছি সব সাধুসন্ন্যাসীদের একই রোগ, ব্যক্তিগত জীবনের কোনও প্রশ্ন করলে মুখ খুলতে চান না কেউ। নিজেও জানি, তাঁদের পূর্বাশ্রমের কথা বলতে নেই। তবুও আমার জানতে হবে। তাই আবার বললাম,
– বলুন না বাবা, এপথ বেছে নিলেন কেন?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
– ওসব কথা জানতে চাস না, বলব না।
মনে মনে বললাম, বলতেই হবে। দুহাতে সাধুবাবার পা দুটো ধরে অনুরোধের সুরে বললাম,
– দয়া করে বলুন না বাবা, এতে আপনার ক্ষতি তো কিছু হবে না। সারাজীবনে না হয় একজনকেই বললেন।
মিনিটপাঁচেক গম্ভীর থেকে কি যেন ভাবলেন। তাকালেন একবার মুখের দিকে। শুরু করলেন এইভাবে,
– দেখ, মানুষের ইচ্ছায় কোনও কাজই হয় না জগৎ সংসারে। ইচ্ছে করে সাধু হইনি আমি। ভগবানের ইচ্ছাতেই এই জীবন আমার। তখন বয়েস বছর পাঁচেক হবে। ঠিক মনে নেই। একবার আমাকে নিয়ে বাবা মা গেলেন গঙ্গাস্নানে। আমাকে বসিয়ে দিলেন ঘাটে। বসে রইলাম চুপ করে। দুজনে নেমে গেলেন স্নানে। গঙ্গায় তখন ভরা জোয়ার। তখন জোয়ার–টোয়ার কিছু বুঝি না আমি। হঠাৎ কি মনে হল, একদৌড়ে নেমে গেলাম জলে। ব্যস, দেখতে দেখতে তলিয়ে গেলাম। ঘাটে লোক ছিল অনেক। আচমকা ব্যাপারটা হওয়ায় ধরার সুযোগ পেল না কেউ। তারপর আর কিছু জানি না আমি। এসব কথা বলছি ওই বয়সের হাল্কা স্মৃতি থেকে, গুছিয়ে।
একটু থামলেন। এদিক ওদিক তাকালেন একবার। তাকিয়ে রইলাম সাধুবাবার মুখের দিকে। তিনি বললেন,
– যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন দেখি আমি এক সাধুর কুঠিয়াতে শুয়ে আছি একটা কম্বলের উপর। তিনজন সাধু বসে আছেন। তিনজন বুড়ো। আমাকে ঘিরেই বসে আছেন তাঁরা। দেহে আমার কোনও বল নেই। ওঠার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম তাঁদের মুখের দিকে। কোথা থেকে দুধ এনেছিলেন তাঁরা বলতে পারব না। গরম করে আধলোটা দুধ খাইয়ে দিলেন আমাকে। অসাড় দেহটা ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে উঠল। উঠে বসলাম বেশ কিছুক্ষণ পর। দেখলাম গঙ্গার পাড়েই সাধুবাবার কুঠিয়াটা।
যেখানে ডুবে ছিলাম সেই ঘাটের নাম তো আমার জানা ছিল না। ঘাটটা কি রকম তা মোটামুটি একটু বুঝিয়ে বলতে পেরেছিলাম সাধুবাবাদের। ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করাতে বুঝেছিলাম গঙ্গার জোয়ার ভাটায় আমি দেড় দুদিনের পথ অতিক্রম করে এসেছি।
কথাটা শুনে বিস্ময়ের আর অবধি রইল না। অবিশ্বাস্য মনে হল। অবধারিত মৃত্যু হওয়ার কথা। অথচ সাধুবাবা বেঁচে রইলেন কিভাবে! মনে মনে ভেবে শিহরিত হয়ে উঠলাম। জিজ্ঞাসা করলাম,
– সাধুরা আপনাকে উদ্ধার করলেন কিভাবে?
একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
– পরে এসব কথা জানতে পেরেছিলাম গুরুজির মুখে। তখন তো আমি বাচ্চা, অত কিছু বুঝি না। ওই তিনজন সাধু একে অপরের গুরুভাই। ওঁদেরই একজনের কাছ থেকে আমার দীক্ষালাভ হয়। আমার গুরুজির মুখে শুনেছি, প্রতিদিন ভোর চারটেয় উঠে স্নান করতেন তিনি। গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে দেখেন অচৈতন্য দেহটা আমার পড়ে রয়েছে ঘাটের পাড়ে। তুলে আনেন কুঠিয়াতে। পরে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন আমাকে।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন একটা। হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন কারও উদ্দেশ্যে। পরে বললেন,
– বলতে পারিস মরেই গেছিলাম আমি। সে যাত্রায় গুরুজিই দেহে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন নতুন করে।
কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম,
– যখন সুস্থ হলেন তখন মা বাবার কথা মনে পড়ল না? বাড়ির ঠিকানা বলে সাধুদের পৌঁছে দিতে বললেন না?
নিরুদ্বেগ মুখেই বললেন সাধুবাবা,
– গ্রামের নাম ঠিকানা কিছু জানতাম না। বলতে পারিনি। মা বাবার কথা মনে পড়ে খুব কান্না পেয়েছিল আমার। কেঁদেও ছিলাম। সাধুবাবারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাড়ি যাব কিনা, মন খারাপ লাগছে কিনা? মনটা খারাপ লাগছিল। তবে বাড়িতে যাবার কথায় বলেছিলাম ‘যাব না’। কেন যে বলেছিলাম তা আজও ভেবে পাই না আমি। অথচ বাবামাকে দেখার জন্য তখন সত্যিই মনটা আমার কেঁদেছিল। বাড়িতে আর ফিরে গেলাম না। এখন মনে হয়, এই জীবনটাই ভাগ্যে লেখা ছিল, তাই হয়ত বলেছিলাম যাব না।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বয়স্ক সাধু যিনি আপনার গুরুদেব, তাঁর কাছেই থাকতেন। ছোট্ট একটা শিশু। লোকে দেখলে তো সন্দেহ করত। ছেলেধরা বলে পুলিশের ঝামেলার একটা ব্যাপার ছিল, সেসব কিছু হয়নি?
হাসতে হাসতে বললেন,
– আসলে বেটা, ভগবান আমাকে এপথে নেবেন বলেই এক অদ্ভুতভাবে টেনে নিয়ে এলেন ঘর থেকে। মৃত্যু না হয়ে বেঁচে আছি আজও। এ পথে জীবনটা কাটবে, এটাই বিধিলিপি। তাই গুরুজিকে কখনও ঝামেলায় পড়তে হয়নি। আমার সাধুজীবন নির্দিষ্ট না থাকলে হয়ত কোনও ঝামেলায় পড়তেন তিনি। ফিরে যেতে হত সংসারে।
জানতে চাইলাম,
– আপনার দীক্ষা হয়েছিল কত বছর বয়সে?
আগের কথার জের টেনেই বললেন,
– গুরুজি আমাকে বাঁচানোর পর অল্প কিছুদিন ছিলাম ওখানে। তারপর একদিন একটা নেংটি পরিয়ে নিয়ে বেরলেন তীর্থভ্রমণে। গুরুজির গুরুভাই দুজন তাঁরা কে কোথায় যে গেলেন তা জানতে পারিনি। তীর্থপরিক্রমা আর পথ চলার সময় সাধনভজনের নানা কথা বলতেন গুরুজি। একটা কথা বারবার বলতেন, ‘বেটা, মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবি। নইলে কোনওদিনই তাঁর কৃপালাভ করতে পারবি না। ভাল ব্যবহার করলে ভগবানের করুণাধারা বর্ষিত হবে অজস্রধারে। তাঁকে লাভ করতে পারবি।’ এই তীর্থভ্রমণের পথেই দীক্ষা হয়ে গেল একদিন। গুরুজির সান্নিধ্যে যাওয়ার মাসছয়েক পরে।
অতীত জীবনের বন্ধ দরজা খুলে গেল সাধুবাবার। জিজ্ঞাসা করলাম,
– এ জীবনে মাবাবার স্নেহ, মমতা কিছুই পেলেন না আপনি। তাদের কথা, তাদের কোনও স্মৃতি কি কিছু মনে আছে আপনার?
ভুরুটা সামান্য কোঁচকালেন। অনেক চেষ্টা করলেন মনে হল। তাও মিনিট খানেক। পরে বললেন,
– না বেটা, তাঁদের কোনও স্মৃতিই আমার স্মৃতিতে নেই। মায়ের মুখটাও মনে পড়ে না। বয়েস তো আর কম হল না!
জানতে চাইলাম,
– এখন কত বয়েস হবে আপনার?
এবারও ভাবলেন একটু। উদাসীনভাবে বললেন,
– এ দেহটার বয়স হল অনেক। তাও আশি পঁচাশি তো হবেই। এর কম হবে না বেটা।
প্রসঙ্গ পালটে গেলাম অন্য প্রসঙ্গে,
– আপনি তো বাবা অনেকবারই গেছেন কুম্ভমেলাতে। অনেক অভিজ্ঞতাও আছে আপনার। সেখানে তীর্থকামী সাধারণ মানুষ, সাধুসন্ন্যাসী ছাড়াও যায় বহু ধনবান ব্যবসায়ী সাধুদের মাধ্যমে লক্ষলক্ষ টাকা খরচ করে ভাণ্ডারা দেয়। সাধুসন্ন্যাসীদের অঢেল খাবার, বস্ত্র, কম্বল দান দক্ষিণা দেয়ার কোনও কার্পণ্য থাকে না। সবটাই একেবারে রাজকীয় ব্যাপার। একটা কথা জানতে ইচ্ছা করে বাবা, এই দানে সত্যিই কি সাংসারিক বা আধ্যাত্মিক কল্যাণ কিছু হয়?
হুট করে এরকম একটা প্রশ্ন করায় একটু অবাক হলেন সাধুবাবা। তাকিয়ে রইলেন মুখের দিকে। কি যেন ভাবলেন। বললেন,
– হঠাৎ এই প্রশ্ন করলি?
কোনও উত্তর দিলাম না। চুপ করে রইলাম। চুপ করে রইলেন সাধুবাবাও। কয়েক মিনিট। বললেন,
– আত্মিক বা পারমার্থিক কল্যাণ কিছু হয় না এই দানে। তবে দাতার কপাল ভাল থাকলে ভোগবাদ বা পার্থিবজীবনের কল্যাণ তো কিছু হয়ই।
‘দাতার কপাল ভাল থাকলে’ কথাটা শুনে মনে হল কোনও একটা রহস্য লুকিয়ে আছে এর ভিতরে। বিষয়টা খোলাখুলি জানার জন্য বললাম,
– একটু বুঝিয়ে বলবেন বাবা।
এবার একটু সোজা হয়ে বসলেন। এতক্ষণ বসেছিলেন হেলান দিয়ে। নজরটা একবার এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,
– কুম্ভমেলায় ধনী বা ধনবান ব্যবসায়ীদের দানের কথা অনেকেরই শোনা। কেউ কেউ দেখেছেও হয়ত। এই দানের পিছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর রহস্য। সাধুদের মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধিই দাতার একমাত্র লক্ষ্য, প্রধান উদ্দেশ্য। দানটা তাদের নামেই। আসলে একটা কথা কেনার উদ্দেশ্যে তারা দান করে।
‘কথা কেনা’ কথাটা শুনে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। কথায় কথা এনে ছেদ টানলাম না সাধুবাবার কথায়। তিনি বলে চললেন,
– দানের মুখ্য উদ্দেশ্যটা বলি শোন। কুম্ভমেলা চলছে। কোনও বড় আখড়ার মহান্তকে ধর কেউ দুলাখ টাকা দিল। সাধুদের কম্বল বস্ত্র ভোজন আর দক্ষিণা। সঙ্গে তার নামটা। আবার অনেকে ওইসব জিনিস কিনেও দেয় প্রচুর পরিমাণে। এবার সেই মহান্ত একটা নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে ভাণ্ডারার জন্য। তারপর নিমন্ত্রণ করে বিভিন্ন আখড়ার কয়েক হাজার সাধুকে। যথাসময়ে সেইসব সাধুসন্ন্যাসীদের সমাগম হয় ভাণ্ডারায়। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সমাপ্ত হয় ভোজনপর্ব। পরে দেয়া হয় বস্ত্র ও ভোজনদক্ষিণা।
একটু থেমে বললেন,
– এখানে একটু কথা আছে। আসনে বসার পর, ভোজন শুরুর সময় মহান্তজি ধ্বনি দিতে থাকেন তার গুরু, সম্প্রদায় এবং দেবদেবীর নামে। তখন সমবেত সাধুরা তার উত্তরে ধ্বনি দিতে থাকেন ‘জয়’ বলে। সবশেষে ধ্বনি দেয়া হয় ভাণ্ডারাদাতার নাম করে। তাতেও জয়ধ্বনি দেয় সকলে। এবার দাতার কপাল ভাল থাকলে আর কথা নেই। ভাণ্ডারায় জমায়েত হয়েছে কয়েক হাজার সাধু। তাদের মধ্যে কেউ ‘বাকসিদ্ধ’ থাকলে তার মুখ থেকেও নিঃসৃত হয় ‘জয়’ কথাটা। ব্রহ্ম সত্যে প্রতিষ্ঠিত, সত্য বাক্যে প্রতিষ্ঠিত। বাকসিদ্ধ সাধুর ‘জয়’ বাক্যটা সত্যে পরিণত হয় দাতার উদ্দেশ্যে। ফলে উদ্দেশ্য সফল হয় দাতারও। তখন থেকেই সমস্ত কাজে জয়লাভ হতে থাকে ভাণ্ডারাদাতার। এ ফলের কোনও মার নেই।
ওই বাকসিদ্ধ সাধুর ‘জয়’ ধ্বনিতে দাতার জয়ই হতে থাকে দিনের পর দিন, সব কাজে। শুধু এই ‘জয়’ কথাটা কেনার জন্যে ধনী বা ধনবান ব্যবসায়ীরা সাধুদের উদ্দেশ্যে ভাণ্ডারা দেয় কুম্ভমেলায়। এখন কোন ভাণ্ডারায় কার ভাগ্যে বাকসিদ্ধ সাধু থাকবে, না থাকবে তা কেউই বলতে পারে না। কপাল ভাল থাকলে উতরে যায়। সেইজন্য ভাণ্ডারাতে নিমন্ত্রণ করা হয় হাজার হাজার সাধুদের। দাতা খরচ করে লক্ষ লক্ষ টাকা। বুঝলি এবার, এই হল কুম্ভমেলায় ভাণ্ডারা দেয়ার আসল রহস্য।
দানের পিছনে এমন উদ্দেশ্যের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মানুষ কত সুযোগ সন্ধানী। যাঁরা সংসারে নেই তাঁদের দিয়েও জাগতিক সুখলাভের চেষ্টার অন্ত নেই। এখানেই থামলেন না সাধুবাবা,
– বেটা, একেবারে বোঝার উপায় নেই কে বাকসিদ্ধ, আর কে নয়। যদি ওই সমবেত সাধুদের মধ্যে তেমন কেউ না থাকে তবে আসল উদ্দেশ্যটা ব্যর্থ হল। কোনও ফল হল না। তবে দাতার উদ্দেশ্যে সম্মিলিত সাধুদের জয়ধ্বনিতে দাতার কল্যাণ তো কিছু হয়ই।
‘ফল’-এর কথা বলায় জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, গৃহীরা দেবদেবীর উদ্দেশ্যে যে বলি দেয়, তাতে কি কোনও ফললাভ হয়? ভগবান কি সত্যি প্রাণিহত্যার ভোগ গ্রহণ করেন? তিনি কি আমিষাশী না নিরামিষাশী?
কথাটা শুনে হাসলেন, বিরক্ত হলেন না। বললেন,
– খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছিস। তবে শোন বেটা, জগৎ সংসারটা তিনিই সৃষ্টি করেছেন, যেন সাজানো বাগান। তাঁর সৃষ্ট বাগানের ফল তিনিই গ্রহণ করেন। দানও করেন তিনিই। উপলক্ষ বা মাধ্যম মানুষ। সুতরাং পরমেশ্বরের কাছে আমিষের কোনও প্রশ্ন নেই, নিরামিষেরও নয়। তিনি আপেল আঙ্গুরের সৃষ্টিকর্তা, ছাগ-মেষেরও।
কণ্ঠে এবার দৃঢ়তার সুর ফুটে উঠল সাধুবাবার,
– সংকল্প যদি সৎ আর ঐকান্তিক হয়, একই সঙ্গে সংকল্প যদি ভগবানের নিয়ম লঙ্ঘন না করে, তাঁর বিবেচনাধীনে কোনও বিষয়কে কেন্দ্র করে বলিদানের প্রার্থনা করলে তা পূরণ হয়ই। শাস্ত্রে বলিদানের কথা বলা হয়েছে। গুরুজি বলেছেন, সংকল্প করে আরাধ্য দেবদেবীর তুষ্টিসাধনের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য বা উৎসর্গীকৃত বস্তুর নামই বলি। বলিদানের উপাসনাটা সকাম উপাসনা।
বেটা, শক্তির উপাসনায় অনেকের বংশানুক্রমিক বলির প্রথা প্রচলিত আছে। আবার অনেকে বলি দেয় মানসিক করে। চার প্রকার বলির মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা ও কার্যসিদ্ধির প্রার্থনা করা হয়। যেমন নৈবেদ্যদান, পুজোপহার, প্রাণিবধ এবং যেকোনোও মহৎকার্যে সম্পূর্ণ আত্মত্যাগ। প্রাণিদের মধ্যে ছাগবধই বলি বলে। হরিণ উট হস্তিশাবক ইত্যাদি বধকে মহাবলি আর অতিবলি বলে নরবলিকে।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– অনেকক্ষেত্রে দেখি মহিষ, ভেড়া, পায়রা, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি বলি দেয়, সেগুলোকে কি বলে?
ঘাড় নেড়েও মুখে বললেন,
– হাঁ বেটা, এগুলোও দেয়া হয় ভক্ত বা উপাসকের ইচ্ছানুক্রমে। তবে প্রাণিবধে অনেকের মন চায় না অথচ উপাসনা তাদের সকাম। তাই বলি দেয় শসা, চালকুমড়ো, আখ, ক্ষীরের পাঁঠা এমন অনেক কিছু। তাহলে বুঝতে পারছিস, ভগবানের কাছে আমিষ নিরামিষ ব্যাপারটা একই। আসলে দেবদেবীর তুষ্টি বিধানই বলির উদ্দেশ্য।
যেমন পুরাণের কথা গুরুজির মুখে শুনেছি, মহিষ বলিতে দেবী তুষ্ট থাকেন একশো বছর। অন্যান্য বলির মধ্যে হরিণজাতীয় প্রাণি, উট, ছাগ ইত্যাদি বলিতে দশবছর, ভেড়া, পাখি, চালকুমড়ো বলিতে দেবী প্রসন্ন থাকেন এক বছর। প্রাণির বিকল্পে ক্ষীরজাতীয় কোনও দ্রব্যের তৈরি কৃত্রিম পশুতে ছ’মাস, আতপ চাল ও ফুল-ফলাদি নিবেদনে উপাসকের প্রতি দেবী তুষ্ট থাকেন একমাস পর্যন্ত। তবে বেটা বলির মধ্যে ভগবান বা যেকোনোও মহৎকার্যে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিবেদনই হল সর্বোৎকৃষ্ট বলি।
সাধুসঙ্গের সময় কোনও সাধুর কাছে রুটিন মাফিক প্রশ্ন করিনি। এতো আর ইস্কুলে পড়া নয়! যখন যেখানে যে প্রশ্ন মনে এসেছে তাই-ই জিজ্ঞাসা করেছি। কোনও নিয়মে নয়। প্রশ্ন করলাম প্রসঙ্গ পালটে,
– বাবা, সাধুজীবনে এতগুলো বছর তো পার হয়ে এলেন। অনেক পথও চললেন। এই চলার পথে বড় বিপদে পড়েছেন কখনও?
একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
– না বেটা, বড় বিপদ বা দুর্ঘটনা জ্ঞানত আমার জীবনে কখনও ঘটেনি। তবে বহুকাল আগের কথা। তখন একের পর এক তীর্থে ঘুরতাম গুরুজির সঙ্গে। সে বারই প্রথম গেছিলাম বদরীনারায়ণে। এখনকার মত তো আর নয়, তখন ছিল হাঁটাপথ। বয়েসও ছিল কম। অনেক পথকষ্ট সহ্য করে তো পৌঁছলাম বদরীনারায়ণে। দুদিন থাকার পর হঠাৎ লেগে গেল ঠান্ডা। কফ বসে গেলে বুকে। শেষে অবস্থা এমন হল যে প্রাণ আমার যায় আর কি! গুরুজির দিনরাতের অক্লান্ত সেবা আর জড়িবুটি চলল কয়েকদিন ধরে। তারপর আরোগ্য লাভ করলাম ধীরে ধীরে।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত আর কিছু হয়নি। ওই সময় আরও একটা অভিজ্ঞতা হল আমার। গুরুর সেবা করে শিষ্য। এই নিয়মই প্রচলিত আছে সমাজে। কিন্তু শিষ্যকে গুরুজির সেবা যে কি, তা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আমার বিশ্বাস, গৃহী মাবাবাও বোধ হয় এমনভাবে সেবা করতে পারেন না তার অসুস্থ সন্তানকে।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– সারা ভারতবর্ষের সব তীর্থই তো আপনার ঘোরা। তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল লেগেছে কোন তীর্থ?
একমুহুর্ত দেরি না করে বললেন,
– হাঁ বেটা, সমস্ত তীর্থেই গেছি কয়েকবার করে। কৈলাস মানস সরোবরেও গেছি তিন তিনবার। কিন্তু বেটা হরিদ্বার, কেদার বদরী, যমুনোত্রী ও গঙ্গোত্রী এমন তীর্থ আমি দেখিনি কোথাও। আহা, কি অপূর্ব! বহুবার গেছি। আজও টানে আমায়। মানস কৈলাসের চেয়েও ভাল লেগেছে এই তীর্থগুলো।
জানতে চাইলাম,
– কি এমন আছে ওখানে যে উত্তরাখণ্ডের তীর্থগুলোই গেঁথে আছে আপনার মনে? আপনি কি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলতে চাইছেন?
– না না বেটা, ও কথা বলছি না আমি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মানস সরোবর, কৈলাস কি কমতি যায়! আসলে ওখানকার মাটিতে আধ্যাত্মিক কোনও ভাব নেই। উত্তরাখণ্ডে পা দিলে মনে এমন এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক ভাবের সঞ্চার হয় যে, জাগতিক কোনও আবিলতা, কোনও মলিনতাই স্পর্শ করতে পারে না দেহ মন আত্মাকে। বেটা, এ যে একেবারে মাটির গুণ। এ তোকে বলে বোঝাতে পারব না। ওখানে কিন্তু তা আমার মনে হয়নি। আর কারও হয়েছে কিনা, বা হয় কিনা বলতে পারব না। অবশ্য এগুলো যার যেমন তার সেইরকম ভাবের সৃষ্টি হয় বিভিন্ন তীর্থে। হরিদ্বার আমি আগেও দেখেছি, অনেক পরেও দেখেছি, এখন আর সে হরিদ্বার কোথায়?
একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছি সেই কখন থেকে। অথচ কোনও বিরক্তিকর ভাবই দেখলাম না। কি সংযম, কি ধৈর্য সাধুবাবার! অনেক বেলা হল। এবার উঠতে হবে। প্রণাম করে শেষ প্রশ্ন করলাম,
– সারাজীবন তো সাধনভজন করলেন। তীর্থদর্শনও হল অসংখ্য। কিন্তু ঈশ্বরের দর্শন কি পেয়েছেন?
একথায় একগাল হেসে ফেললেন সাধুবাবা। স্বতঃস্ফূর্ত হাসি। আহ, এমন হাসি দেখাই যায় না। সাধুবাবা হাসছেন আর আমার ভিতরে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের হিল্লোল। বুঁদ হয়ে গেলাম আনন্দে। হাসতে হাসতেই বললেন,
– এতক্ষণ পর তুই বেশ মজার প্রশ্ন করেছিস একটা। যদি বলি তাঁর দর্শন পাইনি ওমনি ভাববি, বাপরে এত বছর এই জীবনে থেকেও কিছু পাইনি! অবাক হবি! কিছুতেই বিশ্বাস হবে না তোর। আবার যদি বলি পেয়েছি, তাহলেও তোর শান্তি হবে না। সেটা কিরকম, কেমন করে পেলাম এমন হাজার প্রশ্ন ঘুরবে তোর মাথায়। এসব কথা তোকে বলে বোঝাতে পারব না, দেখাতেও পারব না কিছু, ঠিক কিনা বল?
হতচকিত হয়ে গেলাম এমন একটা পালটা প্রশ্নে। সে ভাবটা কাটিয়ে ঘাড় নেড়ে মুখে বললাম,
– হ্যাঁ বাবা। ঠিকই বলেছেন আপনি। তবুও আন্তরিকভাবে জানতে চাইছি আপনার ঈশ্বরদর্শন বা ঈশ্বরীয় সজ্ঞান উপলব্ধির কথা।
এবার ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে এল সাধুবাবার মুখমণ্ডল। ভাবটাই কেমন যেন বদলে গেল। এটা হল কয়েক মুহুর্তের মধ্যে। পরে শান্তকণ্ঠে বললেন,
– বেটা, জংলিফুলে অলক্ষ্যে যিনি সুন্দর বিচিত্র রঙ ছড়িয়ে মধু ভরে দেন, তিনিই তো ঈশ্বর। তাঁকে কি তোর মতো এমন করে চোখে দেখা যায়!
খুব ভালো লাগল।অনেক ধনযবাদ।