১৯৭০ সাল থেকেই লেখক ও পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতীর ভ্রমণ ও সাধুসঙ্গের জীবন শুরু, যা আজও জারি আছে। আসমুদ্র হিমাচলের প্রায় সব জায়গায় ঘুরেছেন। প্রায় পাঁচ হাজার পথচলতি (রমতা সাধু) বিভিন্ন বয়স ও সম্প্রদায়ের সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।
সাধুসন্ন্যাসীরা কেন ঘর ছেড়েছেন, কিসের আশায়, কিভাবে চলছে তাঁদের, কেমন করে কাটে জীবন, এমন অসংখ্য কৌতূহলী প্রশ্নই লেখককে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে ভারতের অসংখ্য তীর্থে, পথে প্রান্তরে। এসব প্রশ্নের উত্তরই আছে এ লেখায়। একইসঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের দেখা ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে অনুভূত ও উপলব্ধ মতামত।
তাঁদের জ্ঞানের পরিধির বিশালতা উপলব্ধি করে বারবার মুগ্ধ হয়েছেন লেখক। যাঁকে প্রথমে নিতান্তই ভিখারি ভেবেছেন, পরে কথা বলে পেয়েছেন অগাধ জ্ঞানের পরিচয়। অশিক্ষিত অক্ষরজ্ঞানহীন সাধুদের এমন সব তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ কথা, যা অনেক পণ্ডিতমনাদের ধারণায় আসবে না। তাঁদের কাছে পর্যায়ক্রমে কথোপকথন, বিভিন্ন তত্ত্বের বিশ্লেষণ, যা অধ্যাত্ম্যজীবন, ভারতীয় দর্শন ও জীবনধারার পরিবাহক।
এ লেখায় কোনও মঠ, মন্দির, আশ্রমের সাধুসন্ন্যাসীদের কথা লেখা হয়নি। কারণ অধিকাংশই তাঁরা গৃহীজীবনের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে জড়িত। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের উপর নির্ভরশীল। এখানে সেইসব পথচলতি সাধুদের কথা আছে, যাঁদের জীবন জীবিকা চিন্তাভাবনা ইত্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে সম্পূর্ণই অজ্ঞাত। যাঁরা সংসারের গণ্ডী ভেঙে বেরিয়েছেন এক অজানা অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্যে। যাঁদের কৌতূহলী অন্বেষণ নেই। চাওয়া পাওয়ার বাসনায় যাঁরা নির্বিকার অথচ আত্মতৃপ্ত। এ লেখায় তাঁদের কথাই লিখেছেন পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতী।
সাধুবাবার কথায় এবং নিজের অভিজ্ঞতায় ভরে বলা কথা সত্য বা মিথ্যা হওয়ার মোটামুটি কয়েকটা কারণ জানতে পারলাম। এবার জানতে চাইলাম,
– এই ভরটা কাদের হয়, কেন হয়? আমি দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ ভরে পড়ে থাকে। মহাশক্তিসম্পন্ন দেবদেবীদের কি খেয়েদেয়ে আর কোনও কাজ নেই? অশুভ আত্মা, সাধক মহাপুরুষ আর দেবদেবী, এঁদের কার আগমনে কি রকম অবস্থা হয় ভরকারীর দয়া করে বলবেন?
সাধুবাবার দেখা ভরের সঙ্গে আমার দেখা ভরের মিল আছে অনেক। তিনি বললেন,
– বেটা, ভরে যখন কোনও দেবদেবী বা সাধকের আবির্ভাব হয় তখন ভরকারীর চোখমুখ কণ্ঠস্বরের অদ্ভুত একটা পরিবর্তন ঘটে। তবে তা মোটেই ভয়ঙ্কর নয়। কণ্ঠস্বরে কোনও উগ্রতা থাকে না, কর্কশও নয়। ভাবটা সম্পূর্ণ শান্ত। তাতে থাকে প্রেম ও স্নেহের ভাব। বিশেষ করে ভরে যদি কোনও দেবীর আবির্ভাব ঘটে। কণ্ঠস্বর যেমন কোমল ও কমনীয় হয় তেমনই কথায় থাকে একটা মাতৃস্নেহের ভাব। কোনও দেবতা বা সাধক মহাপুরুষের ভরে আবির্ভাবেও ওই ভাব। কণ্ঠস্বরে কোনও পরিবর্তন ঘটে না। তাঁরা এবং দেবদেবী ব্যতীত অন্য কেউ ভরে আসলে ভাব ও কণ্ঠস্বরের আমূল পরিবর্তন ঘটে।
যেমন ধর চোখে মুখে উগ্রতা দেখা দেয়, চিৎকার করে কথা বলে, কণ্ঠস্বরে কোন মধুরতা থাকে না, মাথা ঝাঁকানো চুল ছেঁড়া, দাপাদাপি করা, স্থির হয়ে বসে বা শুয়ে না থাকা, মুখ থেকে কুকথা বলা, কোনও কিছু খাবার বা পুজো চাওয়া, কারও উপরে ক্রোধ প্রকাশ করা, এটা না করলে তোর ক্ষতি হবে, ভয় দেখানো কথা বলা ইত্যাদিতে জানবি ভরে কোনও দেবদেবী বা সাধক মহাপুরুষ আসেননি। তাঁদের কেউ এলে এমনটা হবে না। আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করবি, দেবদেবী বা সাধক মহাপুরুষরা ভরে এলে ভরকারীর চোখের পলক পড়বে না যতক্ষণ না তাঁরা চলে যাচ্ছেন। একমাত্র দেবদেবীরা যার উপরে আসছেন, তাকে কেউ স্পর্শ করলে তৎক্ষণাৎ তার দেহ পরিত্যাগ করেন। দেবদেবী ভিন্ন অন্য কেউ এলে ভরকারীকে স্পর্শ করলে ভর ভঙ্গ হয় না।
এক নাগাড়ে বলে সাধুবাবা থামলেন। বুঝতে এতটুকু দেরি হল না যে, আমার দেখা ভরে কে এসেছিল, কার কথা মিলেছে আর কাদের কথা মেলেনি। তবে ভরগুলোর মধ্যে শতকরা নিরানব্বইটা ক্ষেত্রেই এখন বুঝতে পারছি কোনও দেবদেবীর আগমন ঘটেনি। যেক্ষেত্রে আবির্ভাব ঘটেছে তাঁদের কথাই ঠিকঠাক হয়েছে। একটু বিশ্রাম নিয়ে সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, দেবদেবীর ভরটা সকলের হয় না। হাজারে এক আধটা হয়। বাদ বাকি যাদের ভর হয়, দেবদেবীর আগমন তাদের মধ্যে প্রায়ই ঘটে না। আর বাবা, এটা তো বুঝিস যে একটা মহাশক্তির আবির্ভাব ঘটতে গেলে যার মধ্যে ঘটে তার একটা শুদ্ধ সাত্ত্বিক নির্লোভ সুখদুঃখে বিকারহীন জীবনযাপন প্রয়োজন। তাই সাধনভজনশীল নারী বা পুরুষের মধ্যেই সেই মহাশক্তির আবির্ভাব ঘটে ক্ষণকালের জন্য।
যার ভর হয় তার ইচ্ছায় দেবদেবীরা আসেন না, তাঁরা আসেন ভক্তের উপর কৃপাপরবশ হয়ে। ভগবানকে ডাকলাম অমনি এসে গেল, ফটাফট সব বলে দিয়ে গেল, অত সস্তা নয়! তবে সাধনভজন বা শুদ্ধ সাত্ত্বিক জীবনযাপন করলেই যে ভর হবে এমন কোনও কথা নেই। তাঁদের আসাটা বা পাত্রপাত্রী নির্বাচন করাটা সম্পূর্ণ তাঁদের ইচ্ছাধীন, বুঝলি?
কথাগুলো শুনলাম তবে হ্যাঁ বা না আমি কিছু বললাম না। ভাবতে লাগলাম। মিলিয়ে নিতে থাকলাম আমার দেখা বিভিন্ন জায়গার ভরের সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা হল। মোদ্দা কথা ওইটুকু। সাধুবাবা হাসতে হাসতে বললেন,
– কিরে বেটা, আমার সঙ্গে বসে তোর লাভই হল, বল?
আমিও হাসতে হাসতে মাথাটা নাড়ালাম। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা এ পথে তো আছেন বহু বছর ধরে। শান্তি পাওয়ার পথের কোনও হদিশ পেলেন?
প্রসন্ন হাসিতে ভরা সাধুবাবার মুখখানা। মাথাটা নাড়িয়ে বললেন,
– হাঁ বেটা পেয়েছি। সংসারে যার চাওয়া গেছে তার চিন্তা গেছে। মন যার কোনও কিছুরই পরোয়া করে না, কিছুই চায় না সেই মনের দিক থেকে প্রকৃত রাজা। সেই শান্তি লাভ করে। অন্তরে চাওয়া পাওয়ার বাসনা যার ঘোচেনি, সংসারে সে কিছুতেই শান্তি পাবে না।
এই প্রসঙ্গে সাধুবাবা একটা শ্লোকের মতো বলেছিলেন। বহু বছর আগের কথা। আজ আর অতটা মনে নেই। এতক্ষণ পর গৃহত্যাগের কারণ জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, দয়া করে বলবেন, কেন গৃহত্যাগ করে এপথে এলেন?
উত্তরে বললেন,
– হাঁ হাঁ বেটা, জরুর বলব। আমি যখন তোকে ডেকে বসিয়েছি তখন তোর জিজ্ঞাসার উত্তর কি না দিয়ে পারি!
একটু অবাক হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। এতদিন ধরে যেসব সাধুদের জিজ্ঞাসা করেছি তাদের অতীত জীবন ও গৃহত্যাগের কথা তারা কিন্তু কেউই চট করে বলতে রাজি হননি। কখনও পায়ে ধরে, কখনও কাকুতি মিনতি করে, কখনও অনেক অনুরোধের পর বলেছেন তার ফেলে আসা জীবন কথা, গৃহত্যাগের কথা। অথচ এই সাধুবাবাকে বলা মাত্রই রাজি হলেন দেখে মনে একটা ধন্দের সৃষ্টি হল। জানার অপেক্ষায় রইলাম। সাধুবাবা বলতে লাগলেন,
– বেটা, নির্দোষ জীবন যে কিভাবে কলুষিত হতে পারে তার প্রমাণ আমি নিজে। আমার মতো নিরপরাধ এমন কত হাজার হাজার মানুষ সংসারে বিভিন্ন অপরাধের বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ব্যর্থ জীবনযাপন করছে, জেল খাটছে, কেউবা আত্মহত্যা করে প্রাণ দিয়েছে, তার কোনও হিসাব সমাজের কেউ করেনি, রাখেওনি। ভাগ্যিস বেরিয়ে পড়েছিলাম, নইলে সংসারে থাকলে আজও নির্দোষ হয়েও মানসিক গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হত আমাকে।
কথাটুকু বলে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। গৃহত্যাগের ঘটনা যে মর্মান্তিক হবে কথাবার্তার আঁচেই তা বুঝতে পারলাম, যদিও আসল কথাটা এখনও শোনা হয়নি। সাধুবাবার মুখখানা দেখলাম, কেমন যেন একটা যন্ত্রণায় ভরে উঠল। এ যন্ত্রণা নিজের না অন্য কারও জন্য তা বুঝতে পারলাম না। লক্ষ্য করলাম বৃদ্ধের চোখদুটোও জলে বেশ ঝাপসা হয়ে এল। বললেন,
– বেটা বিহারের দেওঘরের কাছে এক গাঁয়ে আমার বাড়ি ছিল। বয়স যখন বছর কুড়ি তখনকার কথা বলছি। আমার এক ঘনিষ্ঠ দোস্ত ছিল। বলতে পারিস আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতাম না শুধু খাওয়া আর শোয়ার সময়টুকু ছাড়া। এক গাঁয়ের পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। রাম লক্ষ্মণের মত সম্পর্ক ছিল আমাদের। বয়েসে ও ছিল আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। যাইহোক একসময় বন্ধুটি গাঁয়েরই একটা মেয়ের প্রেমে পড়ল। তাকে আমি চিনতাম। আমার সঙ্গে তার সম্পর্কও ছিলও অত্যন্ত প্রীতির। ওদের বাড়িতে বন্ধুটির মতো আমারও যাতায়াত ছিল অবাধ। তবে মেয়েটির প্রতি বিন্দুমাত্র দুর্বলতা বা আকর্ষণ ছিল না। ওদের বাড়িতে বন্ধুটির যাতায়াতের ফলে প্রেম মন থেকে গড়িয়ে গেল দেহে। তারপর যা হবার তাই হল।
বছর ষোলোর মেয়েটির পেটে বাচ্চা এল। বন্ধুটির বাবা ছিল গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে অবস্থাপন্ন। সম্মান বাঁচাতে বন্ধুটি অবাঞ্ছিত এই ঘটনার দায় অস্বীকার করল। ওদের সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি এতটাই প্রবল যে, মেয়েটির স্বীকারোক্তি উড়িয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ দায়টা চাপিয়ে দিল আমার উপর, যেহেতু যাতায়াত ছিল ওদের বাড়িতে, সম্পর্ক ছিল মধুর। ফলে একদিন মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্ধুর বাবা গ্রামবাসীদের সঙ্গে জোট বেঁধে আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল সেই অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটির সঙ্গে। এই বিয়ের পর লজ্জায় ও ঘৃণায় মেয়েটির দেহ তো স্পর্শ করিইনি, মনের মধ্যে সংসারের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা, ক্রোধ জন্মে গেল। ভাবলাম, সংসারে থাকলে এই অযাচিত গ্লানি ও অসম্মানের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু। এইভাবে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বাবা মা ভাই বোন আর পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে বেঁচে থাকাটা মৃত্যুরই সমান। মাথা তুলে জীবনে চলতে পারব না। তাই মনেমনে ঠিক করলাম, এ শালার সংসারে আর কিছুতেই থাকব না। দুচোখ যেদিকে যায় সে দিকেই চলে যাব।
সাধু হব এসব এক মুহুর্তের জন্য ভাবিনি জীবনে, যখন ঘর ছেড়েছিলাম তখনও না। বিয়ের ঠিক দুদিনের দিন গভীর রাতে পালালাম বাড়ি ছেড়ে। অপরাধ না করেও অপরাধীর মতো। বুঝলি বেটা, এই হল আমার গৃহত্যাগের কথা। সংসারে নিরপরাধ হয়ে মানুষ যে কত ভাবে, কত কষ্ট পাচ্ছে আর এ যে ভগবানের কত বিচিত্র খেলা তা আজও বুদ্ধিতে এল না। বেটা আমি বেরিয়ে পরেছিলাম বলে আজ শান্তিতে আছি। কিন্তু বিনাদোষে দোষী হয়ে যারা সংসারে আছে তাদের মানসিক যন্ত্রণার কথা ভাবলে গা-টা আমার আজও শিউড়ে ওঠে, কারণ আমি একজন ভুক্তভোগী।
একটানা বলে বৃদ্ধ একটু থামতেই বললাম,
– ঘর ছেড়ে বেরনোর পর কি করলেন, কোথায় গেলেন, কেমন করে পেলেন এ জীবন আর গুরুর আশ্রয়?
এ প্রশ্নে সাধুবাবার মুখখানা ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল। বৃন্দাবনে দেহটাকে রেখে মনটাকে নিয়ে গেলেন ফেলে আসা সুদূর অতীতে। বললেন,
– ওই দিন রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এলাম স্টেশনে। দেওঘর থেকে সোজা যশিডি। তারপর ট্রেন ধরে একেবারে মোঘলসরাই। ওখান থেকে বেনারস। বেনারসে এসে খাওয়ার অভাব হল না। দীপাবলির পর সেই সময় চলছিল অন্নকূট উৎসব। কয়েকদিন আহার জুটে গেল। এই সময়েই পেয়ে গেলাম এক সাধুবাবার আশ্রয়। তাঁকে জানালাম আমার সমস্ত কথা। তিনি থাকেন গঙ্গোত্রীতে। এসেছিলেন অন্নকূট উৎসবে। তার কথা মতো সেই সময় আমি জামাকাপড় ছেড়ে একটা চেলি পরে চেলা বনে গেলাম সাধুবাবার। অবশ্য দীক্ষা আমার অনেক পরেই হয়েছিল।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তাকালেন আমার মুখের দিকে। ভাবটা এমন তখন আমায় আর পায় কে? কোনও কথা বললাম না। সাধুবাবা বললেন,
– অন্নকূট উৎসব শেষ হতে আমি আর সাধুবাবা বেনারস থেকে চলে গেলাম বিন্ধ্যাচলে। ওখানে থাকলাম কয়েকদিন। তারপর রওনা দিলাম গঙ্গোত্রীর পথে। তখন যেমন ঠান্ডা তেমনই সে বার অসম্ভব বরফ পড়ছিল পাহাড়ে। আমরা ধরাসুর পর আর এগোতে পারলাম না। কয়েক মাস ওখানে থাকার পর বরফ পড়া বন্ধ হল, ঠান্ডা কমল। যাওয়ার পথ সুগম হলে গেলাম গঙ্গোত্রীতে। ওখানে আমি আর সাধুবাবা থাকতাম একটা পাহাড়ি গুহায়। আগে সাধুবাবা ওখানেই থাকতেন। তারপর একদিন এক শুভক্ষণে দীক্ষা হল গঙ্গোত্রীতে। সেই সাধুবাবা তখন থেকে হলেন আমার পরমধন গুরুজি।
একটু থেমে বললেন,
– বেটা, দীক্ষা নিলে দক্ষিণা কিছু দিতে হয়। আমি কি দক্ষিণা দিয়েছিলাম জানিস? দীক্ষার পর গুরুজি আমার কাছে দক্ষিণা চাইলেন। আমি বললাম, ‘গুরুজি, আমার কাছে দেয়ার মতো তো কিছু নেই।’ গুরুজি বললেন, ‘কেন রে বেটা, নেই? টাকাপয়সা ধন দৌলতের চেয়েও মানুষের অনেক বড় সম্পদ আছে গুরুকে দেয়ার। সেটা হল মন। তোর মনটাই আমাকে দক্ষিণা হিসাবে দে।’ আমি হতবাক হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। মুখে মনটা দিলাম বললে কি আর দেওয়া হল! ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম গুরুজির মুখের দিকে। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একবার হাসলেন। তখন বয়স কম। অত বুঝতাম না কিছু। গুরুজি মুচকি হাসি হেসে বললেন, ‘গুরু ভিন্ন পার্থিব অন্য কোনও চিন্তা না করলেই মনটা দেয়া হয় গুরুকে। সময় মতো দক্ষিণাবাবদ তোর মনটাই নিয়ে নেব আমি’।
এবার একটা অদ্ভুত আনন্দময় ভাব নিয়ে বললেন,
– হাঁ বেটা, গুরুজি কথা দিয়েছিলেন, রক্ষাও করেছেন। এখন বুঝি দক্ষিণা বাবদ তিনি আমার মনটাকে নিয়েই নিয়েছেন। যাইহোক, গুরুজির আশ্রয়লাভের পর গঙ্গোত্রীর মনোরম পরিবেশে গুহায় বসে চলতে লাগল সাধনভজন। ধীরেধীরে সমস্ত কামনা বাসনা ধুয়ে মুছে গেল মন থেকে। শীতের সময়টুকু ছাড়া পাহাড়ে ছিলাম প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর।
হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘জয় গুরু মহারাজ কি জয় – গুরু কৃপাহি কেবলম’। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সাধুবাবার আনন্দঘন মুখের দিকে। তিনি প্রশান্ত মধুর কণ্ঠে বললেন,
– বেটা, যেমন অপবিত্র ময়লা জলও পবিত্র হয়, গঙ্গাজল হয়ে যায় গঙ্গায় পড়লে, গঙ্গাজলে মিশলে, ঠিক তেমন ভাবে বিষয়ে মলিন মনের মানুষও মলিনতা মুক্ত হয়ে পবিত্র হয় গুরুসঙ্গ, সাধুসঙ্গ, সৎসঙ্গ করলে। গঙ্গোত্রী থেকে বয়ে আসা গঙ্গার পবিত্র নির্মল ধারার মতই যে এদের ধারা। বেটা, মানুষের আত্মা হল নদী, ধর্ম তার ঘাট, ধৈর্য হল তীর, দয়া হল তার তরঙ্গ, সত্যের স্রোতে তার প্রকাশ, ওই ধারাতে যারা (গুরুসঙ্গ, সৎসঙ্গ, সাধুসঙ্গ) স্নান করে, তারা পবিত্র নির্মল হবেই হবে।
এবার সাধুবাবার আবেগভরা কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল একটা পরিতৃপ্তির শব্দ, আহ। এ শব্দ হয়ত তার গুরুমনে নিজমন একাকার হয়ে যাওয়ার। তৃপ্তিতে চোখ বুজলেন ক্ষণিকের জন্য। আবার তাকালেন আমার মুখের দিকে। বললেন,
– বেটা, সুন্দরী রমণীর যেমন সিঁথির সিঁদুর আর কপালের টিপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তাদের মাতৃভাবে প্রতিষ্ঠিত করে, তেমনই ইষ্টনাম মনের মাধুর্য বৃদ্ধি করে নারীপুরুষের মনকে একাকার করে গুরুমনে।
ভাবাবেগে সাধুবাবার কণ্ঠস্বরটা রোধ হয়ে এল। মিনিটখানেক চুপ করে থাকার পর বললেন,
– গুরুজি সেদিন যদি আমাকে আশ্রয় না দিতেন তাহলে তখন আমার পথে কোথাও হয়ত মৃত্যুও হয়ে যেত। বেটা, সুখ চাই না এতটুকুও। চাই সারাটা জীবনব্যাপী দুঃখ, সে দুঃখ এমনই দুঃখ হোক, যে দুঃখে আমি যেন সবসময় স্মরণ করতে পারি আমার গুরুজিকে।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, এপথে জীবনটাই তো কেটে গেল। গুরুগত প্রাণ আপনি। নিশ্চয়ই আমার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। আমরা গৃহী যারা কেউ কম, কেউ বেশি কোনও না কোনওভাবে ঈশ্বরকে ডাকছি কিন্তু গুরুতে বা ঈশ্বরে যাই বলুন, প্রেম এসেছে কিনা কি করে বুঝব?
প্রশ্নটা শুনে সাধুবাবা একটু ভাবলেন। পরে বললেন,
– বেটা, প্রেম মানুষে বল আর ঈশ্বরেই বল প্রেম একই। মানুষ হয়ে মানুষে প্রেম বা ঈশ্বরে প্রেম, এর আলাদা কোনও সংজ্ঞা নেই। প্রেম বাস করে বহু বহু দূরে। ভগবৎ বিমুখ যারা, এতটুকু বিষয় বাসনা যাদের আছে তারা মুখে যতই ঈশ্বরের নাম করুক না কেন বেটা, বুঝবি ঈশ্বরে, নারীর পুরুষে, পুরুষের নারীতে আদৌ প্রেম আসেনি। প্রেম বলে যেটুকু মনে হয় সেটুকু নিজের সুপ্ত মনের চাহিদা বা বাসনা সিদ্ধির প্রকাশ মাত্র, প্রেম নয়। কেন জানিস, মানুষের বিষয়ী মন হাতির চেয়েও বড় আর প্রেমের দরজা হল চুলের মতো সরু। তাই প্রেমের দরজা দিয়ে অত বড় বিষয়ী মন চট করে ঢুকতে পারে না। সুতরাং ঈশ্বরে প্রেম এসেছে কিনা তখনই বুঝবি, যখন দেখবি বিষয়ী মন তোর বাসনাবিহীন হয়েছে।
কথাটুকু শেষ করে স্নেহভরা সুরে বললেন,
– যা বেটা, এখন আর তোকে আটকাব না। তোর কাজ আছে, এবার যা।
সাধুবাবা বলা মাত্রই উঠলাম না। ভাবতে লাগলাম কি অদ্ভুত জীবন মানুষের! অদৃশ্য কোনও এক মহাশক্তি বলে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুরে যাচ্ছে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মতো মানুষের জীবন প্রবাহের গতি। সাধুবাবা কি জীবন থেকে চলে এলেন কোন জীবনে! ভাবতেই পারছি না। হঠাৎ একটা প্রশ্ন এল মাথায়, করে ফেললাম,
– বাবা, ধরুন আমি যদি সাধু হই কিংবা কোনও গৃহী যদি সাধু হতে চায় অর্থাৎ বলতে চাইছি, কী গুণ থাকলে মানুষ ভাল সাধু হতে পারে?
প্রশ্নটা শুনে সাধুবাবা খুশিতে একেবারে উপচে পড়লেন। হাসিভরা মুখে বললেন,
– বাঃ বেটা বাঃ, বেশ মজার প্রশ্ন করেছিস তো! এমন সুন্দর প্রশ্ন করবি ভাবতে পারিনি। তাহলে বলি শোন, ভাল সাধু হতে গেলে কারও কাছে হাত পাততে নেই। যারা ভাল সাধু তারা দিতে ছাড়া কিছু চাইতে শেখেনি। চাইলে কখনও সাধু হতে পারবে না। যে সাধু চায়, সে সাধু সাধুর ভেকধারণ করলেও সাধু নয়। সাধুর সব পাওয়ার আশাকে পূরণ করে না চাওয়ার গুণ, এমনকি ঈশ্বরকেও, বুঝলি?
এবার উঠে দাঁড়ালাম চলে যাব বলে। সিঁড়ির একটা ধাপ নিচে নেমে মাথাটা পায়ে ঠেকিয়ে প্রণাম করতেই হাত দুটো মাথায় বুলিয়ে দিলেন। আমি তাকালাম সাধুবাবার মুখের দিকে, তিনিও তাকালেন আমার মুখের দিকে। এবার আমার শেষ জিজ্ঞাসা,
– বাবা ঈশ্বর কে?
নির্বিকার বৃদ্ধ সাধুবাবার প্রশান্ত মুখখানা এ প্রশ্নে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কোমল মধুর কণ্ঠে বললেন,
– বেটা, বিনা দাঁড়িপাল্লায় প্রতিমুহুর্তে, প্রতিটা মানুষের প্রতিটা জীবের সমান নিখুঁত ওজন যিনি করেন, তিনিই ঈশ্বর।