এ বিষয়ে এখন আর কোনও প্রশ্ন এল না মাথায়। কুণ্ডের সিঁড়িও অনেক ফাঁকা হয়ে গেছে। সাধুবাবা এতক্ষণ কথা বলছিলেন সিঁড়ির নিচের ধাপে পা রেখে। আমি বসে আছি মুখের দিকে চেয়ে। এবার পা দুটো লম্বা টান টান করে দিলেন। অনেক দিনের একটা প্রশ্ন ছিল মাথায়। চট করে মনে পড়ে না, খেয়ালও থাকে না। হঠাৎ মনে পড়তেই বললাম,
– বাবা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, উত্তর দেবেন?
হাসিমুখে সম্মতি জানালেন মাথা নেড়ে। অভয় পেয়ে বললাম,
– আপনি ‘ভর’-এ পড়া বিশ্বাস করেন, দেখেছেন কখনও?
ভর কথাটা শুনে সাধুবাবা তাকালেন আমার মুখের দিকে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভর’ কথাটা কী? আর আমি নিজেও জানিনা ভর শব্দের হিন্দি প্রতিশব্দ। বেশ মুশকিলে পড়ে গেলাম। অবশ্য এমনটা অনেক সময়েই হয়েছে হিন্দিভাষী সাধুদের সঙ্গে কথা বলার সময়। পরে অবশ্য অসুবিধা হয় না কথাটা অন্যভাবে বলা বা বোঝানোর জন্য।
সব হিন্দির মানে বুঝি না। অনেক সময় বলতে গিয়েও কথা আটকে যায়। ভর কথাটা অন্যভাবে বুঝিয়ে বলতেই সাধুবাবা মাথা নেড়ে জানালেন,
– হাঁ বেটা, অভি মেরা সমঝ মে আয়া। ভর-এ পড়া নারীপুরুষ আমি জীবনে দেখেছি বেশ কয়েকবার। এটা আমি বিশ্বাস করি।
এবার বললাম,
– বাবা, আমি আগে এ সব ব্যাপারে খুব কৌতূহলী ছিলাম। যখন যেখানে ভরে পড়ার কথা শুনতাম তখনই ছুটে যেতাম সেখানে। নারীপুরুষ উভয়কে দেখেছি ভরে পড়তে। ভরে পড়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। এখন আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। যারা ভরে পড়েন তাদের মুখ থেকে অনেককে অনেক কথাই বলতে শুনেছি আমি। নিজের জীবন সম্পর্কেও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেছি। দেখেছি, তাদের বলা অনেকের কথা মিলে গেছে অদ্ভুতভাবে অক্ষরে অক্ষরে।
শুনলে কেউ বিশ্বাস তো করবে না, ভাবতে পারবে না কল্পনাতে। আবার এমনও দেখেছি, ভরে পড়া অবস্থায় বলা কথার একটা অক্ষরও মেলেনি। তাই বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় আমি দুলছি। এটা কেমন করে হয়, কি করে হয়, কেন অনেক সময় কথাগুলি সত্য হয়, কেন হয় না, এর অন্তর্নিহিত সত্য ও রহস্যটা কি দয়া করে জানাবেন?
কথাটা শুনে সাধুবাবার মুখখানা দেখলাম খুশিতে ভরে উঠল। হাসিভরা মুখে বললেন,
– হাঁ বেটা তুই ঠিকই বলেছিস। তোর দুটো কথাই ঠিক। কখনও ভরে পড়া অবস্থায় বলা কথা ঠিক ঠিক হয়, কখনও হয় না। কারণ আছে বেটা। প্রথমে বলি ভর জিনিসটা কী? মানুষের মধ্যে কোনও কোনও সময় এক বিশেষ বিশেষ শক্তির আবির্ভাব ঘটে। সেই আবির্ভূত শক্তি সুখ দুঃখ ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু কথা বলে। সেই কথা কারও জীবনে সুন্দর ভাবে মিলে যায়, কারও মেলে না। এখন কথা হল সেই শক্তিটা কি?
মানুষের মধ্যে অনেক সময় কিছু পরলোকগত আত্মার আবির্ভাব ঘটে। অশুভ আত্মার আবির্ভাবে প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর যা দেয় তা কখনোও সঠিক হয় না। সাধারণ মানুষের মতো প্রশ্ন কর্তার প্রশ্ন বুঝে তার উত্তর দেয়। কারণ এদের মানুষের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বিষয়টা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থাকে। এমন কি নিকট বা সুদূর ভবিষ্যতের ঘটনাবলী কি হবে না হবে এইসব আত্মারা কিছুই জানতে পারে না, জানেও না। তাই এরা ভরের সময় এসে কিছু বললে তা আদৌ ঠিক হয় না। যখন ভরে পড়া কারও কথা মিলবে না তখন বুঝবি কোনও অশুভ আত্মা আবির্ভূত হয়েছিল ওই সময়।
সাধুবাবা একটা হাই তুললেন। কোনও কথা বলে কথার স্রোতকে বাধা দিলাম না। তিনি বললেন,
– ভরে অনেকসময় উন্নত বা শুদ্ধ আত্মার আবির্ভাবও ঘটে। সে আত্মা কোনও মহাপুরুষ বা সাধকের হতে পারে। এইসব আত্মা মানুষের জীবন সম্পর্কে সবটা নয়, খুব সামান্য কিছু নিকট ভবিষ্যৎ বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকে। আত্মার স্তরভেদে কিছুটা বেশি জানা থাকতে পারে, তবে সম্পূর্ণ নয়। এই শ্রেণীর আত্মা ভরে এলে কারও সম্পর্কে কিছু বলে না। যদি কিছু বলে তা একান্ত মামুলি কিছু কথা। প্রশ্নকর্তার প্রশ্নকে এড়িয়ে অথচ সত্যকে বজায় রেখে প্রায়ই তা হয় উপদেশমূলক।
এক্ষেত্রে অতি নিকট ভবিষ্যতের কথা কিছু বলে না। জানলেও না, আত্মার স্তরভেদে অনেকে জানেও না। অর্থাৎ এই আত্মার ভরে বলা কথা মেলা বা না মেলা বলতে পারিস সমান। অমন কথা কোনও কথাই না। তবে দয়া করে যদি নির্দিষ্ট করে কিছু বলে তা জানবি নিকট ভবিষ্যতের কথা এবং তা সত্য।
সাধুবাবাকে উপেক্ষা করে চলে গেলে আজ অনেক কথাই জানা হত না। জীবনে সময় চলে যায় মানুষের, অসম্পূর্ণ থেকে যায় জানাটা। তার মধ্যে যারা যেটুকু জানতে পারে লাভ তার সেটুকুই। অযাচিত সাধুসঙ্গ হয়েছে খুব কম। যাচিত সাধুসঙ্গই হয়েছে সবসময়। আজকের সাধুসঙ্গ আমার অতিরিক্ত লাভ। সাধুবাবা বললেন,
– বেটা মুসলমানদের ভরও আমি দেখেছি। তাতে ওদের বলতে শুনেছি পীর বা কোনও মুসলমান মহাত্মা এসে কথা বলেন। হিন্দু সাধক মহাপুরুষ স্তরের মতো হয়ত কোনও আত্মা হবে তারা। বেটা, ভরে অপদেবতা কিংবা সাধক মহাপুরুষরা অনেক সময় আসেন তবে সাধনে সিদ্ধিলাভ ভিন্ন উপদেবতা আসেন না। ভরে তো আসেনই না।
একটু থেমে বললেন,
– বেটা, দেবদেবীদের অনেক পার্ষদ আছে। যেমন ধর শিবের নন্দী ভৃঙ্গীর মতো কারও অনেক, কারও অল্প কিছু পার্ষদ থাকে। অনেক সময় ভরে সেইসব দেবদেবীদের কোনও পার্ষদ এসে উপস্থিত হয়। এরা কখনও নিজের নাম বলে না। যেমন ধর ভরে নন্দী এল। তোরা জিজ্ঞাসা করলি, উত্তরে নন্দী বলল, আমি বাবা মহাদেব এসেছি। আসলে ভরে কে আসছে বা যাচ্ছে তা কেউ জানতে পারছে না। তারা যা বলছে প্রশ্নকর্তা মহাদেবের কথা বলেই বিশ্বাস করছে। এইরকম পার্ষদরা নিজের নাম গোপন করে কোনও দেবদেবীর নাম করে।
ভরে যার উপরে এরা আসছে, সে ব্যক্তি নিজেও জানেনা কে আসছে। এইসব পার্ষদেরাও কিন্তু অনেক শক্তির অধিকারী। এরা কিছু কথা ঠিকঠাক বলে আর প্রশ্নের উত্তর যদি দেখে হতাশমূলক তাহলে মনরক্ষার জন্য মিথ্যা বলে। এরাও অতি নিকট ভবিষ্যতের অনেক কথা জানে এবং বলতে পারে। সুদূর ভবিষ্যতের কথা এদেরও অনেকে দেবদেবীদের নিকট-দূরের অবস্থান ভেদে বলতে পারে, অনেকে পারে না। তাই ভরে পড়া অবস্থায় এদের কথা কিছু ঠিক হয়, অনেকক্ষেত্রে হয় না।
এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনি বললেন পার্ষদের অনেক কিছু জানা সত্ত্বেও মিথ্যা বলেন মনরক্ষার জন্য। কেন বলেন, তাদের কি স্বার্থ আছে মিথ্যা বলায়?
উত্তরে সাধুবাবা জানালেন,
– ওদের স্বার্থ কিছু নেই তবে তারা বলেই থাকে। যেমন ধর কেউ মহাদেবের ভক্ত। ভরে মহাদেব এলেন না। এলেন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কেউ একজন। এবার ভরে তার কাছে কেউ প্রশ্ন করল। সে প্রশ্নের উত্তরটা ধর অশুভসূচক। এখন সেই অশুভ কথাটা শুনলে প্রশ্নকর্তা মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়বে বা তার মনকষ্টের কারণ হবে বুঝে সেই প্রশ্নের উল্টোপাল্টা উত্তর দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এড়িয়ে যায়, নইলে মিথ্যা কিছু বলে। যেমন আমি দেখেছি, কোনও প্রশ্নকর্তা কঠিন ব্যাধিতে ভুগছে। সে প্রশ্ন করল তার রোগ আরোগ্য হবে কিনা?
এখন সে প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর হল, না, রোগ মৃত্যু পর্যন্ত ভাল হবে না। শারীরিক যন্ত্রণাভোগ তার আমৃত্যু থাকবে। ভরে এ প্রশ্নের উত্তর মিথ্যা বলে মন খারাপ হবে বলে। তখন ধর এই রকম উত্তর দিল, ‘ওষুধ খা, ভগবানকে ডাক, ধীরে ধীরে ভাল হয়ে যাবে।’ একথায় প্রশ্নকর্তা রুগী মনের জোর পেল, হতাশ হল না। তবে রোগ যন্ত্রণার উপশমও কিন্তু হল না। পরবর্তীকালে এরা বলে, ভরে বলেছিল রোগ ভাল হয়ে যাবে কিন্তু আমার কিছুই হল না। অনেক সময় ভরে বিভিন্ন গাছগাছড়া, ওষুধপত্তর বা বিভিন্ন পুজোপাটের কথাও বলে। এখানেও সেই একই কথা বেটা, যার কাজ হবে তাকে দিল, দেখা গেল সত্যিই কাজ হল। আবার কোনও কাজ হবে না জেনেও তাকে দিল মনের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। ভরের বিষয়ে প্রায় সবক্ষেত্রে এরকম জানবি।
জানতে চাইলাম,
– তাহলে তো ভরের কোনও ল্যাজা মাথাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাধক মহাপুরুষ, অশুভ আত্মা, দেবদেবীদের পার্ষদ, এদের মধ্যে কারা ভরে আসছে, বলছে, চলে যাচ্ছে, তার তো কোনও হদিশই পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সাধারণ মানুষ তো এদের চোখে দেখতে পাচ্ছে না, তারা সকলের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এখন তো দেখছি ভরে পড়া অবস্থায় বলা কথাগুলো সব সত্য মিথ্যা মিলিয়ে, যেগুলোর কিছু সত্য হতে পারে আবার সব কথা মিথ্যাও হতে পারে!
আমার কথাগুলো মন দিয়ে সাধুবাবা শুনলেন। টান টান করে রাখা পা-দুটোও ভাঁজ করে সিঁড়ির নিচের ধাপে রাখলেন। এবার সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– বেটা, ভরে কিন্তু দেবদেবীদেরও আগমন ঘটে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে তাঁদের আগমন হয় তাঁর বিশেষ ভক্তের প্রয়োজনে, সকলের কারণে বা প্রয়োজনে নয়। তাঁরা ভরে এলে থাকেন মাত্র তিরিশ সেকেন্ড থেকে একমিনিট, খুব বেশি হলে দেড় মিনিট। এর চেয়ে বেশি সময় কিছুতেই থাকেন না। এই সময়ের মধ্যে ভক্তের যেটুকু প্রয়োজন তা বলে দিয়ে চলে যান। সেটা অব্যর্থ হয়। কথার একটা অক্ষরও মিথ্যা হয় না। প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর যদি অশুভসূচক হয় তাহলে ক্ষেত্রবিশেষে তার কোনও উত্তর দেন না, ভক্তের মন খারাপ হবে বলে। যদি উত্তর দেন তবে তা অশুভসূচক হলে সরাসরি ঠিকঠাক উত্তর দেন।
দেবদেবীরা মিথ্যা বলেন না। তাঁরা ছাড়া আর কেউই সর্বজ্ঞতা লাভ করে না। তাঁরা অতীত বর্তমান সুদূর ভবিষ্যৎ এবং মৃত্যুর পর প্রশ্নকর্তার কি হবে না হবে তা সবই জানেন। প্রয়োজন মনে করলে প্রশ্নের উত্তর দেন নাহলে দেন না। তবে মিথ্যা বা মনরক্ষার জন্য কোনও কথা বলেন না। তোর কথা ঠিক। নিজে কয়েক জায়গায় ভর দেখে এই ধারণাই হয়েছে। আমি যেটুকু বুঝেছি, হাজারে এক-আধটা ক্ষেত্র ছাড়া ভরে দেবদেবীর আগমন প্রায় ঘটেই না। ঘটলেও তা বিশেষ ভক্তদের জন্য, বিশেষ প্রয়োজন এবং তা অতি স্বল্প সময়ের জন্য।
আর একটা বেটা, দেবদেবীরা ভক্তের প্রয়োজনে ভরে এলে কখনও তার কাছে প্রশ্ন করেন না, কোনও প্রশ্ন শোনার অপেক্ষায় থাকেন না। কারণ তাঁর তো সব জানা। ভরে এসে প্রয়োজনীয় উত্তরটুকু বলে দিয়ে চলে যান। ভরে অনেকক্ষণ বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেবদেবীর অবস্থানের কথা শুনলে বা দেখলে জানবি কোনও দেবদেবীর আগমন ঘটেনি। বেটা, সেখানে ভরের কথা কিছু মিলবে, কিছু মিলবে না, আগে যেসব কারণগুলো বলেছি সেইসব কারণে।